ইমদাদুল হক মিলন
সাহিত্য সংস্কৃতি জীবনবোধের চিরন্তন সত্যপাঠ, এক বিশাল পরিম-ল। এই পরিম-লে বাস করে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছড়া- সঙ্গে ভাস্কর্য, গ্রাফিতি, দেয়ালিকা, তৈলচিত্র, ক্যানভাস, গান, বাজনা, সুর, নৃত্য, কাঠ খোদাই, কাদা বালির মৃৎশিল্প অঙ্কনসহ প্রভৃতি সৃজনশীল অসংখ্য উপাদান। এর প্রত্যেকটি উপাদান জীবন ঘনিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ। এসব সৃজনশীল কর্মকা-ের গভীরে যারা প্রবেশ করতে পারেন তারা অমর হয়ে যান। আর এই অমরত্বের সুধা হাতে গোনা যে কয়জন পান করতে পেরেছে তাদের মধ্যে এসএম সুলতান অন্যতম। তিনি মরেও অমর হয়ে আছেন চিত্রপিপাসু মন ক্যানভাসে।
শিল্পী এসএম সুলতান (শেখ মোহাম্মদ সুলতান) যার পৈতৃক নাম লাল মিয়া; জন্ম ১০ আগস্ট ১৯২৪ সালে অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের যশোর জেলার অন্তর্গত নড়াইলের (বর্তমান জেলা) মাছিমদিয়া গ্রামে। পিতা মেছের আলী ছিলেন রাজমিস্ত্রি ও মাতা মাজু বিবি ছিলেন গৃহিণী।
রাজমিস্ত্রি বাবার সঙ্গে কাজের সূত্রে আনমনে তার চিত্রকলার হাতে খড়ি। ১৯৩৮ সালে অষ্টম শ্রেণী পাস করার পর তিনি নড়াইল ছেড়ে তার শিক্ষক কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে কলকাতা চলে যান এবং এখানে থেকেই সুলতানের জীবনে আসে এক চরম পরিবর্তন। ১৯৪১ সালে দুই বছর অপেক্ষার পর নড়াইলের জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের সুপারিশে আর হাসান শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি লাল মিয়া এখানেই তার নাম পরিবর্তন করে এসএম সুলতান রাখা হয়। ১৯৫০ সালে তিনি চিত্রশিল্পীদের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ যাত্রা করেন এবং বিভিন্ন সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় এবং সহকারী কর্তৃপক্ষের সংবর্ধনা লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে পুনরায় তিনি লন্ডন যাত্রা করেন এবং লন্ডনের বিখ্যাত লিস্টার আর্ট গ্যালারিতে এশিয়ার প্রথম কোন চিত্রশিল্পী হিসেবে সুলতানের চিত্রকর্ম স্থান করে নেয়। ফ্রান্স জার্মানিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সুলতানের চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয় এবং প্রশংসিত হয় দারুণভাবে। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব গ্যালারির প্রদর্শনীজুড়ে।
এত যশ-খ্যাতি নিয়ে সুলতান চিত্রকলার স্বর্গ ইউরোপের মতো জায়গায় থেকে যেতে পারতেন কিন্তু না তিনি চলে এসেছেন নিজগৃহে প্রকৃতির টানে দেশকে ভালোবেসে শেকড় সন্ধানী সুলতান ফিরে আসেন তার নিজ এলাকা নড়াইলে, মা মাটির কাছাকাছি। জগৎ বিখ্যাত লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, পাবলো পিকাসো, ভ্যান গগ, পল গগ্যাঁ থেকে সুলতান একটু স্বতন্ত্র। দেশে ফিরে সুলতান ১৯৮৭ সালে কুড়িগ্রাম ফাইন আর্ট স্কুল (শিশু স্বর্গ) ও ১৯৯০ সালে শিশুদের জন্য নৌকা (ভ্রাম্যমাণ শিশু স্বর্গ) তৈরি করেন। সুলতান চিত্র স্বর্গের স্মৃতি সংগ্রহশালার বারান্দায় পা রাখলেই চোখে পড়বে বিচিত্র সব চিত্রকর্ম যার মধ্যে রয়েছে প্রথম বৃক্ষরোপণ, ফসল নিয়ে ঘরে ফেরাসহ অসংখ্য রেপলিকা ক্যানভাস। আর এসব চিত্রকর্ম বিমোহিত করে নিবে যে কোন সংস্কৃতি বোধসম্পন্ন মানুষকে।
