রেজাউল করিম খোকন
দেশের অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সবার জন্য সমান অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি। সমাজ সভ্যতার পরিবর্তন ঘটছে খুব দ্রুত। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রাত্যহিক কর্মকা-েও নানা পালাবদল ঘটছে। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকা-ও বদলে গেছে। বলা যায়, অনেক ক্ষেত্রে সহজ-সাবলীল হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক কলাকৌশলের প্রয়োগে অনেকটা টেকনিক্যাল হয়ে উঠেছে। ৫০ কিংবা ১০০ বছর আগের মতো অর্থনৈতিক কর্মকা- কিছু নির্ধারিত বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংক, বিমা এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। এই সব প্রতিষ্ঠান নানাভাবে মানুষকে আর্থিক সেবা দিয়ে যাচ্ছে। মানুষ আজকাল এইসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এড়িয়ে ব্যবসাবাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, কোনোটাই করতে পারে না। অতীতে একজন মানুষ ব্যাংকে না গিয়েও ঠিকই জীবন চালিয়ে নিতে পারলেও এখন তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর এই অর্থনৈতিক কর্মকা-কে সঠিক, নিরাপদ, লাভজনক এবং স্থিতিশীল রাখার জন্য নানা ধরনের আর্থিক জ্ঞান থাকা জরুরি হয়ে উঠেছে। যার ফলে এখন আর্থিক শিক্ষা বা ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সবার জন্য।
সঠিক আর্থিক জ্ঞান না থাকায় এখন অনেকের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকা- দারুণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ব্যাংকিং কর্মকা-, ব্যবসাবাণিজ্য, দৈনন্দিন আর্থিক লেনদেন প্রভৃতিতে আর্থিক শিক্ষা মানে ফাইন্যন্সিয়াল লিটারেসির যথার্থ প্রয়োগ এবং গুরুত্বের বিষয়টি এখন সবাই উপলব্ধি করছেন। ব্যাংকে হিসাব খোলা, আর্থিক লেনদেন করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সঞ্চয়ী স্কিমে টাকা জমা করার মাধ্যমে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন এবং তার নিরাপত্ত নিশ্চিত করা সবকিছুতেই আর্থিক নানা কৌশল জানা থাকা প্রয়োজন। যার অভাবে ব্যাংকে নিজের জন্য মানানসই লাভজনক সঞ্চয় স্কিমটি নির্বাচন করতে গিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়ছেন।
আবার কেউ ভুল পথে পরিচালিত হয়ে অহেতুক আর্থিক গচ্চার শিকার হচ্ছেন। সঠিক আর্থিক শিক্ষা বা জ্ঞানের অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ নানাভাবে প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন। মাঝে মধ্যে পত্রপত্রিকায় সমবায় সমিতি, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির নামে বিভিন্ন প্রতারক চক্রের লোভনীয় ফাঁদে পড়ে কোটি কোটি টাকা হারিয়ে সহজ-সরল সাধারণ মানুষের নিঃস্ব রিক্ত হয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির চর্চা থাকলে প্রতারক চক্র এভাবে সহজ সরল সাধারণ মানুষকে নয়-ছয় বুঝিয়ে, অবিশ্বাস্য মুনাফার লোভ দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ পেত না কোনোভাবেই।
শেয়ারবাজারে না বুঝে, না জেনে স্রেফ হুজুগে মেতে রাতারাতি অনেক টাকার মালিক হয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিজের সর্বস্ব ভিটে মাটি সম্বল বিক্রি করে, বন্ধক রেখে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছিল অনেকেই, ন্যূনতম আর্থিক শিক্ষা অর্থাৎ ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি থাকলে এভাবে আত্মঘাতী আর্থিক কর্মকা-ে কেউ কোনোভাবেই লিপ্ত হতেন না। আজও শেয়ার ব্যবসায় সর্বস্ব হারানো অনেক মানুষ চরম দুরবস্থা এবং অসহায়ত্বের মধ্যে দিনযাপন করছেন। তাদের দীর্ঘশ্বাস আর আর্তনাদে বুক ভারী হয়ে ওঠে সবার। নিজেদের অজ্ঞতা এবং অসতর্কতার কারণেই তারা ভুল পথে পরিচালিত হয়েছিলেন, এটা এখন ঠিকই উপলব্ধি করছেন।
