জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস
এবারের আমন ফসলটা বেশ ঝুঁকির মধ্যেই আছে বলা যায়। কারণ মৌসুমের শুরুতেই কিছুটা ঝাঁকুনি; উজান এবং ভাটিতে প্রচ- বৃষ্টির উপদ্রব। ফলে সারা দেশজুড়ে লাগামছাড়া বন্যার তা-ব। কোথাও আগাম বন্যা। কোথাও বন্যার পানি সময়মতো আসলেও নামতে বেশ সময় নিচ্ছে। কোথাও বা একাধিকবার বন্যা হয়ে গেছে। অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে এবারের পানিবৃদ্ধিও ছিল অস্বাভাবিক। একই সাথে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনসাপেক্ষে কিছুটা সময়ক্ষেপণ। এ সমস্ত কারণে আমন ধান প্রতিষ্ঠা করতে কৃষকদের বর্ণনাতীত কষ্ট পোয়াতে হচ্ছে। অনেক জায়গায় ভাদ্রের শেষ ছাড়িয়ে আশ্বিনের প্রথমদিকেও ধান রোপণ করেছে কৃষকরা।
সময়ের আবাদ সময়ে না করতে পারলে ফলন ভালো হয় না। জাত বুঝে চারা রোপণ না করতে পারলে সাড়ে সর্বনাশ। নাবি রোপণের জন্য জাতটিকে অবশ্যই আলোক-সংবেদি হতে হবে। তাহলে কার্তিকের শেষদিকে শিষ বের হয়ে যাবে। এজন্য চারার বয়স হতে হবে ৩০ থেকে ৪০ দিন। তাই আশ্বিনে লাগিয়ে খুব ভালো কিছু আশা করা দুরূহ। কারণ কায়ক্লেশে শিষ বের করতে পারলেও কার্তিকে যদি তাপমাত্রা বেশ কমে যায় তাহলে ধান চিটে হয়ে যাবে।
বিকল্প হিসেবে হয়তো কেউ স্বল্প জীবনকালীন (১০০-১২৫ দিন) কিছু জাত ব্যবহার করে থাকতে পারেন। এগুলো আলোক-সংবেদি নয়। তাই রোপণের নির্দিষ্ট সময়ের পরে ধান ঘরে তোলার কথা; কিন্তু এরাও নিচু বা উঁচু তাপমাত্রার কোনোটা সহ্য করতে পারে না। বেশি আগাম রোপণ করলে ভাদরের গরমে ধান চিটে হয়ে যেতে পারে। আবার একটু দেরি হলে ঠা-ায় ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা। বন্যা-প্রবণ নয় এমন জায়গায় স্বাভাবিক আমনের জাত (যাদের জীবনকাল ১৩৫ দিনের আশপাশে) হয়তো ভালো আছে; কিন্তু বার-বার চুবানি-খাওয়া পরিবেশে এ ধরনের দুয়েকটি জাত নিয়েও কৃষকরা নাকি বেশ বিপাকে। বলছিলাম ব্রি ধান ১০৩ এর কথা। ব্রি-উদ্ভাবিত চিকন চালের নতুন জাত অনুকূল পরিবেশের জাত; কিন্ত পটুয়াখালীর বাউফল ও দশমিনা উপজেলায় ‘ব্রি-পার্টনার’ প্রকল্পের আওতায় জাতটি আগাম ফুলে গেছে। অর্থাৎ যথেষ্ট বাড়-বাড়তির আগেই গাছে ফুল এসে যাওয়ায় ভালো ফলন আশা করা যায় না।
এদিকে বরগুনার আমতলীতে একইভাবে অবস্থা। তবে আমতলীতে ব্যবহৃত জাতটি ব্রি-উদ্ভাবিত নয়। কৃষকেরা বলছে গুটিস্বর্ণা। স্থানীয় একজন ডিলারের কাছ থেকে জাতটি তারা সংগ্রহ করেছে। জাতটি সত্যিকারের গুটি স্বর্ণা হলে এবং সময় মতো রোপণ করা গেলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। সরকারিভাবে অনুমোদিত না হওয়া সত্ত্বেও কৃষকরা জাতটি পছন্দ করে। যাই হোক গুটি স্বর্ণা হোক আর ব্রি ধান১০৩ হোক সময়ের আগেই ফুলে যাবে কেন? আপনার খেয়াল করেছেন কিনাÑ জমিতে ধান লাগানোর পরে কোনো কৃষক অনেক সময় অতিরিক্ত কিছু ধানের চারা কয়েকটি বড় মুঠো করে জমির এক কোণায় পুঁতে রেখে দেয়। কোনো যতœ-আত্তি করে না। পুঁতে রাখার কিছুদিনের মধ্যেই সেই ধানগুলো থেকে দুর্বল কিছু শিষ বেরিয়ে আসে। তখনও জমিতে রোপণ করা ধানগাছগুলোতে শিষ বের হতে বেশ দেরি।