প্রথম গ্যালারিতে ঢুকেই প্রথমে চোখে পড়ে ‘সভ্যতার ক্রমবিকাশ’ পাটের চটের ওপর তেল রং এ আঁকা ৩৬ ফুট ৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি প্রস্থে বিশাল চিত্রকর্ম। তার পাশে জমি চাষ, ধান কাটা/ফসল সংগ্রহ, ধান মাড়াই চিত্রকর্মগুলো এক একটি জীবনের গল্প হয়ে দীপ্তি ছড়াচ্ছে দর্শনার্থীদের পিপাসিত মন ও মননে। তার পাশেই রয়েছে সুলতানের ব্যবহৃত বাঁশি, সারেঙ্গী, সিতারা, বায়া ও তবলাসহ বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র। এ থেকেই বোঝা যায় সুলতান ছিলেন সংস্কৃতি সাগরের বহুরূপী প্রতিভার প্রতিভু। পাশে তার ব্যবহৃত রং-তুলির বিভিন্ন উপকরণ কিছু কাপড়-চোপড় ও ব্যবহার্য ব্যাগসহ উপহার সামগ্রী। উপরে অর্থাৎ দ্বিতীয় গালিতে গেলেই ‘গুন টানা’, ‘ধান মাড়াই’ ‘জমিকর্ষণ, ‘কাপড় ধোয়া’, ‘মাছ ধরা’ ‘ধান ভানা ১ ও ২, কর্ম ও জীবন’, ‘গ্রাম্য পথ, ‘মাছ ধরা’ ও ‘গণহত্যা-১৯৭১’। সুলতানের যে সব চিত্রকর্ম দেখা যায় তার প্রত্যেকটি এক একটি মহাকাব্যের প্রতিরূপ এবং এটা যেন সাহিত্যের এক নির্ঘাত পরিপাঠ যা পাঠ করলে পাঠক হৃদয় ভাস্বর হয়ে ওঠে আপন মনের সুর নিকেতনে। সব যেন সৃষ্টির সংকল্পে এক একটি সাহিত্য যা পাঠে ক্ষুধার্ত হৃদয়ে আত্মতৃপ্তির অঙ্গন রচনা করতে পারে পাঠক হৃদয় অনায়াসেই।
ফিলিপ্পো টমাসোর ফিউচারিজম, ভলতেয়ারের সঙ্গে যুক্ত একদল শিল্পী ও কবি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দাদাই, কিউবিস্ট, ফ্র্যাগমেন্টিজম, অ্যাবস্ট্রাকশন চিত্রকলা ছেড়ে সুলতান বেছে নিলেন কৃষক ও কৃষি জনপদের জীবন। সুলতান জানতেন বাংলা সাহিত্যের হাতে খড়ি হয়েছিল কৃষি ও পুঁথি সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে। সাহিত্য ও চিত্রকলা সংস্কৃতি সত্তার এক অভিন্ন রসদ এ ধারণা থেকেই সুলতান চিত্রকলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চেয়েছিলেন। সুলতানের যে স্বপ্ন ছিল তা সম্পূর্ণ একটি স্বতন্ত্র স্বপ্ন। আর স্বপ্নের মূল ছিল বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
সুলতানের সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা যদি বাস্তবায়ন হতো তাহলে বাংলাদেশে আজকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানও গড়ে উঠত। সুলতানের এই স্বতন্ত্র সৃষ্টিসত্তাকে আমরা আজও ধারণ করতে পারিনি। রাষ্ট্র সব সময়ই দায়সারা গোছের পদক্ষেপ নিয়েছে চিত্রকলা ও সংস্কৃতি শিক্ষা নিয়ে। বাংলাদেশের প্রথিতযশা পরিচালক তারেক মাসুদ ১৯৮৯ সালে যে ৪৭ মিনিটের আদম সুরত নামক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন তাতে সুলতানের সৃষ্টিসত্তা ও স্বপ্ন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। তাতে কিছুটা সুলতানের সেই স্বপ্নের বাংলাদেশের চিত্র ফুটে ওঠে।
