alt

উপ-সম্পাদকীয়

কতটুকু এগোলো বিমা খাত?

রেজাউল করিম খোকন

: সোমবার, ০৪ মার্চ ২০২৪

স্বাধীনতা লাভের পর গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই বিকশিত হয়েছে। অর্থনীতির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর বৈশিষ্ট্য এবং স্বরূপে নানা পরিবর্তন ঘটেছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্প ও সেবানির্ভর অর্থনীতির নতুন রূপ এখন আমাদের সামনে দৃশ্যমান। শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এসবের একটি প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে বিমা খাতেরও বিস্তৃতি ঘটেছে। যদিও অর্থনীতির আরেকটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে ব্যাংকিং খাতের যতটা অগ্রগতি হয়েছে, সেই তুলনায় বাংলাদেশে বিমা খাতের তেমন সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়নি। আকার-আয়তন-সংখ্যায় বিমা খাতের প্রসার ঘটলেও প্রকৃতপক্ষে গুণগত উন্নতি লাভ ঘটেনি। গত ৫০ বছরে বিমা খাতে নতুন নতুন অনেক কিছুর সংযোজন হয়েছে বটে তবে তা আন্তর্জাতিক মানদ-ে উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে যেতে পারেনি।

প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশের বিমা শিল্প বেশ পিছিয়ে আছে বলা যায়। যেহেতু আধুনিক সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকা- নানাভাবে বিমানির্ভর। শিল্পকারখানা স্থাপন, পরিচালনা, উৎপাদন, বিপণন-বিতরণ, বাজারজাতকরণ- প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদ্যমাণ ঝুঁকির নিরাপত্তা বিধানে বিমাকরণ বিধিদ্ধভাবে আবশ্যিক ব্যাপার হিসেবে বিবেচিত বলেই এটাকে গুরুত্বহীন কিংবা অপ্রয়োজনীয় ভাবার কোনো অবকাশ নেই। বর্তমান প্রাত্যহিক জীবনযাপনেও বিদ্যমান ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পেতে বিমার কোনো বিকল্প নেই। অগ্নিকা-, সড়ক দুর্গটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় ইত্যাদির পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিপরীতেও নিরাপত্তা দিতে বিমাকরণের প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।

প্রত্যেক মানুষের জীবনে নানা ধরনের ঝুঁকি এক ধরনের অনিশ্চয়তাবোধ সৃষ্টি করে। সেই ঝুঁকির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দিতে নির্ভরযোগ্য, শক্তিশালী সহায় হতে উঠতে পারে জীবনবিমাÑ এটা উপলদ্ধি করতেই সচেতন মানুষ স্বাভাবিকভাবে জীবনবীমার প্রতি আকৃষ্ট হন। ফলে জীবনবীমা জীবনযাপনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়। যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জীবন বিমা সেভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি সিংহভাগ মানুষের মধ্যে। তবে এ জন্য মানুষের অজ্ঞতা, অসচেতনতার পাশাপাশি বিভিন্ন বিমা প্রতিষ্ঠানের অনুন্নত সেবার মান, প্রতারণামূলক কর্মকা-, হয়রানিমূলক আচরণ, অপেশাদার মনোভাব, বীমাকর্মীদের অমানবিক, অদক্ষ আচরণ এক্ষেত্রে আস্থাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে আজও।

দুর্যোগপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিমা খাতের উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকলেও এ খাতের প্রতি মানুষের দীর্ঘদিনের আস্থার সংকটের কারণে সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছেনা। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে বিমার আওতায় রয়েছে ৮ শতাংশের কম মানুষ। জিডিপিতে এ খাতের অবদান মাত্র দশমিক ৫৫ শতাংশ। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তা ৪ শতাংশেরও বেশি। এখানে বিমাখাতের প্রতি সাধারণভাবে আস্থা সংকটের কারণগুলো কি? খুঁজতে গেলে যা সহজে চোখে পড়েÑ গ্রাহকদের বিমা দাবি পূরণে কোম্পানিগুলোর অনীহা, দক্ষ জনবলের অভাব, বিমা কোম্পানিগুলোর পেশাদারিত্বের ঘাটতি, সামগ্রিকভাবে এ খাতের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন বিমাপণ্য না আসা, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব, প্রযুক্তিগত দক্ষতায় পিছিয়ে থাকা, প্রয়োজনীয় যুগোপযোগী আইন-কানুনে ঘাটতি এবং কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিরাজমান অসুস্থ প্রতিযোগিতা এ খাতের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে প্রতিনিয়ত।

