alt

উপ-সম্পাদকীয়

ক্ষমতার সাতকাহন

শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ

: বুধবার, ২৪ জুলাই ২০২৪

সৃষ্টির শুরু থেকে অদ্যাবধি সমাজের প্রতিটি স্তরে কিছু অধরা ব্যক্তিকে ক্ষমতার দম্ভে আকাশে হেঁটে বেড়ানো দেখে অনেকেরই মন আঁকুপাঁকু করে ক্ষমতা নামক সোনার হরিণের সন্ধান লাভে। ক্ষমতা চায় না সমাজে এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রদর্শন প্রভাবে মানুষের আজীবন আরাধ্য হয়ে ওঠে পরাক্রান্ত ক্ষমতা। অন্যের ক্ষমতার অনলে পুড়ে ক্ষমতাবান হতে না পারার বেদনায় আইঢাই করে মন। তাহলে এ মহামূল্যবান ক্ষমতা আসলে কী, আমাদের জানা দরকার। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবীয় পরিসরে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রাধান্য হচ্ছে ক্ষমতা। অর্থাৎ সামাজিক জীবনে কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর প্রভাব বা আধিপত্য বিস্তার করাকেই ক্ষমতা বলা হয়। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী গধী ডবনবৎ এর মতে “চড়বিৎ রং ঃযব ধনরষরঃু ঃড় পড়হঃৎড়ষ ঃযব নবযধারড়ৎ ড়ভ ড়ঃযবৎং বাবহ রহ ঃযব ধনংবহপব ড়ভ ঃযবরৎ পড়হংবহঃ.” আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঘবরষ ঝসবষংবৎ এর মতে ‘‘চড়বিৎ রং ঃযব ধনরষরঃু ঃড় রসঢ়ড়ংব ড়হব’ং রিষষ ড়হ ড়ঃযবৎং ধহফ ঃযব ধনরষরঃু ঃড় সড়নরষরুব ৎবংড়ঁৎপব ঃড় ধপযরবাব ধ মড়ধষ.’’ ক্ষমতা বলতে শক্তি, কাজ করার সামর্থ্য বা দক্ষতাকে বুঝায়। মানুষ শক্তি, সামর্থ্য বা দক্ষতাসম্পন্ন হলেও তাকে ক্ষমতাবান বলা যায় না। শারীরিক শক্তি হয়তো প্রাধান্য বিস্তারে কিছুটা সহায়ক হতে পারে। কিন্তু কাজ করার সামর্থ্য বা দক্ষতা অন্যের ওপর প্রাধান্য বা প্রভাব বিস্তারে সহায়ক নয়। এক্ষেত্রে দরকার ক্ষমতাবান হওয়া। যাতে সমাজের মানুষ তার কথায় ওঠবস করে। তার ইশারায় সবকিছু হয়। সর্বত্র তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। ক্ষমতা মানুষকে আরাম দেয়, স্বাচ্ছন্দ্য দেয়, তৃপ্তি দেয়, আনন্দ দেয়। ভোগের অবারিত সুযোগ করে দেয়। ক্ষমতার মোহে মানুষ তার চিন্তাচেতনায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। যখন সেই ক্ষমতা নিজ স্বার্থ চরিতার্থে ব্যবহার করে তখন সেটি সমাজে ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। এতে মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়, লাঞ্ছিত হয়, নিষ্পেষিত হয়, অত্যাচারিত হয়, বঞ্চিত হয়, নিগৃহীত হয়। সে কারণে হয়তো আমরা সমাজে ক্ষমতাবান হওয়ার শুধু নেতিবাচক দিকটাই দেখি। এর ইতিবাচক দিকও যে আছে আমরা তা কখনো বোধে আনি না। যদি সমাজে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার প্রবল হয় তখন প্রয়োজন হয় সমাজ পরিবর্তনের। আর সমাজ পরিবর্তনে মানুষের ওপর প্রত্যক্ষ আধিপত্য বিস্তার আবশ্যক। এজন্য দরকার সুষ্ঠু নেতৃত্ব এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্ব। ক্ষমতা মানুষকে নেতৃত্ব দানের সুযোগ করে দেয়। অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। ফলে সমাজের মানুষকে বাধ্য করা যায় সব অসঙ্গতি দূর করতে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে। সামাজিক মূল্যবোধকে উন্নত করতে। মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করতে। এভাবে