alt

উপ-সম্পাদকীয়

আধুনিক রূপকথা এবং আমাদের রাজাদের গল্প

শেখর ভট্টাচার্য

: বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন ২০২৪
image

কেঁচো খুঁড়তে যখন সাপ বেরিয়ে আসে তখন মাছের মায়ের পুত্র শোক শুরু হয়ে যায়। আধুনিক যুগ বড় বিচিত্র! এ যুগে উল্টো পুরাণ। মাছের মায়ের কোন ভূমিকা নেই, সাপ বেরোতে দেখলে মাছের বাবারা শোকের বদলে রাগে-গোস্বায় ফেটে পড়েন। স্বাভাবিক অবস্থায় পুত্রেরা টাকার জোগানের জন্য চিন্তা করেন না। পিতা গৌরি সেন পুত্রের স্বাদ-আহ্লাদ মেটাতে টাকার পাহাড় পুত্রের সামনে হাজির করেন। পুত্রের কাছে তিনি দয়ার সাগর, যেমন এককালে হাজী মুহম্মদ মহসীন ছিলেন দরিদ্র মানুষের কাছে।

তবে আধুনিক গৌরি সেন যে কাজটি করলেন তা দেখে আমাদের আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেলো। কী নির্মম, কী নিষ্ঠুর এই আধুনিক গৌরি সেন। আদি গৌরি সেন কিন্তু এতো নিষ্ঠুর ছিলেন না। দেশবাসী বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো, পুত্র যখন সামান্য একটি ছাগল কেনে আনন্দে বিগলিত হয়ে ছাগলের সাথে ‘ছাগল-ফ্রি’ সোশ্যাল মাধ্যমে পোস্ট করলো, তখন কেমন করে জানি প্যান্ডোরার বাক্স উন্মোচিত হতে শুরু করলো। রাগে-দুঃখে বিবেক-বিবেচনাহীন গৌরি সেন সরাসরি কিনা পিতৃত্ব অস্বীকার করে বললেনÑ ‘এই পুত্র আমার নয়।’ বাংলা সিনেমার গল্পে এক সময় এই পিতৃত্ব, মাতৃত্ব নিয়ে ঘুরপাক খেতো। পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানের গল্প নিয়ে গোটা তিন ঘণ্টার একটি বাংলা সিনেমার গল্প রচনা করা হতো। নাম হতো এরকমÑ ‘ছেলে কার’ অথবা ‘ছেলে তুমি কার’। তিন ঘণ্টা ধরে জট ছাড়ানো। কাহিনী একবার উত্তরে একবার দক্ষিণে, শেষ দৃশ্যে দর্শকরা পিতৃত্ব স্বীকার এবং মধুর মিলন দেখে হাততালি এবং সিটি দিয়ে সিনেমা হল থেক বের হতো।

আর এক ধরনের গল্প ছিলো। শ্রেণী সংঘাত নিয়ে। শ্রেণী চরিত্রের মহিমা না জেনে যে সব ছেলেরা প্রণয়কা- ঘটাতো তাদের ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করতে হরদম দেখা যেতো। বাংলা সিনেমায় চৌধুরী সাহেবরা (পড়ুন গৌরি সেন) সামান্য রিকশাচালক, গাড়ির ড্রাইভার, কিংবা কাজের বুয়ার মেয়ের সাথে ঢলাঢলি পছন্দ করলেও প্রেমে গদ-গদ হয়ে মোমের মতো গলে যাওয়াকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারতেন না। ধৈর্যের বাঁধ তাদের ভেঙে যেতো। গোপনে এসব মেয়েদের সাথে ফষ্টি-নষ্টি করবে এটি তারা মেনে নিতেন তবে প্রেম করে ঘরের বউ হিসেবে তুলে নেবেÑ এটি কোনভাবেই মানতে পারতেন না। অগণিত সিনেমায় আমরা পিতা পুত্রকে ত্যাজ্য ঘোষণা করছেন এরকম দৃশ্য দেখেছি। হল কাঁপানো কন্ঠে চৌধুরী সাহেবকে বলতে শুনেছি- ‘বেরিয়ে যাও, তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করলাম, এরকম নীচু কাজ যে করতে পারে সে আমার সন্তান নয়।’ দর্শকের চোখের জলে সিনেমা হলের মেঝে ভেসে গেলেও ছেলেকে শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে বলেন না চৌধুরী সাহেব। শ্রেণীচ্যুতি বলে কথা!

