আলী আকবর মাসুম
একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন অবস্থান থেকে কোনো নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নজর রাখা ও এ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্যের একত্রিত সমন্বয়কে পর্যবেক্ষণ বলা যায়। পর্যবেক্ষণ এক একটি ক্ষেত্র বিশেষে পৃথকভাবে ব্যবহৃত বিষয়। তেমনি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো একটি বিষয়েও পর্যবেক্ষণের ধারণা ও পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে অনেক দেশেই। আমাদের দেশেও স্বাধীনতা লাভ ও পরবর্তীতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের শুরু থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়টি পরিচিতি ও তা একভাবে গ্রহনীয়তা পেতে শুরু করে। তবে আনুষ্ঠানিক পর্যবেক্ষণ শুরুর আগে সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত কিছু অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ বা পর্যবেক্ষকের আলাদা একটি গুরুত্ব তৈরি হয়।
বিদেশি পর্যবেক্ষক বা সংস্থার কথা বাদ দিলে বলা যায়, সাংবাদিকদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের একরকম ধারণা থেকে একসময় আনুষ্ঠানিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। প্রথমে ঢাকা থেকে তার কার্যক্রম শুরু হলেও তারপর ধাপে ধাপে জেলা, উপজেলা হয়ে এখন ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও সুযোগও তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে কোনা কোনো সংস্থা ও পর্যবেক্ষকদের দল নিরপেক্ষতা, গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাসহ নির্বাচন ও পর্যবেক্ষণকে ফলপ্রসূ করার জন্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গতানুগতিকতার চেয়ে আরো প্রাতিষ্ঠানিক ও পদ্ধতিগতভাবে পর্যবেক্ষণকে সময়োপযোগী করার প্রয়োজনের কথাও বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আরও একবার আগের কথা স্মরণ করে নিদিষ্ট ভাবে বললে বলতেই হয়, বিশেষ করে ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব ও পরিধি আরও বেড়েছে। তার আগে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংস হত্যার পর শাসন ব্যবস্থা প্রশ্নে বিরোধ ও রাজনীতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে একাধিক জাতীয় নির্বাচন হলেও তার অর্থবহ গুরুত্ব ও গণতান্ত্রিক রূপ অনেকটাই কম ছিল বললেই চলে।
তারপর ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পদত্যাগের পর প্রায় সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অধীন ১৯৯১ সালে যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা যেমন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ছিল, তেমনি তার মধ্য দিয়ে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার নতুন যাত্রা শুরু হয়। এ নির্বাচনের আগে সরকার ও রাজনীতিক অচলাবস্থার অবসান ও সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের গুরুত্বের বিবেচনায় দেশে ও বিদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়টিও বেশ প্রাধান্য পায়।
তার পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশের মতো কুমিল্লা জেলাতেও সাংবাদিক ও শিক্ষক দেলোয়ার জাহিদকে প্রধান করে সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের নিয়ে মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদের উদ্দ্যোগে একটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ দল গঠন করা হয়। এ দলের একজন সদস্য হিসেবে আমি নিজেও প্রথমবারের মতো নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাই।
তারপর ২০১৮ সাল পর্যন্ত মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, টিআইবি, সুজন, মানবাধিকার কমিশন, অধিকার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও প্রক্রিয়াগত বিষয়ে কাজ করার সুযোগ থেকে আমিও অন্যদের সঙ্গে মনে করি একাজের পরিপূর্ণতা ও মানসম্মত উন্নয়ন প্রয়োজন। এদিকে ’৯১-এর নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় দেশের রাজনীতিক দলগুলোর মাঝে যে সম্প্রীতি, আস্থা, বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে ওঠা, কিংবা নির্বাচন ও রাজনীতিক কর্মকান্ডে যে শৃঙ্খলা ফিরে আসার কথা ছিল, তার কোনোটাই বাস্তবে খুব বেশি হয়নি। অবশ্য পরবর্তীতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও পরে তার অধীন তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়ায় কিছুটা হলেও সহাবস্থান ও সহনশীলতা কিছুদিন বজায় ছিল। কিন্ত সর্বশেষ দশম সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধান বিচারপতির এক আদেশে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল ও দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচন মানা না মানার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমেই দেশের রাজনীতিক পরিস্থিতি আরো একবার