উল্লেখ্য, তারা একই জাত এবং একই সাথে একই জমিতে পাত দেওয়া এবং একই দিনে জমিতে লাগানো বা পুঁতে রাখা হয়। স্বাভাবিক ভাবে রোপণ করা চারাগুলোকে কোনো বৈরী পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়নি; কিন্তু এক জায়গায় পুঁতে রাখা চারাগুলোকে শুরু থেকেই ভীষণ বৈরী পরিবেশের সাথে লড়াই করতে হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে শারীরতাত্ত্বিক পরিপক্বতা এসে গেছে আগেই। যদিও তাদের বাড়-বাড়তি মোটেই ভালো হয় না। তারপরেও ভয়ানক কোনো বৈরী পরিবেশ তৈরি না হলে রোপণ করা গাছগুলোর মধ্যে কিছু গাছ কিছু বীজ উৎপাদন করতে পারে। এর জবাব কী হতে পারে?
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিখ্যাত উদ্ভিদ প্রজননবিদ মরহুম ড. নূর মোহাম্মদ মিয়া এক কথায় এর একটা চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে অভাবের সংসারে বেঁচে থাকাই দায়। তাই তাড়াতাড়ি পরবর্তী প্রজন্ম রেখে যাওয়ার ইচ্ছে। নইলে তো সবংশে নিবংশ হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ প্রত্যেক জীবেরই একটা সুপ্ত ইচ্ছে থাকে মরে যাওয়ার আগে নিজের প্রজন্ম রেখে যাওয়ার। স্যার নিশ্চয়ই বিজ্ঞানের কঠিন কথাটি রসিকতার ছলে সহজ করে বলেছিলেন। ১৯৮৩ সালের কথা। তখনও ধানগাছের ফুলফোটা প্রক্রিয়াটা আজকের মতো করে জানা যায়নি।
প্রসঙ্গত মহাভারতের একটা গল্প বলতে হয়। পুরাকালের এক ঋষি ভরদ্বাজ তার গুরুভৃগুকে জিগ্যেস করেছিলেন যে গাছের প্রাণ আছে কিনা। ঋষিভৃগু তার জবাবে বলেছিলেন, ‘অবশ্যই গাছের প্রাণ আছে। তারা সুগন্ধ এবং দুর্গন্ধের প্রতি প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। রোগাক্রান্ত হলে ধোঁয়া দিয়ে তাদের রোগমুক্ত করা যায়। তাদের সুখ ও দুঃখ বোধ আছে; যা অনেকটা আমাদের মনের মতোই কাজ করে।‘
উল্লেখ্য, আচার্য জগদীশ বসু ঋষি ভৃগুর এই কথায়ই অনুপ্রাণীত হয়ে গাছের যে প্রাণ আছে তা প্রমাণ করেছিলেন। অতএব বিপদে পড়লে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আশায় ধান গাছের শিষ বের হবে এতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? যাই হোক গাছের ফুলফোটা বা শিষ বের হওয়ার অবশ্যই কিছু হরমোনজনিত বিষয় আছে। যারা এক বা একাধিক জিন কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে। প্রক্রিয়াগুলো বেশ জটিল। সাম্প্রতিক কালের এক গবেষণায় ধানের গাছের বেলায় পীড়ন-পরিস্থিতির প্রভাব প্রমাণিত হয়েছে। পীড়ন-পরিস্থিতি খরা বা জলে নাকানি-চুবানি খাওয়া বা জলাবদ্ধতা যে কোনো পরিস্থিতি হতে পারে।