এ দেশে অতীত সময় থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে বিমা খাতের প্রতি নেতিবাচক ভাবমূর্তি বিরাজ করছে। বিমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকের দাবি পরিশোধে টালবাহানা করে, যথাসময়ে পরিশোধ না করার ক্ষেত্রে অহেতুক অজুহাত খাঁড়া করে। ফলে হয়রানির শিকার হতে হতে গ্রাহক তথা সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সাধারণত মানুষ একান্ত বাধ্য না হলে বিমা কোম্পানির দারস্থ হতে চায়না। এতে করে সামগ্রিকভাবে বিমাশিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে দেশে ৭৮টি বিমা কোম্পানির কাজ করছে, যার মধ্যে জীবন বিমা কোম্পানি ৩২টি এবং সাধারণ বিমা কোম্পানি ৪৬টি।

গত একদশকে দেশে বিমা কোম্পানির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বটে তবে অধিকাংশ কোম্পানিই এখনও টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত। কিছু কিছু জীবনবিমা কোম্পানি পল্লী বা মফস্বল এলাকায় তাদের অনেক শাখা বন্ধ করে দিয়েছে এবং নতুন প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ শাখা এখন টিমটিম করে প্রায় নিবু নিবু অবস্থায় চলছে। আগামি দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে নিঃসন্দেহে বলা যায়। বৈশ্বিকভাবে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত বিমা কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অধিকাংশ ছোট এবং দুর্বল অসংগঠিত কোম্পানিগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং পরিচালনা করা দুস্কর হয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিশেষ করে, প্রতিবেশী দেশ কিংবা আমাদের সমপর্যায়ের একই ধরনের দেশগুলোতে যা ঘটছে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে বলা যায়, আমাদের বিমা খাতকে এখনও আরো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।

সরকারি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ আইডিআরএ কাজ করছে বিমা খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, অনিয়ম, দুর্নীতি দূর করা এবং সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গ্রাহক ও কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে নানাভাবে। জনবল সংকটের কারণে এখনও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠন করা সম্ভব হয়নি। তবে দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত জনবল সংকটের কারণে এখনও যথার্থ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠন করা যায়নি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধি ও প্রবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। আইডিআরএ এখনও যথার্থ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বিমা কোম্পানিগুলোর ওপর।

একটি কথা অবশ্যই মানতে হবে, যে দেশের বিমা খাত যত শক্তিশালী, সে দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী। বিমার গ্যারান্টি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিমার প্রতি মানুষের অনীহা লক্ষ্য করা যায় সাধারণভাবে। আমাদের সমাজে এটা বিদ্যমান। এটা দূর করতে হলে সরকারি নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবনযাপনের নানা বিষয় বিমার আওতায় আনার ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শুধুমাত্র শহর এলাকার মানুষ, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকঋত কার্যক্রম, পরিবহন, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদির মধ্যে বিমাখাতকে সীমাবদ্ধ না রেখে কৃষিখাত, কৃষক, উৎপাদিত ফসল, কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতকরণ, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগির খামার, হাওর, কৃষিজমিকে বিমার আওতায় আনার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশে আজকাল প্রায় বড় বড় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। তাতে জানমালের বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। বিমাকৃত না হওয়ায় সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার তেমন কোনো সুযোগ থাকছেনা। সময়ের দাবি পূরণে দেশের বিভিন্ন আবাসিক- বাণিজ্যিক ভবন, শিল্পকারখানাকে আবশ্যিকভাবে বিমার আওতায় আনার ব্যাপারে তৎপর হতে হবে সংশ্লিষ্ট মহলকে। আজকাল কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি কোষাগার থেকে সাহায্যের হাত বাড়াতে হয়। যদি তা বিমাকৃত হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানি ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে তার সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করবে। সড়ক, নৌ, বিমান পথে চলাচলকারীদের আবশ্যিকভাবে বিমার আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিমার ব্যাপারে সাধারণের মধ্যে যে অনীহাভাব, অসচেতনতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার বিরাজমান তা দূর করতে বাস্তবমুখী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুধাবনের মাধ্যমে উৎসাহী করে তুলতে হবে । সাধারণত, সরকারি নির্দেশনা ছাড়া মানুষ কিছু করতে চায় না। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা জারির মাধ্যমে বিমার প্রতি সবাইকে আকৃষ্ট করতে হবে। এর মাধ্যমে প্রকারন্তরে মানুষ উপকৃত এবং লাভবান হনÑ এটা বোঝাতে হবে সবাইকে।

