alt

উপ-সম্পাদকীয়

একজন উদ্যোগী গবেষকের কথা

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

: শনিবার, ০৬ জুলাই ২০২৪

আজ আমরা খেয়েপরে ভালোই আছি। অথচ এই নিকট অতীতেও আমাদের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। দেশব্যাপী ভাতের অভাব ছিল প্রকট। সে কথা মাথায় রেখেই ব্রিটিশ আমলে বহু কাটখড় পুড়িয়ে ঢাকাতে একটি কৃষি গবেষণা খামার প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেখানেই প্রথম ধান নিয়ে গবেষণা শুরু হয় ১৯১০-১১ সালে। এর নেতৃত্বে ছিলেন ড. জি পি হেক্টর। তিনি ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত এই খামারে ছিলেন। ধান গবেষণা সংক্রান্ত প্রাথমিক পরিকল্পনা তারই। তবে সাথে ছিলেন ছিলেন ড. সৈয়দ হেদায়েতুল্লাহ।

ড. হেক্টর ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত তার দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর দায়িত্ব দেয়া হয় ড. হেদায়েতুল্লাহকে। তিনি উক্ত ফার্মে আরও দশ বছর কাজ করার পর ১৯৪৪ সালে ঢাকাস্থ বেঙ্গল কৃষি ইনস্টিটিউটে অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন। পরে কৃষিবিভাগের পরিচালক পদে যোগ দেন। ১৯১০ থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যে আউশ আমন মিলিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠান পঞ্চাশটির বেশি দেশি কিন্তু মোটামুটি ভালো ফলন দিতে সক্ষম ধানের জাত নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। ধান গবেষণার উষালগ্নে তাদের অবদান অবশ্যই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। তবে তাদের সেই অবদান ভবিষ্যতের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয় সে কথা অনেকেই জানতেন। তাদেরই একজন ছিলেন ড. আলীম। তিনি না থাকলে আজকের বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বলে যে প্রতিষ্ঠান দেশকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে সেটাকে পেতাম কিনা কে জানে! অথচ এই বিজ্ঞানীর কথা আমরা খুব একটা জানিনে।

১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে আমার কর্মজীবন শুরু। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কাউকে তার কথা বলতে শুনিনি। তিনি ধান গবেষণার পাশাপাশি কৃষিবিজ্ঞানের বেশ কিছু বইও লিখেছিলেন। সেই বইগুলোর সূত্রেই তাকে আমি জানতে পেরেছি।