ক্ষমতা মানুষকে মহিমান্বিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সুযোগ দেয়। মানুষের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকার বর দেয়। এখানে মৌলিক প্রশ্ন হলো সমাজ পরিবর্তনে ক্ষমতার ধরন কী? এ ক্ষমতা অর্জনের উপায় কী, উৎসই বা কী? ক্ষমতাকে পরিমাপই বা করা যাবে কিভাবে? পদার্থবিজ্ঞানে প্রতি একক সময়ে স্থানান্তরিত বা রূপান্তরিত শক্তির পরিমাণকে ক্ষমতা বলে। আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা পরিমাপের একক হলো ওয়াট, যা প্রতি সেকেন্ডে এক জুলের সমান। শক্তি পরিমাপের আর একটি একক হলো হর্সপাওয়ার যেটি সাধারণত ইঞ্জিন বা মোটরের আউটপুটের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। হর্সপাওয়ার সাধারণত দুই ধরনের। ইম্পেরিয়াল হর্সপাওয়ার যা ৭৪৫.৭ ওয়াট এবং মেট্রিক হর্সপাওয়ার যা ৭৩৫.৫ ওয়াট। ঘোড়ার শক্তির সঙ্গে বাষ্প ইঞ্জিনের আউটপুট তুলনা করার জন্য ১৮ শতকের শেষের দিকে স্কটিশ প্রকৌশলী জেমস ওয়াট এই শব্দটি গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী ক্ষমতা পরিমাপ করা যায়; কিন্তু জি ফ্যাক্টর এর মাধ্যমে মানুষের সাধারণ বুদ্ধিমত্তা বা সাধারণ মানসিক ক্ষমতা পরিমাপ করা গেলেও সমাজবিজ্ঞানীরা অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর মানুষের আধিপত্য বিস্তারের ক্ষমতা পরিমাপের কোন উপায় উদ্ভাবন করতে পারেননি। এটি শুধু অনুধাবনের বিষয়, উপলব্ধির বিষয়, প্রত্যক্ষ করার বিষয়। এ ক্ষমতাকে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থানে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতে পারি। যেমনÑ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে আমরা বল প্রয়োগ করতে পারি। এটি দমনমূলক ক্ষমতা। আবার কোন ব্যক্তিকে উৎসাহ প্রদানের জন্য তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কোন পুরস্কার প্রদান করা যেতে পারে। এটি উপযোগিতামূলক ক্ষমতা। এছাড়া বিভিন্ন লোক একত্রিত হয়ে অভিন্ন স্বার্থে বল প্রয়োগ ছাড়া কোন গঠনমূলক ও গ্রহণযোগ্য ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। এটি আত্মপরিচয়মূলক ক্ষমতা। আবার মানুষের অবস্থান বা পদমর্যাদার কারণেও কেউ কেউ কিছু ক্ষমতার অধিকারী হন। যেমনÑ কোন প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার তার অবস্থানের কারণে অধস্তনদের ওপর আনুষ্ঠানিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। যাকে অবস্থান ক্ষমতা বলা হয়। এছাড়া রয়েছে বিশেষজ্ঞ ক্ষমতা। একজন ডাক্তার তার বিশেষজ্ঞ ক্ষমতা রোগীর ওপর আরোপ করতে পারেন। গধী ডবনবৎ এর মতে, আইনের দৃষ্টিতে ক্ষমতা বৈধ, অবৈধ দুই রকম হতে পারে। তিনি বৈধ ক্ষমতাকে আবার তিন ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমত, ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতা। সামাজিক রীতিনীতি এবং প্রথা অনুযায়ী বৈধতার স্বীকৃতির ভিত্তিতে এ ধরনের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত। দ্বিতীয়ত, কোন ব্যক্তি তার নিজস্ব গুণাবলির ভিত্তিতে অন্যের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। এটি সম্মোহনী ক্ষমতা। আবার রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী যখন কোন ব্যক্তির ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় তখন