alt

উপ-সম্পাদকীয়

তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি

দোয়াবখ্শ শেখ

: শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

তামাক এবং ধূমপান, হার্টঅ্যাটাক, স্ট্রোক ও ফুসফুসের ব্যাধিসহ মুখ, গলা, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয়, মূত্রাশয়, কিডনি, লিভার এবং পাকস্থলির মতো একাধিক অঙ্গকে প্রভাবিত করে এবং ২০টিরও বেশি বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার রোগের বিস্তৃতি ঘটায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তামাকের মধ্যে থাকা নিকোটিনের অত্যন্ত আসক্তি এবং ফলত তামাকের ব্যবহার কার্ডিওভাসকুলার ও শ্বাসযন্ত্রের রোগসহ অন্যান্য রোগ দুর্বল স্বাস্থ্য ও মৃত্যুর প্রধান ঝুঁকির কারণ। ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী তামাক ব্যবহারের ফলে বিশ্বে প্রতি বছর ৮ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মারা যায়।

তামাক অধূমপায়ীদের জন্যও মারাত্মক হতে পারে। সেকেন্ড-হ্যান্ড ধূমপান স্বাস্থ্যের প্রতিকূল ফলাফলের সাথে জড়িত যার ফলে বছরে ১.২ মিলিয়ন মৃত্যু ঘটে। প্রায় অর্ধেক শিশু তামাকের ধোঁয়া দ্বারা দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেয় এবং ৬৫,০০০ শিশু গর্ভবতী থাকাকালীন ধূমপানের কারণে প্রতি বছর মারা যায়। গর্ভবতী থাকাকালীন ধূমপানে শিশুর জীবনব্যাপী স্বাস্থ্যগত অসুস্থার কারণ হতে পারে। তাই তামাক-সম্পর্কিত অসুস্থতা এবং মৃত্যুহার হ্রাস রোধে তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ একান্ত অপরিহার্য।

২০১৭ সালের এক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৩৭.৮ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিয়মিত তামাক সেবন করে। তাদের মধ্যে ১৯.২ মিলিয়ন ধূমপায়ী। অপরদিকে প্রায় ২২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে, যা মুখের ক্যান্সারের জন্য উচ্চ মাত্রায় অবদান রাখে। ধোঁয়াবিহীন তামাক জর্দা, গুল, খাইনি এবং সাদাপাতাসহ বিভিন্ন আকারে পাওয়া যায় এবং তাদের কম দাম এটিকে সবার কাছে সাশ্রয়ী করে তুলেছে। ক্রয় ও ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার জন্য কম দাম তামাকজাত পণ্য সবার কাছে সাশ্রয়ী করে তোলা রোধ করতে তামাকের ওপর অধিকতর আরোপ একটি কার্যকর কৌশল বলে স্বীকৃত। কিন্তু বাংলাদেশে কর কাঠামো বেশ জটিল এবং ভিত্তিমূল্য এখনও খুবই কম। এর পেছনেও যে তামাক কোম্পানির অদৃশ্য হস্তক্ষেপ রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তামাক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গ্লোবাল টোব্যাকো ইনডেক্স ২০২০ অনুসারে ৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ২৭তম স্থানে রয়েছে এবং ‘শিল্প হস্তক্ষেপ’ সূচক ৬৮, যা উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চস্তরে। একটি সর্বসম্মত ঐকমত্য রয়েছে যে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সীমিত বা বন্ধ করতে একটি কার্যকর তামাক কর কাঠামোর উপস্থিতি তামাক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেখানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টায় দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছে, সেখানে অন্যান্য সরকারি সংস্থা রয়েছে; যা তামাক কোম্পানিগুলো তামাকের প্রকোপ রোধে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলোকে বাধা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছে। এছাড়া কোম্পানির সরকারি শেয়ারও বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে একটি বড় বাধা।

প্রতি বছর তামাক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে। ক্রমবর্ধমানভাবে তরুণদের টার্গেট করা হয় প্রতি বছর যে ৮ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় তামাক ব্যবহারের ফলে তাদের প্রতিস্থাপন করার জন্য। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য শিশু ও যুবকদের তামাকের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ও আশু প্রয়োজন।