বাংলাদেশে ধানের গুরুত্ব অপরিসীম। এই কারণেই ধান গবেষণার জন্য একটি আলাদা প্রতিষ্ঠানের তাগিদ ছিল অনেক আগে থেকেই। ব্রিটিশ সরকার তৎকালীন বেঙ্গলের জন্য এমন চিন্তা ভাবনা করলেও পরে সেটা প্রতিষ্ঠিত হয় উড়িষ্যার কটকে। দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান জরুরি হয়ে পড়ে; কিন্তু ধান ক্যাশক্রপ না হওয়ায় এই নিয়ে নানা প্রশাসনিক-রাজনৈতিক ঝামেলা চলতে থাকে। তাছাড়া তখন দৈব-দুর্বিপাক ছাড়া মানুষের ভাতের অভাব হতে পারে এমনটি যারা ক্ষমতাসীন ছিলেন তাদের মাথায় ঢুকতে সময় লেগেছিল। নির্দ্বিধায় বলা যায় তখনকার পলিসি-প্ল্যানাররা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন না। যাই হোক, ড. এ আলীম একজন উদ্যোগী গবেষক ছিলেন। তিনি ১৯৫৫ সালে একটি স্বাধীন ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার বরাবরে একটি স্কিম জমা দেন। সম্ভবত এই স্কীমটি সরকারি পর্যায়ে তেমন গুরুত্ব না পাওয়ায় তিনি আরেকটি স্কিম তৈরি করে জমা দেন। ড. এম ও গনি এ ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন। তিনি স্কিমটি যথেষ্ট পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করেন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা-আলাপ-আলোচনার পর ১৯৫৯ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার অবসরে যাওয়া কৃষি বিভাগের পরিচালক উপর্যুক্ত ড. হেদায়েতুল্লাহকে স্কিমটির নেতৃত্বদানের জন্য নিয়োগ দেয়। তিনি স্কিমটি কিছুটা পরিমার্জিত করে A scheme for Intensifzing Research on Rice Breeding in East Pakistan শিরোনামে সরকার বরাবরে আবার জমা দেন। বিভিন্ন সরকারি সংস্থার বিশেষজ্ঞ কর্তৃক পরীক্ষিত হওয়ার পর ১৯৬০ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার তা অনুমোদন করে। প্রকৃত কাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। বেশ কিছু নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। আরও জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন থাকে। অফিস এবং গবেষণাগারের জন্য দালানকোঠা তৈরি শুরু হয়। বিদেশে যন্ত্রপাতির অর্ডার দেওয়া হয়; কিন্তু প্রকল্পটি সূতিকাগারেই মারা পড়ে। ড. শাহ্ মো. হাছানুজ্জামানের মতে সে সময়ের কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন সহকারি সচিবের কারচুপিতে এমনটি ঘটে। পক্ষান্তরে Economic Botanist (Cerial) পদটিকে জোরদার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়; কিন্তু সেটাও নানা কারণে হয়ে উঠেনি। যাই হোক তখন থেকেই সে সময়কার ধান-গবেষকরা স্বাধীন এবং পূর্ণাঙ্গ একটি ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। ঠিক সে সময়েই আরেকটা ধাক্কা এসে এই প্রচেষ্টারও অপমৃত্যু ঘটায়। পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় রাজধানী গড়ে তোলার তোড়জোড় শুরু হয়।

এর আগে ১৯৫৭-৫৮ সালে তেজগাঁও গবেষণা কেন্দ্রটি (ঢাকা ফার্ম) যথাযথ জায়গায় হয়নি বলে যুক্তফ্রণ্ট সরকার Dhaka Improvement Trust এর কাছে হস্তান্তর করে; কিন্তু গবেষণা কেন্দ্রটি কোথায় যাবে এ ব্যাপারে কেউ কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি। এই সূত্র ধরেই ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লে. জে. ওমরাও খাঁর নেতৃত্বে এক কমিটি কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে ঢাকা ফার্মের জায়গায় দ্বিতীয় রাজধানী আইয়ুব নগর তৈরির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই আইয়ুব নগরই পরবর্তীকালের শেরেবাংলা নগর বলে পরিচিতি লাভ করে। ইতোমধ্যে ফিলিপিন্সের লসবানোস শহরে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট (IRRI) প্রতিষ্ঠিত হয়। FAO, Ford foundation আগে থেকেই সক্রিয় ছিল। ড. আলীম ১৯৬৫ সালে সংশোধিত আকারে East Pakistan Accelerated Rice Research (EPARR) শিরোনামে আরেকটি স্কিম জমা দেন। FAO, Ford foundation এবং IRRI-এর চেষ্টায় এক বছরের মধ্যে সেটি পাশ হয়। এই স্কিমটিই ১৯৭০ সালে ১ অক্টোবর আলাদা মর্যাদায় পূর্ব পাকিস্তান ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (EPRRI) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন ড. মো. আমীরুল ইসলাম। সহযোগী পরিচালক হিসেবে ছিলেন ঊচঅজজ স্কীমের প্রধান ধান গবেষণা বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্ মোহাম্মদ হাছানুজ্জামান।

স্কিমটি পরিমার্জন ও পরিবর্ধনে সাহায্যকারী ড. এম ও গনি (১৯১২- ১৯৮৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত প্রথমে বেঙ্গল সরকার পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কৃষি রসায়নবিদ হিসাবে কাজ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ কৃষি) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) তাকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেয় ১৯৬৬ সালে।