অস্থিতিশীল ও জটিল অবস্থায় পড়ে। অর্থাৎ রাজনীতিক সহাবস্থানের পরিবর্তে যখন দল ও নেতাকর্মীদের মাঝে নির্বাচন নিয়ে অবিশ্বাস, দূরত্ব তৈরি হয় এবং একসময় তা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে রূপ নেয় তখন কিন্ত কোনো রাজনীতিক সমঝোতায় পৌঁছা ছাড়া অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা থাকে না বললেই চলে। ফলে ২০২৪ সালে আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন ব্যবস্থায় হবে কিংবা তাতে সব দলের অংশগ্রহণ থাকবে কি থাকবে না- তার ওপরই নির্বাচনী পরিবেশ কেমন হবে ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের বিষয়টি অনেকখানি নির্ভর করছে। তাছাড়া দেশে রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে যেরকম সংকট তৈরি হয়েছে, এরকম অবস্থায় গতানুগতিক, নামমাত্র বা পক্ষপাতমূলক কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ হলে তা থেকে সঠিক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন ও তার কোনো সুফল থাকবে বলে বলা যায় না। তবে এক্ষেত্রে বিদেশি কোনো সংস্থা বা পর্যবেক্ষকদের সরাসরি নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সিদ্বান্ত, পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি ও তার সুফল প্রশ্নে বলা যায়, এটি বৈশি^ক ধারণা ও মানের দিক থেকে অবশ্যই তার সহায়ক কার্যকারিতা রয়েছে।
বাংলাদেশের যে কয়টি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অনুমতি পেয়ে থাকে তাদের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি, পর্যবেক্ষক নির্বাচন ও প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কমবেশি পূর্বেও ছিল, এখনো আছে। আর তা থাকাটা অস্বাভাবিকও কিছু নয়। নির্বাচনের সময় অনেকগুলো সংস্থা ও অনেক সংখ্যক পর্যবেক্ষককে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেলেও হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যরা নির্বাচন, নির্বাচন ব্যবস্থার ভালো-মন্দ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে নিয়মিত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করে বলে বলার সুযোগ নেই। অর্থাৎ জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অনেক বেশি পর্যবেক্ষক নিযুক্ত ও কিছু সহযোগী সংস্থাকে এ কাজে সংযুক্ত করতে গিয়ে দল নিরপেক্ষ, উপযুক্ত পর্যবেক্ষকসহ মানসম্পন্ন ও যথাযথ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির একরকম ঘাটতি ও সক্ষমতার অভাব বারবারই লক্ষ্য করা গেছে। কিন্ত বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকে যদি সময়োপযোগী ও অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি অন্যতম সহায়ক কার্যক্রম হিসেবে তার সফলতা আশা করি, তাহলে দুর্বলতার দিকগুলো কাটিয়ে আরো কার্যকর ও অর্থবহ পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ অবশ্যই থাকা দরকার।
এ ব্যাপারে অর্থ সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানের কাছেও কার্যক্রমের পুরো পরিকল্পনা ও অর্থের চাহিদাসহ পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা আগে থেকেই দেওয়া উচিত। তার সঙ্গে দেশের রাজনীতিক পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সংকট উত্তরণের দিক থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং নাগরিকদের অবাধ, স্বাধীন ভোটাধিকার নিশ্চিতের প্রত্যেকটি বিষয়কে গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই এবার আরো অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আবেদনকৃতদের মধ্য থেকে ৬৮টি দেশি সংস্থাকে অনুমতি দিয়েছে। বিদেশি ও দেশি দাতা সংস্থার অর্থ সহায়তায় হয়তো এসব সংস্থাই সমন্বিত বা এককভাবে সারাদেশের কোনো না কোনো এলাকায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পর্যবেক্ষক বাছাইসহ অন্যান্য প্রস্তুতিও গ্রহণ করছে।
কিন্ত পূর্বের মতো তার সব কার্যক্রম যদি হয় গতানুগতিক, কিংবা নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত সহ রাজনীতিক সংকট উত্তরণে নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ফলাফল ও তার প্রতিবেদন বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সময়োপযোগী হিসেবে গ্রহণীয় না হয়, তাহলে তা আবারও নামমাত্র পর্যবেক্ষণ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তাই কমপক্ষে নির্বাচনের আগের তিন মাস ও নির্বাচনের পরের তিন মাসের পরিকল্পনায় নির্বাচনের দিন ও আগে-পরের দিনকে যুক্ত করে একটি সমন্বিত যৌক্তিক পর্যবেক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। যাতে নির্বাচন কমিশন, রাজনীতিক দল, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষের ভূমিকা ও দায়-দায়িত্বের দিকগুলো পর্যবেক্ষণের আওতাভুক্ত বিবেচনায় নির্বাচনের আগে ও পরের পরিস্থিতির দিক থেকে নিবিড় ভাবে প্রত্যক্ষ করা এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষের জন্য করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে সময় সময় সুপারিশ রাখা যায়।