যদি আর্থিক শিক্ষার যথার্থ বিকাশ ঘটত এখানে তাহলে এত বড় বিপর্যয়ের শিকার হতে হতো না হতভাগ্য মানুষগুলোকে। এসব কারণেই এখন ফাইন্যান্সিয়াল লিটারিসির গুরুত্ব এবং এর যথার্থ প্রয়োগ নিয়ে সবাই ভাবছেন। ফাইন্যন্সিয়াল লিটারেসির জন্য বাণিজ্য কিংবা হিসাববিজ্ঞান কিংবা অর্থনীতি, ব্যবসা প্রশাসন বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রির প্রয়োজন নেই। আর্থিক লেনদেনকে নিরাপদ, নিশ্চিত, লাভজনক এবং টেকসই করতে কিছু ন্যূনতম জ্ঞান থাকা জরুরি সবার। আর এটাকেই ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি বা আর্থিক শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির যথার্থ বিকাশ হলে ব্যাংকিং খাত, আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য, খুচরা-পাইকারি ব্যবসা সবই নিরাপদ হয়ে উঠবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। গত এক দশকে যেসব আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে আমাদের ব্যাংকিং খাতে তার পেছনেও আর্থিক শিক্ষার অর্থাৎ ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির অভাবকে দায়ি করা যেতে পারে অনেকাংশে। ব্যাংকারদের মধ্যে কারো কারো যথার্থ আর্থিক শিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তার অভাব হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংকের লোপাট কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলোর জন্য অনেকটাই দায়ী। এটা অনেক আর্থিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক মন্তব্যও করেছেন।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়ছে দিনে দিনে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণের অর্থকে কীভাবে ব্যবসাবাণিজ্য, কিংবা শিল্প উদ্যোগে যথাযথভাবে ব্যবহারের আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কে তেমন কেছু জানেন না অনেক ঋণগ্রহীতা। ফলে তারা ঋণের অর্থের সদ্ব্যবহার করতে পারেন না, যে কারণে তাদের ব্যবসা কিংবা শিল্প উদ্যোগ লাভজনক হওয়ার বদলে লোকসানমুখী হয়ে পড়ে। এভাবেই ব্যবসায় মার খেতে খেতে, লোকসান গুনতে গুনতে তারা ব্যাংকের ঋণের অর্থ যথাসময়ে ফেরত দিতে ব্যর্থ হন। এক সময়ে তারা ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন। ব্যাংক ঋণের অর্থ ব্যবসাবাণিজ্য শিল্প উদ্যোগে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করে, তা না মেনে উপায় নেই। কোন সময়ে কোন ব্যবসাটি লাভজনক হবে তা ঠিক না করতে পারলে ভুল পথে বিনিয়োগ করলে সে ব্যবসায় লোকসান ছাড়া লাভের আশা করা বৃথা।
বাংলাদেশ উন্নয়নের নানা ধাপ অতিক্রম করে ক্রমেই এগিয়ে চলেছে। দরিদ্র দেশ হিসেবে একসময়ে দুনিয়াজুড়ে পরিচিতি থাকলেও এখন সবাই বাংলাদেশকে নিম্নœ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে চেনে। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সমাজের সর্বস্তরের নারী-পুরুষকে সামিল করতে সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহারের পাশাপাশি উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে জরুরিভাবে। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কর্মকা-কে আরো গতিশীল এবং নিরাপদ করতে হবে।