দেশের অধিকাংশ জনসংখ্যার একটি বড় অংশ হলো তরুণ। সিগারেট কোম্পানি এ তরুণদের ধূমপানে আকৃষ্ট করতে বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা চালাচ্ছে। বৈশ্বিক প্রমাণ ইঙ্গিত করে যে বর্তমান প্রাপ্তবয়স্ক তামাক ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই বয়ঃসন্ধিকালে তামাক ব্যবহার শুরু করে, যা বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত চলতে থাকে।

বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ১০ জন ধূমপায়ীর মধ্যে প্রায় ৯ জনই ১৮ বছর বয়সের আগে ধূমপান শুরু করে এবং ৯৮% ২৬ বছর বয়সে ধূমপান শুরু করে। নিকোটিন আসক্তির ফলে ১৩-১৫ বছর বয়সি ৪০ মিলিয়নেরও বেশি শিশু এবং কিশোর-কিশোরী ইতোমধ্যে তামাক ব্যবহার শুরু করেছে। এই শিশুদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল থেকে আসে। এ অঞ্চলের কিছু দেশে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের পারিবারিক আয় বাড়ানোর জন্য তামাক চাষে নিযুক্ত করা হয় এবং তারা সবুজ তামাক রোগসহ বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। তামাক চাষের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। সেইসংগে সিনেমা ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ধূমপানের দৃশ্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে শিশুদের ভবিষ্যত জীবন। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটির আরো সংশোধনের মাধ্যমে রক্ষা হতে পারে বাংলাদেশের শিশু স্বাস্থ্য।

বাংলাদেশসহ বিশ্বে যদিও গত ৫০ বছরে সামগ্রিক ধূমপানের হার অবশ্যই হ্রাস পেয়েছে, তবুও বেশ কয়েকটি দেশে এখনও সক্রিয় ধূমপায়ীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এরূপ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে তামাকজাত দ্রব্যের উচ্চ উৎপাদন এবং সেবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে, যার ফলে তামাকজনিত অসুস্থতার একটি ভারী বোঝা থেকে গেছে।

বাংলাদেশে তামাক ব্যবহার কারণে বছরে ১,৬১,০০০ মানুষ মারা যায় এবং ৩০,০০০ কোটি টাকা চিকিৎসা ব্যয় হয় যা রাজস্ব আয় হতে বেশি। বাংলাদেশ সরকার ‘ধূমপান এবং তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫’ প্রণয়ন করে। বাংলাদেশই প্রথম দেশ যারা ২০০৩ সালে ডব্লিউএইচও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল স্বাক্ষর করে, যা বিশ্বব্যাপী তামাক মহামারীর বিরুদ্ধে বিশ্বের প্রথম স্বাস্থ্য চুক্তি এবং মে ২০০৪ সালে এই চুক্তিটি অনুমোদনকারী প্রথম দেশগুলোর মধ্যেও ছিল। এই আইনে নির্বাচিত পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ধূমপান নিষিদ্ধ। পণ্যের প্যাকেজিংয়ে স্বাস্থ্য সতর্কতা সহ তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।

২০১৩ সালে আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে ধোঁয়াবিহীন তামাককে আইনের আওতায় আনা, আইনের বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি বৃদ্ধি ও তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে তামাক বিক্রি নিষিদ্ধ এবং তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকে গ্রাফিক হেলথ ওয়ার্নিং ছাপানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নিয়মগুলোও ২০১৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটির বিধিমালাগুলোও আপডেট করা হয়েছে। ফলত তামাক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ ইতোমধ্যেই ফলাফল দেখাতে শুরু করেছে। গ্লোবাল টোব্যাকো এপিডেমিক ২০১৫-এর ডব্লিউএইচও রিপোর্ট অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপানের প্রবণতা ৩৪.৬% থেকে ২০% এ নেমে এসেছে। আইনটি কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও আইনের কিছু ফাঁকফোকর এটিকে পুরোপুরি কার্যকর হতে বাধা দিয়েছে। আইনটি যথাযথ প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের কিছু ঘাটতি ও দুর্বলতা এখনও বিদ্যমান; যার ফলে পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ধূমপান, যত্রতত্র তামাকজাত পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও এসব পণ্যের অবৈধ বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা এখনও চলছে।