আমাদের এখানে বিমা খাত অনেক সম্ভাবনাময় সন্দেহ নেই। বাজার অর্থনীতিতে বিমাখাত বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সাধারণ বিমা সরাসরি সম্পৃক্ত। মাথাপিছু গড় আয়, শিক্ষার হার, স্বাস্থ্য সচেতনতা ইত্যাদির সঙ্গে জীবন বিমার সম্পৃক্ততা থাকে। এসব মানদ-ে আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিমা খাতের অগ্রগতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। এর জন্য দুর্বল রেগুলেটরি অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে দায়ী করা যায়। আমাদের উন্নয়ন সহযোগিদের সহযোগিতায় অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে বিমা আইন-২০১০ পাশ হয়েছে। দীর্ঘ চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে বিমা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইন্সুরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ) কার্যক্রম শুরু করেছে আরো বেশ কয়েক বছর আগেই।

বিমা খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন বিধিবিধান পরিপালনের মাধ্যমে অনিয়ম, দুর্নীতি দূর করতে তারা বেশ তৎপর। ইতোমধ্যে এ সংস্থা অনেকগুলো বিধিমালা, প্রবিধিমালা, প্রণয়ন করেছে। এই সবাই বিধিমালা ও প্রবিধিমালা বাস্তবায়িত হলে বিমা খাতে প্রত্যাশিত উন্নয়ন সাধিত হবে। দীর্ঘমেয়াদি সুফল পেতে হলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পাঠক্রমে বিমা শিক্ষা বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমাদের দেশে এতো বেশি সংখ্যক বিমা কোম্পানির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিনা তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। অধিক সংখ্যক বিমা কোম্পানি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এখানে উন্নতমানের বিমা সেবার নিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়নি। ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে থাকা অনেক বিমা কোম্পানি গ্রাহকদের প্রিমিয়ামের অর্থ আত্মসাতের ধান্ধায় নিয়োজিত থাকায় এখাতে সুস্থ পরিবেশ সুনিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে নজরদারি আরো বাড়াতে হবে। নতুন বিমা কোম্পানিকে অনুমোদন দেয়ার সময় রাজনৈতিক বিবেচনা ও পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদিকে গুরুত্ব না দিয়ে অর্থনৈতিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।

বিমা খাতের অনেক কোম্পানি নির্ধারিত সীমার চাইতে বেশি ব্যয় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কর্পোরেট সুশাসনের বিষয়টিও এখানে প্রায়ই উপেক্ষিত রয়ে যাচ্ছে। প্রিমিয়াম সংগ্রহ, পুর্নাবিমা, বিমাদাবি নিষ্পত্তিসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে প্রায়ই। অনেক বিমা কোম্পানি মিথ্যা দাবি সাজিয়ে আগের তারিখে কাভারে নোট ইস্যু করে এবং প্রভাব খাটিয়ে গ্রাহকের বিমাদাবির অর্থ আত্মসাৎ করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। এ খাতে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, পরিচালকদের দুর্নীতি ও নিয়ন্ত্রণহীনতার যথেষ্ট পরিমাণ উদাহরণ রয়েছে। বিমা উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকাসুরেন্স চালুর বিধান করেছে।

