alt

opinion » post-editorial

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সন্দেশখালি লাইন

গৌতম রায়

: শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

উত্তর চব্বিশ পরগণার সন্দেশখালির গ্রামে গণধর্ষণ নিয়ে তোলপাড় চলছে। উত্তর চব্বিশ পরগনার সন্দেশখালি ও সন্নিহিত এলাকার শেখ শাজাহান নামক তৃণমূলের এক নেতা তথা দুর্বৃত্ত, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং অর্থকরী বিষয়ক তদন্তকারী সংস্থা ইডির জালে পড়বার পর, গোটা সন্দেশখালি যখন উত্তাল হয়ে উঠেছে, এইরকম সময়ে বহু যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সন্দেশখালির সাধারণ মা-বোনেরা প্রকাশ্যে গণমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমের সামনে তাদের এলাকায় শাসক তৃণমূলের নেতাকর্মীদের এই পাশবিক বিকৃতির কথা বলতে পেরেছেন।

সন্দেশখালিতে তৃণমূলের করিতকর্মা নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে ইডির তল্লাশির পর, সেখানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে মিডিয়ার সামনে মুখ খোলবার সাহস পেয়েছেন সেখানকার নারী সমাজ। মুখ খোলবার সাহস পেয়েছে সেখানকার ছোট ছোট শিশুরাও; কিন্তু যারা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের খবরা খবর জানতেন, তারা প্রত্যেকেই জানেন যে, কেবলমাত্র সন্দেশখালি নয়, পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই, শাসক তৃণমূল কংগ্রেস, তাদের সীমাহীন দুর্নীতি-চুরি থেকে শুরু করে সরকারি অর্থ তছরূপ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

মাঝে মাঝে সমাজ মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের ‘দামাল’ ছেলেদের মহাভারতের কুরু রাজসভার পুনরাবৃত্তি করবার কিছু কিছু ঘটনা এর আগে উঠে এসেছে। আমরা দেখেছি ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে, বিরোধীদলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দেয়ার জন্য শাসক তৃণমূল কংগ্রেস নেতাকর্মীরা, কিভাবে প্রকাশ্য রাস্তায়, বামপন্থী দলের মহিলা প্রার্থীকে বিবস্ত্র করেছে।চুলের মুঠি ধরে মারধর করেছে।

সেই সব ঘটনাক্রম পুলিশের দৃষ্টিগোচরে আনা সত্ত্বেও, একজন ও অপরাধীকে পশ্চিমবঙ্গের দলদাস পুলিশ ধরেনি।তাদের শাস্তি পাওয়া তো দূরের কথা। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা -এগুলো সবই অকেজো হয়ে গেছে। তারা শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমি স্তরের কর্মীদের, পশ্চিমবঙ্গের মহিলা সমাজের প্রতি পাশবিক বর্বরোচিত আচরণ সম্পর্কে, খোদ পুলিশ মন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঠিক তথ্য দিতে পারছে না, বা দিতে ভয় পাচ্ছে। নয়তো গোয়েন্দারা সঠিক তথ্য দেয়া সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

আজ সন্দেশখালীর ঘটনা যখন প্রকাশ্যে এসেছে, তখনও কেন সমস্ত দায় ঝেড়ে ফেলবার মতো আচরণ করছেন মমতা? একটিবারের জন্য কেন সন্দেশখালির মহিলাদের, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সম্পর্কে যে ভয়াবহ অভিযোগ সমাজ মাধ্যমে ভিডিও চিত্রের ভেতর দিয়ে এসেছে, সে সম্পর্কে একটা শব্দ উচ্চারণও মমতা করেননি? মমতা কি ভয় পাচ্ছেন? তিনি কি মনে করছেন, যদি নিজের দলের ভূমিস্তরের নেতা, কর্মীদের এই গণধর্ষকদের ভূমিকার বিরুদ্ধে তিনি মুখ হলেন, তাহলে এমন কোনো বিদ্রোহ তার নিজের দল থেকে উঠে আসবে, যোকে সামাল দেয়ার মত ক্ষমতা তার নেই?

পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্ন না হয় ছেড়েই দেয়া হলো; কিন্তু সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা আজ এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে, যেটা বিহার- উত্তরপ্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা থেকেও নিকৃষ্টতর। পশ্চিমবঙ্গে কেবল যে তৃণমূলের বিরোধী বামপন্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে তা নয়। খোদ তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যেও এলাকায়-এলাকায় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই, এমন তৃণমূল কর্মীরা, এমনকি তাদের ঘরের মা বোনেরাও চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজ অভিযোগ করে আসছে যে, যে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ, একদম লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে একটা ব-াহীন মাত্রায় পৌঁছে দিয়ে, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের জায়গাটিকে ভোটের আগে আরো জোরদার করে তুলতেই এই কাজ তারা করছে।

আমরা দেখতে পেলাম, ঠিক সেভাবেই সন্দেশখালির ঘটনার প্রতিবাদে সিপিআই (এম) গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যে আন্দোলন করছে, আইন অমান্য করছে, থানা গুলির সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, সেখানেই এই ধরনের ভূমিকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ পালন করছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশের অত্যাচারে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে, সেই জেলার ডোমকলের অত্যন্ত গরিব ক্ষেতমজুর, বামপন্থী কর্মী, আনারুল ইসলামকে প্রাণ দিতে হয়েছে আন্দোলনরত অবস্থায়।

এখানে পুলিশের অত্যাচারে যে কেবলমাত্র আনারুল কে ই প্রাণ দিতে হয়েছে তা নয়।পুলিশের বেধড়ক মার, লাঠি, বুটের আঘাত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। পুলিশ সরাসরি ইঁট ছুঁড়ে আন্দোলনরত আরো বহু মানুষকে আহত করেছে। পুলিশ যে গুন্ডাদের মতো আন্দোলনরত নাগরিকদের ওপর ইট বৃষ্টি করতে পারেÑ এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশের কাছ থেকেই আমরা দেখতে পেলাম।

মুর্শিদাবাদে বহরমপুরে পুলিশের এই ভয়াবহ অত্যাচারে ক্ষেতমজুর আনারুল ছাড়াও আরো ছজন আন্দোলনরত কর্মী, গুরুতর আহত হয়েছেন। তারা মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। সাতজন মহিলাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আরো ২৩ জন আন্দোলনকারীকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আনারুলকে হত্যা করবার পর একটা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের খেলা গোটা মুর্শিদাবাদ জুড়ে তৃণমূল এবং বিজেপি, নিজের নিজের রাজনৈতিক লাইন অনুযায়ী ইতিমধ্যেই করতে শুরু করে দিয়েছে।

এই যে ভয়াবহ পরিস্থিতি মধ্য বঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গে রাজ্য সরকার নিয়েছে, তার প্রভাব যে উত্তরবঙ্গে পড়েছে না, তা নয়; কিন্তু উত্তরবঙ্গকে বিজেপির খোলা জমি হিসেবে ছেড়ে দেয়ার লক্ষ্যে, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার রাজনৈতিক কার্যক্রমগুলো ভিন্নধারায় পরিচালিত করছেন।

সমস্ত সংবাদমাধ্যম এবং বৈদ্যুতিক মাধ্যমগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের নেতা কর্মী মন্ত্রী সাংসদদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে মূল লড়াইটা লড়ছেন কিন্তু বামপন্থীরা। বিজেপি কোনোভাবেই এই লড়াইতে নেই। বরঞ্চ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থাগুলো এসব দুর্নীতি ঘিরে যে ধরনের ভূমিকা পালন করছে, তাতে অপরাধীরা, বেশ জামাই আদরে কোনো না কোনো জায়গায় আত্মগোপন করে থাকছে।

এটা খুব ভালো বুঝতে পারা যাচ্ছে সন্দেশখালির শাহজাহান, যাকে ঘিরে গোটা সন্দেশখালি উত্তাল হয়েছে, আজ প্রায় বাংলা উত্তাল, সেই শাহজাহান পুলিশের জালে ধরা পড়ছে না। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার জালেও ধরা পড়ছে না। অথচ সেই শাহজাহান একাধিকবার ওকালতনামায় সই করে আদালতে আগাম জামিনের আবেদন জানাচ্ছে। খোদ পশ্চিমবঙ্গের হাইকোর্ট সন্দেশখালির ভয়াবহ ঘটনা ঘিরে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানাচ্ছেন। তা সত্ত্বেও মমতা ব্যানার্জির পুলিশ, বেছে বেছে আন্দোলনকারীদের ধরছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের হত্যা করছে। আর কেন্দ্রীয় সরকার নানা ধরনের হম্বিতম্বি করলেও সেসব গর্জনের কোনো বর্ষণ আমরা আজ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না।

পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষদের আশঙ্কা; যেভাবে বামপন্থীদের আন্দোলনগুলোকে সংবাদ মাধ্যম চেপে যাচ্ছে তাতে মনে হয়; সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ, সরাসরি ধর্মান্ধ রাজনীতি এবং প্রতিযোগিতা মূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক বাহকদের স্বার্থ পূরণের দিকটাকেই নাগরিক সমাজের স্বার্থের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

tab

opinion » post-editorial

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সন্দেশখালি লাইন

গৌতম রায়

শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

উত্তর চব্বিশ পরগণার সন্দেশখালির গ্রামে গণধর্ষণ নিয়ে তোলপাড় চলছে। উত্তর চব্বিশ পরগনার সন্দেশখালি ও সন্নিহিত এলাকার শেখ শাজাহান নামক তৃণমূলের এক নেতা তথা দুর্বৃত্ত, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং অর্থকরী বিষয়ক তদন্তকারী সংস্থা ইডির জালে পড়বার পর, গোটা সন্দেশখালি যখন উত্তাল হয়ে উঠেছে, এইরকম সময়ে বহু যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সন্দেশখালির সাধারণ মা-বোনেরা প্রকাশ্যে গণমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমের সামনে তাদের এলাকায় শাসক তৃণমূলের নেতাকর্মীদের এই পাশবিক বিকৃতির কথা বলতে পেরেছেন।

সন্দেশখালিতে তৃণমূলের করিতকর্মা নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে ইডির তল্লাশির পর, সেখানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে মিডিয়ার সামনে মুখ খোলবার সাহস পেয়েছেন সেখানকার নারী সমাজ। মুখ খোলবার সাহস পেয়েছে সেখানকার ছোট ছোট শিশুরাও; কিন্তু যারা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের খবরা খবর জানতেন, তারা প্রত্যেকেই জানেন যে, কেবলমাত্র সন্দেশখালি নয়, পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই, শাসক তৃণমূল কংগ্রেস, তাদের সীমাহীন দুর্নীতি-চুরি থেকে শুরু করে সরকারি অর্থ তছরূপ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

মাঝে মাঝে সমাজ মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের ‘দামাল’ ছেলেদের মহাভারতের কুরু রাজসভার পুনরাবৃত্তি করবার কিছু কিছু ঘটনা এর আগে উঠে এসেছে। আমরা দেখেছি ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে, বিরোধীদলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দেয়ার জন্য শাসক তৃণমূল কংগ্রেস নেতাকর্মীরা, কিভাবে প্রকাশ্য রাস্তায়, বামপন্থী দলের মহিলা প্রার্থীকে বিবস্ত্র করেছে।চুলের মুঠি ধরে মারধর করেছে।

সেই সব ঘটনাক্রম পুলিশের দৃষ্টিগোচরে আনা সত্ত্বেও, একজন ও অপরাধীকে পশ্চিমবঙ্গের দলদাস পুলিশ ধরেনি।তাদের শাস্তি পাওয়া তো দূরের কথা। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা -এগুলো সবই অকেজো হয়ে গেছে। তারা শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমি স্তরের কর্মীদের, পশ্চিমবঙ্গের মহিলা সমাজের প্রতি পাশবিক বর্বরোচিত আচরণ সম্পর্কে, খোদ পুলিশ মন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঠিক তথ্য দিতে পারছে না, বা দিতে ভয় পাচ্ছে। নয়তো গোয়েন্দারা সঠিক তথ্য দেয়া সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

আজ সন্দেশখালীর ঘটনা যখন প্রকাশ্যে এসেছে, তখনও কেন সমস্ত দায় ঝেড়ে ফেলবার মতো আচরণ করছেন মমতা? একটিবারের জন্য কেন সন্দেশখালির মহিলাদের, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সম্পর্কে যে ভয়াবহ অভিযোগ সমাজ মাধ্যমে ভিডিও চিত্রের ভেতর দিয়ে এসেছে, সে সম্পর্কে একটা শব্দ উচ্চারণও মমতা করেননি? মমতা কি ভয় পাচ্ছেন? তিনি কি মনে করছেন, যদি নিজের দলের ভূমিস্তরের নেতা, কর্মীদের এই গণধর্ষকদের ভূমিকার বিরুদ্ধে তিনি মুখ হলেন, তাহলে এমন কোনো বিদ্রোহ তার নিজের দল থেকে উঠে আসবে, যোকে সামাল দেয়ার মত ক্ষমতা তার নেই?

পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্ন না হয় ছেড়েই দেয়া হলো; কিন্তু সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা আজ এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে, যেটা বিহার- উত্তরপ্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা থেকেও নিকৃষ্টতর। পশ্চিমবঙ্গে কেবল যে তৃণমূলের বিরোধী বামপন্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে তা নয়। খোদ তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যেও এলাকায়-এলাকায় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই, এমন তৃণমূল কর্মীরা, এমনকি তাদের ঘরের মা বোনেরাও চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজ অভিযোগ করে আসছে যে, যে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ, একদম লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে একটা ব-াহীন মাত্রায় পৌঁছে দিয়ে, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের জায়গাটিকে ভোটের আগে আরো জোরদার করে তুলতেই এই কাজ তারা করছে।

আমরা দেখতে পেলাম, ঠিক সেভাবেই সন্দেশখালির ঘটনার প্রতিবাদে সিপিআই (এম) গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যে আন্দোলন করছে, আইন অমান্য করছে, থানা গুলির সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, সেখানেই এই ধরনের ভূমিকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ পালন করছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশের অত্যাচারে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে, সেই জেলার ডোমকলের অত্যন্ত গরিব ক্ষেতমজুর, বামপন্থী কর্মী, আনারুল ইসলামকে প্রাণ দিতে হয়েছে আন্দোলনরত অবস্থায়।

এখানে পুলিশের অত্যাচারে যে কেবলমাত্র আনারুল কে ই প্রাণ দিতে হয়েছে তা নয়।পুলিশের বেধড়ক মার, লাঠি, বুটের আঘাত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। পুলিশ সরাসরি ইঁট ছুঁড়ে আন্দোলনরত আরো বহু মানুষকে আহত করেছে। পুলিশ যে গুন্ডাদের মতো আন্দোলনরত নাগরিকদের ওপর ইট বৃষ্টি করতে পারেÑ এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশের কাছ থেকেই আমরা দেখতে পেলাম।

মুর্শিদাবাদে বহরমপুরে পুলিশের এই ভয়াবহ অত্যাচারে ক্ষেতমজুর আনারুল ছাড়াও আরো ছজন আন্দোলনরত কর্মী, গুরুতর আহত হয়েছেন। তারা মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। সাতজন মহিলাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আরো ২৩ জন আন্দোলনকারীকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আনারুলকে হত্যা করবার পর একটা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের খেলা গোটা মুর্শিদাবাদ জুড়ে তৃণমূল এবং বিজেপি, নিজের নিজের রাজনৈতিক লাইন অনুযায়ী ইতিমধ্যেই করতে শুরু করে দিয়েছে।

এই যে ভয়াবহ পরিস্থিতি মধ্য বঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গে রাজ্য সরকার নিয়েছে, তার প্রভাব যে উত্তরবঙ্গে পড়েছে না, তা নয়; কিন্তু উত্তরবঙ্গকে বিজেপির খোলা জমি হিসেবে ছেড়ে দেয়ার লক্ষ্যে, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার রাজনৈতিক কার্যক্রমগুলো ভিন্নধারায় পরিচালিত করছেন।

সমস্ত সংবাদমাধ্যম এবং বৈদ্যুতিক মাধ্যমগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের নেতা কর্মী মন্ত্রী সাংসদদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে মূল লড়াইটা লড়ছেন কিন্তু বামপন্থীরা। বিজেপি কোনোভাবেই এই লড়াইতে নেই। বরঞ্চ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থাগুলো এসব দুর্নীতি ঘিরে যে ধরনের ভূমিকা পালন করছে, তাতে অপরাধীরা, বেশ জামাই আদরে কোনো না কোনো জায়গায় আত্মগোপন করে থাকছে।

এটা খুব ভালো বুঝতে পারা যাচ্ছে সন্দেশখালির শাহজাহান, যাকে ঘিরে গোটা সন্দেশখালি উত্তাল হয়েছে, আজ প্রায় বাংলা উত্তাল, সেই শাহজাহান পুলিশের জালে ধরা পড়ছে না। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার জালেও ধরা পড়ছে না। অথচ সেই শাহজাহান একাধিকবার ওকালতনামায় সই করে আদালতে আগাম জামিনের আবেদন জানাচ্ছে। খোদ পশ্চিমবঙ্গের হাইকোর্ট সন্দেশখালির ভয়াবহ ঘটনা ঘিরে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানাচ্ছেন। তা সত্ত্বেও মমতা ব্যানার্জির পুলিশ, বেছে বেছে আন্দোলনকারীদের ধরছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের হত্যা করছে। আর কেন্দ্রীয় সরকার নানা ধরনের হম্বিতম্বি করলেও সেসব গর্জনের কোনো বর্ষণ আমরা আজ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না।

পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষদের আশঙ্কা; যেভাবে বামপন্থীদের আন্দোলনগুলোকে সংবাদ মাধ্যম চেপে যাচ্ছে তাতে মনে হয়; সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ, সরাসরি ধর্মান্ধ রাজনীতি এবং প্রতিযোগিতা মূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক বাহকদের স্বার্থ পূরণের দিকটাকেই নাগরিক সমাজের স্বার্থের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top