ড. আলীমও একজন মেধাবী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪১ সালে তার উদ্ভিদ বিদ্যায় এমএসসি পাস করেন। বেঙ্গল গভর্নমেন্টের রিসার্স স্কলার হিসেবে ভারতীয় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন। ভারত সরকারের স্কলার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন ১৯৪৯ সালে।

ঢাকা ফার্মে ১৯৪৩-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত গবেষণা সহকারী (Fibre expert) হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৫০ সাল থেকে ঢাকা ফার্মের ইকোনমিক বোটানিস্ট হিসেবে ধান গবেষণা কার্যক্রম তদারকি শুরু করেন। তিনি কোন না কোন সময় কোন না কোনভাবে BRRI, BARI, BARC and Seed Institute এর হয়ে মুখ্য দায়িত্ব পালন করেন। (EPRRI) ও headed (EPRRI) BRRI, BARI, BARC, and Seed Institute and rather founder of them. Victory has however many parents. ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠায় ড. এম ও গনির ভূমিকাকে ছোট করে দেখছি না। এমনকি ড. হেদায়েতুল্লাহর ভূমিকাও নয়, কিন্তু তাদের থেকেও এই কার্যক্রমের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং মূল স্কিম প্রণয়নকারী ড. আলীমের ভূমিকাকে আমি একটু ভিন্নভাবে মূল্যায়িত করতে চাই।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নিজের গুণেই আজ দেশব্যাপী পরিচিত। অথচ ড. আলীম আজকের প্রজন্মের কৃষিবিজ্ঞানীদের কাছে তেমন পরিচিত নয়।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

বিয়েতে মিতব্যয়িতা

এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বঞ্চনার কথা

রোহিঙ্গা সমস্যা : বাহবা, ব্যর্থতা ও ভবিষ্যতের ভয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

প্রযুক্তির ফাঁদে শৈশব : স্ক্রিন টাইম গিলে খাচ্ছে খেলার মাঠ

রমগদ্য : সিরাজগঞ্জে ‘ব্রিটিশ প্রেতাত্মা’

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : জনশিক্ষা ও সুশাসনের পথ

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

tab

উপ-সম্পাদকীয়

একজন উদ্যোগী গবেষকের কথা

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

শনিবার, ০৬ জুলাই ২০২৪

আজ আমরা খেয়েপরে ভালোই আছি। অথচ এই নিকট অতীতেও আমাদের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। দেশব্যাপী ভাতের অভাব ছিল প্রকট। সে কথা মাথায় রেখেই ব্রিটিশ আমলে বহু কাটখড় পুড়িয়ে ঢাকাতে একটি কৃষি গবেষণা খামার প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেখানেই প্রথম ধান নিয়ে গবেষণা শুরু হয় ১৯১০-১১ সালে। এর নেতৃত্বে ছিলেন ড. জি পি হেক্টর। তিনি ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত এই খামারে ছিলেন। ধান গবেষণা সংক্রান্ত প্রাথমিক পরিকল্পনা তারই। তবে সাথে ছিলেন ছিলেন ড. সৈয়দ হেদায়েতুল্লাহ।

ড. হেক্টর ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত তার দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর দায়িত্ব দেয়া হয় ড. হেদায়েতুল্লাহকে। তিনি উক্ত ফার্মে আরও দশ বছর কাজ করার পর ১৯৪৪ সালে ঢাকাস্থ বেঙ্গল কৃষি ইনস্টিটিউটে অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন। পরে কৃষিবিভাগের পরিচালক পদে যোগ দেন। ১৯১০ থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যে আউশ আমন মিলিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠান পঞ্চাশটির বেশি দেশি কিন্তু মোটামুটি ভালো ফলন দিতে সক্ষম ধানের জাত নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। ধান গবেষণার উষালগ্নে তাদের অবদান অবশ্যই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। তবে তাদের সেই অবদান ভবিষ্যতের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয় সে কথা অনেকেই জানতেন। তাদেরই একজন ছিলেন ড. আলীম। তিনি না থাকলে আজকের বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বলে যে প্রতিষ্ঠান দেশকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে সেটাকে পেতাম কিনা কে জানে! অথচ এই বিজ্ঞানীর কথা আমরা খুব একটা জানিনে।