ডব্লিউএইচও তামাক এবং সংশ্লিষ্ট দিকগুলোকে শিশু এবং যুবকদের টার্গেট করা থেকে বন্ধ করতে সাহায্য করার জন্য সমস্ত সেক্টরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। যদি স্কুলগুলো সেলিব্রিটি এবং প্রভাবশালীরা যে কোনও ধরনের স্পনসরশিপ প্রত্যাখ্যান করে, টেলিভিশন এবং স্ট্রিমিং পরিষেবাগুলো স্ক্রিনে তামাক বা ই-সিগারেটের ব্যবহার দেখানো বন্ধ করে দেয়, সরকারি এবং আর্থিক খাত তামাক এবং সংশ্লিষ্ট দিকগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং সরকার সব ধরনের তামাকের বিজ্ঞাপন, প্রচার এবং পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ করে দেয়, তাহলে তামাকের ব্যবহার কমতে পারে।

এছাড়াও অধিকতর জনসচেতনতাসহ সরকারি সংস্থাগুলোকে নাগরিক সমাজ, এনজিও, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, মিডিয়া এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ পরামর্শকদের সাথে আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে; যাতে তামাক বিধিগুলো আরও ভালোভাবে প্রয়োগ করা যায় এবং তা কার্যকর করা যায়।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

বন্যার বিভিন্ন ঝুঁকি ও করণীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

রম্যগদ্য : এ-পাস, না ও-পাস?

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

গৃহকর্মী নির্যাতনের অবসান হোক

মাঙ্কিপক্স : সতর্কতা ও সচেতনতা

সবার আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে

শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে

বাদী কিংবা বিবাদীর মৃত্যুতে আইনি ফলাফল কী?

নদ-নদীর সংজ্ঞার্থ ও সংখ্যা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবেশ ন্যায়বিচার

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কি দূর হবে

আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তহীন কাজ

নিষ্ঠার সাথে নিজের কাজটুকু করাই দেশপ্রেম

দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে

ছবি

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

ক্যাপিটল : মার্কিনিদের গণতন্ত্রের প্রতীক

হাওর উন্নয়নে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি

দোয়াবখ্শ শেখ

শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

তামাক এবং ধূমপান, হার্টঅ্যাটাক, স্ট্রোক ও ফুসফুসের ব্যাধিসহ মুখ, গলা, ফুসফুস, অগ্ন্যাশয়, মূত্রাশয়, কিডনি, লিভার এবং পাকস্থলির মতো একাধিক অঙ্গকে প্রভাবিত করে এবং ২০টিরও বেশি বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার রোগের বিস্তৃতি ঘটায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তামাকের মধ্যে থাকা নিকোটিনের অত্যন্ত আসক্তি এবং ফলত তামাকের ব্যবহার কার্ডিওভাসকুলার ও শ্বাসযন্ত্রের রোগসহ অন্যান্য রোগ দুর্বল স্বাস্থ্য ও মৃত্যুর প্রধান ঝুঁকির কারণ। ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী তামাক ব্যবহারের ফলে বিশ্বে প্রতি বছর ৮ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মারা যায়।

তামাক অধূমপায়ীদের জন্যও মারাত্মক হতে পারে। সেকেন্ড-হ্যান্ড ধূমপান স্বাস্থ্যের প্রতিকূল ফলাফলের সাথে জড়িত যার ফলে বছরে ১.২ মিলিয়ন মৃত্যু ঘটে। প্রায় অর্ধেক শিশু তামাকের ধোঁয়া দ্বারা দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেয় এবং ৬৫,০০০ শিশু গর্ভবতী থাকাকালীন ধূমপানের কারণে প্রতি বছর মারা যায়। গর্ভবতী থাকাকালীন ধূমপানে শিশুর জীবনব্যাপী স্বাস্থ্যগত অসুস্থার কারণ হতে পারে। তাই তামাক-সম্পর্কিত অসুস্থতা এবং মৃত্যুহার হ্রাস রোধে তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ একান্ত অপরিহার্য।