এক্ষেত্রে যে কয়টি সংস্থা ও নাগরিক বা মানবাধিকার সংগঠন এসব বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে নিয়মিত কাজ করে কেবল তারা কেন্দ্রীয় অথবা অঞ্চলগত ভাবে তার পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে। তার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষণের তিনটি অধ্যায়ের প্রাথমিক মূল্যায়ন ও পরামর্শগুলো তিনটি ধাপে আলাদাভাবে প্রকাশ করা ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে তা জনগণের অবগতির জন্য তুলে ধরার মতো কার্যক্রম ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব নেওয়া যায়। আর সবশেষে বিস্তারিতভাবে এসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করা। যে প্রতিবেদনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন, নির্বাচনী ব্যয়, ভোটের পরিবেশ, সংঘাত-সহিংসতার তথ্য ও এ কাজের দায়িত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত পক্ষগুলোর ভালো-মন্দের দিকগুলো তুলে ধরা খুব প্রয়োজন। যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রয়োজনে একটি স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করার নৈতিক অবস্থান এবং সার্বিক সক্ষমতার প্রমাণ রাখা যায়। এক্ষেত্রে নির্বাচনের প্রতিটি প্রক্রিয়ার দিককে প্রাধান্য দেওয়ার বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সারাদেশে পর্যবেক্ষক নিযুক্ত ও কার্যক্রম পরিচালনার দরকার আছে হয়তো এমনটিও নয়।
প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য ও সক্ষমতার মধ্যে নির্দিষ্টসংখ্যক নির্বাচনী আসন বা অঞ্চল বিবেচনাতেও পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমের দ্বারা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক ভূমিকা পালন ও অন্যতম অংশীদার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তার সঙ্গে জনমতের ভিত্তিতে জনমুখী জনপ্রতিনিধিত্বের প্রাধান্যসহ সুষ্ঠু নির্বাচন ও ভোটাধিকার প্রয়োগে জনগণের চাহিদার দাবি পূরণেও যে কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ এবং তার পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াগত কার্যক্রমকে আরও কার্যকর ও গ্রহণীয় করা সম্ভব।
[লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ নর্থ-আমেরিকান নির্বাচন পর্যবেক্ষণ হাব]
আলী আকবর মাসুম
বৃহস্পতিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন অবস্থান থেকে কোনো নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নজর রাখা ও এ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্যের একত্রিত সমন্বয়কে পর্যবেক্ষণ বলা যায়। পর্যবেক্ষণ এক একটি ক্ষেত্র বিশেষে পৃথকভাবে ব্যবহৃত বিষয়। তেমনি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো একটি বিষয়েও পর্যবেক্ষণের ধারণা ও পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে অনেক দেশেই। আমাদের দেশেও স্বাধীনতা লাভ ও পরবর্তীতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের শুরু থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়টি পরিচিতি ও তা একভাবে গ্রহনীয়তা পেতে শুরু করে। তবে আনুষ্ঠানিক পর্যবেক্ষণ শুরুর আগে সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত কিছু অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ বা পর্যবেক্ষকের আলাদা একটি গুরুত্ব তৈরি হয়।
বিদেশি পর্যবেক্ষক বা সংস্থার কথা বাদ দিলে বলা যায়, সাংবাদিকদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের একরকম ধারণা থেকে একসময় আনুষ্ঠানিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। প্রথমে ঢাকা থেকে তার কার্যক্রম শুরু হলেও তারপর ধাপে ধাপে জেলা, উপজেলা হয়ে এখন ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও সুযোগও তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে কোনা কোনো সংস্থা ও পর্যবেক্ষকদের দল নিরপেক্ষতা, গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাসহ নির্বাচন ও পর্যবেক্ষণকে ফলপ্রসূ করার জন্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গতানুগতিকতার চেয়ে আরো প্রাতিষ্ঠানিক ও পদ্ধতিগতভাবে পর্যবেক্ষণকে সময়োপযোগী করার প্রয়োজনের কথাও বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আরও একবার আগের কথা স্মরণ করে নিদিষ্ট ভাবে বললে বলতেই হয়, বিশেষ করে ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব ও পরিধি আরও বেড়েছে। তার আগে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংস হত্যার পর শাসন ব্যবস্থা প্রশ্নে বিরোধ ও রাজনীতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে একাধিক জাতীয় নির্বাচন হলেও তার অর্থবহ গুরুত্ব ও গণতান্ত্রিক রূপ অনেকটাই কম ছিল বললেই চলে।
