alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

আলুর দাম ও ভোক্তার ভোগান্তি

মিহির কুমার রায়

: বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
image

চাহিদার বিপরীতে ২২ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও বাড়ছে আলুর দাম

বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে আলু মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য। বহু দেশে এটি পশুখাদ্য হিসেবেও সমাদৃত। আমাদের নিত্যকার খাবারে ও বাণিজ্যে আলু অন্যতম অনুষঙ্গ। আলু শুধু খাদ্য হিসেবেই আবাদ করা হয় না, অর্থকরী ফসল হিসেবেও এর কদর যথেষ্ট। আলু উৎপাদনের দিক থেকে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম স্থানে।

বহু বছর ধরে অর্থকরী ফসল হিসেবে রংপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, বরিশাল, কুষ্টিয়া ফরিদপুর অঞ্চলে পাটের আবাদ হতো বেশি পরিমাণে। ময়মনসিংহের নালিতাবাড়ী, রংপুরের লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় পাটগাতি এবং কোস্টার দেশ কুষ্টিয়ার সঙ্গে পাটের নাম জড়িয়ে আছে। ব্রিটিশ আমলে দ্বিতীয় মহাসমরে বিশ্বের পাটের বড় জোগানদার ছিল পূর্ববাংলা। দ্রত গড়ে ওঠে রেল ও নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা। কৃষকদের আয় ও মান বাড়তে থাকে সমানতালে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে ধীরে ধীরে অর্থকরী ফসল পাট ও আখের স্থান দখল করে নিয়েছে আলু। এখন আলুর রমরমা বাণিজ্যে তার জয়জয়কার অবস্থা। আলুর ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে অগণিত কৃষক, শ্রমিক, মধ্যস্বত্বভোগী, পরিবহন ও হিমাগার প্রতিষ্ঠান।

লাভজনক অর্থকরী ফসল আলু চাষের চ্যালেঞ্জও কম নয়। হেক্টরপ্রতি বীজের প্রয়োজন প্রায় ১ দশমিক ৫ টন। বিপুল পরিমাণ বীজকন্দ পরিবহন খরচও কম নয়। চাষের প্রায় ৪০ শতাংশ খরচ বীজকন্দ কেনার পেছনে ব্যয় হয়। বীজের চাহিদা বেড়ে গেলে মানসম্পন্ন বীজকন্দ সংগ্রহ করা যেমন সমস্যাসংকুল, তেমনি নীরোগ ও নবীন প্রজন্মের বীজকন্দের স্বরূপ খোলা চোখে বোঝা অসাধ্য। তাই অনেক সময় বহু কৃষকের আশানুরূপ ফলনের স্বপ্ন দিবাস্বপ্নে পর্যবসিত হয়। রবি মৌসুমে ফসলি জমিতে অন্য ফসলের সঙ্গে আলুকে জমিন ভাগ করে নিতে হয়। পরিবেশ ও আবহাওয়ার ওপর কৃষকের হাত থাকে না বিধায় মেঘমুক্ত আকাশ এবং ১৫ ডিগ্রি থেকে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রার হেরফের হলে এর ফলনে বিপর্যয় ঘটে। সময়মতো সেচ, সার প্রয়োগে বিঘ্ন ঘটলে এবং মেঘলা ও গুমট আবহাওয়ায় জীবণুনাশক প্রয়োগ না করতে পারলে আলু ফসল মাঠে মারা যায়। উদ্ভিদ সংরক্ষণ খাতের ছোট-বড় করপোরেট বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য ব্যবসা চলে আলুর মৌসুমে। কিন্তু কৃষককে এজন্য সমুদয় ব্যয় মেটাতে হয় গাঁটের কড়কড়ে কড়ি দিয়ে।