সম্প্রতি জ্যান্ত (পড়ুন প্রকৃত) একজন বাবা সাপ বেরোনোর আলামত পেয়েই সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করেছেন। আহারে পুত্র যে দেশে হাজার কোটি টাকার নিচে রাগভৈরবী আলাপের সূচনা হয় না, সেই দেশে সামান্য পনেরো লাখ টাকার ছাগল নিয়ে কথা হওয়ায় বাবা তার সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করলেন। এতোই সামান্য পরিমাণ অর্থ যা দিয়ে অনেকের পরিবারের সন্তানদের পাশের বাড়ি থাইল্যান্ড ট্রিপের খরচও কুলোয় না। দেশের ইজ্জত-সম্মান জলাঞ্জলি হলো। ছাগলকা-ের পুত্রের অবস্থা দেখে দেশপ্রেমিক অর্থ পাচারকারীরা মুখ লুকোচ্ছেন।

কয়েক দিন আগে যাকে নিয়ে শোরগোল চলছিলো তিনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শক। তিনি তো দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারেন না। তিনি আবার শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত। তিনি মহাজন। তিনি আমাদের রোল মডেল। মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটি ফ্ল্যাট কিনে কী এমন অপিরাধ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ‘খুকুমনি’ ক্লাস করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বিরতীতে একটু বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলো। মেয়ের আবদার বলে কথা। সামান্য কয়েক কোটি টাকা দিয়ে মেয়ের জন্য দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামাগার তৈরি করেছিলেন তিনি অভিজাত এলাকায়। তবে তিনি পিতৃত্ব অস্বীকারকারী নয়। একবারের জন্যও তিনি বলেননি, এই মেয়ে আমার নয়। তিনি বাংলা সিনেমার লাইনে হাঁটেননি, তিনি মার্জিত আধুনিক পিতা।

তবে বড় নিষ্ঠুর ওই রাজস্ব-পিতা, শব্দটি নতুন, শুনতে খারাপ লাগলেও আমার উদ্ভাবনীকে অনুৎসাহিত করবেন না পাঠক। তাকে আমি সম্মান করে রাজস্ব-পিতা হিসেবে তাকে সম্বোধন করছি। রাজস্ব পিতা পুলিশ পিতার থেকে কিছুটা বোকা কিসিমের। তিনি ছেলেকে দিয়ে ছেলেখেলা না করালেও পারতেন। কোরবানির মহৎ উদ্দেশ্যে ছাগল কিনবে, ছাগলের সঙ্গে গলাগলি করে ‘ছাগলফি’ তোলার কী প্রয়োজন ছিলো। রাজস্ব পিতা পুলিশ পিতার মতো শুরুতে শত হাজার কোটিতে ধরা পড়েননি, তিনি ভাংতি টাকা অর্থাৎ পনেরো লাখ টাকার ছাগলে আটকে গেছেন। তবে দুজনই বাংলা বাগধারা অনুযায়ী শিখন্ডি খাড়া করেননি। বড়ই মহৎ, বড়ই স্বচ্ছ তারা। আধুনিক বিসিএসকাক্সক্ষীদের কাছে রোল মডেল। তবে অনেক দুষ্ট লোক বলছে- মহাপরিদর্শকের দিক থেকে মুখ ফেরানোর জন্য নাকি রাজস্ব বাবুর মুখে আল ফেলানো হয়েছে। জানি না রাজা-রাজরাদের কর্মকা-ের মহিমা বোঝা দায়।

দেশে এক দল মানুষ সীমাহীন স্বাধীনতা ভোগ করছে। তাদের আগমন ঘটে ক্যাডার সার্ভিস এবং রাজনৈতিক দলগুলো থেকে। রাজনীতিকে তার মুঠোবন্দি করেন নানাভাবে। ক্ষমতাসীন দল থেকে টিকিট জোগাড় করে প্রথমে তারা সাংসদ পদ লাভ করেন। অন্যদিকে তারা যখন ‘জনসেবা’ করেন তখন রাজনীতির মানুষ হয় তাদের হাতের পুতুল। রাজনীতির মানুষ যখন সাংসদ, মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নেন ক্যাডাররা।

