alt

opinion » post-editorial

পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে কি জলাঞ্জলি দিয়েছে মোদি প্রশাসন

গৌতম রায়

: শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় দফার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণের অল্প সময়ের পরই আবার ভারত সফর করলেন। এই সফরে ভারতের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং সে দেশের প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাদের একাধিক শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। এই বৈঠকের ফলশ্রুতি হিসেবে দুই দেশেরই স্বার্থবাদী বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তার মধ্যে পাঁচটি নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং তিনটি পুরনো সমঝোতা স্মারক নবায়িত হয়েছে।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্লু ইকোনমি, সমুদ্র বিজ্ঞান গবেষণা, মাছ, দুর্যোগ এবং স্বাস্থ্য, মহাকাশ ও সামরিক শিক্ষা। বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরে ব্লু ইকোনমি এবং মেরিটাইম কো-অপারেটিভ বিষয়টি ভারত সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক হিসেবে, ভারত মহাসাগরে সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ে যৌথ গবেষণার জন্য একটি বিশেষ বার্তা বহনকারী। বাংলাদেশ ওসানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং ভারতের কাউন্সিলার সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের মধ্যে যে সমঝোতাটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা আগামী দিনে ভারত বাংলাদেশ উভয়ের ক্ষেত্রেই গবেষণা এবং নদী-সমুদ্রকে অর্থাৎ পানি সম্পর্কে ব্যবহার করে, মানবসম্পদের উন্নয়নকে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।

ভারত বাংলাদেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ ঘিরে যে ধরনের আলাপ-আলোচনা এবং চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সেটি দুই দেশেরই বিস্তৃত উপকারে আসবে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে উপগ্রহ প্রকল্পের সহযোগিতার জন্য ভারতে ন্যাশনাল স্পেস অ্যান্ড প্রমোশন অ্যান্ড অথরাইজেশন সেন্টার আর বাংলাদেশের ডাক, টেলিফোন, যোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যে স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এগুলো উভয় দেশের আর্থসামাজিক উন্নতির ক্ষেত্রে একটা বিশেষ রকমের সহায়ক হবে।

তাছাড়া প্রতিরক্ষা, স্টাফ কলেজগুলোর মধ্যে একাডেমিক সহযোগিতা সম্পর্কেও সমঝোতার শক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

নবায়িত স্মারকগুলো হলোÑ মৎস্য খাতে সহযোগিতা সমঝোতা স্মারক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সমঝোতা স্মারক এবং স্বাস্থ্য আর ওষুধের ক্ষেত্রে সহযোগিতা ঘিরে সমঝোতাপত্র।

নরেন্দ্র মোদি গোটা ভারতজুড়ে বিভাজনের রাজনীতির মধ্য দিয়ে ভারতের সামাজিক সংকটকে বন্ডাহীন করে দিয়েছেন। বিগত দশ বছরের শাসনকালে ভারতের অর্থনীতি একেবারে তলানিতে থেকেছে। হিন্দু- মুসলমানের নিরিখে মানুষকে দেখার চিন্তাধারার ভেতর দিয়ে নরেন্দ্র মোদি বা তার সরকার বা তার দল, গোটা ভারতজুড়ে এক ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছেন। ভারতে বেকারত্ব ভয়ংকর একটা জায়গায় রয়েছে। দুর্নীতি পর্বতপ্রমাণ।

তবুও বলতে হয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মোদির যে ভয়ংকর হিন্দু সম্প্রদায়িক পরিচিতি, কৌশলগত কারণেই সেই ব্যাপারটাকে খানিকটা হালকা করবার তাগিদেই বাংলাদেশ ঘিরে, মোদি কখনো তার পূর্বসূরী অটলবিহারী বাজপেয়ির মতপ্রকাশ্য বাংলাদেশ বিরোধিতা করেন না।

মোদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব তৃতীয়বার গ্রহণ করার পর, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু হয়েছে। সেই প্রতিক্রিয়ার মূল অঙ্গই হলো; মোদি বিরোধিতার নাম করে, এমন একটি পটভূমিকা তৈরি করা, যেখানে মোদির রাজনৈতিক ভূমিকা সম্প্রদায়িক ভূমিকাÑ এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে একাত্ম করে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টির সময়কাল থেকে, ভারতের যে সম্পর্ক, তাকে বিঘিœত করা।