১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে আমার কর্মজীবন শুরু। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কাউকে তার কথা বলতে শুনিনি। তিনি ধান গবেষণার পাশাপাশি কৃষিবিজ্ঞানের বেশ কিছু বইও লিখেছিলেন। সেই বইগুলোর সূত্রেই তাকে আমি জানতে পেরেছি।

বাংলাদেশে ধানের গুরুত্ব অপরিসীম। এই কারণেই ধান গবেষণার জন্য একটি আলাদা প্রতিষ্ঠানের তাগিদ ছিল অনেক আগে থেকেই। ব্রিটিশ সরকার তৎকালীন বেঙ্গলের জন্য এমন চিন্তা ভাবনা করলেও পরে সেটা প্রতিষ্ঠিত হয় উড়িষ্যার কটকে। দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান জরুরি হয়ে পড়ে; কিন্তু ধান ক্যাশক্রপ না হওয়ায় এই নিয়ে নানা প্রশাসনিক-রাজনৈতিক ঝামেলা চলতে থাকে। তাছাড়া তখন দৈব-দুর্বিপাক ছাড়া মানুষের ভাতের অভাব হতে পারে এমনটি যারা ক্ষমতাসীন ছিলেন তাদের মাথায় ঢুকতে সময় লেগেছিল। নির্দ্বিধায় বলা যায় তখনকার পলিসি-প্ল্যানাররা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন না। যাই হোক, ড. এ আলীম একজন উদ্যোগী গবেষক ছিলেন। তিনি ১৯৫৫ সালে একটি স্বাধীন ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার বরাবরে একটি স্কিম জমা দেন। সম্ভবত এই স্কীমটি সরকারি পর্যায়ে তেমন গুরুত্ব না পাওয়ায় তিনি আরেকটি স্কিম তৈরি করে জমা দেন। ড. এম ও গনি এ ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন। তিনি স্কিমটি যথেষ্ট পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করেন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা-আলাপ-আলোচনার পর ১৯৫৯ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার অবসরে যাওয়া কৃষি বিভাগের পরিচালক উপর্যুক্ত ড. হেদায়েতুল্লাহকে স্কিমটির নেতৃত্বদানের জন্য নিয়োগ দেয়। তিনি স্কিমটি কিছুটা পরিমার্জিত করে A scheme for Intensifzing Research on Rice Breeding in East Pakistan শিরোনামে সরকার বরাবরে আবার জমা দেন। বিভিন্ন সরকারি সংস্থার বিশেষজ্ঞ কর্তৃক পরীক্ষিত হওয়ার পর ১৯৬০ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার তা অনুমোদন করে। প্রকৃত কাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। বেশ কিছু নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। আরও জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন থাকে। অফিস এবং গবেষণাগারের জন্য দালানকোঠা তৈরি শুরু হয়। বিদেশে যন্ত্রপাতির অর্ডার দেওয়া হয়; কিন্তু প্রকল্পটি সূতিকাগারেই মারা পড়ে। ড. শাহ্ মো. হাছানুজ্জামানের মতে সে সময়ের কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন সহকারি সচিবের কারচুপিতে এমনটি ঘটে। পক্ষান্তরে Economic Botanist (Cerial) পদটিকে জোরদার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়; কিন্তু সেটাও নানা কারণে হয়ে উঠেনি। যাই হোক তখন থেকেই সে সময়কার ধান-গবেষকরা স্বাধীন এবং পূর্ণাঙ্গ একটি ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। ঠিক সে সময়েই আরেকটা ধাক্কা এসে এই প্রচেষ্টারও অপমৃত্যু ঘটায়। পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় রাজধানী গড়ে তোলার তোড়জোড় শুরু হয়।