এখন দেখা যাক পটুয়াখালী বা বরগুনাতে কেন ধান রোপণের কিছুদিন পরেই শিষ বেরিয়ে গেল। ব্রি ধান ১০৩ এর বেলায় যদ্দুর জানা গেছে যে চারার বয়স বেশি ছিল। ৬০ থেকে ৬৫ দিন। আমার বিশ্বাস গুটি-স্বর্ণার বেলায় একই কথা প্রযোজ্য। একবার পাত দেওয়ার পর বন্যা ও বৃষ্টির কারণে মাঠের জমিকে সময় মতো রোপণের উপযোগী করে প্রস্তুত করা যায়নি। কারণ অতিবৃষ্টির কারণে জমিতে পানির গভীরতা বেশি ছিল। ফলে ১৩০ দিনের জীবনকাল বিশিষ্ট (ব্রি ধান ১০৩ বা গুটি-স্বর্ণা) রোপণের ৫-১০ দিনের মধ্যেই থোড় বৃদ্ধি শুরু হয়ে যায়। এর ১৫ দিন পরে কিছু-কিছু কুশিতে শিষের দেখা মেলে। পাশাপাশি রোপণের আগে এবং পরেও গাছকে চুবানি খাওয়ার পীড়ন-পরিস্থিতি সহ্য করতে হয়েছে। এসব কারণেই হয়তো ধান গাছে আগাম ফুল এসে গেছে। যাই হোক, ব্রি উদ্ভাবিত জাতটি এভাবে ফুলে যাওয়া দুর্ভাগ্য জনক। ব্রি কোনো জাত অবমুক্ত করার আগে সারা দেশে মাঠ পর্যায়ে একাদিক্রমে তিন বছর ট্রায়াল দেয়। বীজ অনুমোদন এজেন্সি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দেশব্যাপী পরিচালিত ট্রায়াল সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে। তারপরও কিছু জাতের মধ্যে এ ধরনের দুর্বলতা ধরা না পড়া দুর্ভাগ্যজনক। তবে প্রতি বছর হবে এমন নয়। ওখানে খারাপ করলেও অন্য জায়গায়তো জাতটি খুবই ভালো করছে। আসলে সব জাত সব জায়গায় ভালো করবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। যখন কৃষকের জমিতে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায় তখন কি কিছু করার থাকে? চর এলাকার কৃষকেরা বেশি বয়সের চারা রোপণ করে থাকে। সেখানে আসল চারাটি বেঁচে থাকে না। পরে তার গোড়া থেকে নতুন কুশি গজিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করে। তবে বিশেষ যতেœর দরকার হয়। পটুয়াখালী-বরগুনার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে পারে। যেমন ফুলে যাওয়া কুশিটা মারা যাওয়ার পরে গজানো কুশিগুলো যদি নতুন করে জীবন শুরু করে দেয়। বিষয়টি তৃণমূল পর্যায়ের কৃষক এবং কৃষিবিদেরা গবেষণা করে দেখতে পারেন। এছাড়াও আরেকটি কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থা আছে। যেমন বৃহত্তর ফরিদপুরের ব্রি ধান ৩৩ নিয়ে কৃষকের উদ্ভাবিত একটা পদ্ধতি। ওখানে অনেক জায়গায় পাট কেটে জমি তৈরি করতে-করতে মৌসুম দেরিতে শুরু হয়। তার বেশ আগে কৃষককে বীজতলায় বীজ ফেলে রাখতে হয়। জমি রোপণের উপযোগী হতে-হতে চারার বয়স বেশি হয়ে যায়। কৃষক সেই চারাই জমিতে রোপণ করে দেয়। তারপর চারা কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর-পরই মই দিয়ে চারার গোড়া থেঁতলে দেয়। এরপর গোড়া থেকে চারা গজিয়ে আবার নতুন করে বাড়তে শুরু করে। বরগুনার কৃষদের কেউ কেউ এমন ধরনের চেষ্টা করছে। কৃষিবিভাগ থেকেও এমন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ব্রি-ও এমন পরামর্শ দিয়ে থাকে। সাথে বিঘে প্রতি ১০-১৫ কেজি ইউরিয়া এবং ৫ কেজি পটাশ সার। তবে ব্রি ধান ৩৩ এর বেলায় যেটা সত্যি হয়েছে এই জাতগুলোর বেলায় সেটা কতখানি সত্যি হবে কে জানে! আর যদি হয়ও তাহলে ফলন কখনই স্বাভাবিক আবাদের মত হবে না। এজন্যই আমার মনে হয় এই (রোপা) আমনের কথা আর না ভেবে পরবর্তী বোরোর বা অন্যকোনো ফসলের কথা চিন্তা করা উচিত।
[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]
জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস
শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
এবারের আমন ফসলটা বেশ ঝুঁকির মধ্যেই আছে বলা যায়। কারণ মৌসুমের শুরুতেই কিছুটা ঝাঁকুনি; উজান এবং ভাটিতে প্রচ- বৃষ্টির উপদ্রব। ফলে সারা দেশজুড়ে লাগামছাড়া বন্যার তা-ব। কোথাও আগাম বন্যা। কোথাও বন্যার পানি সময়মতো আসলেও নামতে বেশ সময় নিচ্ছে। কোথাও বা একাধিকবার বন্যা হয়ে গেছে। অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে এবারের পানিবৃদ্ধিও ছিল অস্বাভাবিক। একই সাথে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনসাপেক্ষে কিছুটা সময়ক্ষেপণ। এ সমস্ত কারণে আমন ধান প্রতিষ্ঠা করতে কৃষকদের বর্ণনাতীত কষ্ট পোয়াতে হচ্ছে। অনেক জায়গায় ভাদ্রের শেষ ছাড়িয়ে আশ্বিনের প্রথমদিকেও ধান রোপণ করেছে কৃষকরা।
সময়ের আবাদ সময়ে না করতে পারলে ফলন ভালো হয় না। জাত বুঝে চারা রোপণ না করতে পারলে সাড়ে সর্বনাশ। নাবি রোপণের জন্য জাতটিকে অবশ্যই আলোক-সংবেদি হতে হবে। তাহলে কার্তিকের শেষদিকে শিষ বের হয়ে যাবে। এজন্য চারার বয়স হতে হবে ৩০ থেকে ৪০ দিন। তাই আশ্বিনে লাগিয়ে খুব ভালো কিছু আশা করা দুরূহ। কারণ কায়ক্লেশে শিষ বের করতে পারলেও কার্তিকে যদি তাপমাত্রা বেশ কমে যায় তাহলে ধান চিটে হয়ে যাবে।
বিকল্প হিসেবে হয়তো কেউ স্বল্প জীবনকালীন (১০০-১২৫ দিন) কিছু জাত ব্যবহার করে থাকতে পারেন। এগুলো আলোক-সংবেদি নয়। তাই রোপণের নির্দিষ্ট সময়ের পরে ধান ঘরে তোলার কথা; কিন্তু এরাও নিচু বা উঁচু তাপমাত্রার কোনোটা সহ্য করতে পারে না। বেশি আগাম রোপণ করলে ভাদরের গরমে ধান চিটে হয়ে যেতে পারে। আবার একটু দেরি হলে ঠা-ায় ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা। বন্যা-প্রবণ নয় এমন জায়গায় স্বাভাবিক আমনের জাত (যাদের জীবনকাল ১৩৫ দিনের আশপাশে) হয়তো ভালো আছে; কিন্তু বার-বার চুবানি-খাওয়া পরিবেশে এ ধরনের দুয়েকটি জাত নিয়েও কৃষকরা নাকি বেশ বিপাকে। বলছিলাম ব্রি ধান ১০৩ এর কথা। ব্রি-উদ্ভাবিত চিকন চালের নতুন জাত অনুকূল পরিবেশের জাত; কিন্ত পটুয়াখালীর বাউফল ও দশমিনা উপজেলায় ‘ব্রি-পার্টনার’ প্রকল্পের আওতায় জাতটি আগাম ফুলে গেছে। অর্থাৎ যথেষ্ট বাড়-বাড়তির আগেই গাছে ফুল এসে যাওয়ায় ভালো ফলন আশা করা যায় না।
এদিকে বরগুনার আমতলীতে একইভাবে অবস্থা। তবে আমতলীতে ব্যবহৃত জাতটি ব্রি-উদ্ভাবিত নয়। কৃষকেরা বলছে গুটিস্বর্ণা। স্থানীয় একজন ডিলারের কাছ থেকে জাতটি তারা সংগ্রহ করেছে। জাতটি সত্যিকারের গুটি স্বর্ণা হলে এবং সময় মতো রোপণ করা গেলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। সরকারিভাবে অনুমোদিত না হওয়া সত্ত্বেও কৃষকরা জাতটি পছন্দ করে। যাই হোক গুটি স্বর্ণা হোক আর ব্রি ধান১০৩ হোক সময়ের আগেই ফুলে যাবে কেন? আপনার খেয়াল করেছেন কিনাÑ জমিতে ধান লাগানোর পরে কোনো কৃষক অনেক সময় অতিরিক্ত কিছু ধানের চারা কয়েকটি বড় মুঠো করে জমির এক কোণায় পুঁতে রেখে দেয়। কোনো যতœ-আত্তি করে না। পুঁতে রাখার কিছুদিনের মধ্যেই সেই ধানগুলো থেকে দুর্বল কিছু শিষ বেরিয়ে আসে। তখনও জমিতে রোপণ করা ধানগাছগুলোতে শিষ বের হতে বেশ দেরি।