আগামী পৃথিবীর যে সংকট ঘনিয়ে আসছে, তার অন্যতম হলো লবণমুক্ত সুপেয় পানি। মানুষের ব্যবহূত লবণহীন সুপেয় পানির প্রায় ৩০ শতাংশ সেচবাবদ ব্যয় হয়। আর এর বড় একটা অংশ জানিয়ে বা না জানিয়ে অপচয়ের খাতে চলে যায়। ব্যাপক আবাদি চারটি ফসলের অন্যতম ফসল আলুতে ব্যয় হওয়া সেচ ও মূল্য সংযোজনে পানির পরিমাণ ধানের পরেই অধিক। রোপা আউশ ও রোপা আমনে বৃষ্টির পর কিছু পরিমাণে সম্পূরক সেচের প্রয়োজন পড়ে মাত্র; কিন্তু আলুতে বোরো ফসলের মতো পুরোটা সেচই দিতে হয় শুষ্ক মৌসুমে, যখন চলে পানির আকাল মৌসুম। তখন খালে বা ভূ-উপরস্থ পানির চেয়ে বহু যুগ ধরে সঞ্চিত ভূগর্ভস্থ পানির ওপর বেশি চাপ পড়ে। সে পরিমাণ পানি দিয়ে এর দ্বিগুণেরও বেশি জমিতে ভুট্টা, গম বা অন্য প্রায় সব রবি ফসলে সেচ দেয়া সম্ভব। আর বাজারজাত বা রফতানির আগে আলু পরিষ্কারকরণেও দরকার পড়ে বেশি পরিমাণে অমূল্য পানি। ক্রমপচনশীল কৃষিপণ্য হিসেবে আলু তাপমাত্রার প্রতি সংবেদনশীল বিধায় সংরক্ষণের জন্য বিশেষ অবকাঠামো ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন। পরিবহনে অন্য ফসলের আয়তনের তুলনামূলক ব্যয় ও স্থান লাগে বেশি। আবাদকালে ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি এবং পরিবহনকালে ৮ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকা চাই। হিমাগারে সংরক্ষণের জন্য আরো নিম্নতাপের প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞদের কারো কারো মতে, আলু পরিবহনে কার্গো বিমানের চেয়ে সমুদ্রপথে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সাশ্রয়ী মূল্যে তা রফতানি করা সম্ভব। এ ধারণা যতটা সহজ, বাস্তবে তা কঠিনতর। কার গোয়ালে কে দেবে ধোঁয়া। তার ওপর আমাদের আশপাশে রয়েছে রফতানি প্রতিযোগী দেশ ভারত, মিয়ানমার, চীন, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া প্রভৃতি। আলুর রফতানির ধারাবাহিক প্রবাহ নিশ্চিত করায় প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত টানা সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। একই প্রজন্ম বারকয়েক এবং একই জমিকে বারবার আলু চাষে এর ফলন ও মান কমে যায়, তেমনি মাটির গুণাগুণ ও উত্তম কৃষি ব্যবস্থার অভাবও বাজারজাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নির্বিচারে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার বিদেশে আলু রফতানির বড় বাধা।

সম্প্রতি আলুর চড়া দামে এবার আলু মজুতের সরকারি তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করল হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটি দাবি করেছে, সরকার আলু মজুতের যে তথ্য দিচ্ছে তা সঠিক নয়। কারণ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কোল্ড স্টোরেজের ২০ শতাংশ খালি রয়েছে। আর এ কারণে বাড়ছে আলুর দাম। এছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা আলু মজুত করছে বলেও মনে করে সংগঠনটি। বর্তমান রেকর্ড মূল্যে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি আলু মানভেদে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, কোল্ড স্টোরেজ শেড থেকে আলু বের হয় ১৮ টাকা কেজি দরে; যা খুচরা বাজারে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

গত জুলাই মাসে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে আলুর উৎপাদন ও দাম নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই প্রতিবেদনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়- ১৫ টাকার আলু ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে। সাধারণত কৃষকের হাতে আলু শেষ হওয়ার পর জুন থেকে হিমাগারের আলু বাজারে সরবরাহ আসতে থাকে; কিন্তু এই সরবরাহ ঠিকভাবে হচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এবার প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ হয়েছে ১০.৫০ টাকা। সব খরচ মিলে খুচরা বাজারে এর দর কেজি প্রতি ৩২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়; কিন্তু কৃত্রিমভাবে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী আলুর দাম বৃদ্ধি করছে, যা এখন ৪৫-৫০ টাকায় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এজন্য অবশ্য হিমাগার মালিকদেরও দায়ী করা হয়েছে। কারণ হিমাগার মালিকরা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত পরিমাণ আলু বাজারে ছাড়ছে।

