alt

উপ-সম্পাদকীয়

ব্যাংকিং সেক্টরের অনিয়ম দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

: সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪

ব্যাংকিং খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ অথর্নীতির বিকাশ সম্পকির্ত। এ খাতে আরও বেশি গভীরতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, নিয়মানুবতির্তা এনে আথির্ক খাত তথা অথনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পরিপক্বতার পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন। আমরা ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া কিংবা ভারতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেয়া পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে জানছি। এ দেশগুলো জনস্বার্থ রক্ষার জন্য তাদের আর্থিক খাতে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, তা থেকে আমরা ধারণা নিতে পারি। তিনশ বছরের কিছু আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্ভবের পর থেকে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার নির্ধারণ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ (টার্গেটিং), সরকারের ব্যাংক এবং ব্যাংকগুলোর ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করে অথর্নীতির ওঠানামা সামাল দিয়ে আসছে। সম্প্রতি ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) সুদের হার ঘোষণা দেয়ায় এবং সাম্প্রতিককালে এই একই সংগঠনের আরও কিছু কাযর্কলাপের ফলে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা ও অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা হলো খেলাপি ঋণ ও ব্যাংক খাতের করপোরেট ব্যবস্থাপনার সংকট। ব্যাংক কোম্পানি আইনের এক সংশোধনীর মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের সদস্যসংখ্যা ২ থেকে ৪ এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মেয়াদ ৬ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করার ফলে করপোরেট ব্যবস্থাপনার সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় সমস্যা সবচেয়ে প্রকট। পরিচালনা পর্ষদে ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সার্বিক নির্দেশনা দেবে, নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে আর ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা নীতিমালা বাস্তবায়ন করবেন, এটাই নিয়ম। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কার্যপরিধি আইন দিয়ে নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়, পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কাজে হস্তক্ষেপ করে। এখন দেখা যায়, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নীতিগত সিদ্ধান্ত দেয়ার চেয়ে ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতেই যেন বেশি উৎসাহী। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের পক্ষে স্বাধীনভাবে সৃজনশীলতা কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা প্রায়শ পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই ব্যাংক সেক্টরের জন্য মঙ্গলজনক নয়। অবশ্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনাও যেসব সময় দক্ষ হয়, তা নয়। অনেক সময় ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও ত্রুটির কারণেও সমস্যা সৃষ্টি হয়।

ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যারা নিয়োগ লাভ করেন, তাদের নিযুক্তি অনেকটাই নির্ভর করে পরিচালনা পর্ষদের ওপর। কাজেই তারা ইচ্ছা করলেই পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা চেয়ারম্যানের পরামর্শ বা নির্দেশনা উপেক্ষা করতে পারেন না। কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থাকবেন কি থাকবেন না, তা অনেকটাই নির্ভর করে ওই ব্যক্তির ওপর পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের সন্তুষ্টির ওপর। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দক্ষতা ও কাজের সাফল্যের ওপর তার টিকে থাকা, না থাকা তেমন একটা নির্ভর করে না। পরিচালনা পর্ষদে অনেকেই থাকেন, যারা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজনৈতিক প্রভাব বহুলাংশে দক্ষ ও সৎভাবে ব্যাংক পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করে। পরিচালকদের অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চান। একজন পরিচালক বা চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতেই পারে; কিন্তু তা যদি ব্যাংকের কাজে ব্যবহার করতে চান, তাহলেই সমস্যা দেখা দেয়। ব্যবস্থাপনার মধ্যেও অনেকে আছেন, যারা দক্ষ নন, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যদি অদক্ষ বা দুর্বল হন, তাহলে এর প্রভাব সর্বত্রই পড়ে। এতে নিচের দিকের কর্মীরা নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। দুর্নীতি-অনিয়ম ওপর থেকে নিচের দিকে ধাবিত হয়। কাজেই টপ ম্যানেজমেন্ট যদি কঠোরভাবে সুশাসন নিশ্চিত করে, তাহলে তার প্রভাব নিচের দিকে পড়বেই। কিন্তু আমাদের এখানে টপ ম্যানেজমেন্টের মধ্যেও সমস্যা রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে এখন সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা জেঁকে বসেছে।

ব্যাংকিং খাতের সুশাসন হলো সরকারি প্রতিষ্ঠান ও দেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে দেশের সম্পদ পরিচালনার সুব্যবস্থা করা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, স্বচ্ছতা হলো এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি, যেখানে মুদ্রা ও আর্থিক নীতি-সম্পর্কিত সব তথ্য সময় সময় জনগণকে বোধগম্য উপায়ে জানানো হয়। দেশের ব্যাংক খাতে সংকটের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে ব্যাংকিং কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য, সরকারি এবং বেসরকারি দায়িত্বকে পুনর্জীবিত করার জন্য সুশাসন শব্দটি এখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।