বিমা খাতের উন্নয়নে ব্যাংকাসুরেন্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার উদাহরণ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোতে রয়েছে। বিশেষ করে জীবন বিমার মতো দীর্ঘমেয়াদি পলিসির প্রসারে ব্যাংকাসুরেন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, আশা করা যায়।

২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিমা খাত নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রাইজওয়াটার হাউজকুপারস। সেই প্রতিবেদনে দেশের বিমা খাতের অবস্থা, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটির তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছরই জিডিপির তুলনায় বিমা প্রিমিয়ামের পরিমাণ কমেছে। জিডিপির অনুপাতে প্রিমিয়ামের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানেরও নিচে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাতে প্রিমিয়ামের পরিমাণ ছিল দশমিক ৫৫ শতাংশ। অথচ সমপর্যায়ের দেশের অবস্থা ও মাথাপিছু আয় বিবেচনায় এটি অতি সহজে ১ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়া উচিত।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

বিয়ের কিছু লোকাচার ও অপব্যয় প্রসঙ্গে

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পকে রক্ষা করুন

তরুণদের দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব

শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় কী

সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও মনঃসমীক্ষণ

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরবর্তী বিয়ের আইনি প্রতিকার ও বাস্তবতা

তথ্য-উপাত্তের গরমিলে বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতিতে বিভ্রান্তি

দেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের গুরুত্ব

ইরানে কট্টরপন্থার সাময়িক পরাজয়

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার ভবিষ্যৎ কী

ক্ষমতার সাতকাহন

জলবায়ু সংকট : আমাদের উপলব্ধি

নারী-পুরুষ চুড়ি পরি, দেশের অন্যায় দূর করি!

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার

ছবি

সাধারণ মানুষেরা বড় অসাধারণ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও কারিগরি শিক্ষা

মাদক রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

পারিবারিক অপরাধপ্রবণতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

ডারউইনকে খুঁজে পেয়েছি

চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফসল উৎপাদন করা জরুরি

পিএসসি প্রশ্নফাঁসের দায় এড়াবে কীভাবে

এত উন্নয়নের পরও বাসযোগ্যতায় কেন পিছিয়েই থাকছে ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য কি কেউ নেই?

জলবায়ু রক্ষায় কাজের কাজ কি কিছু হচ্ছে

অধরার হাতে সমর্পিত ক্ষমতা

প্রসঙ্গ : কোটাবিরোধী আন্দোলন

রম্যগদ্য : যে করিবে চালাকি, বুঝিবে তার জ্বালা কী

একটি মিথ্যা ধর্ষণ মামলার পরিণতি

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কেন শ্রেণীকক্ষের বাইরে

মেধা নিয়ে কম মেধাবীর ভাবনা

প্রজাতন্ত্রের সেবক কেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বনে যান

ছবি

বাইডেন কি দলে বোঝা হয়ে যাচ্ছেন?

ছবি

দুই যুগের পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সাপ উপকারী প্রাণীও বটে!

ছবি

বাস্তববাদী রাজনীতিক জ্যোতি বসু

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কতটুকু এগোলো বিমা খাত?

রেজাউল করিম খোকন

সোমবার, ০৪ মার্চ ২০২৪

স্বাধীনতা লাভের পর গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই বিকশিত হয়েছে। অর্থনীতির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর বৈশিষ্ট্য এবং স্বরূপে নানা পরিবর্তন ঘটেছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্প ও সেবানির্ভর অর্থনীতির নতুন রূপ এখন আমাদের সামনে দৃশ্যমান। শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এসবের একটি প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে বিমা খাতেরও বিস্তৃতি ঘটেছে। যদিও অর্থনীতির আরেকটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে ব্যাংকিং খাতের যতটা অগ্রগতি হয়েছে, সেই তুলনায় বাংলাদেশে বিমা খাতের তেমন সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়নি। আকার-আয়তন-সংখ্যায় বিমা খাতের প্রসার ঘটলেও প্রকৃতপক্ষে গুণগত উন্নতি লাভ ঘটেনি। গত ৫০ বছরে বিমা খাতে নতুন নতুন অনেক কিছুর সংযোজন হয়েছে বটে তবে তা আন্তর্জাতিক মানদ-ে উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে যেতে পারেনি।