সুলতান স্বপ্ন দেখতেন এবং ভাবতেন যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরিচালক যারা সেই শহুরে ভদ্রলোক যারা কিনা গ্রামের কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের ফসল ভোগ করছে এবং তাদের নামে আসা সাহায্য সহযোগিতার সম্পদও ভোগ করছে কিন্তু কখনো তারা কৃষকের সেই অবদানের কথা ভাবে না। এই কৃষকদের কথা যখন কেউ ভাবেনি তখন সুলতানের চিত্রকলা ও সাহিত্যের রসদ জুগিয়েছে এই কৃষি ও কৃষকের জীবন। তিনি ফিরে গেছেন নিভৃত পল্লীর কৃষক ও কৃষি জীবনের স্বপ্নডানা হয়ে।
সুলতানের বসবাস তাই প্রকৃতির নদী, গাছ, ফুল, পশু-পাখি, সাপ, কৃষক, কৃষি ও বিভিন্ন বাদ্য- বাঁশি, ঢোল, তবলা, সারিঙ্গী এসব নিয়ে। এসবের মধ্যেই সুলতান খুঁজে পেয়েছেন তার সৃষ্টির সত্তাকে রং তুলির আঁচড়ে। এটাই তো সুলতানের সৃষ্টি সত্তার আসল সৃষ্টিশীল সাহিত্য সংস্কৃতির রূপ।
অসংখ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববরেণ্য এই অবিবাহিত চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর সঙ্গে শেষ হয়ে যায় তার দৈহিক জীবন কিন্তু বেঁচে থাকে তার সব সৃষ্টিকর্ম ও সৃষ্টির সত্তার স্বপ্ন। সুলতানের সেই স্বপ্নেরা ডানা পাখা মেলুক মন-বিহঙ্গের স্বপ্ন জানালায়; বারবার এ রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে যাক অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাহিত্য সংস্কৃতি ও চিত্রকলার বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে।
[লেখক : প্রভাষক, আলহাজ সারোয়ার খান ডিগ্রি কলেজ, খুলনা]
ইমদাদুল হক মিলন
বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪
সাহিত্য সংস্কৃতি জীবনবোধের চিরন্তন সত্যপাঠ, এক বিশাল পরিম-ল। এই পরিম-লে বাস করে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছড়া- সঙ্গে ভাস্কর্য, গ্রাফিতি, দেয়ালিকা, তৈলচিত্র, ক্যানভাস, গান, বাজনা, সুর, নৃত্য, কাঠ খোদাই, কাদা বালির মৃৎশিল্প অঙ্কনসহ প্রভৃতি সৃজনশীল অসংখ্য উপাদান। এর প্রত্যেকটি উপাদান জীবন ঘনিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ। এসব সৃজনশীল কর্মকা-ের গভীরে যারা প্রবেশ করতে পারেন তারা অমর হয়ে যান। আর এই অমরত্বের সুধা হাতে গোনা যে কয়জন পান করতে পেরেছে তাদের মধ্যে এসএম সুলতান অন্যতম। তিনি মরেও অমর হয়ে আছেন চিত্রপিপাসু মন ক্যানভাসে।
শিল্পী এসএম সুলতান (শেখ মোহাম্মদ সুলতান) যার পৈতৃক নাম লাল মিয়া; জন্ম ১০ আগস্ট ১৯২৪ সালে অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের যশোর জেলার অন্তর্গত নড়াইলের (বর্তমান জেলা) মাছিমদিয়া গ্রামে। পিতা মেছের আলী ছিলেন রাজমিস্ত্রি ও মাতা মাজু বিবি ছিলেন গৃহিণী।
রাজমিস্ত্রি বাবার সঙ্গে কাজের সূত্রে আনমনে তার চিত্রকলার হাতে খড়ি। ১৯৩৮ সালে অষ্টম শ্রেণী পাস করার পর তিনি নড়াইল ছেড়ে তার শিক্ষক কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে কলকাতা চলে যান এবং এখানে থেকেই সুলতানের জীবনে আসে এক চরম পরিবর্তন। ১৯৪১ সালে দুই বছর অপেক্ষার পর নড়াইলের জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের সুপারিশে আর হাসান শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি লাল মিয়া এখানেই তার নাম পরিবর্তন করে এসএম সুলতান রাখা হয়। ১৯৫০ সালে তিনি চিত্রশিল্পীদের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ যাত্রা করেন এবং বিভিন্ন সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় এবং সহকারী কর্তৃপক্ষের সংবর্ধনা লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে পুনরায় তিনি লন্ডন যাত্রা করেন এবং লন্ডনের বিখ্যাত লিস্টার আর্ট গ্যালারিতে এশিয়ার প্রথম কোন চিত্রশিল্পী হিসেবে সুলতানের চিত্রকর্ম স্থান করে নেয়। ফ্রান্স জার্মানিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সুলতানের চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয় এবং প্রশংসিত হয় দারুণভাবে। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব গ্যালারির প্রদর্শনীজুড়ে।
এত যশ-খ্যাতি নিয়ে সুলতান চিত্রকলার স্বর্গ ইউরোপের মতো জায়গায় থেকে যেতে পারতেন কিন্তু না তিনি চলে এসেছেন নিজগৃহে প্রকৃতির টানে দেশকে ভালোবেসে শেকড় সন্ধানী সুলতান ফিরে আসেন তার নিজ এলাকা নড়াইলে, মা মাটির কাছাকাছি। জগৎ বিখ্যাত লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, পাবলো পিকাসো, ভ্যান গগ, পল গগ্যাঁ থেকে সুলতান একটু স্বতন্ত্র। দেশে ফিরে সুলতান ১৯৮৭ সালে কুড়িগ্রাম ফাইন আর্ট স্কুল (শিশু স্বর্গ) ও ১৯৯০ সালে শিশুদের জন্য নৌকা (ভ্রাম্যমাণ শিশু স্বর্গ) তৈরি করেন। সুলতান চিত্র স্বর্গের স্মৃতি সংগ্রহশালার বারান্দায় পা রাখলেই চোখে পড়বে বিচিত্র সব চিত্রকর্ম যার মধ্যে রয়েছে প্রথম বৃক্ষরোপণ, ফসল নিয়ে ঘরে ফেরাসহ অসংখ্য রেপলিকা ক্যানভাস। আর এসব চিত্রকর্ম বিমোহিত করে নিবে যে কোন সংস্কৃতি বোধসম্পন্ন মানুষকে।
প্রথম গ্যালারিতে ঢুকেই প্রথমে চোখে পড়ে ‘সভ্যতার ক্রমবিকাশ’ পাটের চটের ওপর তেল রং এ আঁকা ৩৬ ফুট ৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি প্রস্থে বিশাল চিত্রকর্ম। তার পাশে জমি চাষ, ধান কাটা/ফসল সংগ্রহ, ধান মাড়াই চিত্রকর্মগুলো এক একটি জীবনের গল্প হয়ে দীপ্তি ছড়াচ্ছে দর্শনার্থীদের পিপাসিত মন ও মননে। তার পাশেই রয়েছে সুলতানের ব্যবহৃত বাঁশি, সারেঙ্গী, সিতারা, বায়া ও তবলাসহ বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র। এ থেকেই বোঝা যায় সুলতান ছিলেন সংস্কৃতি সাগরের বহুরূপী প্রতিভার প্রতিভু। পাশে তার ব্যবহৃত রং-তুলির বিভিন্ন উপকরণ কিছু কাপড়-চোপড় ও ব্যবহার্য ব্যাগসহ উপহার সামগ্রী। উপরে অর্থাৎ দ্বিতীয় গালিতে গেলেই ‘গুন টানা’, ‘ধান মাড়াই’ ‘জমিকর্ষণ, ‘কাপড় ধোয়া’, ‘মাছ ধরা’ ‘ধান ভানা ১ ও ২, কর্ম ও জীবন’, ‘গ্রাম্য পথ, ‘মাছ ধরা’ ও ‘গণহত্যা-১৯৭১’। সুলতানের যে সব চিত্রকর্ম দেখা যায় তার প্রত্যেকটি এক একটি মহাকাব্যের প্রতিরূপ এবং এটা যেন সাহিত্যের এক নির্ঘাত পরিপাঠ যা পাঠ করলে পাঠক হৃদয় ভাস্বর হয়ে ওঠে আপন মনের সুর নিকেতনে। সব যেন সৃষ্টির সংকল্পে এক একটি সাহিত্য যা পাঠে ক্ষুধার্ত হৃদয়ে আত্মতৃপ্তির অঙ্গন রচনা করতে পারে পাঠক হৃদয় অনায়াসেই।