সেটি আইনানুগ ক্ষমতা। আইন বহির্ভূতভাবে কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করা হলে সেটি হবে অবৈধ ক্ষমতা। রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী ক্ষমতা তিন ধরনের। যেমনÑ কর্তৃত্বব্যঞ্জক ক্ষমতা, গণতান্ত্রিক ক্ষমতা এবং সর্বাত্মক ক্ষমতা। যখন কোন ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে তখন তাকে কর্তৃত্বব্যঞ্জক ক্ষমতা বলা হয়। ক্ষমতার উৎস যখন জনগণ, তখন তাকে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা বলে। আবার যখন কোন এক দল লোকের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে তখন তাকে বলা হয় সর্বাত্মক ক্ষমতা। প্রত্যেক ধরনের ক্ষমতার ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা দুটো দিকই আছে। কর্তৃত্ব যখন জনহিতকর হয় সেটি তখন সমাজ পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়। এটি মানুষের জন্য মঙ্গলজনক। কল্যাণকর। আবার এর বিপরীত হলে ক্ষমতা নিজ স্বার্থ চরিতার্থে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ অবারিত হয়। গণতান্ত্রিক ক্ষমতা ইতিবাচক হতে পারে তখনই, যখন সমাজে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত বজায় থাকে। তখন সঠিক নেতৃত্ব বাছাই করা সম্ভব হয়ে ওঠে। আর এর সুফল পায় সাধারণ মানুষ। অন্যথায় বুমেরাং হওয়াই স্বাভাবিক। সর্বাত্মক ক্ষমতার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ক্ষমতার উৎস ক্ষমতার ধরন অনুযায়ী হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত ক্ষমতার উৎস কী হবে সেটি নির্ভর করে ব্যক্তি প্রেক্ষাপট এবং বৈশিষ্ট্যের ওপর। ক্ষমতার এ উৎসগুলোর মধ্যে দক্ষতা, কর্তৃত্বের অবস্থান, ব্যক্তিগত গুণাবলি, জ্ঞান এবং শারীরিক শক্তি অন্যতম। কেউ কেউ অর্থবিত্তকে ক্ষমতার আর একটি উল্লেখযোগ্য উৎস হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ধরুন কোন ব্যক্তি কাউকে দিয়ে একটি কাজ করাতে চান। বিভিন্ন উপায়ে তিনি কাজটি করাতে পারেন। তিনি অস্ত্র উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে তাকে কাজটি করার জন্য বাধ্য করতে পারেন। আবার অর্থ দিয়ে অথবা অন্য কোন প্রলোভন দেখিয়ে তাকে দিয়ে কাজটি করিয়ে নিতে পারেন। এছাড়া তিনি স্বাভাবিকভাবে উক্ত ব্যক্তিকে কাজটি করতে বলায় ভয়-ভীতি বা প্রলোভন ব্যতিরেকে বিনা বাক্যব্যয়ে লোকটি কাজটি করে দিতে পারে। এটি হলো সম্মোহনী ক্ষমতা। কেউ কেউ এটিকে ক্যারিশম্যাটিক ক্ষমতা নামেও অভিহিত করে থাকেন। এটি একটি বিশেষ ক্ষমতা, ব্যতিক্রমী ক্ষমতা। মানুষের নিজস্ব গুণাবলি, জ্ঞান, মেধা, মূল্যবোধ, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, গ্রহণযোগ্যতা, অবস্থান ইত্যাদির ওপর এটি নির্ভর করে। একইসঙ্গে মানুষের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস, ভক্তি ও আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আর এটিই ক্ষমতার সর্বোত্তম উৎস বা পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সমাজে সব স্তরের ক্ষমতাবানরা যত বেশি সম্মোহনী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠবেন আপামর মানুষের জন্য তত বেশি কল্যাণ বয়ে আনবে। মঙ্গল বয়ে আনবে। আর এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

[লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক]

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

বন্যার বিভিন্ন ঝুঁকি ও করণীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

রম্যগদ্য : এ-পাস, না ও-পাস?

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

গৃহকর্মী নির্যাতনের অবসান হোক

মাঙ্কিপক্স : সতর্কতা ও সচেতনতা

সবার আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে

শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে

বাদী কিংবা বিবাদীর মৃত্যুতে আইনি ফলাফল কী?

নদ-নদীর সংজ্ঞার্থ ও সংখ্যা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবেশ ন্যায়বিচার

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কি দূর হবে

আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তহীন কাজ

নিষ্ঠার সাথে নিজের কাজটুকু করাই দেশপ্রেম

দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে

ছবি

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

ক্যাপিটল : মার্কিনিদের গণতন্ত্রের প্রতীক

হাওর উন্নয়নে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ক্ষমতার সাতকাহন

শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ

বুধবার, ২৪ জুলাই ২০২৪

সৃষ্টির শুরু থেকে অদ্যাবধি সমাজের প্রতিটি স্তরে কিছু অধরা ব্যক্তিকে ক্ষমতার দম্ভে আকাশে হেঁটে বেড়ানো দেখে অনেকেরই মন আঁকুপাঁকু করে ক্ষমতা নামক সোনার হরিণের সন্ধান লাভে। ক্ষমতা চায় না সমাজে এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রদর্শন প্রভাবে মানুষের আজীবন আরাধ্য হয়ে ওঠে পরাক্রান্ত ক্ষমতা। অন্যের ক্ষমতার অনলে পুড়ে ক্ষমতাবান হতে না পারার বেদনায় আইঢাই করে মন। তাহলে এ মহামূল্যবান ক্ষমতা আসলে কী, আমাদের জানা দরকার। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবীয় পরিসরে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রাধান্য হচ্ছে ক্ষমতা। অর্থাৎ সামাজিক জীবনে কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর প্রভাব বা আধিপত্য বিস্তার করাকেই ক্ষমতা বলা হয়। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী গধী ডবনবৎ এর মতে “চড়বিৎ রং ঃযব ধনরষরঃু ঃড় পড়হঃৎড়ষ ঃযব নবযধারড়ৎ ড়ভ ড়ঃযবৎং বাবহ রহ ঃযব ধনংবহপব ড়ভ ঃযবরৎ পড়হংবহঃ.” আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঘবরষ ঝসবষংবৎ এর মতে ‘‘চড়বিৎ রং ঃযব ধনরষরঃু ঃড় রসঢ়ড়ংব ড়হব’ং রিষষ ড়হ ড়ঃযবৎং ধহফ ঃযব ধনরষরঃু ঃড় সড়নরষরুব ৎবংড়ঁৎপব ঃড় ধপযরবাব ধ মড়ধষ.’’ ক্ষমতা বলতে শক্তি, কাজ করার সামর্থ্য বা দক্ষতাকে বুঝায়। মানুষ শক্তি, সামর্থ্য বা দক্ষতাসম্পন্ন হলেও তাকে ক্ষমতাবান বলা যায় না। শারীরিক শক্তি হয়তো প্রাধান্য বিস্তারে কিছুটা সহায়ক হতে পারে। কিন্তু কাজ করার সামর্থ্য বা দক্ষতা অন্যের ওপর প্রাধান্য বা প্রভাব বিস্তারে সহায়ক নয়। এক্ষেত্রে দরকার ক্ষমতাবান হওয়া। যাতে সমাজের মানুষ তার কথায় ওঠবস করে। তার ইশারায় সবকিছু হয়। সর্বত্র তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। ক্ষমতা মানুষকে আরাম দেয়, স্বাচ্ছন্দ্য দেয়, তৃপ্তি দেয়, আনন্দ দেয়। ভোগের অবারিত সুযোগ করে দেয়। ক্ষমতার মোহে মানুষ তার চিন্তাচেতনায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। যখন সেই ক্ষমতা নিজ স্বার্থ চরিতার্থে ব্যবহার করে তখন সেটি সমাজে ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। এতে মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়, লাঞ্ছিত হয়, নিষ্পেষিত হয়, অত্যাচারিত হয়, বঞ্চিত হয়, নিগৃহীত হয়। সে কারণে হয়তো আমরা সমাজে ক্ষমতাবান হওয়ার শুধু