প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশের বিমা শিল্প বেশ পিছিয়ে আছে বলা যায়। যেহেতু আধুনিক সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকা- নানাভাবে বিমানির্ভর। শিল্পকারখানা স্থাপন, পরিচালনা, উৎপাদন, বিপণন-বিতরণ, বাজারজাতকরণ- প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদ্যমাণ ঝুঁকির নিরাপত্তা বিধানে বিমাকরণ বিধিদ্ধভাবে আবশ্যিক ব্যাপার হিসেবে বিবেচিত বলেই এটাকে গুরুত্বহীন কিংবা অপ্রয়োজনীয় ভাবার কোনো অবকাশ নেই। বর্তমান প্রাত্যহিক জীবনযাপনেও বিদ্যমান ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পেতে বিমার কোনো বিকল্প নেই। অগ্নিকা-, সড়ক দুর্গটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় ইত্যাদির পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিপরীতেও নিরাপত্তা দিতে বিমাকরণের প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।

প্রত্যেক মানুষের জীবনে নানা ধরনের ঝুঁকি এক ধরনের অনিশ্চয়তাবোধ সৃষ্টি করে। সেই ঝুঁকির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দিতে নির্ভরযোগ্য, শক্তিশালী সহায় হতে উঠতে পারে জীবনবিমাÑ এটা উপলদ্ধি করতেই সচেতন মানুষ স্বাভাবিকভাবে জীবনবীমার প্রতি আকৃষ্ট হন। ফলে জীবনবীমা জীবনযাপনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়। যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জীবন বিমা সেভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি সিংহভাগ মানুষের মধ্যে। তবে এ জন্য মানুষের অজ্ঞতা, অসচেতনতার পাশাপাশি বিভিন্ন বিমা প্রতিষ্ঠানের অনুন্নত সেবার মান, প্রতারণামূলক কর্মকা-, হয়রানিমূলক আচরণ, অপেশাদার মনোভাব, বীমাকর্মীদের অমানবিক, অদক্ষ আচরণ এক্ষেত্রে আস্থাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে আজও।

দুর্যোগপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিমা খাতের উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকলেও এ খাতের প্রতি মানুষের দীর্ঘদিনের আস্থার সংকটের কারণে সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছেনা। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে বিমার আওতায় রয়েছে ৮ শতাংশের কম মানুষ। জিডিপিতে এ খাতের অবদান মাত্র দশমিক ৫৫ শতাংশ। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তা ৪ শতাংশেরও বেশি। এখানে বিমাখাতের প্রতি সাধারণভাবে আস্থা সংকটের কারণগুলো কি? খুঁজতে গেলে যা সহজে চোখে পড়েÑ গ্রাহকদের বিমা দাবি পূরণে কোম্পানিগুলোর অনীহা, দক্ষ জনবলের অভাব, বিমা কোম্পানিগুলোর পেশাদারিত্বের ঘাটতি, সামগ্রিকভাবে এ খাতের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন বিমাপণ্য না আসা, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব, প্রযুক্তিগত দক্ষতায় পিছিয়ে থাকা, প্রয়োজনীয় যুগোপযোগী আইন-কানুনে ঘাটতি এবং কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিরাজমান অসুস্থ প্রতিযোগিতা এ খাতের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে প্রতিনিয়ত।

এ দেশে অতীত সময় থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে বিমা খাতের প্রতি নেতিবাচক ভাবমূর্তি বিরাজ করছে। বিমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকের দাবি পরিশোধে টালবাহানা করে, যথাসময়ে পরিশোধ না করার ক্ষেত্রে অহেতুক অজুহাত খাঁড়া করে। ফলে হয়রানির শিকার হতে হতে গ্রাহক তথা সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সাধারণত মানুষ একান্ত বাধ্য না হলে বিমা কোম্পানির দারস্থ হতে চায়না। এতে করে সামগ্রিকভাবে বিমাশিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে দেশে ৭৮টি বিমা কোম্পানির কাজ করছে, যার মধ্যে জীবন বিমা কোম্পানি ৩২টি এবং সাধারণ বিমা কোম্পানি ৪৬টি।