গ্রামের দরিদ্র নি¤œবিত্ত কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষগুলো এমনিতেই অজ্ঞতা, নিরক্ষতা, দুর্বল সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে নানাভাবে শোষণ বঞ্চনা নিপীড়ন নিগ্রহের শিকার হয়। অপেক্ষাকৃত শক্ত সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থানের মানুষগুলো দরিদ্র, অশিক্ষিত, গরিব কৃষক, সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, সারল্য এবং অসহায়ত্বের সুযোগে নানাভাবে প্রতারিত করে। সহজ-সরল সাধারণ মানুষগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকা- গ্রামীণ টাউট, বাটপার, সুদখোর মহাজন, রাজনৈতিক মাস্তানদের প্রতরণার শিকার হয়ে ভিটেমাটি হারায়, সঞ্চিত টাকা-পয়সা স্বর্ণালঙ্কারসহ সব সম্বল খোয়ায়। ন্যূনতম আর্থিক জ্ঞান না থাকায় তারা পদে পদে শোষণ বঞ্চনা প্রতারণার শিকার হয়। এটা গ্রামের মতো শহরেও নি¤œ আয়ের লোকজনদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। বঞ্চনা প্রতারণা শোষণের দুষ্টচক্র থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারে না আর্থিক বিষয়ে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম জ্ঞান না থাকার কারণে। এক্ষেত্রে তাদের অসচেতনতাও একটি বড় ব্যাপার সন্দেহ নেই।
অভাব, অস্বচ্ছলতা, দারিদ্রের চরম কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে প্রাত্যাহিক নানা ব্যয় মেটাতে এবং অসুস্থতায় চিকিৎসা, ছেলেকন্যার বিয়ে, ঘরবাড়ি তৈরির অথবা মেরামতের জন্য ঋণগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে সেই ঋণের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের ভিটেমাটি, শেষ সম্বল সবই সুযোগসন্ধানী মতলববাজ, টাউট ঋণ দাতাদের হাতে অকাতরে তুলে দিতে বাধ্য হয় তারা। বাংলাদেশে দারিদ্রতা দূরীকরণে ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা চালু হয়েছে বহু আগেই।
আজকাল শহর ও গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই নিজেদের নানা প্রয়োজনে অনেকেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন ধরনের ঋণ নিতে দেখা যায়। এর মধ্যে ব্যক্তিগত ঋণ (পার্সোনেল লোন), গৃহনির্মাণ ঋণ, ভোগ্যপণ্য ঋণ, কার লোন প্রভৃতির কথা বলা যায়। কিন্তু ঋণগ্রহীতাদের যথার্থ ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসির অর্থাৎ আর্থিক সাক্ষরতার অভাবে তারা সেই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ব্যাংকের কোন ঋণটি তার জন্য সুবিধাজনক কিংবা কোন ঋণের পরিশোধের পদ্ধতি সহজ তা বোঝার জন্য উপলব্ধির জন্য কিছু আর্থিক জ্ঞান ও কলাকৌশল জানার প্রয়োজন রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী কার্যকর এবং টেকসই করে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্যোগে গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পরিচালনা করা হয় এজন্য।
কিন্তু এসব কর্মসূচি আশানুরূপ সুফল বয়ে আনতে পারছে না জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশের আর্থিক সাক্ষরতার অভাবে। যদি সমাজের বিভিন্ন স্তরে অর্থনৈতিক সাক্ষরতা বা ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির যথাযথ বিকাশ ঘটত তাহলে আজকের বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার চেয়ে আরো অনেক দূর সামনে এগিয়ে যেতে পারত অনায়াসেই। অর্থনীতির মূলধারার বাইরে রয়েছেন যারা তারাও সামিল হতে পারতেন এর সুফল হিসেবে। এখনও ব্যাংকিং কর্মকা-ের বাইরে রয়েছেন সমাজের বিরাট একটি অংশের মানুষ। ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি তাদের খুব সহজেই ব্যাংকিং কর্মকা-ে উদ্ধুদ্ধ এবং উৎসাহী করে তুলতে পারে।
বিশ্বব্যাপী আজ ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশেষ করে দুনিয়াজুড়ে আর্থিক মন্দা দূরীকরণে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অর্থনৈতিক সাক্ষরতা বা ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি দারুন গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সম্পদের সুষম বণ্টন, ধনী দরিদ্রের আয় বৈষম্য প্রভৃতি দূরীকরণে প্রত্যেককে সচেতন এবং সচেষ্ট করে তুলতে বর্তমান সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির কোনো বিকল্প নেই।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট ২০২৪