২০১৭ সালের এক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৩৭.৮ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিয়মিত তামাক সেবন করে। তাদের মধ্যে ১৯.২ মিলিয়ন ধূমপায়ী। অপরদিকে প্রায় ২২ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে, যা মুখের ক্যান্সারের জন্য উচ্চ মাত্রায় অবদান রাখে। ধোঁয়াবিহীন তামাক জর্দা, গুল, খাইনি এবং সাদাপাতাসহ বিভিন্ন আকারে পাওয়া যায় এবং তাদের কম দাম এটিকে সবার কাছে সাশ্রয়ী করে তুলেছে। ক্রয় ও ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার জন্য কম দাম তামাকজাত পণ্য সবার কাছে সাশ্রয়ী করে তোলা রোধ করতে তামাকের ওপর অধিকতর আরোপ একটি কার্যকর কৌশল বলে স্বীকৃত। কিন্তু বাংলাদেশে কর কাঠামো বেশ জটিল এবং ভিত্তিমূল্য এখনও খুবই কম। এর পেছনেও যে তামাক কোম্পানির অদৃশ্য হস্তক্ষেপ রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তামাক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গ্লোবাল টোব্যাকো ইনডেক্স ২০২০ অনুসারে ৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ২৭তম স্থানে রয়েছে এবং ‘শিল্প হস্তক্ষেপ’ সূচক ৬৮, যা উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চস্তরে। একটি সর্বসম্মত ঐকমত্য রয়েছে যে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সীমিত বা বন্ধ করতে একটি কার্যকর তামাক কর কাঠামোর উপস্থিতি তামাক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেখানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টায় দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছে, সেখানে অন্যান্য সরকারি সংস্থা রয়েছে; যা তামাক কোম্পানিগুলো তামাকের প্রকোপ রোধে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলোকে বাধা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছে। এছাড়া কোম্পানির সরকারি শেয়ারও বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে একটি বড় বাধা।

প্রতি বছর তামাক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে। ক্রমবর্ধমানভাবে তরুণদের টার্গেট করা হয় প্রতি বছর যে ৮ মিলিয়ন মানুষ মারা যায় তামাক ব্যবহারের ফলে তাদের প্রতিস্থাপন করার জন্য। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য শিশু ও যুবকদের তামাকের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ও আশু প্রয়োজন।

দেশের অধিকাংশ জনসংখ্যার একটি বড় অংশ হলো তরুণ। সিগারেট কোম্পানি এ তরুণদের ধূমপানে আকৃষ্ট করতে বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা চালাচ্ছে। বৈশ্বিক প্রমাণ ইঙ্গিত করে যে বর্তমান প্রাপ্তবয়স্ক তামাক ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই বয়ঃসন্ধিকালে তামাক ব্যবহার শুরু করে, যা বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত চলতে থাকে।

বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ১০ জন ধূমপায়ীর মধ্যে প্রায় ৯ জনই ১৮ বছর বয়সের আগে ধূমপান শুরু করে এবং ৯৮% ২৬ বছর বয়সে ধূমপান শুরু করে। নিকোটিন আসক্তির ফলে ১৩-১৫ বছর বয়সি ৪০ মিলিয়নেরও বেশি শিশু এবং কিশোর-কিশোরী ইতোমধ্যে তামাক ব্যবহার শুরু করেছে। এই শিশুদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল থেকে আসে। এ অঞ্চলের কিছু দেশে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের পারিবারিক আয় বাড়ানোর জন্য তামাক চাষে নিযুক্ত করা হয় এবং তারা সবুজ তামাক রোগসহ বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। তামাক চাষের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। সেইসংগে সিনেমা ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ধূমপানের দৃশ্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে শিশুদের ভবিষ্যত জীবন। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটির আরো সংশোধনের মাধ্যমে রক্ষা হতে পারে বাংলাদেশের শিশু স্বাস্থ্য।