দোষ শুধু তাদের নয়, দোষ যদি দিতেই হয় তাহলে এ সমস্ত কর্মকা-ের সংস্কৃতি আমরা যারা তৈরি করেছি আমাদের সবার। তাদের ডেকে আমরা ধর্মালয়ের ‘মেম্বরস অনলি’ ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত করেছি। সমাজ মেনে নিয়েছে তাদেরকে ধর্মালয়, ধর্ম-সভা, খেলেধুলা, সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতি সব কিছুর মধ্যমণি হিসেবে। এছাড়া পদাধিকার বলে তারা নানা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও সচিব। তারা সবাই মিলে আমাদের একটি শৃঙ্খল দিয়ে ঘিরে রেখেছেন, সেই শৃঙ্খলের ভেতর থেকে আমরা লম্ফঝম্ফ করছি।কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ছাড়া আমাদের করার আর কিছুই নাই।

দেশে এখন দুইরকম বংশের নাগরিক বসবাস করেন। একটি হলো উচ্চবংশীয় এবং অন্যটি চরম নিম্নবংশীয়। উচ্চবংশীয়রা সব বংশীয় এবং সব ভান্ডার থেকে নানা কায়দায় অর্থ দেশ-বিদেশে রাখা নিজেদের সিন্দুকে রাখার সম্মতি পেয়েছেন। উচ্চবংশীয়রা চলেন উচ্চলয়ে ও উচ্চতালে। এ কারণে কোরবানির জন্য তাদের প্রয়োজন উচ্চবংশীয় ছাগল। রাজস্ব বাবুর ছেলেটি যে কা-ে ভাইরাল হয়ে গেলো তাহলো ১৫ লাখ টাকায় ‘উচ্চবংশীয়’ ছাগল কেনার উদ্যোগ নিয়ে।

একজন সরকারি চাকরিজীবীর কলেজ পড়ুয়া ছেলে কিভাবে এত বিলাসী জীবনযাপন করতে পারেন, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। পিতা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালেরও প্রেসিডেন্ট। একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও শেয়ারবাজারে প্লেসমেন্ট শেয়ারের বড় ব্যবসায়ী তিনি। বিষয়টি তিনি নিজেও অস্বীকার করেননি। যে সন্তানকে অস্বীকার করে সম্পদের হেফাজত করতে চেষ্টা করছেন তার পরিচয় এখন শরতের সকালের আকাশের মতো স্বচ্ছ। পুত্রের মাতা রাজস্ব বাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী। দ্বিতীয়ার বাড়িঘরের খবরও এখন সবার কাছে পরিশ্রুত জলের মতো। মহামান্যার বাবার বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। তিনি ফেনীর আওয়ামী ঘরানার বিখ্যাত হাজারী পরিবারের নিকটাত্মীয়। ছাগলকা- দিয়ে যে গল্পের শুরু হলো, সেই গল্প বিস্তৃত হচ্ছে ক্রমশ। বিস্তৃত হতে হতে এটি হাজার লাখ কোটিতে ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে।

‘এক দেশে ছিলো এক রাজা’- এরকম বাক্য দিয়ে একসময় রূপকথার গল্প শুরু হতো। আধুনিক রূপকথা যারা লিখবেন তারা গল্প শুরু করবেন, এক দেশে ছিলো হাজার হাজার রাজা। রাজারা ছিলেন বড়ই স্বাধীন। তাদের টাকশাল ছিলো না আবার ছিলোও। তাদের হাতিশাল নেই, তবে কুকুর, বেড়াল, হরিণশাল আছে। প্রজাদের সাথে তাদের যোগাযোগ রক্ষার মাথাব্যথা নেই। প্রজাদের শ্রমে যে টাকশাল, ব্যাংক, শেয়ারবাজার, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি গড়ে উঠে সেগুলো থেকে তারা প্রকাশ্যে অর্থ লোপাট করেন। রাজাদের মধ্যে বড়ই সদ্ভাব। একজনের বিপদে আরেকজন দ্রুত এগিয়ে আসেন। দুষ্টু প্রজারা যখন তাদের নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করেন তখন তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এ কাজে তারা একে-অপরকে সহায়তা করেন। প্রজাদের মধ্যে তারা ধর্ম, রাজনীতি, সামাজিক নীতি নিয়ে সব সময় মারামারি, ঝগড়াঝাটি বাধিয়ে রেখে দেশ পরিচালনা করতে তারা আনন্দ উপভোগ করেন। তাদের আদর্শ, কৌশল বিশ্ববাসীর অনুসরণ করা উচিত।