সামষ্টিক অর্থনীতিতে টেকসই সুশাসন ও সার্বিক আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারি কার্য পরিচালনায় স্বচ্ছতা বিধান পূর্বশর্ত। জবাবদিহি হলো পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে বিদ্যমান সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারি বা বেসরকারি কোনো এজেন্ট কর্তৃক সুলভে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান। আর্থিক বাজারে অংশগ্রহণকারী প্রধান গোষ্ঠী ঋণদাতা-ঋণগ্রহীতা, ব্যাংক-বিমা প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগকারী, জাতীয় কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা প্রয়োজন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি পরস্পর সম্পর্কিত। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে নজরদারি বাড়ে। আবার জবাবদিহি থাকলে স্বচ্ছতা বাড়ে, এটা সবার জন্য উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করে। সবাই নিশ্চিত হয় যে মানুষ তাদের কাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জেনেছে এবং বুঝেছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতির যথার্থ উদাহরণ হচ্ছে ব্যাংকে সংঘটিত হলমার্ক, বিসমিল্লাহ ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি। সেখানে ঋণগ্রহীতা ও কর্মকর্তারা গোপন সমঝোতার মাধ্যমে অস্বচ্ছ উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলেন। সে ঘটনায় যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এর মধ্য দিয়ে তারা ‘বিকৃত প্রণোদনা’ পেয়েছেন এবং একই ব্যাংক ও অন্যত্র যেসব সৎ কর্মকর্তা কাজ করেন, তাদের অবহেলা করে পেছনে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এ যেন মন্দ অর্থ ভালো অর্থকে বিতাড়িত করা।

পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছেন কিছু ব্যাংক মালিক ও শীর্ষ খেলাপি। এই শীর্ষ খেলাপিদের কেউ কেউ এখন রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী জায়গায় থেকে নিজেদের মতো একটা আর্থিক সংস্কৃতি তৈরিতে সক্রিয় আছেন। ফলে ঋণ জালিয়াতির নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঘটছে একের পর এক দুর্নীতির ঘটনা। কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির কেলেঙ্কারির কথা উঠতে উঠতেই জানা যাচ্ছে অন্য কোনো ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা লুটপাটের তথ্য। যারা এই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় না আনার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে মানুষকে। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকসহ রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিংসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের তথ্য এখন জনগণের মুখে মুখে। কিন্তু অবস্থা বদলাচ্ছে না। ক্ষমতার জোর এমনই যে চাল নেই চুলো নেই এমন কোম্পানিও ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ পাচ্ছে। আমরা মনে করি, দেশের সুশাসনের একটি বড় সূচক হলো অর্থনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত করা। এক দশকের বেশি সময় ধরে চাঞ্চল্যকর ব্যাংক ও আর্থিক কেলেঙ্কারির প্রতি প্রশ্রয়মূলক মনোভাব আমাদের হতাশ করেছে। ব্যাংকিং খাতের বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় কারণ বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতা আর সরকারি ব্যাংকে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। খুব নাজুক অবস্থায় রয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি আর বাড়তে না দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আইন অনুযায়ী তার ওপর প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেয়া উচিত।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

বেঁটে নারকেল গাছ নিয়ে কিছু কথা

রাসেলস ভাইপার : আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

হুমকিতে সমুদ্র, ঝুঁকিতে উন্নয়নশীল দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী

পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে কি জলাঞ্জলি দিয়েছে মোদি প্রশাসন

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ : আইন কী বলে

হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে

বাংলাদেশের উন্নতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর লজ্জা

মাদকমুক্ত দেশ গড়তে প্রয়োজন প্রতিরোধ কার্যক্রম

রম্যগদ্য : ‘ন্যায়-অন্যায় জানি নে, জানি নে...’

ছবি

কুরবানির ছাগল তাকে চিনতে পেরেছে

ছবি

সুইডিশ মিডসামার : এক আনন্দময় দিনের সূচনা

ছবি

আধুনিক রূপকথা এবং আমাদের রাজাদের গল্প

গাছে গাছে সবুজ হোক দেশ

কত বিষে আমাদের বসবাস

ছবি

তিস্তার দুই নয়নে দুই অশ্রুধারা

বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান

আদিবাসীরা বৈষম্যের শিকার

ছবি

নারীর অগ্রযাত্রা

ছবি

সিলেট-সুনামগঞ্জের ‘জলাবদ্ধ বন্যার’ দায় কার?

ছবি

বুড়িতিস্তা রিজার্ভার খনন : কৃষক কি উপকৃত হবে?

সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে কী হচ্ছে?

উচ্ছেদকৃত দলিতদের পুনর্বাসন করুন

রম্যগদ্য : অভিযোগ ‘অভিযোগ’ নয়

কেন হেরে গেলেন সেলিম

নীরবে-নিভৃতে কাজ করা এক কৃষিবিজ্ঞানীর কথা

অর্থনীতি কী অবস্থায় আছে?

কোরবানির চামড়ার হকদার

যোগাযোগ অধ্যয়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ

এমপি আনারকে নিয়ে যত আইনি জটিলতা

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আইনের শাসন

দূর হোক মনের পশুত্ব

মনের পশুত্বের প্রতীকী ত্যাগের আরেক নাম কোরবানি

ঈদে সুস্থ খাদ্যাভ্যাস

এমআইটি : প্রযুক্তির সৃষ্টি রহস্যের খোঁজ

কবিগুরুর বাণী ‘প্রমাণিত মিথ্যা’

কিশোর গ্যাং কালচার বন্ধ হবে কিভাবে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ব্যাংকিং সেক্টরের অনিয়ম দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪

ব্যাংকিং খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ অথর্নীতির বিকাশ সম্পকির্ত। এ খাতে আরও বেশি গভীরতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, নিয়মানুবতির্তা এনে আথির্ক খাত তথা অথনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পরিপক্বতার পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন। আমরা ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া কিংবা ভারতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেয়া পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে জানছি। এ দেশগুলো জনস্বার্থ রক্ষার জন্য তাদের আর্থিক খাতে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, তা থেকে আমরা ধারণা নিতে পারি। তিনশ বছরের কিছু আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্ভবের পর থেকে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার নির্ধারণ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ (টার্গেটিং), সরকারের ব্যাংক এবং ব্যাংকগুলোর ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করে অথর্নীতির ওঠানামা সামাল দিয়ে আসছে। সম্প্রতি ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) সুদের হার ঘোষণা দেয়ায় এবং সাম্প্রতিককালে এই একই সংগঠনের আরও কিছু কাযর্কলাপের ফলে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা ও অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা হলো খেলাপি ঋণ ও ব্যাংক খাতের করপোরেট ব্যবস্থাপনার সংকট। ব্যাংক কোম্পানি আইনের এক সংশোধনীর মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের সদস্যসংখ্যা ২ থেকে ৪ এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মেয়াদ ৬ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করার ফলে করপোরেট ব্যবস্থাপনার সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় সমস্যা সবচেয়ে প্রকট। পরিচালনা পর্ষদে ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সার্বিক নির্দেশনা দেবে, নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে আর ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা নীতিমালা বাস্তবায়ন করবেন, এটাই নিয়ম। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কার্যপরিধি আইন দিয়ে নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়, পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কাজে হস্তক্ষেপ করে। এখন দেখা যায়, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নীতিগত সিদ্ধান্ত দেয়ার চেয়ে ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতেই যেন বেশি উৎসাহী। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থাপকদের পক্ষে স্বাধীনভাবে সৃজনশীলতা কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা প্রায়শ পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই ব্যাংক সেক্টরের জন্য মঙ্গলজনক নয়। অবশ্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনাও যেসব সময় দক্ষ হয়, তা নয়। অনেক সময় ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও ত্রুটির কারণেও সমস্যা সৃষ্টি হয়।

ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যারা নিয়োগ লাভ করেন, তাদের নিযুক্তি অনেকটাই নির্ভর করে পরিচালনা পর্ষদের ওপর। কাজেই তারা ইচ্ছা করলেই পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা চেয়ারম্যানের পরামর্শ বা নির্দেশনা উপেক্ষা করতে পারেন না। কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে থাকবেন কি থাকবেন না, তা অনেকটাই নির্ভর করে ওই ব্যক্তির ওপর পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের সন্তুষ্টির ওপর। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দক্ষতা ও কাজের সাফল্যের ওপর তার টিকে থাকা, না থাকা তেমন একটা নির্ভর করে না। পরিচালনা পর্ষদে অনেকেই থাকেন, যারা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজনৈতিক প্রভাব বহুলাংশে দক্ষ ও সৎভাবে ব্যাংক পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করে। পরিচালকদের অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চান। একজন পরিচালক বা চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতেই পারে; কিন্তু তা যদি ব্যাংকের কাজে ব্যবহার করতে চান, তাহলেই সমস্যা দেখা দেয়। ব্যবস্থাপনার মধ্যেও অনেকে আছেন, যারা দক্ষ নন, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যদি অদক্ষ বা দুর্বল হন, তাহলে এর প্রভাব সর্বত্রই পড়ে। এতে নিচের দিকের কর্মীরা নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। দুর্নীতি-অনিয়ম ওপর থেকে নিচের দিকে ধাবিত হয়। কাজেই টপ ম্যানেজমেন্ট যদি কঠোরভাবে সুশাসন নিশ্চিত করে, তাহলে তার প্রভাব নিচের দিকে পড়বেই। কিন্তু আমাদের এখানে টপ ম্যানেজমেন্টের মধ্যেও সমস্যা রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে এখন সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা জেঁকে বসেছে।