গত একদশকে দেশে বিমা কোম্পানির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে বটে তবে অধিকাংশ কোম্পানিই এখনও টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত। কিছু কিছু জীবনবিমা কোম্পানি পল্লী বা মফস্বল এলাকায় তাদের অনেক শাখা বন্ধ করে দিয়েছে এবং নতুন প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ শাখা এখন টিমটিম করে প্রায় নিবু নিবু অবস্থায় চলছে। আগামি দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে নিঃসন্দেহে বলা যায়। বৈশ্বিকভাবে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত বিমা কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অধিকাংশ ছোট এবং দুর্বল অসংগঠিত কোম্পানিগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং পরিচালনা করা দুস্কর হয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিশেষ করে, প্রতিবেশী দেশ কিংবা আমাদের সমপর্যায়ের একই ধরনের দেশগুলোতে যা ঘটছে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে বলা যায়, আমাদের বিমা খাতকে এখনও আরো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।

সরকারি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ আইডিআরএ কাজ করছে বিমা খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, অনিয়ম, দুর্নীতি দূর করা এবং সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গ্রাহক ও কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণ করার লক্ষ্যে নানাভাবে। জনবল সংকটের কারণে এখনও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠন করা সম্ভব হয়নি। তবে দক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রশিক্ষিত জনবল সংকটের কারণে এখনও যথার্থ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠন করা যায়নি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধি ও প্রবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। আইডিআরএ এখনও যথার্থ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বিমা কোম্পানিগুলোর ওপর।

একটি কথা অবশ্যই মানতে হবে, যে দেশের বিমা খাত যত শক্তিশালী, সে দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী। বিমার গ্যারান্টি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিমার প্রতি মানুষের অনীহা লক্ষ্য করা যায় সাধারণভাবে। আমাদের সমাজে এটা বিদ্যমান। এটা দূর করতে হলে সরকারি নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবনযাপনের নানা বিষয় বিমার আওতায় আনার ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শুধুমাত্র শহর এলাকার মানুষ, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকঋত কার্যক্রম, পরিবহন, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদির মধ্যে বিমাখাতকে সীমাবদ্ধ না রেখে কৃষিখাত, কৃষক, উৎপাদিত ফসল, কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতকরণ, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগির খামার, হাওর, কৃষিজমিকে বিমার আওতায় আনার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশে আজকাল প্রায় বড় বড় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটছে। তাতে জানমালের বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। বিমাকৃত না হওয়ায় সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার তেমন কোনো সুযোগ থাকছেনা। সময়ের দাবি পূরণে দেশের বিভিন্ন আবাসিক- বাণিজ্যিক ভবন, শিল্পকারখানাকে আবশ্যিকভাবে বিমার আওতায় আনার ব্যাপারে তৎপর হতে হবে সংশ্লিষ্ট মহলকে। আজকাল কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি কোষাগার থেকে সাহায্যের হাত বাড়াতে হয়। যদি তা বিমাকৃত হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানি ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে তার সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করবে। সড়ক, নৌ, বিমান পথে চলাচলকারীদের আবশ্যিকভাবে বিমার আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিমার ব্যাপারে সাধারণের মধ্যে যে অনীহাভাব, অসচেতনতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার বিরাজমান তা দূর করতে বাস্তবমুখী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুধাবনের মাধ্যমে উৎসাহী করে তুলতে হবে । সাধারণত, সরকারি নির্দেশনা ছাড়া মানুষ কিছু করতে চায় না। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা জারির মাধ্যমে বিমার প্রতি সবাইকে আকৃষ্ট করতে হবে। এর মাধ্যমে প্রকারন্তরে মানুষ উপকৃত এবং লাভবান হনÑ এটা বোঝাতে হবে সবাইকে।