তারপর ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পদত্যাগের পর প্রায় সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অধীন ১৯৯১ সালে যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা যেমন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ছিল, তেমনি তার মধ্য দিয়ে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার নতুন যাত্রা শুরু হয়। এ নির্বাচনের আগে সরকার ও রাজনীতিক অচলাবস্থার অবসান ও সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের গুরুত্বের বিবেচনায় দেশে ও বিদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়টিও বেশ প্রাধান্য পায়।
তার পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশের মতো কুমিল্লা জেলাতেও সাংবাদিক ও শিক্ষক দেলোয়ার জাহিদকে প্রধান করে সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের নিয়ে মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদের উদ্দ্যোগে একটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ দল গঠন করা হয়। এ দলের একজন সদস্য হিসেবে আমি নিজেও প্রথমবারের মতো নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাই।
তারপর ২০১৮ সাল পর্যন্ত মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, টিআইবি, সুজন, মানবাধিকার কমিশন, অধিকার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও প্রক্রিয়াগত বিষয়ে কাজ করার সুযোগ থেকে আমিও অন্যদের সঙ্গে মনে করি একাজের পরিপূর্ণতা ও মানসম্মত উন্নয়ন প্রয়োজন। এদিকে ’৯১-এর নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় দেশের রাজনীতিক দলগুলোর মাঝে যে সম্প্রীতি, আস্থা, বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে ওঠা, কিংবা নির্বাচন ও রাজনীতিক কর্মকান্ডে যে শৃঙ্খলা ফিরে আসার কথা ছিল, তার কোনোটাই বাস্তবে খুব বেশি হয়নি। অবশ্য পরবর্তীতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও পরে তার অধীন তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠান হওয়ায় কিছুটা হলেও সহাবস্থান ও সহনশীলতা কিছুদিন বজায় ছিল। কিন্ত সর্বশেষ দশম সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধান বিচারপতির এক আদেশে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল ও দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচন মানা না মানার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমেই দেশের রাজনীতিক পরিস্থিতি আরো একবার অস্থিতিশীল ও জটিল অবস্থায় পড়ে। অর্থাৎ রাজনীতিক সহাবস্থানের পরিবর্তে যখন দল ও নেতাকর্মীদের মাঝে নির্বাচন নিয়ে অবিশ্বাস, দূরত্ব তৈরি হয় এবং একসময় তা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে রূপ নেয় তখন কিন্ত কোনো রাজনীতিক সমঝোতায় পৌঁছা ছাড়া অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা থাকে না বললেই চলে। ফলে ২০২৪ সালে আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন ব্যবস্থায় হবে কিংবা তাতে সব দলের অংশগ্রহণ থাকবে কি থাকবে না- তার ওপরই নির্বাচনী পরিবেশ কেমন হবে ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের বিষয়টি অনেকখানি নির্ভর করছে। তাছাড়া দেশে রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে যেরকম সংকট তৈরি হয়েছে, এরকম অবস্থায় গতানুগতিক, নামমাত্র বা পক্ষপাতমূলক কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ হলে তা থেকে সঠিক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন ও তার কোনো সুফল থাকবে বলে বলা যায় না। তবে এক্ষেত্রে বিদেশি কোনো সংস্থা বা পর্যবেক্ষকদের সরাসরি নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সিদ্বান্ত, পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি ও তার সুফল প্রশ্নে বলা যায়, এটি বৈশি^ক ধারণা ও মানের দিক থেকে অবশ্যই তার সহায়ক কার্যকারিতা রয়েছে।
বাংলাদেশের যে কয়টি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অনুমতি পেয়ে থাকে তাদের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি, পর্যবেক্ষক নির্বাচন ও প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কমবেশি পূর্বেও ছিল, এখনো আছে। আর তা থাকাটা অস্বাভাবিকও কিছু নয়। নির্বাচনের সময় অনেকগুলো সংস্থা ও অনেক সংখ্যক পর্যবেক্ষককে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেলেও হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যরা নির্বাচন, নির্বাচন ব্যবস্থার ভালো-মন্দ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে নিয়মিত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করে বলে বলার সুযোগ নেই। অর্থাৎ জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অনেক বেশি পর্যবেক্ষক নিযুক্ত ও কিছু সহযোগী সংস্থাকে এ কাজে সংযুক্ত করতে গিয়ে দল নিরপেক্ষ, উপযুক্ত পর্যবেক্ষকসহ মানসম্পন্ন ও যথাযথ পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির একরকম ঘাটতি ও সক্ষমতার অভাব বারবারই লক্ষ্য করা গেছে। কিন্ত বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকে যদি সময়োপযোগী ও অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি অন্যতম সহায়ক কার্যক্রম হিসেবে তার সফলতা আশা করি, তাহলে দুর্বলতার দিকগুলো কাটিয়ে আরো কার্যকর ও অর্থবহ পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ অবশ্যই থাকা দরকার।