বাংলাদেশসহ বিশ্বে যদিও গত ৫০ বছরে সামগ্রিক ধূমপানের হার অবশ্যই হ্রাস পেয়েছে, তবুও বেশ কয়েকটি দেশে এখনও সক্রিয় ধূমপায়ীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এরূপ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে তামাকজাত দ্রব্যের উচ্চ উৎপাদন এবং সেবনের অভিজ্ঞতা রয়েছে, যার ফলে তামাকজনিত অসুস্থতার একটি ভারী বোঝা থেকে গেছে।

বাংলাদেশে তামাক ব্যবহার কারণে বছরে ১,৬১,০০০ মানুষ মারা যায় এবং ৩০,০০০ কোটি টাকা চিকিৎসা ব্যয় হয় যা রাজস্ব আয় হতে বেশি। বাংলাদেশ সরকার ‘ধূমপান এবং তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫’ প্রণয়ন করে। বাংলাদেশই প্রথম দেশ যারা ২০০৩ সালে ডব্লিউএইচও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল স্বাক্ষর করে, যা বিশ্বব্যাপী তামাক মহামারীর বিরুদ্ধে বিশ্বের প্রথম স্বাস্থ্য চুক্তি এবং মে ২০০৪ সালে এই চুক্তিটি অনুমোদনকারী প্রথম দেশগুলোর মধ্যেও ছিল। এই আইনে নির্বাচিত পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ধূমপান নিষিদ্ধ। পণ্যের প্যাকেজিংয়ে স্বাস্থ্য সতর্কতা সহ তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।

২০১৩ সালে আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে ধোঁয়াবিহীন তামাককে আইনের আওতায় আনা, আইনের বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি বৃদ্ধি ও তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে তামাক বিক্রি নিষিদ্ধ এবং তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকে গ্রাফিক হেলথ ওয়ার্নিং ছাপানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নিয়মগুলোও ২০১৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটির বিধিমালাগুলোও আপডেট করা হয়েছে। ফলত তামাক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ ইতোমধ্যেই ফলাফল দেখাতে শুরু করেছে। গ্লোবাল টোব্যাকো এপিডেমিক ২০১৫-এর ডব্লিউএইচও রিপোর্ট অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপানের প্রবণতা ৩৪.৬% থেকে ২০% এ নেমে এসেছে। আইনটি কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও আইনের কিছু ফাঁকফোকর এটিকে পুরোপুরি কার্যকর হতে বাধা দিয়েছে। আইনটি যথাযথ প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের কিছু ঘাটতি ও দুর্বলতা এখনও বিদ্যমান; যার ফলে পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ধূমপান, যত্রতত্র তামাকজাত পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও এসব পণ্যের অবৈধ বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা এখনও চলছে।

ডব্লিউএইচও তামাক এবং সংশ্লিষ্ট দিকগুলোকে শিশু এবং যুবকদের টার্গেট করা থেকে বন্ধ করতে সাহায্য করার জন্য সমস্ত সেক্টরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। যদি স্কুলগুলো সেলিব্রিটি এবং প্রভাবশালীরা যে কোনও ধরনের স্পনসরশিপ প্রত্যাখ্যান করে, টেলিভিশন এবং স্ট্রিমিং পরিষেবাগুলো স্ক্রিনে তামাক বা ই-সিগারেটের ব্যবহার দেখানো বন্ধ করে দেয়, সরকারি এবং আর্থিক খাত তামাক এবং সংশ্লিষ্ট দিকগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং সরকার সব ধরনের তামাকের বিজ্ঞাপন, প্রচার এবং পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ করে দেয়, তাহলে তামাকের ব্যবহার কমতে পারে।

এছাড়াও অধিকতর জনসচেতনতাসহ সরকারি সংস্থাগুলোকে নাগরিক সমাজ, এনজিও, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, মিডিয়া এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ পরামর্শকদের সাথে আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে; যাতে তামাক বিধিগুলো আরও ভালোভাবে প্রয়োগ করা যায় এবং তা কার্যকর করা যায়।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

back to top