(পুনশ্চ : লেখাটি শুরু করেছিলাম রাজস্ব বাবু দেশে থাকা অবস্থায়। জাদুর কাঠি ব্যবহার করে তিনি গতকাল রোববার ২৩ জুন ২০২৪ তারিখে দেশত্যাগ করেছেন বলে ঢাকার সব পত্রিকা থেকে জানা গেলো)।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

বেঁটে নারকেল গাছ নিয়ে কিছু কথা

রাসেলস ভাইপার : আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

ব্যাংকিং সেক্টরের অনিয়ম দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে

হুমকিতে সমুদ্র, ঝুঁকিতে উন্নয়নশীল দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী

পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে কি জলাঞ্জলি দিয়েছে মোদি প্রশাসন

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ : আইন কী বলে

হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে

বাংলাদেশের উন্নতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর লজ্জা

মাদকমুক্ত দেশ গড়তে প্রয়োজন প্রতিরোধ কার্যক্রম

রম্যগদ্য : ‘ন্যায়-অন্যায় জানি নে, জানি নে...’

ছবি

কুরবানির ছাগল তাকে চিনতে পেরেছে

ছবি

সুইডিশ মিডসামার : এক আনন্দময় দিনের সূচনা

গাছে গাছে সবুজ হোক দেশ

কত বিষে আমাদের বসবাস

ছবি

তিস্তার দুই নয়নে দুই অশ্রুধারা

বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান

আদিবাসীরা বৈষম্যের শিকার

ছবি

নারীর অগ্রযাত্রা

ছবি

সিলেট-সুনামগঞ্জের ‘জলাবদ্ধ বন্যার’ দায় কার?

ছবি

বুড়িতিস্তা রিজার্ভার খনন : কৃষক কি উপকৃত হবে?

সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে কী হচ্ছে?

উচ্ছেদকৃত দলিতদের পুনর্বাসন করুন

রম্যগদ্য : অভিযোগ ‘অভিযোগ’ নয়

কেন হেরে গেলেন সেলিম

নীরবে-নিভৃতে কাজ করা এক কৃষিবিজ্ঞানীর কথা

অর্থনীতি কী অবস্থায় আছে?

কোরবানির চামড়ার হকদার

যোগাযোগ অধ্যয়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ

এমপি আনারকে নিয়ে যত আইনি জটিলতা

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আইনের শাসন

দূর হোক মনের পশুত্ব

মনের পশুত্বের প্রতীকী ত্যাগের আরেক নাম কোরবানি

ঈদে সুস্থ খাদ্যাভ্যাস

এমআইটি : প্রযুক্তির সৃষ্টি রহস্যের খোঁজ

কবিগুরুর বাণী ‘প্রমাণিত মিথ্যা’

কিশোর গ্যাং কালচার বন্ধ হবে কিভাবে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আধুনিক রূপকথা এবং আমাদের রাজাদের গল্প

শেখর ভট্টাচার্য

image

বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন ২০২৪

কেঁচো খুঁড়তে যখন সাপ বেরিয়ে আসে তখন মাছের মায়ের পুত্র শোক শুরু হয়ে যায়। আধুনিক যুগ বড় বিচিত্র! এ যুগে উল্টো পুরাণ। মাছের মায়ের কোন ভূমিকা নেই, সাপ বেরোতে দেখলে মাছের বাবারা শোকের বদলে রাগে-গোস্বায় ফেটে পড়েন। স্বাভাবিক অবস্থায় পুত্রেরা টাকার জোগানের জন্য চিন্তা করেন না। পিতা গৌরি সেন পুত্রের স্বাদ-আহ্লাদ মেটাতে টাকার পাহাড় পুত্রের সামনে হাজির করেন। পুত্রের কাছে তিনি দয়ার সাগর, যেমন এককালে হাজী মুহম্মদ মহসীন ছিলেন দরিদ্র মানুষের কাছে।