নেতিবাচক দিকটাই দেখি। এর ইতিবাচক দিকও যে আছে আমরা তা কখনো বোধে আনি না। যদি সমাজে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার প্রবল হয় তখন প্রয়োজন হয় সমাজ পরিবর্তনের। আর সমাজ পরিবর্তনে মানুষের ওপর প্রত্যক্ষ আধিপত্য বিস্তার আবশ্যক। এজন্য দরকার সুষ্ঠু নেতৃত্ব এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্ব। ক্ষমতা মানুষকে নেতৃত্ব দানের সুযোগ করে দেয়। অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। ফলে সমাজের মানুষকে বাধ্য করা যায় সব অসঙ্গতি দূর করতে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে। সামাজিক মূল্যবোধকে উন্নত করতে। মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করতে। এভাবে ক্ষমতা মানুষকে মহিমান্বিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সুযোগ দেয়। মানুষের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকার বর দেয়। এখানে মৌলিক প্রশ্ন হলো সমাজ পরিবর্তনে ক্ষমতার ধরন কী? এ ক্ষমতা অর্জনের উপায় কী, উৎসই বা কী? ক্ষমতাকে পরিমাপই বা করা যাবে কিভাবে? পদার্থবিজ্ঞানে প্রতি একক সময়ে স্থানান্তরিত বা রূপান্তরিত শক্তির পরিমাণকে ক্ষমতা বলে। আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা পরিমাপের একক হলো ওয়াট, যা প্রতি সেকেন্ডে এক জুলের সমান। শক্তি পরিমাপের আর একটি একক হলো হর্সপাওয়ার যেটি সাধারণত ইঞ্জিন বা মোটরের আউটপুটের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। হর্সপাওয়ার সাধারণত দুই ধরনের। ইম্পেরিয়াল হর্সপাওয়ার যা ৭৪৫.৭ ওয়াট এবং মেট্রিক হর্সপাওয়ার যা ৭৩৫.৫ ওয়াট। ঘোড়ার শক্তির সঙ্গে বাষ্প ইঞ্জিনের আউটপুট তুলনা করার জন্য ১৮ শতকের শেষের দিকে স্কটিশ প্রকৌশলী জেমস ওয়াট এই শব্দটি গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী ক্ষমতা পরিমাপ করা যায়; কিন্তু জি ফ্যাক্টর এর মাধ্যমে মানুষের সাধারণ বুদ্ধিমত্তা বা সাধারণ মানসিক ক্ষমতা পরিমাপ করা গেলেও সমাজবিজ্ঞানীরা অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর মানুষের আধিপত্য বিস্তারের ক্ষমতা পরিমাপের কোন উপায় উদ্ভাবন করতে পারেননি। এটি শুধু অনুধাবনের বিষয়, উপলব্ধির বিষয়, প্রত্যক্ষ করার বিষয়। এ ক্ষমতাকে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থানে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতে পারি। যেমনÑ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে আমরা বল প্রয়োগ করতে পারি। এটি দমনমূলক ক্ষমতা। আবার কোন ব্যক্তিকে উৎসাহ প্রদানের জন্য তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কোন পুরস্কার প্রদান করা যেতে পারে। এটি উপযোগিতামূলক ক্ষমতা। এছাড়া বিভিন্ন লোক একত্রিত হয়ে অভিন্ন স্বার্থে বল প্রয়োগ ছাড়া কোন গঠনমূলক ও গ্রহণযোগ্য ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। এটি আত্মপরিচয়মূলক ক্ষমতা। আবার মানুষের অবস্থান বা পদমর্যাদার কারণেও কেউ কেউ কিছু ক্ষমতার অধিকারী হন। যেমনÑ কোন প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার তার অবস্থানের কারণে অধস্তনদের ওপর আনুষ্ঠানিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। যাকে অবস্থান ক্ষমতা বলা হয়। এছাড়া রয়েছে বিশেষজ্ঞ ক্ষমতা। একজন ডাক্তার তার বিশেষজ্ঞ ক্ষমতা রোগীর ওপর আরোপ করতে পারেন। গধী ডবনবৎ এর মতে, আইনের দৃষ্টিতে ক্ষমতা বৈধ, অবৈধ দুই রকম হতে পারে। তিনি বৈধ ক্ষমতাকে আবার তিন ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমত, ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতা। সামাজিক রীতিনীতি এবং প্রথা অনুযায়ী বৈধতার স্বীকৃতির ভিত্তিতে এ ধরনের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত। দ্বিতীয়ত, কোন ব্যক্তি তার নিজস্ব গুণাবলির ভিত্তিতে অন্যের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। এটি সম্মোহনী ক্ষমতা। আবার রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী যখন কোন ব্যক্তির ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় তখন সেটি আইনানুগ ক্ষমতা। আইন বহির্ভূতভাবে কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করা হলে সেটি হবে অবৈধ ক্ষমতা। রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী ক্ষমতা তিন ধরনের। যেমনÑ কর্তৃত্বব্যঞ্জক ক্ষমতা, গণতান্ত্রিক ক্ষমতা এবং সর্বাত্মক ক্ষমতা। যখন কোন ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে তখন তাকে কর্তৃত্বব্যঞ্জক ক্ষমতা বলা হয়। ক্ষমতার উৎস যখন জনগণ, তখন তাকে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা বলে। আবার যখন কোন এক দল লোকের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে তখন তাকে বলা হয় সর্বাত্মক ক্ষমতা। প্রত্যেক ধরনের ক্ষমতার ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা দুটো দিকই আছে। কর্তৃত্ব যখন জনহিতকর হয় সেটি তখন সমাজ পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়। এটি মানুষের জন্য মঙ্গলজনক। কল্যাণকর। আবার এর বিপরীত হলে ক্ষমতা নিজ স্বার্থ চরিতার্থে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ অবারিত হয়। গণতান্ত্রিক ক্ষমতা ইতিবাচক হতে পারে তখনই, যখন সমাজে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত বজায় থাকে। তখন সঠিক নেতৃত্ব বাছাই করা সম্ভব হয়ে ওঠে। আর এর সুফল পায় সাধারণ মানুষ। অন্যথায় বুমেরাং হওয়াই স্বাভাবিক। সর্বাত্মক ক্ষমতার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ক্ষমতার উৎস ক্ষমতার ধরন অনুযায়ী হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত ক্ষমতার উৎস কী হবে সেটি নির্ভর করে ব্যক্তি প্রেক্ষাপট এবং বৈশিষ্ট্যের ওপর। ক্ষমতার এ উৎসগুলোর মধ্যে দক্ষতা, কর্তৃত্বের অবস্থান, ব্যক্তিগত গুণাবলি, জ্ঞান এবং শারীরিক শক্তি অন্যতম। কেউ কেউ অর্থবিত্তকে ক্ষমতার আর একটি উল্লেখযোগ্য উৎস হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ধরুন কোন ব্যক্তি কাউকে দিয়ে একটি কাজ করাতে চান। বিভিন্ন উপায়ে তিনি কাজটি করাতে পারেন। তিনি অস্ত্র উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে তাকে কাজটি করার জন্য বাধ্য করতে পারেন। আবার অর্থ দিয়ে অথবা অন্য কোন প্রলোভন দেখিয়ে তাকে দিয়ে কাজটি করিয়ে নিতে পারেন। এছাড়া তিনি স্বাভাবিকভাবে উক্ত ব্যক্তিকে কাজটি করতে বলায় ভয়-ভীতি বা প্রলোভন ব্যতিরেকে বিনা বাক্যব্যয়ে লোকটি কাজটি করে দিতে পারে। এটি হলো সম্মোহনী ক্ষমতা। কেউ কেউ এটিকে ক্যারিশম্যাটিক ক্ষমতা নামেও অভিহিত করে থাকেন। এটি একটি বিশেষ ক্ষমতা, ব্যতিক্রমী ক্ষমতা। মানুষের নিজস্ব গুণাবলি, জ্ঞান, মেধা, মূল্যবোধ, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, গ্রহণযোগ্যতা, অবস্থান ইত্যাদির ওপর এটি নির্ভর করে। একইসঙ্গে মানুষের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস, ভক্তি ও আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আর এটিই ক্ষমতার সর্বোত্তম উৎস বা পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সমাজে সব স্তরের ক্ষমতাবানরা যত বেশি সম্মোহনী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠবেন আপামর মানুষের জন্য তত বেশি কল্যাণ বয়ে আনবে। মঙ্গল বয়ে আনবে। আর এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

[লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক]

back to top