আর কে চৌধুরী
অমর গায়ক কিশোর কুমার গেয়েছিলেন- ‘জিনিসের দাম বেড়েছে, মানুষের দাম কমেছে, হায়রে কপাল করব কী’। কিশোর কুমারের ওই গানে নিম্ন-মধ্যবিত্তের যে অসহায়ত্বের প্রকাশ ঘটেছিল তা এক কঠিন বাস্তবতা। জিনিসের দাম বাড়লে মানুষের দাম কমে- এটি সংসারের ঘানি টানা নিম্নবিত্তদের প্রতিক্ষণের উপলব্ধি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানাচ্ছে, চলতি বছরের আগস্টে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ; যা এর আগে কখনো হয়নি। এর আগের মাসে এ খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ১১ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির এ হার সর্বোচ্চ। ২০১১ সালের মে মাসে ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি। ২০২০-২১ অর্থবছরে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি হয়েছে দ্বিগুণের ঢের বেশি।
বিবিএসের হালনাগাদ তথ্য জানাচ্ছে, আগস্ট মাসে খাদ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাকজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। ২০২০ সালে খাদ্য খাতে ১০০ টাকার পণ্যে ৫ টাকা ৫৬ পয়সা বৃদ্ধি হয়েছিল। একই পণ্যে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে বেড়েছে ১২ টাকা ৫৪ পয়সা। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিতে অসহায় অবস্থায় পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে গত অর্থবছর বাংলাদেশে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। অবশ্য ওই সময় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বাড়লেও ভারত ও নেপালসহ নানা দেশে মূল্যস্ফীতি কমছে বলে জানায় বিশ্বব্যাংক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবিএস সরকারি তথ্য-উপাত্তকেই গুরুত্ব দেয়।
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কোনো একক পণ্যের নাম বলা যাবে না। বেশিরভাগ পণ্যের দামই তো ক্রেতাসাধারণের নাগালের বাইরে। তাই বলা যায়, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি সুষ্ঠুভাবে করা গেলে মূল্যস্ফীতি কমবে।
দেশে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতিটা খুব বিস্তৃত। আমদানি করা পণ্যে, দেশে উৎপাদিত পণ্যে কিংবা যেসব পণ্য বা সেবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঢোকে না, সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতির লক্ষণ প্রবল। তাই এটি বলার সুযোগ নেই যে, শুধু আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধিই আমাদের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির কারণ। মূল্যস্ফীতির জন্য একটি বড় কারণ হলো, অভ্যন্তরীণ চাহিদার একটি বড় ধরনের বৃদ্ধি হয়েছে।
কোনো নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে সেটি যত দ্রুত কমিয়ে আনার ওপর জোর দিতে হবে। দীর্ঘসূত্রতা বড় সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। দাম বেশি হলেও সেটি নিয়ন্ত্রণে আছে- এমন বক্তব্যে অসাধু ব্যবসায়ীরাই প্রশ্রয় পায়। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে প্রান্তিক ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি ঠেকাতে অবশ্যই মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পণ্যের আমদানি-রপ্তানি সরবরাহ ও মজুত তথ্যে যেন গরমিল না থাকে তাও নিশ্চিত করতে হবে।
করোনা-দুর্যোগে অনেকের আয়-রোজগার কমে গেছে, অনেকেই হয়েছেন কর্মহীন। এখনো বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যাতে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখার কথা জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন কর্মকর্তারা। অবশ্য এসব তৎপরতায় তেমন কোনো সাফল্য আমরা দেখি না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে।
কেন্দ্র থেকে স্থানীয় উৎপাদন ক্ষেত্র পর্যন্ত ব্যবস্থাপনাও নজরদারির আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে আমদানিকৃত ও দেশজ উৎপাদিত- এই দুই ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও নির্বিঘ্ন রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।
[লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক]
আর কে চৌধুরী
মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩
অমর গায়ক কিশোর কুমার গেয়েছিলেন- ‘জিনিসের দাম বেড়েছে, মানুষের দাম কমেছে, হায়রে কপাল করব কী’। কিশোর কুমারের ওই গানে নিম্ন-মধ্যবিত্তের যে অসহায়ত্বের প্রকাশ ঘটেছিল তা এক কঠিন বাস্তবতা। জিনিসের দাম বাড়লে মানুষের দাম কমে- এটি সংসারের ঘানি টানা নিম্নবিত্তদের প্রতিক্ষণের উপলব্ধি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানাচ্ছে, চলতি বছরের আগস্টে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ; যা এর আগে কখনো হয়নি। এর আগের মাসে এ খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ১১ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির এ হার সর্বোচ্চ। ২০১১ সালের মে মাসে ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি। ২০২০-২১ অর্থবছরে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি হয়েছে দ্বিগুণের ঢের বেশি।
বিবিএসের হালনাগাদ তথ্য জানাচ্ছে, আগস্ট মাসে খাদ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাকজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। ২০২০ সালে খাদ্য খাতে ১০০ টাকার পণ্যে ৫ টাকা ৫৬ পয়সা বৃদ্ধি হয়েছিল। একই পণ্যে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে বেড়েছে ১২ টাকা ৫৪ পয়সা। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিতে অসহায় অবস্থায় পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে গত অর্থবছর বাংলাদেশে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল। অবশ্য ওই সময় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বাড়লেও ভারত ও নেপালসহ নানা দেশে মূল্যস্ফীতি কমছে বলে জানায় বিশ্বব্যাংক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবিএস সরকারি তথ্য-উপাত্তকেই গুরুত্ব দেয়।
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কোনো একক পণ্যের নাম বলা যাবে না। বেশিরভাগ পণ্যের দামই তো ক্রেতাসাধারণের নাগালের বাইরে। তাই বলা যায়, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি সুষ্ঠুভাবে করা গেলে মূল্যস্ফীতি কমবে।
দেশে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতিটা খুব বিস্তৃত। আমদানি করা পণ্যে, দেশে উৎপাদিত পণ্যে কিংবা যেসব পণ্য বা সেবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঢোকে না, সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতির লক্ষণ প্রবল। তাই এটি বলার সুযোগ নেই যে, শুধু আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধিই আমাদের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির কারণ। মূল্যস্ফীতির জন্য একটি বড় কারণ হলো, অভ্যন্তরীণ চাহিদার একটি বড় ধরনের বৃদ্ধি হয়েছে।
কোনো নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে সেটি যত দ্রুত কমিয়ে আনার ওপর জোর দিতে হবে। দীর্ঘসূত্রতা বড় সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। দাম বেশি হলেও সেটি নিয়ন্ত্রণে আছে- এমন বক্তব্যে অসাধু ব্যবসায়ীরাই প্রশ্রয় পায়। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে প্রান্তিক ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি ঠেকাতে অবশ্যই মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পণ্যের আমদানি-রপ্তানি সরবরাহ ও মজুত তথ্যে যেন গরমিল না থাকে তাও নিশ্চিত করতে হবে।
করোনা-দুর্যোগে অনেকের আয়-রোজগার কমে গেছে, অনেকেই হয়েছেন কর্মহীন। এখনো বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যাতে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখার কথা জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন কর্মকর্তারা। অবশ্য এসব তৎপরতায় তেমন কোনো সাফল্য আমরা দেখি না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে।
কেন্দ্র থেকে স্থানীয় উৎপাদন ক্ষেত্র পর্যন্ত ব্যবস্থাপনাও নজরদারির আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে আমদানিকৃত ও দেশজ উৎপাদিত- এই দুই ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও নির্বিঘ্ন রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।
[লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক]