alt

উপ-সম্পাদকীয়

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ : আইন কী বলে

মুহাম্মদ ইয়াছিন তোহা

: শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪

ভালোবাসা বলতে একটি তীব্র আকর্ষণ এবং মানসিক সংযুক্তির অনুভূতিকে বোঝায়। ভালোবাসাকে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয়ই মনে করা হয়। এর গুণগুলো মানুষের উদারতা, সহানুভূতি এবং স্নেহের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন অন্যের ভালোর জন্য নিঃস্বার্থ থাকা এবং উদ্বেগ প্রকাশ করা। আর প্রেম বা কল্পনাপ্রবণ ভালোবাসা হলো ভালোবাসার অনুভূতি বা অন্য ব্যক্তির প্রতি তীব্র আকর্ষণ আর সেই সামগ্রিক অনুভূতি এবং আবেগ প্রকাশ করার জন্য ফলস্বরূপ একজন ব্যক্তির দ্বারা গৃহীত প্রণয়আচরণ।

নারী-পুরুষের প্রেম থেকে ভালোবাসা এবং ভালোবাসা থেকে প্রণয়ের সৃষ্টি হয়। প্রণয় সৃষ্টি হওয়ার আগে নারী-পুরুষের মধ্যকার যে সম্পর্কটা বিদ্যমান থাকে সেটাকে প্রেম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মানব সৃষ্টির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রেম ভালোবাসার গল্প। মানুষের মানবিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো ভালোবাসা। ডিজিটালাইজেশনের কারণে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে হরহামেশাই প্রেম-ভালোবাসার গল্প বোনা হচ্ছে, আবার মুহূর্তেই ঘটছে বিচ্ছেদ।

পশ্চিমা সংস্কৃতির বলয়ে প্রাচ্য দেশগুলোতেও ভালোবাসার সম্পর্কটা এখন বদলে গেছে। আমাদের দেশেও কারও কারও কাছে প্রেম-ভালোবাসা মানেই হলো লিভ-টুগেদার। লিভ-টুগেদার আইনত দ-নীয় হলেও এটা যেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবহারিক প্রথায় পরিণত হয়েছে। নারী-পুরুষ যথেচ্ছা প্রেম-ভালোবাসার নামে লিভ-টুগেদার করছে কিন্তু যখনই পুরুষের সঙ্গে নারীর মনের অমিল দেখা দেয় তখনই শুনতে পাওয়া যায় ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ নামক টার্মটি।

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ কথাটি আইনের অপব্যাখ্যার শামিল। ধর্ষণ-সংক্রান্ত আইন তথা বাংলাদেশ দ-বিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নজর বুলালে এবং ধর্ষণ শব্দটিকে আইন ব্যাখ্যার মূলনীতি ও বিজ্ঞ আদালেতের নজির দিয়ে বিশ্লেষণ করলে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ কথাটির কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ দ-বিধি দ্বারা ধর্ষণের বিচার হলেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়নের পর দ-বিধিতে বিচার বন্ধ হয়ে যায়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের বিচার হলেও ধর্ষণের সংজ্ঞা নেয়া হচ্ছে দ-বিধি থেকে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ এর ২ (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ধর্ষণ’ অর্থ ধারা ৯ এর বিধান সাপেক্ষে, দ-বিধি, ১৮৬০ এর ধারা ৩৭৫ এ বর্ণিত সংজ্ঞা ‘ধর্ষণ’। দ-বিধি, ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় ৫টি অবস্থায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে তাকে ধর্ষণ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এক. নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে; দুই. নারীর সম্মতি ছাড়া; তিন. নারীর সম্মতি আদায়, তবে তা মৃত্যু কিংবা জখমের ভয় দেখিয়ে; চার. নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানেন যে, তিনি ওই নারীর স্বামী নন এবং ওই নারী তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করছেন যে পুরুষটির সঙ্গে তার আইনসংগতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে তিনি বিশ্বাস করেন। পাঁচ. নারীর সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া তবে সেই নারীর বয়স যদি হয় ১৪ বছরের কম।

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিয়ের প্রলোভনে নারীর সম্মতি আদায় করেন, যা ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০২০ এর ধারা ৯(১) এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ছাড়া ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক করেন, তা হলে তিনি ওই নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবে। এই ধারায়ও এটা স্পষ্ট যে, নারীর সম্মতিসহ শারীরিক সম্পর্ক করলে তা ধর্ষণ হবে না; যদি না নারীর বয়স ১৬ বছরের কম হয়। জেনারেল ক্লজের অ্যাক্টে বলা হয়েছে, আইনের শব্দগুলোকে সংশ্লিষ্ট আইনের ভাষায় ব্যাখ্যা করতে হবে। অর্থাৎ, আইনে যে দৃষ্টিতে শব্দটি ব্যহার করা হয়েছে সেটিকে সামনে রেখেই শব্দটির ব্যাখ্যা করতেম হবে। সুতরাং, আইন ব্যাখ্যার মূলনীতি আলোকে কোনভাবেই বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণের আওতায় বিবেচনা করা যায় না।

‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ এ প্রকারের মামলা কখনোই ধর্ষণের অপরাধ হিসেবে দাবি করা যায় না। কারণ মুসলিম ম্যারেজ হলো সিভিল কন্ট্যাক্ট। ১৮ বছরের বেশি বয়সের যে কোনো নারী নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে, বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে বা গ্রহণ করতে পরে । কোনো পুরুষ কোনো নারীর সঙ্গে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেটি লঙ্ঘন করলে তা হবে বিবাহ চুক্তির লঙ্ঘন। তবে এটি হলো সিভিল-সংক্রান্ত ব্যাপার, মোটেই ধর্ষণের অপরাধ নয়।

ভারতের উচ্চ আদালত বলেছেন, কোনো নারী স্বেচ্ছায় দীর্ঘদিন ধরে কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখার পর ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন না। ২০১৭ সালে বোম্বে হাইকোর্ট একটি মামলায় পর্যবেক্ষণ দেন, প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। মামলার রায়ে বোম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি মৃদুলা ভাটকার বলেন, ‘দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক যদি সেই মুহূর্তে উভয়ের সম্মতিতেই হয়ে থাকে, তা হলে তা কীভাবে ধর্ষণ হবে?’ তিনি বলেন, ‘নিজেদের ইচ্ছাতেই প্রেমিক-প্রেমিকা অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকেন। পরে আবার অনেকেই এটাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ তোলেন। এটা হওয়া উচিত নয়।’

৫৭ ডিএলআর ৫৯১ পৃষ্ঠায় দেখা যায়, উচ্চ আদালত মন্তব্য করেন যে, যেহেতু অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে অভিযোগকারীনীর যৌন সঙ্গমে অভ্যস্ত প্রমাণিত হয় এবং উক্ত নারী কখনো সঙ্গমে বাধা প্রদান করেনি বা চিৎকার করেনি সেহেতু তা ধর্ষণের অপরাধ বলে গণ্য হবে না।

৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করে যে, ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে সঙ্গম করে তা হলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। তবে ভিকটিম যদি ১৪ বছরের কম বয়সি হয়, তাহলে সেটিকে ‘ধর্ষণ’ বলা হবে।

২০০৭ সালে মনোয়ার মল্লিক বনাম রাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি রেজাউল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি রায় দিয়েছিল। এতে বলা হয়, ‘অভিযোগকারী নারী বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে স্বেচ্ছায় যৌন মিলন করেছেন। তবে এ কারণে আসামিকে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।’

২০১৬ সালে নাজিম উদ্দিন বনাম রাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি এমদাদুল হক ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দেয় যে, ‘সার্বিক পরিস্থিতি এবং সাক্ষ্য প্রমাণে এটা প্রমাণিত হয় না যে, এখানে এক পক্ষ দোষী, বরং এ কাজে দুইজনের সমান অংশগ্রহণ রয়েছে। তাই ধর্ষণের জন্য শুধু পুরুষ সঙ্গীকে দায়ী করা যায় না।’

১৯৯১ সালে হাইকোর্ট বিভাগ লুকুছ মিয়া বনাম রাষ্ট্র মামলায় একটি পর্যবেক্ষণ দেয়। ‘বিয়ের প্রলোভনে’ যৌন সম্পর্ক কি ধর্ষণ? বিচারপতি আব্দুল বারী সরকার ও বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ লুকুছ মিয়ার বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ খারিজ করে বলে, ‘এটি অপরাধের মধ্যে পড়ে না। তার কারণ অভিযোগকারী নারী স্বেচ্ছায় যৌন সম্পর্কে অংশ নিয়েছেন।

উপরিউক্ত আইন ও নজির বিবেচনায় বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করাকে ধর্ষণ বলে অভিহিত করা যায় না, বড়জোর এটিকে প্রতারণার অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

[লেখক : আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা]

বেঁটে নারকেল গাছ নিয়ে কিছু কথা

রাসেলস ভাইপার : আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

ব্যাংকিং সেক্টরের অনিয়ম দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে

হুমকিতে সমুদ্র, ঝুঁকিতে উন্নয়নশীল দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী

পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে কি জলাঞ্জলি দিয়েছে মোদি প্রশাসন

হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে

বাংলাদেশের উন্নতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর লজ্জা

মাদকমুক্ত দেশ গড়তে প্রয়োজন প্রতিরোধ কার্যক্রম

রম্যগদ্য : ‘ন্যায়-অন্যায় জানি নে, জানি নে...’

ছবি

কুরবানির ছাগল তাকে চিনতে পেরেছে

ছবি

সুইডিশ মিডসামার : এক আনন্দময় দিনের সূচনা

ছবি

আধুনিক রূপকথা এবং আমাদের রাজাদের গল্প

গাছে গাছে সবুজ হোক দেশ

কত বিষে আমাদের বসবাস

ছবি

তিস্তার দুই নয়নে দুই অশ্রুধারা

বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান

আদিবাসীরা বৈষম্যের শিকার

ছবি

নারীর অগ্রযাত্রা

ছবি

সিলেট-সুনামগঞ্জের ‘জলাবদ্ধ বন্যার’ দায় কার?

ছবি

বুড়িতিস্তা রিজার্ভার খনন : কৃষক কি উপকৃত হবে?

সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে কী হচ্ছে?

উচ্ছেদকৃত দলিতদের পুনর্বাসন করুন

রম্যগদ্য : অভিযোগ ‘অভিযোগ’ নয়

কেন হেরে গেলেন সেলিম

নীরবে-নিভৃতে কাজ করা এক কৃষিবিজ্ঞানীর কথা

অর্থনীতি কী অবস্থায় আছে?

কোরবানির চামড়ার হকদার

যোগাযোগ অধ্যয়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ

এমপি আনারকে নিয়ে যত আইনি জটিলতা

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আইনের শাসন

দূর হোক মনের পশুত্ব

মনের পশুত্বের প্রতীকী ত্যাগের আরেক নাম কোরবানি

ঈদে সুস্থ খাদ্যাভ্যাস

এমআইটি : প্রযুক্তির সৃষ্টি রহস্যের খোঁজ

কবিগুরুর বাণী ‘প্রমাণিত মিথ্যা’

কিশোর গ্যাং কালচার বন্ধ হবে কিভাবে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ : আইন কী বলে

মুহাম্মদ ইয়াছিন তোহা

শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪

ভালোবাসা বলতে একটি তীব্র আকর্ষণ এবং মানসিক সংযুক্তির অনুভূতিকে বোঝায়। ভালোবাসাকে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয়ই মনে করা হয়। এর গুণগুলো মানুষের উদারতা, সহানুভূতি এবং স্নেহের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন অন্যের ভালোর জন্য নিঃস্বার্থ থাকা এবং উদ্বেগ প্রকাশ করা। আর প্রেম বা কল্পনাপ্রবণ ভালোবাসা হলো ভালোবাসার অনুভূতি বা অন্য ব্যক্তির প্রতি তীব্র আকর্ষণ আর সেই সামগ্রিক অনুভূতি এবং আবেগ প্রকাশ করার জন্য ফলস্বরূপ একজন ব্যক্তির দ্বারা গৃহীত প্রণয়আচরণ।

নারী-পুরুষের প্রেম থেকে ভালোবাসা এবং ভালোবাসা থেকে প্রণয়ের সৃষ্টি হয়। প্রণয় সৃষ্টি হওয়ার আগে নারী-পুরুষের মধ্যকার যে সম্পর্কটা বিদ্যমান থাকে সেটাকে প্রেম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মানব সৃষ্টির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রেম ভালোবাসার গল্প। মানুষের মানবিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো ভালোবাসা। ডিজিটালাইজেশনের কারণে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে হরহামেশাই প্রেম-ভালোবাসার গল্প বোনা হচ্ছে, আবার মুহূর্তেই ঘটছে বিচ্ছেদ।

পশ্চিমা সংস্কৃতির বলয়ে প্রাচ্য দেশগুলোতেও ভালোবাসার সম্পর্কটা এখন বদলে গেছে। আমাদের দেশেও কারও কারও কাছে প্রেম-ভালোবাসা মানেই হলো লিভ-টুগেদার। লিভ-টুগেদার আইনত দ-নীয় হলেও এটা যেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবহারিক প্রথায় পরিণত হয়েছে। নারী-পুরুষ যথেচ্ছা প্রেম-ভালোবাসার নামে লিভ-টুগেদার করছে কিন্তু যখনই পুরুষের সঙ্গে নারীর মনের অমিল দেখা দেয় তখনই শুনতে পাওয়া যায় ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ নামক টার্মটি।

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ কথাটি আইনের অপব্যাখ্যার শামিল। ধর্ষণ-সংক্রান্ত আইন তথা বাংলাদেশ দ-বিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নজর বুলালে এবং ধর্ষণ শব্দটিকে আইন ব্যাখ্যার মূলনীতি ও বিজ্ঞ আদালেতের নজির দিয়ে বিশ্লেষণ করলে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ কথাটির কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ দ-বিধি দ্বারা ধর্ষণের বিচার হলেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়নের পর দ-বিধিতে বিচার বন্ধ হয়ে যায়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের বিচার হলেও ধর্ষণের সংজ্ঞা নেয়া হচ্ছে দ-বিধি থেকে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ এর ২ (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ধর্ষণ’ অর্থ ধারা ৯ এর বিধান সাপেক্ষে, দ-বিধি, ১৮৬০ এর ধারা ৩৭৫ এ বর্ণিত সংজ্ঞা ‘ধর্ষণ’। দ-বিধি, ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় ৫টি অবস্থায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে তাকে ধর্ষণ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এক. নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে; দুই. নারীর সম্মতি ছাড়া; তিন. নারীর সম্মতি আদায়, তবে তা মৃত্যু কিংবা জখমের ভয় দেখিয়ে; চার. নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানেন যে, তিনি ওই নারীর স্বামী নন এবং ওই নারী তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করছেন যে পুরুষটির সঙ্গে তার আইনসংগতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে তিনি বিশ্বাস করেন। পাঁচ. নারীর সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া তবে সেই নারীর বয়স যদি হয় ১৪ বছরের কম।

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিয়ের প্রলোভনে নারীর সম্মতি আদায় করেন, যা ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০২০ এর ধারা ৯(১) এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ছাড়া ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক করেন, তা হলে তিনি ওই নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবে। এই ধারায়ও এটা স্পষ্ট যে, নারীর সম্মতিসহ শারীরিক সম্পর্ক করলে তা ধর্ষণ হবে না; যদি না নারীর বয়স ১৬ বছরের কম হয়। জেনারেল ক্লজের অ্যাক্টে বলা হয়েছে, আইনের শব্দগুলোকে সংশ্লিষ্ট আইনের ভাষায় ব্যাখ্যা করতে হবে। অর্থাৎ, আইনে যে দৃষ্টিতে শব্দটি ব্যহার করা হয়েছে সেটিকে সামনে রেখেই শব্দটির ব্যাখ্যা করতেম হবে। সুতরাং, আইন ব্যাখ্যার মূলনীতি আলোকে কোনভাবেই বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণের আওতায় বিবেচনা করা যায় না।

‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ এ প্রকারের মামলা কখনোই ধর্ষণের অপরাধ হিসেবে দাবি করা যায় না। কারণ মুসলিম ম্যারেজ হলো সিভিল কন্ট্যাক্ট। ১৮ বছরের বেশি বয়সের যে কোনো নারী নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে, বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে বা গ্রহণ করতে পরে । কোনো পুরুষ কোনো নারীর সঙ্গে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেটি লঙ্ঘন করলে তা হবে বিবাহ চুক্তির লঙ্ঘন। তবে এটি হলো সিভিল-সংক্রান্ত ব্যাপার, মোটেই ধর্ষণের অপরাধ নয়।

ভারতের উচ্চ আদালত বলেছেন, কোনো নারী স্বেচ্ছায় দীর্ঘদিন ধরে কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখার পর ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন না। ২০১৭ সালে বোম্বে হাইকোর্ট একটি মামলায় পর্যবেক্ষণ দেন, প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। মামলার রায়ে বোম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি মৃদুলা ভাটকার বলেন, ‘দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক যদি সেই মুহূর্তে উভয়ের সম্মতিতেই হয়ে থাকে, তা হলে তা কীভাবে ধর্ষণ হবে?’ তিনি বলেন, ‘নিজেদের ইচ্ছাতেই প্রেমিক-প্রেমিকা অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকেন। পরে আবার অনেকেই এটাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ তোলেন। এটা হওয়া উচিত নয়।’

৫৭ ডিএলআর ৫৯১ পৃষ্ঠায় দেখা যায়, উচ্চ আদালত মন্তব্য করেন যে, যেহেতু অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে অভিযোগকারীনীর যৌন সঙ্গমে অভ্যস্ত প্রমাণিত হয় এবং উক্ত নারী কখনো সঙ্গমে বাধা প্রদান করেনি বা চিৎকার করেনি সেহেতু তা ধর্ষণের অপরাধ বলে গণ্য হবে না।

৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করে যে, ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে সঙ্গম করে তা হলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। তবে ভিকটিম যদি ১৪ বছরের কম বয়সি হয়, তাহলে সেটিকে ‘ধর্ষণ’ বলা হবে।

২০০৭ সালে মনোয়ার মল্লিক বনাম রাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি রেজাউল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি রায় দিয়েছিল। এতে বলা হয়, ‘অভিযোগকারী নারী বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে স্বেচ্ছায় যৌন মিলন করেছেন। তবে এ কারণে আসামিকে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।’

২০১৬ সালে নাজিম উদ্দিন বনাম রাষ্ট্র মামলায় বিচারপতি এমদাদুল হক ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দেয় যে, ‘সার্বিক পরিস্থিতি এবং সাক্ষ্য প্রমাণে এটা প্রমাণিত হয় না যে, এখানে এক পক্ষ দোষী, বরং এ কাজে দুইজনের সমান অংশগ্রহণ রয়েছে। তাই ধর্ষণের জন্য শুধু পুরুষ সঙ্গীকে দায়ী করা যায় না।’

১৯৯১ সালে হাইকোর্ট বিভাগ লুকুছ মিয়া বনাম রাষ্ট্র মামলায় একটি পর্যবেক্ষণ দেয়। ‘বিয়ের প্রলোভনে’ যৌন সম্পর্ক কি ধর্ষণ? বিচারপতি আব্দুল বারী সরকার ও বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ লুকুছ মিয়ার বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ খারিজ করে বলে, ‘এটি অপরাধের মধ্যে পড়ে না। তার কারণ অভিযোগকারী নারী স্বেচ্ছায় যৌন সম্পর্কে অংশ নিয়েছেন।

উপরিউক্ত আইন ও নজির বিবেচনায় বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করাকে ধর্ষণ বলে অভিহিত করা যায় না, বড়জোর এটিকে প্রতারণার অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

[লেখক : আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা]

back to top