জানা গেছে, এ বছর আলুর উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ১২ লাখ টন, যেখানে স্থানীয় চাহিদা ৯০ লাখ টন। চাহিদার বিপরীতে ২২ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও আলুর দাম বাড়ছে। এছাড়া গত বছরের তুলনায় চলতি বছর প্রায় দেড় লাখ টন বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। তবে সরকারি এ তথ্যকে এবার চ্যালেঞ্জ করে বসল হিমাগার মালিকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত আলুর দাম বাড়াতেই হিমাগার মালিকরা এখন ভুল তথ্য উপস্থাপন করছেন। এখন হিমাগার মালিকরাই কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি আলু কিনে সংরক্ষণ করে তা সুবিধামতো সময়ে বাজারে ছাড়েন। এবার হিমাগার মালিকদের যোগসাজশে অস্থির হয়ে পড়ছে আলুর বাজার। দ্রুত হিমাগারগুলোতে অভিযান চালিয়ে বাজারে আলু ছাড়ার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে হিমাগারগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

অধিদপ্তর থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশকিছু সুপারিশও করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- হিমাগার থেকে চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত আলু খালাস করতে হবে। আলুর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পর্যাপ্ত পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এর সঙ্গে যেসব অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিমভাবে আলুর বাজার অস্থির করার চেষ্টা করবে তাদের বিভিন্ন তদারকি সংস্থা এবং পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বলেও প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়।

এক কেজি আম আর সমপরিমাণের আলুর স্থান ও পরিবহন খরচ এবং তার বিক্রয় মূল্যের তুলনামূলক বিচারে কোনটি লাভজনক তা অর্থনীতির বিষয়। পাল্টা প্রশ্নও আছে, আলুর বিস্তার আর আমের বিস্তার এক রকম নয়। আম মৌসুমি চাহিদাসম্পন্ন, আর আলু সংবৎসরিক নিত্যব্যবহার্য। প্রতি বছর আলু আবাদের পরিধি ও পরিমাণ ক্রমবর্ধমান; কিন্তু এর সঙ্গে দেশীয় বাজার, সংশ্লিষ্ট শিল্প এবং রফতানি চাহিদা ও মানের ন্যূনতম যোগসূত্র নেই। আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয়হীনতা এবং তথ্য বিভ্রাট ও ঘাটতিও প্রচুর। আর এতে ভোগান্তি হচ্ছে ভোক্তার।

[লেখক : ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]

পিএইচডি: উচ্চ শিক্ষার মানদণ্ড না প্রতীকী মরীচিকা?

আলুর প্রাচুর্যে কৃষকের সংকট

তাহলে কী ‘কোটা’ই জয়যুক্ত হবে!

ব্যাংকিং খাতে বিষফোঁড়া: বাংলাদেশের অর্থনীতির ধমনী বিষাক্ত হয়ে উঠছে

ছবি

ঢাকার নদী ও খালের দখল-দূষণ: পুনরুদ্ধার কোন পথে

জমি কী মূলে রেকর্ড হয়েছে, দলিল মূলে না উত্তরাধিকার মূলে?

কার্বন-নিরপেক্ষ শিশুর অনুপ্রেরণায় দেশ

এবার আমরা সভ্য হলাম!

সোনার প্রাসাদের দেয়ালে ঘামের দাগ

নিরাপদ সড়ক চাই কিন্তু কার্যকর উদ্যোগ কোথায়?

অবহেলিত শিক্ষার দুর্দশা বাড়ছে

টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ সড়ক

বাংলার সংস্কৃতি কি মূলধারা হারিয়ে ফেলবে?

ছবি

সমদৃষ্টি, বহুত্ববাদী সমাজ এবং সহিষ্ণুতা

খাদ্য অপচয় : ক্ষুধার্ত পৃথিবীর এক নিঃশব্দ ট্র্যাজেডি

টেকসই বাংলাদেশ গঠনে পরিবেশ সংস্কার কেন অপরিহার্য

সে এক রূপকথারই দেশ

উপকূলের খাদ্যসংকট নিয়ে ভাবছেন কি নীতিনির্ধারকেরা?