আমাদের এখানে বিমা খাত অনেক সম্ভাবনাময় সন্দেহ নেই। বাজার অর্থনীতিতে বিমাখাত বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সাধারণ বিমা সরাসরি সম্পৃক্ত। মাথাপিছু গড় আয়, শিক্ষার হার, স্বাস্থ্য সচেতনতা ইত্যাদির সঙ্গে জীবন বিমার সম্পৃক্ততা থাকে। এসব মানদ-ে আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিমা খাতের অগ্রগতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। এর জন্য দুর্বল রেগুলেটরি অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে দায়ী করা যায়। আমাদের উন্নয়ন সহযোগিদের সহযোগিতায় অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে বিমা আইন-২০১০ পাশ হয়েছে। দীর্ঘ চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে বিমা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইন্সুরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ) কার্যক্রম শুরু করেছে আরো বেশ কয়েক বছর আগেই।

বিমা খাতে শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন বিধিবিধান পরিপালনের মাধ্যমে অনিয়ম, দুর্নীতি দূর করতে তারা বেশ তৎপর। ইতোমধ্যে এ সংস্থা অনেকগুলো বিধিমালা, প্রবিধিমালা, প্রণয়ন করেছে। এই সবাই বিধিমালা ও প্রবিধিমালা বাস্তবায়িত হলে বিমা খাতে প্রত্যাশিত উন্নয়ন সাধিত হবে। দীর্ঘমেয়াদি সুফল পেতে হলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পাঠক্রমে বিমা শিক্ষা বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমাদের দেশে এতো বেশি সংখ্যক বিমা কোম্পানির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিনা তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। অধিক সংখ্যক বিমা কোম্পানি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এখানে উন্নতমানের বিমা সেবার নিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়নি। ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে থাকা অনেক বিমা কোম্পানি গ্রাহকদের প্রিমিয়ামের অর্থ আত্মসাতের ধান্ধায় নিয়োজিত থাকায় এখাতে সুস্থ পরিবেশ সুনিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে নজরদারি আরো বাড়াতে হবে। নতুন বিমা কোম্পানিকে অনুমোদন দেয়ার সময় রাজনৈতিক বিবেচনা ও পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদিকে গুরুত্ব না দিয়ে অর্থনৈতিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।

বিমা খাতের অনেক কোম্পানি নির্ধারিত সীমার চাইতে বেশি ব্যয় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কর্পোরেট সুশাসনের বিষয়টিও এখানে প্রায়ই উপেক্ষিত রয়ে যাচ্ছে। প্রিমিয়াম সংগ্রহ, পুর্নাবিমা, বিমাদাবি নিষ্পত্তিসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে প্রায়ই। অনেক বিমা কোম্পানি মিথ্যা দাবি সাজিয়ে আগের তারিখে কাভারে নোট ইস্যু করে এবং প্রভাব খাটিয়ে গ্রাহকের বিমাদাবির অর্থ আত্মসাৎ করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। এ খাতে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, পরিচালকদের দুর্নীতি ও নিয়ন্ত্রণহীনতার যথেষ্ট পরিমাণ উদাহরণ রয়েছে। বিমা উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকাসুরেন্স চালুর বিধান করেছে।

বিমা খাতের উন্নয়নে ব্যাংকাসুরেন্সের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার উদাহরণ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোতে রয়েছে। বিশেষ করে জীবন বিমার মতো দীর্ঘমেয়াদি পলিসির প্রসারে ব্যাংকাসুরেন্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, আশা করা যায়।

২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিমা খাত নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রাইজওয়াটার হাউজকুপারস। সেই প্রতিবেদনে দেশের বিমা খাতের অবস্থা, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটির তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছরই জিডিপির তুলনায় বিমা প্রিমিয়ামের পরিমাণ কমেছে। জিডিপির অনুপাতে প্রিমিয়ামের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানেরও নিচে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাতে প্রিমিয়ামের পরিমাণ ছিল দশমিক ৫৫ শতাংশ। অথচ সমপর্যায়ের দেশের অবস্থা ও মাথাপিছু আয় বিবেচনায় এটি অতি সহজে ১ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়া উচিত।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top