দেশের অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সবার জন্য সমান অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি। সমাজ সভ্যতার পরিবর্তন ঘটছে খুব দ্রুত। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রাত্যহিক কর্মকা-েও নানা পালাবদল ঘটছে। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকা-ও বদলে গেছে। বলা যায়, অনেক ক্ষেত্রে সহজ-সাবলীল হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক কলাকৌশলের প্রয়োগে অনেকটা টেকনিক্যাল হয়ে উঠেছে। ৫০ কিংবা ১০০ বছর আগের মতো অর্থনৈতিক কর্মকা- কিছু নির্ধারিত বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংক, বিমা এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। এই সব প্রতিষ্ঠান নানাভাবে মানুষকে আর্থিক সেবা দিয়ে যাচ্ছে। মানুষ আজকাল এইসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এড়িয়ে ব্যবসাবাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, কোনোটাই করতে পারে না। অতীতে একজন মানুষ ব্যাংকে না গিয়েও ঠিকই জীবন চালিয়ে নিতে পারলেও এখন তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর এই অর্থনৈতিক কর্মকা-কে সঠিক, নিরাপদ, লাভজনক এবং স্থিতিশীল রাখার জন্য নানা ধরনের আর্থিক জ্ঞান থাকা জরুরি হয়ে উঠেছে। যার ফলে এখন আর্থিক শিক্ষা বা ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সবার জন্য।
সঠিক আর্থিক জ্ঞান না থাকায় এখন অনেকের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকা- দারুণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ব্যাংকিং কর্মকা-, ব্যবসাবাণিজ্য, দৈনন্দিন আর্থিক লেনদেন প্রভৃতিতে আর্থিক শিক্ষা মানে ফাইন্যন্সিয়াল লিটারেসির যথার্থ প্রয়োগ এবং গুরুত্বের বিষয়টি এখন সবাই উপলব্ধি করছেন। ব্যাংকে হিসাব খোলা, আর্থিক লেনদেন করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সঞ্চয়ী স্কিমে টাকা জমা করার মাধ্যমে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন এবং তার নিরাপত্ত নিশ্চিত করা সবকিছুতেই আর্থিক নানা কৌশল জানা থাকা প্রয়োজন। যার অভাবে ব্যাংকে নিজের জন্য মানানসই লাভজনক সঞ্চয় স্কিমটি নির্বাচন করতে গিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়ছেন।
আবার কেউ ভুল পথে পরিচালিত হয়ে অহেতুক আর্থিক গচ্চার শিকার হচ্ছেন। সঠিক আর্থিক শিক্ষা বা জ্ঞানের অভাবে আমাদের দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ নানাভাবে প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন। মাঝে মধ্যে পত্রপত্রিকায় সমবায় সমিতি, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির নামে বিভিন্ন প্রতারক চক্রের লোভনীয় ফাঁদে পড়ে কোটি কোটি টাকা হারিয়ে সহজ-সরল সাধারণ মানুষের নিঃস্ব রিক্ত হয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির চর্চা থাকলে প্রতারক চক্র এভাবে সহজ সরল সাধারণ মানুষকে নয়-ছয় বুঝিয়ে, অবিশ্বাস্য মুনাফার লোভ দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ পেত না কোনোভাবেই।
শেয়ারবাজারে না বুঝে, না জেনে স্রেফ হুজুগে মেতে রাতারাতি অনেক টাকার মালিক হয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিজের সর্বস্ব ভিটে মাটি সম্বল বিক্রি করে, বন্ধক রেখে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছিল অনেকেই, ন্যূনতম আর্থিক শিক্ষা অর্থাৎ ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি থাকলে এভাবে আত্মঘাতী আর্থিক কর্মকা-ে কেউ কোনোভাবেই লিপ্ত হতেন না। আজও শেয়ার ব্যবসায় সর্বস্ব হারানো অনেক মানুষ চরম দুরবস্থা এবং অসহায়ত্বের মধ্যে দিনযাপন করছেন। তাদের দীর্ঘশ্বাস আর আর্তনাদে বুক ভারী হয়ে ওঠে সবার। নিজেদের অজ্ঞতা এবং অসতর্কতার কারণেই তারা ভুল পথে পরিচালিত হয়েছিলেন, এটা এখন ঠিকই উপলব্ধি করছেন।