এমন একটা ধারণা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় থাকা একটা বড় অংশের লোকজন, বিশেষ করে একটা ছোট অংশের সাংবাদিকরা তৈরি করতে চাচ্ছে, যাতে সাধারণ মানুষের মনে হয় যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময়, ভারত বাংলাদেশের মধ্যে যে কটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো বা যে তিনটি চুক্তি নবায়িত করা হলো; সেগুলোর সবটাইতেই ভারত সরকার, কেবল বাংলাদেশ সরকারের স্বার্থ রক্ষা করে করেছে। ভারতের স্বার্থ সেখানে কিছু নেই।

বিশেষ করে মোদি-মমতার মধ্যে ছদ্ম যে রাজনৈতিক সংঘাত আছে, তাকে প্রকৃত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় উপস্থাপিত করবার লক্ষ্যে, বাবড়ি মসজিদ ধ্বংসের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত লাল কষ্ণ আদবাণীর ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিক যেভাবে গোটা বিষয়টিকে উপস্থাপিত করছেন তা মারাত্মক। ভারতের একাংশের লোক এমনভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপিত করতে চাইছেন যাতে মনে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে, বাংলাদেশ সরকার সঙ্গে মোদি প্রশাসন এই চুক্তিটি করেছে।

এই চুক্তির ফলে পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হবেÑ এমন একটা কথাও কিছু এনজিও, যারা পরিবেশকে তাদের ব্যবসার একটা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে কার্যত মমতার তোষামোদি করে অর্থ উপার্জন করে, তারা এটা নিয়ে আসরে নেমে পড়েছে। একথা প্রত্যেকটি বাঙালিরই জানা আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার পানি, মমতার অন্যায় এবং ষড়যন্ত্রমূলক জেদের কারণে একতরফাভাবে ব্যবহার করে চলেছে ভারত।

আন্তর্জাতিক রীতি এবং নিয়ম আর আইন অনুযায়ী কখনো কোনো আন্তর্জাতিকভাবে প্রবাহিত নদীর পানি একটি বিশেষ দেশ একতরফাভাবে পালন ব্যবহার করতে পারে না। এই দিক থেকে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই মমতা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করছেন, ভারতের একটা অংশের বাঙালি আবেগ এমনভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন, যেখানে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি কে পরিপূর্ণভাবে অমান্য করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো ঘিরে এই যে মমতার শিবিরভুক্ত লোকেদের আপত্তি, তার প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশে যাতে সেখানকার সংখ্যাগুরু মৌলবাদী শক্তি, সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সাফল্যগুলোকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত করতে পারে।

ভারত সরকার যে চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত করেছে বা নবায়িত করেছে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে, সেগুলো ভারত সরকার বা নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশের প্রতি কোনো দয়ার দান নয়। শেখ হাসিনা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে যে কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছেন, ভারত-বাংলাদেশ সাম্প্রতিক চুক্তিগুলো হলো সেই সাফল্যের একটি অংশ এবং অঙ্গ।

শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বে প্রথম দফায় গঙ্গার পানি চুক্তির পর, যখন তৎকালীন বামপন্থী সাংসদ, প্রয়াত গীতা মুখোপাধ্যায়ের একটি চিঠি এই নিবন্ধকার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে তুলে দিয়েছিলেন, তখনই নেত্রীর মনোভাবের মধ্যে দিয়ে বোঝা গিয়েছিল, পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে, এপার বাংলার, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালির প্রতি কী অসীম স্নেহ মমতা তিনি হৃদয়ে ধারণ করেন। যশোর শহরের প্রতিথযশা উকিল, লালু বাবুর কন্যা গীতা মুখোপাধ্যায়ের প্রতি শেখ হাসিনা ঠিক প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পতœী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের মতোই একটা গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। এপার বাংলাতেও শেখ হাসিনাকে কখনো বিদেশের কোনো নাগরিক হিসেবে বাঙালি দেখে না। এপারের বাঙালির কথা হলো হোক না রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ একটি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম, রাষ্ট্র। কিন্তু সেটা তো বাঙালির দেশ। আর শেখ হাসিনা তো বাঙালি। সেই কারণে অন্নদাশঙ্কর যে শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলতেন; আমার বাপ-মা মারা এক এতিম মেয়েÑ সেটাই কিন্তু এবারের বাঙালি মন প্রাণ দিয়ে লালন করে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

tab

opinion » post-editorial

পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে কি জলাঞ্জলি দিয়েছে মোদি প্রশাসন