মানসিক স্বাস্থ্য: মানবাধিকারের নতুন চ্যালেঞ্জ

ঢাকার যানজট ও বিকেন্দ্রীকরণ

নির্বাচনী মাঠে জামায়াতী হেকমত

শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীর বৈষম্য ও জাতির অগ্রযাত্রাধ

উপমহাদেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

এইচএসসি ফল: সংখ্যার খেল না কি শিক্ষার বাস্তব চিত্র?

বিনা ভোট, নিশি ভোট, ডামি ভোটের পরে এবার নাকি গণভোট!

কমরেড ইলা মিত্রের শততম জন্মজয়ন্তী

কত মৃত্যু হলে জাগবে বিবেক?

বৈষম্যের বিবিধ মুখ

মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় জরুরি আইনি সহায়তা

গাজা : এখন শান্তি রক্ষা করবে কে?

দোসর, বাই ডিফল্ট!

জমি কেনা দাগে দাগে কিন্তু ভোগদখল একদাগে

রাষ্ট্র কি শুধু শিক্ষকদের বেলায় এসে দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে?

শতরঞ্জ কি খিলাড়ী

শিক্ষক থাকে রাজপথে, আর পুলিশ ছাড়ে থানা

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা : স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবিষ্যৎ কী?

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

আলুর দাম ও ভোক্তার ভোগান্তি

মিহির কুমার রায়

image

চাহিদার বিপরীতে ২২ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও বাড়ছে আলুর দাম

বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে আলু মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য। বহু দেশে এটি পশুখাদ্য হিসেবেও সমাদৃত। আমাদের নিত্যকার খাবারে ও বাণিজ্যে আলু অন্যতম অনুষঙ্গ। আলু শুধু খাদ্য হিসেবেই আবাদ করা হয় না, অর্থকরী ফসল হিসেবেও এর কদর যথেষ্ট। আলু উৎপাদনের দিক থেকে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম স্থানে।

বহু বছর ধরে অর্থকরী ফসল হিসেবে রংপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, বরিশাল, কুষ্টিয়া ফরিদপুর অঞ্চলে পাটের আবাদ হতো বেশি পরিমাণে। ময়মনসিংহের নালিতাবাড়ী, রংপুরের লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় পাটগাতি এবং কোস্টার দেশ কুষ্টিয়ার সঙ্গে পাটের নাম জড়িয়ে আছে। ব্রিটিশ আমলে দ্বিতীয় মহাসমরে বিশ্বের পাটের বড় জোগানদার ছিল পূর্ববাংলা। দ্রত গড়ে ওঠে রেল ও নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা। কৃষকদের আয় ও মান বাড়তে থাকে সমানতালে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকে ধীরে ধীরে অর্থকরী ফসল পাট ও আখের স্থান দখল করে নিয়েছে আলু। এখন আলুর রমরমা বাণিজ্যে তার জয়জয়কার অবস্থা। আলুর ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে অগণিত কৃষক, শ্রমিক, মধ্যস্বত্বভোগী, পরিবহন ও হিমাগার প্রতিষ্ঠান।