যদি আর্থিক শিক্ষার যথার্থ বিকাশ ঘটত এখানে তাহলে এত বড় বিপর্যয়ের শিকার হতে হতো না হতভাগ্য মানুষগুলোকে। এসব কারণেই এখন ফাইন্যান্সিয়াল লিটারিসির গুরুত্ব এবং এর যথার্থ প্রয়োগ নিয়ে সবাই ভাবছেন। ফাইন্যন্সিয়াল লিটারেসির জন্য বাণিজ্য কিংবা হিসাববিজ্ঞান কিংবা অর্থনীতি, ব্যবসা প্রশাসন বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রির প্রয়োজন নেই। আর্থিক লেনদেনকে নিরাপদ, নিশ্চিত, লাভজনক এবং টেকসই করতে কিছু ন্যূনতম জ্ঞান থাকা জরুরি সবার। আর এটাকেই ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি বা আর্থিক শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির যথার্থ বিকাশ হলে ব্যাংকিং খাত, আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য, খুচরা-পাইকারি ব্যবসা সবই নিরাপদ হয়ে উঠবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। গত এক দশকে যেসব আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে আমাদের ব্যাংকিং খাতে তার পেছনেও আর্থিক শিক্ষার অর্থাৎ ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির অভাবকে দায়ি করা যেতে পারে অনেকাংশে। ব্যাংকারদের মধ্যে কারো কারো যথার্থ আর্থিক শিক্ষা ও বুদ্ধিমত্তার অভাব হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংকের লোপাট কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলোর জন্য অনেকটাই দায়ী। এটা অনেক আর্থিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষক মন্তব্যও করেছেন।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়ছে দিনে দিনে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণের অর্থকে কীভাবে ব্যবসাবাণিজ্য, কিংবা শিল্প উদ্যোগে যথাযথভাবে ব্যবহারের আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কে তেমন কেছু জানেন না অনেক ঋণগ্রহীতা। ফলে তারা ঋণের অর্থের সদ্ব্যবহার করতে পারেন না, যে কারণে তাদের ব্যবসা কিংবা শিল্প উদ্যোগ লাভজনক হওয়ার বদলে লোকসানমুখী হয়ে পড়ে। এভাবেই ব্যবসায় মার খেতে খেতে, লোকসান গুনতে গুনতে তারা ব্যাংকের ঋণের অর্থ যথাসময়ে ফেরত দিতে ব্যর্থ হন। এক সময়ে তারা ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন। ব্যাংক ঋণের অর্থ ব্যবসাবাণিজ্য শিল্প উদ্যোগে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করে, তা না মেনে উপায় নেই। কোন সময়ে কোন ব্যবসাটি লাভজনক হবে তা ঠিক না করতে পারলে ভুল পথে বিনিয়োগ করলে সে ব্যবসায় লোকসান ছাড়া লাভের আশা করা বৃথা।
বাংলাদেশ উন্নয়নের নানা ধাপ অতিক্রম করে ক্রমেই এগিয়ে চলেছে। দরিদ্র দেশ হিসেবে একসময়ে দুনিয়াজুড়ে পরিচিতি থাকলেও এখন সবাই বাংলাদেশকে নিম্নœ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে চেনে। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সমাজের সর্বস্তরের নারী-পুরুষকে সামিল করতে সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহারের পাশাপাশি উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে জরুরিভাবে। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কর্মকা-কে আরো গতিশীল এবং নিরাপদ করতে হবে।