ব্যাংকিং খাতের সুশাসন হলো সরকারি প্রতিষ্ঠান ও দেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে দেশের সম্পদ পরিচালনার সুব্যবস্থা করা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, স্বচ্ছতা হলো এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি, যেখানে মুদ্রা ও আর্থিক নীতি-সম্পর্কিত সব তথ্য সময় সময় জনগণকে বোধগম্য উপায়ে জানানো হয়। দেশের ব্যাংক খাতে সংকটের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে ব্যাংকিং কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য, সরকারি এবং বেসরকারি দায়িত্বকে পুনর্জীবিত করার জন্য সুশাসন শব্দটি এখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।

সামষ্টিক অর্থনীতিতে টেকসই সুশাসন ও সার্বিক আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারি কার্য পরিচালনায় স্বচ্ছতা বিধান পূর্বশর্ত। জবাবদিহি হলো পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে বিদ্যমান সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারি বা বেসরকারি কোনো এজেন্ট কর্তৃক সুলভে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান। আর্থিক বাজারে অংশগ্রহণকারী প্রধান গোষ্ঠী ঋণদাতা-ঋণগ্রহীতা, ব্যাংক-বিমা প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগকারী, জাতীয় কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা প্রয়োজন। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি পরস্পর সম্পর্কিত। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে নজরদারি বাড়ে। আবার জবাবদিহি থাকলে স্বচ্ছতা বাড়ে, এটা সবার জন্য উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করে। সবাই নিশ্চিত হয় যে মানুষ তাদের কাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জেনেছে এবং বুঝেছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতির যথার্থ উদাহরণ হচ্ছে ব্যাংকে সংঘটিত হলমার্ক, বিসমিল্লাহ ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি। সেখানে ঋণগ্রহীতা ও কর্মকর্তারা গোপন সমঝোতার মাধ্যমে অস্বচ্ছ উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলেন। সে ঘটনায় যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এর মধ্য দিয়ে তারা ‘বিকৃত প্রণোদনা’ পেয়েছেন এবং একই ব্যাংক ও অন্যত্র যেসব সৎ কর্মকর্তা কাজ করেন, তাদের অবহেলা করে পেছনে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এ যেন মন্দ অর্থ ভালো অর্থকে বিতাড়িত করা।

পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছেন কিছু ব্যাংক মালিক ও শীর্ষ খেলাপি। এই শীর্ষ খেলাপিদের কেউ কেউ এখন রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী জায়গায় থেকে নিজেদের মতো একটা আর্থিক সংস্কৃতি তৈরিতে সক্রিয় আছেন। ফলে ঋণ জালিয়াতির নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঘটছে একের পর এক দুর্নীতির ঘটনা। কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির কেলেঙ্কারির কথা উঠতে উঠতেই জানা যাচ্ছে অন্য কোনো ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা লুটপাটের তথ্য। যারা এই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় না আনার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে মানুষকে। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকসহ রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিংসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের তথ্য এখন জনগণের মুখে মুখে। কিন্তু অবস্থা বদলাচ্ছে না। ক্ষমতার জোর এমনই যে চাল নেই চুলো নেই এমন কোম্পানিও ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ পাচ্ছে। আমরা মনে করি, দেশের সুশাসনের একটি বড় সূচক হলো অর্থনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত করা। এক দশকের বেশি সময় ধরে চাঞ্চল্যকর ব্যাংক ও আর্থিক কেলেঙ্কারির প্রতি প্রশ্রয়মূলক মনোভাব আমাদের হতাশ করেছে। ব্যাংকিং খাতের বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় কারণ বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতা আর সরকারি ব্যাংকে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। খুব নাজুক অবস্থায় রয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি আর বাড়তে না দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আইন অনুযায়ী তার ওপর প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেয়া উচিত।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

back to top