উল্লেখ্য, তারা একই জাত এবং একই সাথে একই জমিতে পাত দেওয়া এবং একই দিনে জমিতে লাগানো বা পুঁতে রাখা হয়। স্বাভাবিক ভাবে রোপণ করা চারাগুলোকে কোনো বৈরী পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়নি; কিন্তু এক জায়গায় পুঁতে রাখা চারাগুলোকে শুরু থেকেই ভীষণ বৈরী পরিবেশের সাথে লড়াই করতে হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে শারীরতাত্ত্বিক পরিপক্বতা এসে গেছে আগেই। যদিও তাদের বাড়-বাড়তি মোটেই ভালো হয় না। তারপরেও ভয়ানক কোনো বৈরী পরিবেশ তৈরি না হলে রোপণ করা গাছগুলোর মধ্যে কিছু গাছ কিছু বীজ উৎপাদন করতে পারে। এর জবাব কী হতে পারে?
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিখ্যাত উদ্ভিদ প্রজননবিদ মরহুম ড. নূর মোহাম্মদ মিয়া এক কথায় এর একটা চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে অভাবের সংসারে বেঁচে থাকাই দায়। তাই তাড়াতাড়ি পরবর্তী প্রজন্ম রেখে যাওয়ার ইচ্ছে। নইলে তো সবংশে নিবংশ হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ প্রত্যেক জীবেরই একটা সুপ্ত ইচ্ছে থাকে মরে যাওয়ার আগে নিজের প্রজন্ম রেখে যাওয়ার। স্যার নিশ্চয়ই বিজ্ঞানের কঠিন কথাটি রসিকতার ছলে সহজ করে বলেছিলেন। ১৯৮৩ সালের কথা। তখনও ধানগাছের ফুলফোটা প্রক্রিয়াটা আজকের মতো করে জানা যায়নি।
প্রসঙ্গত মহাভারতের একটা গল্প বলতে হয়। পুরাকালের এক ঋষি ভরদ্বাজ তার গুরুভৃগুকে জিগ্যেস করেছিলেন যে গাছের প্রাণ আছে কিনা। ঋষিভৃগু তার জবাবে বলেছিলেন, ‘অবশ্যই গাছের প্রাণ আছে। তারা সুগন্ধ এবং দুর্গন্ধের প্রতি প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। রোগাক্রান্ত হলে ধোঁয়া দিয়ে তাদের রোগমুক্ত করা যায়। তাদের সুখ ও দুঃখ বোধ আছে; যা অনেকটা আমাদের মনের মতোই কাজ করে।‘
উল্লেখ্য, আচার্য জগদীশ বসু ঋষি ভৃগুর এই কথায়ই অনুপ্রাণীত হয়ে গাছের যে প্রাণ আছে তা প্রমাণ করেছিলেন। অতএব বিপদে পড়লে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আশায় ধান গাছের শিষ বের হবে এতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? যাই হোক গাছের ফুলফোটা বা শিষ বের হওয়ার অবশ্যই কিছু হরমোনজনিত বিষয় আছে। যারা এক বা একাধিক জিন কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে। প্রক্রিয়াগুলো বেশ জটিল। সাম্প্রতিক কালের এক গবেষণায় ধানের গাছের বেলায় পীড়ন-পরিস্থিতির প্রভাব প্রমাণিত হয়েছে। পীড়ন-পরিস্থিতি খরা বা জলে নাকানি-চুবানি খাওয়া বা জলাবদ্ধতা যে কোনো পরিস্থিতি হতে পারে।