গ্রামের দরিদ্র নি¤œবিত্ত কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষগুলো এমনিতেই অজ্ঞতা, নিরক্ষতা, দুর্বল সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে নানাভাবে শোষণ বঞ্চনা নিপীড়ন নিগ্রহের শিকার হয়। অপেক্ষাকৃত শক্ত সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থানের মানুষগুলো দরিদ্র, অশিক্ষিত, গরিব কৃষক, সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, সারল্য এবং অসহায়ত্বের সুযোগে নানাভাবে প্রতারিত করে। সহজ-সরল সাধারণ মানুষগুলোর অর্থনৈতিক কর্মকা- গ্রামীণ টাউট, বাটপার, সুদখোর মহাজন, রাজনৈতিক মাস্তানদের প্রতরণার শিকার হয়ে ভিটেমাটি হারায়, সঞ্চিত টাকা-পয়সা স্বর্ণালঙ্কারসহ সব সম্বল খোয়ায়। ন্যূনতম আর্থিক জ্ঞান না থাকায় তারা পদে পদে শোষণ বঞ্চনা প্রতারণার শিকার হয়। এটা গ্রামের মতো শহরেও নি¤œ আয়ের লোকজনদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। বঞ্চনা প্রতারণা শোষণের দুষ্টচক্র থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারে না আর্থিক বিষয়ে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম জ্ঞান না থাকার কারণে। এক্ষেত্রে তাদের অসচেতনতাও একটি বড় ব্যাপার সন্দেহ নেই।
অভাব, অস্বচ্ছলতা, দারিদ্রের চরম কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে প্রাত্যাহিক নানা ব্যয় মেটাতে এবং অসুস্থতায় চিকিৎসা, ছেলেকন্যার বিয়ে, ঘরবাড়ি তৈরির অথবা মেরামতের জন্য ঋণগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে সেই ঋণের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের ভিটেমাটি, শেষ সম্বল সবই সুযোগসন্ধানী মতলববাজ, টাউট ঋণ দাতাদের হাতে অকাতরে তুলে দিতে বাধ্য হয় তারা। বাংলাদেশে দারিদ্রতা দূরীকরণে ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা চালু হয়েছে বহু আগেই।
আজকাল শহর ও গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই নিজেদের নানা প্রয়োজনে অনেকেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন ধরনের ঋণ নিতে দেখা যায়। এর মধ্যে ব্যক্তিগত ঋণ (পার্সোনেল লোন), গৃহনির্মাণ ঋণ, ভোগ্যপণ্য ঋণ, কার লোন প্রভৃতির কথা বলা যায়। কিন্তু ঋণগ্রহীতাদের যথার্থ ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসির অর্থাৎ আর্থিক সাক্ষরতার অভাবে তারা সেই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ব্যাংকের কোন ঋণটি তার জন্য সুবিধাজনক কিংবা কোন ঋণের পরিশোধের পদ্ধতি সহজ তা বোঝার জন্য উপলব্ধির জন্য কিছু আর্থিক জ্ঞান ও কলাকৌশল জানার প্রয়োজন রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী কার্যকর এবং টেকসই করে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্যোগে গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পরিচালনা করা হয় এজন্য।
কিন্তু এসব কর্মসূচি আশানুরূপ সুফল বয়ে আনতে পারছে না জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশের আর্থিক সাক্ষরতার অভাবে। যদি সমাজের বিভিন্ন স্তরে অর্থনৈতিক সাক্ষরতা বা ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির যথাযথ বিকাশ ঘটত তাহলে আজকের বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার চেয়ে আরো অনেক দূর সামনে এগিয়ে যেতে পারত অনায়াসেই। অর্থনীতির মূলধারার বাইরে রয়েছেন যারা তারাও সামিল হতে পারতেন এর সুফল হিসেবে। এখনও ব্যাংকিং কর্মকা-ের বাইরে রয়েছেন সমাজের বিরাট একটি অংশের মানুষ। ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি তাদের খুব সহজেই ব্যাংকিং কর্মকা-ে উদ্ধুদ্ধ এবং উৎসাহী করে তুলতে পারে।
বিশ্বব্যাপী আজ ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশেষ করে দুনিয়াজুড়ে আর্থিক মন্দা দূরীকরণে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অর্থনৈতিক সাক্ষরতা বা ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসি দারুন গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সম্পদের সুষম বণ্টন, ধনী দরিদ্রের আয় বৈষম্য প্রভৃতি দূরীকরণে প্রত্যেককে সচেতন এবং সচেষ্ট করে তুলতে বর্তমান সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ফাইন্যান্সিয়াল লিটারেসির কোনো বিকল্প নেই।
[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]