লাভজনক অর্থকরী ফসল আলু চাষের চ্যালেঞ্জও কম নয়। হেক্টরপ্রতি বীজের প্রয়োজন প্রায় ১ দশমিক ৫ টন। বিপুল পরিমাণ বীজকন্দ পরিবহন খরচও কম নয়। চাষের প্রায় ৪০ শতাংশ খরচ বীজকন্দ কেনার পেছনে ব্যয় হয়। বীজের চাহিদা বেড়ে গেলে মানসম্পন্ন বীজকন্দ সংগ্রহ করা যেমন সমস্যাসংকুল, তেমনি নীরোগ ও নবীন প্রজন্মের বীজকন্দের স্বরূপ খোলা চোখে বোঝা অসাধ্য। তাই অনেক সময় বহু কৃষকের আশানুরূপ ফলনের স্বপ্ন দিবাস্বপ্নে পর্যবসিত হয়। রবি মৌসুমে ফসলি জমিতে অন্য ফসলের সঙ্গে আলুকে জমিন ভাগ করে নিতে হয়। পরিবেশ ও আবহাওয়ার ওপর কৃষকের হাত থাকে না বিধায় মেঘমুক্ত আকাশ এবং ১৫ ডিগ্রি থেকে ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রার হেরফের হলে এর ফলনে বিপর্যয় ঘটে। সময়মতো সেচ, সার প্রয়োগে বিঘ্ন ঘটলে এবং মেঘলা ও গুমট আবহাওয়ায় জীবণুনাশক প্রয়োগ না করতে পারলে আলু ফসল মাঠে মারা যায়। উদ্ভিদ সংরক্ষণ খাতের ছোট-বড় করপোরেট বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য ব্যবসা চলে আলুর মৌসুমে। কিন্তু কৃষককে এজন্য সমুদয় ব্যয় মেটাতে হয় গাঁটের কড়কড়ে কড়ি দিয়ে।

আগামী পৃথিবীর যে সংকট ঘনিয়ে আসছে, তার অন্যতম হলো লবণমুক্ত সুপেয় পানি। মানুষের ব্যবহূত লবণহীন সুপেয় পানির প্রায় ৩০ শতাংশ সেচবাবদ ব্যয় হয়। আর এর বড় একটা অংশ জানিয়ে বা না জানিয়ে অপচয়ের খাতে চলে যায়। ব্যাপক আবাদি চারটি ফসলের অন্যতম ফসল আলুতে ব্যয় হওয়া সেচ ও মূল্য সংযোজনে পানির পরিমাণ ধানের পরেই অধিক। রোপা আউশ ও রোপা আমনে বৃষ্টির পর কিছু পরিমাণে সম্পূরক সেচের প্রয়োজন পড়ে মাত্র; কিন্তু আলুতে বোরো ফসলের মতো পুরোটা সেচই দিতে হয় শুষ্ক মৌসুমে, যখন চলে পানির আকাল মৌসুম। তখন খালে বা ভূ-উপরস্থ পানির চেয়ে বহু যুগ ধরে সঞ্চিত ভূগর্ভস্থ পানির ওপর বেশি চাপ পড়ে। সে পরিমাণ পানি দিয়ে এর দ্বিগুণেরও বেশি জমিতে ভুট্টা, গম বা অন্য প্রায় সব রবি ফসলে সেচ দেয়া সম্ভব। আর বাজারজাত বা রফতানির আগে আলু পরিষ্কারকরণেও দরকার পড়ে বেশি পরিমাণে অমূল্য পানি। ক্রমপচনশীল কৃষিপণ্য হিসেবে আলু তাপমাত্রার প্রতি সংবেদনশীল বিধায় সংরক্ষণের জন্য বিশেষ অবকাঠামো ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন। পরিবহনে অন্য ফসলের আয়তনের তুলনামূলক ব্যয় ও স্থান লাগে বেশি। আবাদকালে ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি এবং পরিবহনকালে ৮ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকা চাই। হিমাগারে সংরক্ষণের জন্য আরো নিম্নতাপের প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞদের কারো কারো মতে, আলু পরিবহনে কার্গো বিমানের চেয়ে সমুদ্রপথে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সাশ্রয়ী মূল্যে তা রফতানি করা সম্ভব। এ ধারণা যতটা সহজ, বাস্তবে তা কঠিনতর। কার গোয়ালে কে দেবে ধোঁয়া। তার ওপর আমাদের আশপাশে রয়েছে রফতানি প্রতিযোগী দেশ ভারত, মিয়ানমার, চীন, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া প্রভৃতি। আলুর রফতানির ধারাবাহিক প্রবাহ নিশ্চিত করায় প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত টানা সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। একই প্রজন্ম বারকয়েক এবং একই জমিকে বারবার আলু চাষে এর ফলন ও মান কমে যায়, তেমনি মাটির গুণাগুণ ও উত্তম কৃষি ব্যবস্থার অভাবও বাজারজাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নির্বিচারে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার বিদেশে আলু রফতানির বড় বাধা।