গৌতম রায়

শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় দফার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণের অল্প সময়ের পরই আবার ভারত সফর করলেন। এই সফরে ভারতের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং সে দেশের প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাদের একাধিক শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। এই বৈঠকের ফলশ্রুতি হিসেবে দুই দেশেরই স্বার্থবাদী বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তার মধ্যে পাঁচটি নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং তিনটি পুরনো সমঝোতা স্মারক নবায়িত হয়েছে।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্লু ইকোনমি, সমুদ্র বিজ্ঞান গবেষণা, মাছ, দুর্যোগ এবং স্বাস্থ্য, মহাকাশ ও সামরিক শিক্ষা। বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরে ব্লু ইকোনমি এবং মেরিটাইম কো-অপারেটিভ বিষয়টি ভারত সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক হিসেবে, ভারত মহাসাগরে সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ে যৌথ গবেষণার জন্য একটি বিশেষ বার্তা বহনকারী। বাংলাদেশ ওসানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং ভারতের কাউন্সিলার সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের মধ্যে যে সমঝোতাটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা আগামী দিনে ভারত বাংলাদেশ উভয়ের ক্ষেত্রেই গবেষণা এবং নদী-সমুদ্রকে অর্থাৎ পানি সম্পর্কে ব্যবহার করে, মানবসম্পদের উন্নয়নকে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।

ভারত বাংলাদেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ ঘিরে যে ধরনের আলাপ-আলোচনা এবং চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সেটি দুই দেশেরই বিস্তৃত উপকারে আসবে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে উপগ্রহ প্রকল্পের সহযোগিতার জন্য ভারতে ন্যাশনাল স্পেস অ্যান্ড প্রমোশন অ্যান্ড অথরাইজেশন সেন্টার আর বাংলাদেশের ডাক, টেলিফোন, যোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যে স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এগুলো উভয় দেশের আর্থসামাজিক উন্নতির ক্ষেত্রে একটা বিশেষ রকমের সহায়ক হবে।

তাছাড়া প্রতিরক্ষা, স্টাফ কলেজগুলোর মধ্যে একাডেমিক সহযোগিতা সম্পর্কেও সমঝোতার শক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

নবায়িত স্মারকগুলো হলোÑ মৎস্য খাতে সহযোগিতা সমঝোতা স্মারক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সমঝোতা স্মারক এবং স্বাস্থ্য আর ওষুধের ক্ষেত্রে সহযোগিতা ঘিরে সমঝোতাপত্র।

নরেন্দ্র মোদি গোটা ভারতজুড়ে বিভাজনের রাজনীতির মধ্য দিয়ে ভারতের সামাজিক সংকটকে বন্ডাহীন করে দিয়েছেন। বিগত দশ বছরের শাসনকালে ভারতের অর্থনীতি একেবারে তলানিতে থেকেছে। হিন্দু- মুসলমানের নিরিখে মানুষকে দেখার চিন্তাধারার ভেতর দিয়ে নরেন্দ্র মোদি বা তার সরকার বা তার দল, গোটা ভারতজুড়ে এক ভয়াবহ সংকট তৈরি করেছেন। ভারতে বেকারত্ব ভয়ংকর একটা জায়গায় রয়েছে। দুর্নীতি পর্বতপ্রমাণ।

তবুও বলতে হয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মোদির যে ভয়ংকর হিন্দু সম্প্রদায়িক পরিচিতি, কৌশলগত কারণেই সেই ব্যাপারটাকে খানিকটা হালকা করবার তাগিদেই বাংলাদেশ ঘিরে, মোদি কখনো তার পূর্বসূরী অটলবিহারী বাজপেয়ির মতপ্রকাশ্য বাংলাদেশ বিরোধিতা করেন না।

মোদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব তৃতীয়বার গ্রহণ করার পর, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ঘিরে পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু হয়েছে। সেই প্রতিক্রিয়ার মূল অঙ্গই হলো; মোদি বিরোধিতার নাম করে, এমন একটি পটভূমিকা তৈরি করা, যেখানে মোদির রাজনৈতিক ভূমিকা সম্প্রদায়িক ভূমিকাÑ এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে একাত্ম করে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টির সময়কাল থেকে, ভারতের যে সম্পর্ক, তাকে বিঘিœত করা।