এর আগে ১৯৫৭-৫৮ সালে তেজগাঁও গবেষণা কেন্দ্রটি (ঢাকা ফার্ম) যথাযথ জায়গায় হয়নি বলে যুক্তফ্রণ্ট সরকার Dhaka Improvement Trust এর কাছে হস্তান্তর করে; কিন্তু গবেষণা কেন্দ্রটি কোথায় যাবে এ ব্যাপারে কেউ কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি। এই সূত্র ধরেই ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লে. জে. ওমরাও খাঁর নেতৃত্বে এক কমিটি কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে ঢাকা ফার্মের জায়গায় দ্বিতীয় রাজধানী আইয়ুব নগর তৈরির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই আইয়ুব নগরই পরবর্তীকালের শেরেবাংলা নগর বলে পরিচিতি লাভ করে। ইতোমধ্যে ফিলিপিন্সের লসবানোস শহরে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট (IRRI) প্রতিষ্ঠিত হয়। FAO, Ford foundation আগে থেকেই সক্রিয় ছিল। ড. আলীম ১৯৬৫ সালে সংশোধিত আকারে East Pakistan Accelerated Rice Research (EPARR) শিরোনামে আরেকটি স্কিম জমা দেন। FAO, Ford foundation এবং IRRI-এর চেষ্টায় এক বছরের মধ্যে সেটি পাশ হয়। এই স্কিমটিই ১৯৭০ সালে ১ অক্টোবর আলাদা মর্যাদায় পূর্ব পাকিস্তান ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (EPRRI) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন ড. মো. আমীরুল ইসলাম। সহযোগী পরিচালক হিসেবে ছিলেন ঊচঅজজ স্কীমের প্রধান ধান গবেষণা বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্ মোহাম্মদ হাছানুজ্জামান।

স্কিমটি পরিমার্জন ও পরিবর্ধনে সাহায্যকারী ড. এম ও গনি (১৯১২- ১৯৮৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত প্রথমে বেঙ্গল সরকার পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কৃষি রসায়নবিদ হিসাবে কাজ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ কৃষি) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) তাকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেয় ১৯৬৬ সালে।

ড. আলীমও একজন মেধাবী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪১ সালে তার উদ্ভিদ বিদ্যায় এমএসসি পাস করেন। বেঙ্গল গভর্নমেন্টের রিসার্স স্কলার হিসেবে ভারতীয় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন। ভারত সরকারের স্কলার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন ১৯৪৯ সালে।

ঢাকা ফার্মে ১৯৪৩-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত গবেষণা সহকারী (Fibre expert) হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৫০ সাল থেকে ঢাকা ফার্মের ইকোনমিক বোটানিস্ট হিসেবে ধান গবেষণা কার্যক্রম তদারকি শুরু করেন। তিনি কোন না কোন সময় কোন না কোনভাবে BRRI, BARI, BARC and Seed Institute এর হয়ে মুখ্য দায়িত্ব পালন করেন। (EPRRI) ও headed (EPRRI) BRRI, BARI, BARC, and Seed Institute and rather founder of them. Victory has however many parents. ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠায় ড. এম ও গনির ভূমিকাকে ছোট করে দেখছি না। এমনকি ড. হেদায়েতুল্লাহর ভূমিকাও নয়, কিন্তু তাদের থেকেও এই কার্যক্রমের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং মূল স্কিম প্রণয়নকারী ড. আলীমের ভূমিকাকে আমি একটু ভিন্নভাবে মূল্যায়িত করতে চাই।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নিজের গুণেই আজ দেশব্যাপী পরিচিত। অথচ ড. আলীম আজকের প্রজন্মের কৃষিবিজ্ঞানীদের কাছে তেমন পরিচিত নয়।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

back to top