সম্প্রতি আলুর চড়া দামে এবার আলু মজুতের সরকারি তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করল হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটি দাবি করেছে, সরকার আলু মজুতের যে তথ্য দিচ্ছে তা সঠিক নয়। কারণ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কোল্ড স্টোরেজের ২০ শতাংশ খালি রয়েছে। আর এ কারণে বাড়ছে আলুর দাম। এছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা আলু মজুত করছে বলেও মনে করে সংগঠনটি। বর্তমান রেকর্ড মূল্যে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি আলু মানভেদে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, কোল্ড স্টোরেজ শেড থেকে আলু বের হয় ১৮ টাকা কেজি দরে; যা খুচরা বাজারে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

গত জুলাই মাসে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে আলুর উৎপাদন ও দাম নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই প্রতিবেদনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়- ১৫ টাকার আলু ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে। সাধারণত কৃষকের হাতে আলু শেষ হওয়ার পর জুন থেকে হিমাগারের আলু বাজারে সরবরাহ আসতে থাকে; কিন্তু এই সরবরাহ ঠিকভাবে হচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এবার প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ হয়েছে ১০.৫০ টাকা। সব খরচ মিলে খুচরা বাজারে এর দর কেজি প্রতি ৩২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়; কিন্তু কৃত্রিমভাবে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী আলুর দাম বৃদ্ধি করছে, যা এখন ৪৫-৫০ টাকায় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এজন্য অবশ্য হিমাগার মালিকদেরও দায়ী করা হয়েছে। কারণ হিমাগার মালিকরা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত পরিমাণ আলু বাজারে ছাড়ছে।

জানা গেছে, এ বছর আলুর উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ১২ লাখ টন, যেখানে স্থানীয় চাহিদা ৯০ লাখ টন। চাহিদার বিপরীতে ২২ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও আলুর দাম বাড়ছে। এছাড়া গত বছরের তুলনায় চলতি বছর প্রায় দেড় লাখ টন বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। তবে সরকারি এ তথ্যকে এবার চ্যালেঞ্জ করে বসল হিমাগার মালিকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত আলুর দাম বাড়াতেই হিমাগার মালিকরা এখন ভুল তথ্য উপস্থাপন করছেন। এখন হিমাগার মালিকরাই কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি আলু কিনে সংরক্ষণ করে তা সুবিধামতো সময়ে বাজারে ছাড়েন। এবার হিমাগার মালিকদের যোগসাজশে অস্থির হয়ে পড়ছে আলুর বাজার। দ্রুত হিমাগারগুলোতে অভিযান চালিয়ে বাজারে আলু ছাড়ার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে হিমাগারগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

অধিদপ্তর থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশকিছু সুপারিশও করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- হিমাগার থেকে চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত আলু খালাস করতে হবে। আলুর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পর্যাপ্ত পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এর সঙ্গে যেসব অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিমভাবে আলুর বাজার অস্থির করার চেষ্টা করবে তাদের বিভিন্ন তদারকি সংস্থা এবং পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে বলেও প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়।

এক কেজি আম আর সমপরিমাণের আলুর স্থান ও পরিবহন খরচ এবং তার বিক্রয় মূল্যের তুলনামূলক বিচারে কোনটি লাভজনক তা অর্থনীতির বিষয়। পাল্টা প্রশ্নও আছে, আলুর বিস্তার আর আমের বিস্তার এক রকম নয়। আম মৌসুমি চাহিদাসম্পন্ন, আর আলু সংবৎসরিক নিত্যব্যবহার্য। প্রতি বছর আলু আবাদের পরিধি ও পরিমাণ ক্রমবর্ধমান; কিন্তু এর সঙ্গে দেশীয় বাজার, সংশ্লিষ্ট শিল্প এবং রফতানি চাহিদা ও মানের ন্যূনতম যোগসূত্র নেই। আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয়হীনতা এবং তথ্য বিভ্রাট ও ঘাটতিও প্রচুর। আর এতে ভোগান্তি হচ্ছে ভোক্তার।

[লেখক : ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]

back to top