তবে আধুনিক গৌরি সেন যে কাজটি করলেন তা দেখে আমাদের আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেলো। কী নির্মম, কী নিষ্ঠুর এই আধুনিক গৌরি সেন। আদি গৌরি সেন কিন্তু এতো নিষ্ঠুর ছিলেন না। দেশবাসী বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো, পুত্র যখন সামান্য একটি ছাগল কেনে আনন্দে বিগলিত হয়ে ছাগলের সাথে ‘ছাগল-ফ্রি’ সোশ্যাল মাধ্যমে পোস্ট করলো, তখন কেমন করে জানি প্যান্ডোরার বাক্স উন্মোচিত হতে শুরু করলো। রাগে-দুঃখে বিবেক-বিবেচনাহীন গৌরি সেন সরাসরি কিনা পিতৃত্ব অস্বীকার করে বললেনÑ ‘এই পুত্র আমার নয়।’ বাংলা সিনেমার গল্পে এক সময় এই পিতৃত্ব, মাতৃত্ব নিয়ে ঘুরপাক খেতো। পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানের গল্প নিয়ে গোটা তিন ঘণ্টার একটি বাংলা সিনেমার গল্প রচনা করা হতো। নাম হতো এরকমÑ ‘ছেলে কার’ অথবা ‘ছেলে তুমি কার’। তিন ঘণ্টা ধরে জট ছাড়ানো। কাহিনী একবার উত্তরে একবার দক্ষিণে, শেষ দৃশ্যে দর্শকরা পিতৃত্ব স্বীকার এবং মধুর মিলন দেখে হাততালি এবং সিটি দিয়ে সিনেমা হল থেক বের হতো।

আর এক ধরনের গল্প ছিলো। শ্রেণী সংঘাত নিয়ে। শ্রেণী চরিত্রের মহিমা না জেনে যে সব ছেলেরা প্রণয়কা- ঘটাতো তাদের ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করতে হরদম দেখা যেতো। বাংলা সিনেমায় চৌধুরী সাহেবরা (পড়ুন গৌরি সেন) সামান্য রিকশাচালক, গাড়ির ড্রাইভার, কিংবা কাজের বুয়ার মেয়ের সাথে ঢলাঢলি পছন্দ করলেও প্রেমে গদ-গদ হয়ে মোমের মতো গলে যাওয়াকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারতেন না। ধৈর্যের বাঁধ তাদের ভেঙে যেতো। গোপনে এসব মেয়েদের সাথে ফষ্টি-নষ্টি করবে এটি তারা মেনে নিতেন তবে প্রেম করে ঘরের বউ হিসেবে তুলে নেবেÑ এটি কোনভাবেই মানতে পারতেন না। অগণিত সিনেমায় আমরা পিতা পুত্রকে ত্যাজ্য ঘোষণা করছেন এরকম দৃশ্য দেখেছি। হল কাঁপানো কন্ঠে চৌধুরী সাহেবকে বলতে শুনেছি- ‘বেরিয়ে যাও, তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করলাম, এরকম নীচু কাজ যে করতে পারে সে আমার সন্তান নয়।’ দর্শকের চোখের জলে সিনেমা হলের মেঝে ভেসে গেলেও ছেলেকে শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে বলেন না চৌধুরী সাহেব। শ্রেণীচ্যুতি বলে কথা!

সম্প্রতি জ্যান্ত (পড়ুন প্রকৃত) একজন বাবা সাপ বেরোনোর আলামত পেয়েই সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করেছেন। আহারে পুত্র যে দেশে হাজার কোটি টাকার নিচে রাগভৈরবী আলাপের সূচনা হয় না, সেই দেশে সামান্য পনেরো লাখ টাকার ছাগল নিয়ে কথা হওয়ায় বাবা তার সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করলেন। এতোই সামান্য পরিমাণ অর্থ যা দিয়ে অনেকের পরিবারের সন্তানদের পাশের বাড়ি থাইল্যান্ড ট্রিপের খরচও কুলোয় না। দেশের ইজ্জত-সম্মান জলাঞ্জলি হলো। ছাগলকা-ের পুত্রের অবস্থা দেখে দেশপ্রেমিক অর্থ পাচারকারীরা মুখ লুকোচ্ছেন।

কয়েক দিন আগে যাকে নিয়ে শোরগোল চলছিলো তিনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শক। তিনি তো দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারেন না। তিনি আবার শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত। তিনি মহাজন। তিনি আমাদের রোল মডেল। মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটি ফ্ল্যাট কিনে কী এমন অপিরাধ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ‘খুকুমনি’ ক্লাস করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বিরতীতে একটু বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলো। মেয়ের আবদার বলে কথা। সামান্য কয়েক কোটি টাকা দিয়ে মেয়ের জন্য দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামাগার তৈরি করেছিলেন তিনি অভিজাত এলাকায়। তবে তিনি পিতৃত্ব অস্বীকারকারী নয়। একবারের জন্যও তিনি বলেননি, এই মেয়ে আমার নয়। তিনি বাংলা সিনেমার লাইনে হাঁটেননি, তিনি মার্জিত আধুনিক পিতা।

তবে বড় নিষ্ঠুর ওই রাজস্ব-পিতা, শব্দটি নতুন, শুনতে খারাপ লাগলেও আমার উদ্ভাবনীকে অনুৎসাহিত করবেন না পাঠক। তাকে আমি সম্মান করে রাজস্ব-পিতা হিসেবে তাকে সম্বোধন করছি। রাজস্ব পিতা পুলিশ পিতার থেকে কিছুটা বোকা কিসিমের। তিনি ছেলেকে দিয়ে ছেলেখেলা না করালেও পারতেন। কোরবানির মহৎ উদ্দেশ্যে ছাগল কিনবে, ছাগলের সঙ্গে গলাগলি করে ‘ছাগলফি’ তোলার কী প্রয়োজন ছিলো। রাজস্ব পিতা পুলিশ পিতার মতো শুরুতে শত হাজার কোটিতে ধরা পড়েননি, তিনি ভাংতি টাকা অর্থাৎ পনেরো লাখ টাকার ছাগলে আটকে গেছেন। তবে দুজনই বাংলা বাগধারা অনুযায়ী শিখন্ডি খাড়া করেননি। বড়ই মহৎ, বড়ই স্বচ্ছ তারা। আধুনিক বিসিএসকাক্সক্ষীদের কাছে রোল মডেল। তবে অনেক দুষ্ট লোক বলছে- মহাপরিদর্শকের দিক থেকে মুখ ফেরানোর জন্য নাকি রাজস্ব বাবুর মুখে আল ফেলানো হয়েছে। জানি না রাজা-রাজরাদের কর্মকা-ের মহিমা বোঝা দায়।

দেশে এক দল মানুষ সীমাহীন স্বাধীনতা ভোগ করছে। তাদের আগমন ঘটে ক্যাডার সার্ভিস এবং রাজনৈতিক দলগুলো থেকে। রাজনীতিকে তার মুঠোবন্দি করেন নানাভাবে। ক্ষমতাসীন দল থেকে টিকিট জোগাড় করে প্রথমে তারা সাংসদ পদ লাভ করেন। অন্যদিকে তারা যখন ‘জনসেবা’ করেন তখন রাজনীতির মানুষ হয় তাদের হাতের পুতুল। রাজনীতির মানুষ যখন সাংসদ, মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নেন ক্যাডাররা।

দোষ শুধু তাদের নয়, দোষ যদি দিতেই হয় তাহলে এ সমস্ত কর্মকা-ের সংস্কৃতি আমরা যারা তৈরি করেছি আমাদের সবার। তাদের ডেকে আমরা ধর্মালয়ের ‘মেম্বরস অনলি’ ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত করেছি। সমাজ মেনে নিয়েছে তাদেরকে ধর্মালয়, ধর্ম-সভা, খেলেধুলা, সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতি সব কিছুর মধ্যমণি হিসেবে। এছাড়া পদাধিকার বলে তারা নানা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও সচিব। তারা সবাই মিলে আমাদের একটি শৃঙ্খল দিয়ে ঘিরে রেখেছেন, সেই শৃঙ্খলের ভেতর থেকে আমরা লম্ফঝম্ফ করছি।কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ছাড়া আমাদের করার আর কিছুই নাই।