এমন একটা ধারণা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় থাকা একটা বড় অংশের লোকজন, বিশেষ করে একটা ছোট অংশের সাংবাদিকরা তৈরি করতে চাচ্ছে, যাতে সাধারণ মানুষের মনে হয় যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময়, ভারত বাংলাদেশের মধ্যে যে কটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো বা যে তিনটি চুক্তি নবায়িত করা হলো; সেগুলোর সবটাইতেই ভারত সরকার, কেবল বাংলাদেশ সরকারের স্বার্থ রক্ষা করে করেছে। ভারতের স্বার্থ সেখানে কিছু নেই।

বিশেষ করে মোদি-মমতার মধ্যে ছদ্ম যে রাজনৈতিক সংঘাত আছে, তাকে প্রকৃত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় উপস্থাপিত করবার লক্ষ্যে, বাবড়ি মসজিদ ধ্বংসের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত লাল কষ্ণ আদবাণীর ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিক যেভাবে গোটা বিষয়টিকে উপস্থাপিত করছেন তা মারাত্মক। ভারতের একাংশের লোক এমনভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপিত করতে চাইছেন যাতে মনে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে, বাংলাদেশ সরকার সঙ্গে মোদি প্রশাসন এই চুক্তিটি করেছে।

এই চুক্তির ফলে পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হবেÑ এমন একটা কথাও কিছু এনজিও, যারা পরিবেশকে তাদের ব্যবসার একটা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে কার্যত মমতার তোষামোদি করে অর্থ উপার্জন করে, তারা এটা নিয়ে আসরে নেমে পড়েছে। একথা প্রত্যেকটি বাঙালিরই জানা আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার পানি, মমতার অন্যায় এবং ষড়যন্ত্রমূলক জেদের কারণে একতরফাভাবে ব্যবহার করে চলেছে ভারত।

আন্তর্জাতিক রীতি এবং নিয়ম আর আইন অনুযায়ী কখনো কোনো আন্তর্জাতিকভাবে প্রবাহিত নদীর পানি একটি বিশেষ দেশ একতরফাভাবে পালন ব্যবহার করতে পারে না। এই দিক থেকে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই মমতা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করছেন, ভারতের একটা অংশের বাঙালি আবেগ এমনভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন, যেখানে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি কে পরিপূর্ণভাবে অমান্য করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো ঘিরে এই যে মমতার শিবিরভুক্ত লোকেদের আপত্তি, তার প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশে যাতে সেখানকার সংখ্যাগুরু মৌলবাদী শক্তি, সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সাফল্যগুলোকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত করতে পারে।

ভারত সরকার যে চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত করেছে বা নবায়িত করেছে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে, সেগুলো ভারত সরকার বা নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশের প্রতি কোনো দয়ার দান নয়। শেখ হাসিনা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে যে কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছেন, ভারত-বাংলাদেশ সাম্প্রতিক চুক্তিগুলো হলো সেই সাফল্যের একটি অংশ এবং অঙ্গ।

শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বে প্রথম দফায় গঙ্গার পানি চুক্তির পর, যখন তৎকালীন বামপন্থী সাংসদ, প্রয়াত গীতা মুখোপাধ্যায়ের একটি চিঠি এই নিবন্ধকার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে তুলে দিয়েছিলেন, তখনই নেত্রীর মনোভাবের মধ্যে দিয়ে বোঝা গিয়েছিল, পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে, এপার বাংলার, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালির প্রতি কী অসীম স্নেহ মমতা তিনি হৃদয়ে ধারণ করেন। যশোর শহরের প্রতিথযশা উকিল, লালু বাবুর কন্যা গীতা মুখোপাধ্যায়ের প্রতি শেখ হাসিনা ঠিক প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পতœী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের মতোই একটা গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। এপার বাংলাতেও শেখ হাসিনাকে কখনো বিদেশের কোনো নাগরিক হিসেবে বাঙালি দেখে না। এপারের বাঙালির কথা হলো হোক না রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ একটি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম, রাষ্ট্র। কিন্তু সেটা তো বাঙালির দেশ। আর শেখ হাসিনা তো বাঙালি। সেই কারণে অন্নদাশঙ্কর যে শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলতেন; আমার বাপ-মা মারা এক এতিম মেয়েÑ সেটাই কিন্তু এবারের বাঙালি মন প্রাণ দিয়ে লালন করে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top