এখন দেখা যাক পটুয়াখালী বা বরগুনাতে কেন ধান রোপণের কিছুদিন পরেই শিষ বেরিয়ে গেল। ব্রি ধান ১০৩ এর বেলায় যদ্দুর জানা গেছে যে চারার বয়স বেশি ছিল। ৬০ থেকে ৬৫ দিন। আমার বিশ্বাস গুটি-স্বর্ণার বেলায় একই কথা প্রযোজ্য। একবার পাত দেওয়ার পর বন্যা ও বৃষ্টির কারণে মাঠের জমিকে সময় মতো রোপণের উপযোগী করে প্রস্তুত করা যায়নি। কারণ অতিবৃষ্টির কারণে জমিতে পানির গভীরতা বেশি ছিল। ফলে ১৩০ দিনের জীবনকাল বিশিষ্ট (ব্রি ধান ১০৩ বা গুটি-স্বর্ণা) রোপণের ৫-১০ দিনের মধ্যেই থোড় বৃদ্ধি শুরু হয়ে যায়। এর ১৫ দিন পরে কিছু-কিছু কুশিতে শিষের দেখা মেলে। পাশাপাশি রোপণের আগে এবং পরেও গাছকে চুবানি খাওয়ার পীড়ন-পরিস্থিতি সহ্য করতে হয়েছে। এসব কারণেই হয়তো ধান গাছে আগাম ফুল এসে গেছে। যাই হোক, ব্রি উদ্ভাবিত জাতটি এভাবে ফুলে যাওয়া দুর্ভাগ্য জনক। ব্রি কোনো জাত অবমুক্ত করার আগে সারা দেশে মাঠ পর্যায়ে একাদিক্রমে তিন বছর ট্রায়াল দেয়। বীজ অনুমোদন এজেন্সি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দেশব্যাপী পরিচালিত ট্রায়াল সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে। তারপরও কিছু জাতের মধ্যে এ ধরনের দুর্বলতা ধরা না পড়া দুর্ভাগ্যজনক। তবে প্রতি বছর হবে এমন নয়। ওখানে খারাপ করলেও অন্য জায়গায়তো জাতটি খুবই ভালো করছে। আসলে সব জাত সব জায়গায় ভালো করবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। যখন কৃষকের জমিতে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায় তখন কি কিছু করার থাকে? চর এলাকার কৃষকেরা বেশি বয়সের চারা রোপণ করে থাকে। সেখানে আসল চারাটি বেঁচে থাকে না। পরে তার গোড়া থেকে নতুন কুশি গজিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করে। তবে বিশেষ যতেœর দরকার হয়। পটুয়াখালী-বরগুনার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে পারে। যেমন ফুলে যাওয়া কুশিটা মারা যাওয়ার পরে গজানো কুশিগুলো যদি নতুন করে জীবন শুরু করে দেয়। বিষয়টি তৃণমূল পর্যায়ের কৃষক এবং কৃষিবিদেরা গবেষণা করে দেখতে পারেন। এছাড়াও আরেকটি কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থা আছে। যেমন বৃহত্তর ফরিদপুরের ব্রি ধান ৩৩ নিয়ে কৃষকের উদ্ভাবিত একটা পদ্ধতি। ওখানে অনেক জায়গায় পাট কেটে জমি তৈরি করতে-করতে মৌসুম দেরিতে শুরু হয়। তার বেশ আগে কৃষককে বীজতলায় বীজ ফেলে রাখতে হয়। জমি রোপণের উপযোগী হতে-হতে চারার বয়স বেশি হয়ে যায়। কৃষক সেই চারাই জমিতে রোপণ করে দেয়। তারপর চারা কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর-পরই মই দিয়ে চারার গোড়া থেঁতলে দেয়। এরপর গোড়া থেকে চারা গজিয়ে আবার নতুন করে বাড়তে শুরু করে। বরগুনার কৃষদের কেউ কেউ এমন ধরনের চেষ্টা করছে। কৃষিবিভাগ থেকেও এমন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ব্রি-ও এমন পরামর্শ দিয়ে থাকে। সাথে বিঘে প্রতি ১০-১৫ কেজি ইউরিয়া এবং ৫ কেজি পটাশ সার। তবে ব্রি ধান ৩৩ এর বেলায় যেটা সত্যি হয়েছে এই জাতগুলোর বেলায় সেটা কতখানি সত্যি হবে কে জানে! আর যদি হয়ও তাহলে ফলন কখনই স্বাভাবিক আবাদের মত হবে না। এজন্যই আমার মনে হয় এই (রোপা) আমনের কথা আর না ভেবে পরবর্তী বোরোর বা অন্যকোনো ফসলের কথা চিন্তা করা উচিত।
[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]