দেশে এখন দুইরকম বংশের নাগরিক বসবাস করেন। একটি হলো উচ্চবংশীয় এবং অন্যটি চরম নিম্নবংশীয়। উচ্চবংশীয়রা সব বংশীয় এবং সব ভান্ডার থেকে নানা কায়দায় অর্থ দেশ-বিদেশে রাখা নিজেদের সিন্দুকে রাখার সম্মতি পেয়েছেন। উচ্চবংশীয়রা চলেন উচ্চলয়ে ও উচ্চতালে। এ কারণে কোরবানির জন্য তাদের প্রয়োজন উচ্চবংশীয় ছাগল। রাজস্ব বাবুর ছেলেটি যে কা-ে ভাইরাল হয়ে গেলো তাহলো ১৫ লাখ টাকায় ‘উচ্চবংশীয়’ ছাগল কেনার উদ্যোগ নিয়ে।

একজন সরকারি চাকরিজীবীর কলেজ পড়ুয়া ছেলে কিভাবে এত বিলাসী জীবনযাপন করতে পারেন, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। পিতা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালেরও প্রেসিডেন্ট। একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও শেয়ারবাজারে প্লেসমেন্ট শেয়ারের বড় ব্যবসায়ী তিনি। বিষয়টি তিনি নিজেও অস্বীকার করেননি। যে সন্তানকে অস্বীকার করে সম্পদের হেফাজত করতে চেষ্টা করছেন তার পরিচয় এখন শরতের সকালের আকাশের মতো স্বচ্ছ। পুত্রের মাতা রাজস্ব বাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী। দ্বিতীয়ার বাড়িঘরের খবরও এখন সবার কাছে পরিশ্রুত জলের মতো। মহামান্যার বাবার বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। তিনি ফেনীর আওয়ামী ঘরানার বিখ্যাত হাজারী পরিবারের নিকটাত্মীয়। ছাগলকা- দিয়ে যে গল্পের শুরু হলো, সেই গল্প বিস্তৃত হচ্ছে ক্রমশ। বিস্তৃত হতে হতে এটি হাজার লাখ কোটিতে ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে।

‘এক দেশে ছিলো এক রাজা’- এরকম বাক্য দিয়ে একসময় রূপকথার গল্প শুরু হতো। আধুনিক রূপকথা যারা লিখবেন তারা গল্প শুরু করবেন, এক দেশে ছিলো হাজার হাজার রাজা। রাজারা ছিলেন বড়ই স্বাধীন। তাদের টাকশাল ছিলো না আবার ছিলোও। তাদের হাতিশাল নেই, তবে কুকুর, বেড়াল, হরিণশাল আছে। প্রজাদের সাথে তাদের যোগাযোগ রক্ষার মাথাব্যথা নেই। প্রজাদের শ্রমে যে টাকশাল, ব্যাংক, শেয়ারবাজার, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি গড়ে উঠে সেগুলো থেকে তারা প্রকাশ্যে অর্থ লোপাট করেন। রাজাদের মধ্যে বড়ই সদ্ভাব। একজনের বিপদে আরেকজন দ্রুত এগিয়ে আসেন। দুষ্টু প্রজারা যখন তাদের নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করেন তখন তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এ কাজে তারা একে-অপরকে সহায়তা করেন। প্রজাদের মধ্যে তারা ধর্ম, রাজনীতি, সামাজিক নীতি নিয়ে সব সময় মারামারি, ঝগড়াঝাটি বাধিয়ে রেখে দেশ পরিচালনা করতে তারা আনন্দ উপভোগ করেন। তাদের আদর্শ, কৌশল বিশ্ববাসীর অনুসরণ করা উচিত।

(পুনশ্চ : লেখাটি শুরু করেছিলাম রাজস্ব বাবু দেশে থাকা অবস্থায়। জাদুর কাঠি ব্যবহার করে তিনি গতকাল রোববার ২৩ জুন ২০২৪ তারিখে দেশত্যাগ করেছেন বলে ঢাকার সব পত্রিকা থেকে জানা গেলো)।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

back to top