ফিলিপ্পো টমাসোর ফিউচারিজম, ভলতেয়ারের সঙ্গে যুক্ত একদল শিল্পী ও কবি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দাদাই, কিউবিস্ট, ফ্র্যাগমেন্টিজম, অ্যাবস্ট্রাকশন চিত্রকলা ছেড়ে সুলতান বেছে নিলেন কৃষক ও কৃষি জনপদের জীবন। সুলতান জানতেন বাংলা সাহিত্যের হাতে খড়ি হয়েছিল কৃষি ও পুঁথি সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে। সাহিত্য ও চিত্রকলা সংস্কৃতি সত্তার এক অভিন্ন রসদ এ ধারণা থেকেই সুলতান চিত্রকলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চেয়েছিলেন। সুলতানের যে স্বপ্ন ছিল তা সম্পূর্ণ একটি স্বতন্ত্র স্বপ্ন। আর স্বপ্নের মূল ছিল বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
সুলতানের সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা যদি বাস্তবায়ন হতো তাহলে বাংলাদেশে আজকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানও গড়ে উঠত। সুলতানের এই স্বতন্ত্র সৃষ্টিসত্তাকে আমরা আজও ধারণ করতে পারিনি। রাষ্ট্র সব সময়ই দায়সারা গোছের পদক্ষেপ নিয়েছে চিত্রকলা ও সংস্কৃতি শিক্ষা নিয়ে। বাংলাদেশের প্রথিতযশা পরিচালক তারেক মাসুদ ১৯৮৯ সালে যে ৪৭ মিনিটের আদম সুরত নামক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন তাতে সুলতানের সৃষ্টিসত্তা ও স্বপ্ন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। তাতে কিছুটা সুলতানের সেই স্বপ্নের বাংলাদেশের চিত্র ফুটে ওঠে।
সুলতান স্বপ্ন দেখতেন এবং ভাবতেন যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরিচালক যারা সেই শহুরে ভদ্রলোক যারা কিনা গ্রামের কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের ফসল ভোগ করছে এবং তাদের নামে আসা সাহায্য সহযোগিতার সম্পদও ভোগ করছে কিন্তু কখনো তারা কৃষকের সেই অবদানের কথা ভাবে না। এই কৃষকদের কথা যখন কেউ ভাবেনি তখন সুলতানের চিত্রকলা ও সাহিত্যের রসদ জুগিয়েছে এই কৃষি ও কৃষকের জীবন। তিনি ফিরে গেছেন নিভৃত পল্লীর কৃষক ও কৃষি জীবনের স্বপ্নডানা হয়ে।
সুলতানের বসবাস তাই প্রকৃতির নদী, গাছ, ফুল, পশু-পাখি, সাপ, কৃষক, কৃষি ও বিভিন্ন বাদ্য- বাঁশি, ঢোল, তবলা, সারিঙ্গী এসব নিয়ে। এসবের মধ্যেই সুলতান খুঁজে পেয়েছেন তার সৃষ্টির সত্তাকে রং তুলির আঁচড়ে। এটাই তো সুলতানের সৃষ্টি সত্তার আসল সৃষ্টিশীল সাহিত্য সংস্কৃতির রূপ।
অসংখ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববরেণ্য এই অবিবাহিত চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর সঙ্গে শেষ হয়ে যায় তার দৈহিক জীবন কিন্তু বেঁচে থাকে তার সব সৃষ্টিকর্ম ও সৃষ্টির সত্তার স্বপ্ন। সুলতানের সেই স্বপ্নেরা ডানা পাখা মেলুক মন-বিহঙ্গের স্বপ্ন জানালায়; বারবার এ রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে যাক অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাহিত্য সংস্কৃতি ও চিত্রকলার বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে।
[লেখক : প্রভাষক, আলহাজ সারোয়ার খান ডিগ্রি কলেজ, খুলনা]