এ ব্যাপারে অর্থ সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানের কাছেও কার্যক্রমের পুরো পরিকল্পনা ও অর্থের চাহিদাসহ পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা আগে থেকেই দেওয়া উচিত। তার সঙ্গে দেশের রাজনীতিক পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সংকট উত্তরণের দিক থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং নাগরিকদের অবাধ, স্বাধীন ভোটাধিকার নিশ্চিতের প্রত্যেকটি বিষয়কে গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই এবার আরো অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আবেদনকৃতদের মধ্য থেকে ৬৮টি দেশি সংস্থাকে অনুমতি দিয়েছে। বিদেশি ও দেশি দাতা সংস্থার অর্থ সহায়তায় হয়তো এসব সংস্থাই সমন্বিত বা এককভাবে সারাদেশের কোনো না কোনো এলাকায় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পর্যবেক্ষক বাছাইসহ অন্যান্য প্রস্তুতিও গ্রহণ করছে।
কিন্ত পূর্বের মতো তার সব কার্যক্রম যদি হয় গতানুগতিক, কিংবা নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত সহ রাজনীতিক সংকট উত্তরণে নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ফলাফল ও তার প্রতিবেদন বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সময়োপযোগী হিসেবে গ্রহণীয় না হয়, তাহলে তা আবারও নামমাত্র পর্যবেক্ষণ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তাই কমপক্ষে নির্বাচনের আগের তিন মাস ও নির্বাচনের পরের তিন মাসের পরিকল্পনায় নির্বাচনের দিন ও আগে-পরের দিনকে যুক্ত করে একটি সমন্বিত যৌক্তিক পর্যবেক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। যাতে নির্বাচন কমিশন, রাজনীতিক দল, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষের ভূমিকা ও দায়-দায়িত্বের দিকগুলো পর্যবেক্ষণের আওতাভুক্ত বিবেচনায় নির্বাচনের আগে ও পরের পরিস্থিতির দিক থেকে নিবিড় ভাবে প্রত্যক্ষ করা এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষের জন্য করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে সময় সময় সুপারিশ রাখা যায়।
এক্ষেত্রে যে কয়টি সংস্থা ও নাগরিক বা মানবাধিকার সংগঠন এসব বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে নিয়মিত কাজ করে কেবল তারা কেন্দ্রীয় অথবা অঞ্চলগত ভাবে তার পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে। তার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষণের তিনটি অধ্যায়ের প্রাথমিক মূল্যায়ন ও পরামর্শগুলো তিনটি ধাপে আলাদাভাবে প্রকাশ করা ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে তা জনগণের অবগতির জন্য তুলে ধরার মতো কার্যক্রম ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব নেওয়া যায়। আর সবশেষে বিস্তারিতভাবে এসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করা। যে প্রতিবেদনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন, নির্বাচনী ব্যয়, ভোটের পরিবেশ, সংঘাত-সহিংসতার তথ্য ও এ কাজের দায়িত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত পক্ষগুলোর ভালো-মন্দের দিকগুলো তুলে ধরা খুব প্রয়োজন। যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রয়োজনে একটি স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করার নৈতিক অবস্থান এবং সার্বিক সক্ষমতার প্রমাণ রাখা যায়। এক্ষেত্রে নির্বাচনের প্রতিটি প্রক্রিয়ার দিককে প্রাধান্য দেওয়ার বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার সারাদেশে পর্যবেক্ষক নিযুক্ত ও কার্যক্রম পরিচালনার দরকার আছে হয়তো এমনটিও নয়।
প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য ও সক্ষমতার মধ্যে নির্দিষ্টসংখ্যক নির্বাচনী আসন বা অঞ্চল বিবেচনাতেও পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমের দ্বারা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক ভূমিকা পালন ও অন্যতম অংশীদার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তার সঙ্গে জনমতের ভিত্তিতে জনমুখী জনপ্রতিনিধিত্বের প্রাধান্যসহ সুষ্ঠু নির্বাচন ও ভোটাধিকার প্রয়োগে জনগণের চাহিদার দাবি পূরণেও যে কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ এবং তার পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াগত কার্যক্রমকে আরও কার্যকর ও গ্রহণীয় করা সম্ভব।
[লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ নর্থ-আমেরিকান নির্বাচন পর্যবেক্ষণ হাব]