আনোয়ারুল হক
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ আটটি জাতীয় দিবস বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমেই অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানাই এ কারণে যে, তারা এ যাত্রায় ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরকে রেহাই দিয়েছেন! আটটি দিবসের মধ্যে ৩-৪টি দলীয় বা পারিবারিকভাবে পালনযোগ্য দিবস। জাতীয় দিবস থেকে বাদ দেওয়ার জন্যও তারা ধন্যবাদ পেতে পারেন। এসব দিবসসহ কয়েকটি দিবস যে জাতীয় দিবস তা এ অধমও জানতো না। এই সংবাদ থেকেই প্রথম জানলাম।
শেখ হাসিনা সরকারের এই যে জোর করে যা খুশি চাপিয়ে দেয়ার স্বেচ্ছাচারী মনোভাব তার খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা পর্বের ঐতিহাসিক দিনসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজডিত সব কিছুকেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজের ও আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পত্তি বানিয়ে,নিজেকে তার একমাত্র উত্তরাধিকারী বানিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অবিসংবাদী নেতাকে পরিচিত করেছিলেন তারই প্রতীক হিসেবে। শেখ হাসিনা পরাজিত হয়েছেন। স্বতঃস্ফূর্ত এবং বৈচিত্র্যময় এক ছাত্র-গণঅভ্যুথানের মুখে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। ফলশ্রুতিতে এক অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছে, যার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে তার মতো করে দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা রেখে চলছিলেন। সেই আশির দশকে যখন পর্যন্ত গ্রামে কৃষি ছাডা অর্থনীতির অন্য কোন খাত বিকশিত হয়নি, দেশে
গার্মেন্টস শিল্পও তখন পর্যন্ত প্রায় গড়ে ওঠার পর্যায়েÑ সেই সময়ে গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে আর্থিক কর্মকা-ে সংগঠিত করে নারী ক্ষমতায়নে গ্রামীণ ব্যাংক এক যুগান্তকারী
ভূমিকা রাখে। এ কর্মসূচি তিনি ছড়িয়ে দেন সারা দেশে এমনকি বহির্বিশ্বে। এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাÑ তিন সরকারের আমলেই গ্রামীণ ব্যাংক সরকারি আনুকল্য পেয়েছে। তবে জামায়াতিসহ কট্টর ইসলামী মৌলবাদীরা গ্রামীণ ব্যাংকের সমালোচনা করতো নারীকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসায় এবং পুরুষের সাথে একত্রে আর্থিক কর্মকা-ে সংযুক্ত করায়। ড.ইউনূসকে ইসলামপন্থীরা সুদখোর বলে গালি দিত। দেশের বহু স্থানে ওই সময় গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মী ও গ্রাহকরা জামায়াতিদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন; কিন্তু দেশে-বিদেশে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস প্রশংসিত হয়েছেন। ইউনূস তার ক্যারিশম্যাটিক গুণাবলী দ্বারা বিশ্বের বহু রাষ্ট্র নায়ক, প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পপতি, ধনকুবেরদের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রয়াসে নিবেদিত একজন সমাজকর্মী হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হন।
কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল! ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল প্রাপ্তির পর থেকে শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন। বিশেষত এক-এগারোর সরকারের সময়ে তার রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা পরিত্যাগ করার পরেও ২০০৯ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ড.ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেন। একের পর এক প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে থাকেন এবং তাকে জেলে আটকে ফেলার পরিকল্পনাও প্রায় সমাপ্তির পথে ছিল। ছাত্র-গণঅভ্যুথান সব কিছু ওলট পালট করে দেয়।
ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পূর্বে ঢাকা বিমানবন্দরে প্রথম এ কথাই বলেছিলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিলে আমার কথা শুনতে হবে।’ সেই বক্তব্য অনুযায়ী এবং প্রধান উপদেষ্টার যে নির্বাহী ক্ষমতা সে অনুযায়ী এখন যা যা ঘটছে এবং সরকারি সিদ্ধান্ত হচ্ছে তার প্রধান দায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। সরকারি কিছু সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে তিনিও কি প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে গেলেন?
তবে তফাত হচ্ছে হাসিনা অকথা-কুকথা (যেমন সুদখোর, পদ্মা সেতু থেকে টুক করে ফেলে দেয়া, চুবিয়ে উঠিয়ে আনা) সরাসরি নিজে বলতেনÑ ইউনূস নিজে বলছেন না। অন্যকে বলার অনুমতি দিচ্ছেন। সরকারের কোন কোন উপদেষ্টা ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, শোকের ১৫ আগস্ট ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যা বলছেন তা কিন্তু অনেকটা অকথা-কুকথার পর্যায়েই পড়ে। তাদের নেতা মাহফুজ আলমের ‘দায় ও দরদের সমাজ ও
রাজনীতির’ সাথে সেসব কথা যায় না।
শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্ব জানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা কে। মানুষ মাত্রই নিখুঁত নয়। শেখ মুজিবও নন। তবু তিনিই স্বাধীনতার নেতা। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন- শেখ মুজিব একা নন, স্বাধীনতা সংগ্রামে আরো অনেকের অবদান আছে। অবশ্যই আছে। নজরুল, তাজউদ্দীন, ভাসানী, মোজাফফর, মনি সিংহ, ফরহাদ, ওসমানী, জিয়া, খালেদ মোশারফ, আওয়ামী লীগের ভেতরের নিউক্লিয়াস সেল এবং আরো অনেকে আছেন।
আন্তর্জাতিকভাবেও অনেক চরিত্র আছে। যেমন ইন্দিরা গান্ধী, পোদগর্নি যাদের সহায়তা ছাডা স্বাধীনতা অর্জন আরো কঠিন হতো; কিন্তু এসবই পার্শ্ব চরিত্র। প্রধান ও কেন্দ্রীয় চরিত্র শেখ মুজিবুর রহমান। তার গগনচুম্বি ও সর্বোপরি ভূমিকাই গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার মরণপণ লড়াইয়ে। ৭ মার্চ তর্জনী উত্তোলন করে তার সেই ঘোষণাÑ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’- এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পথ নির্দেশ।
শেখ মুজিবই আমাদের স্বাধীনতার নেতা। মানলে ভালো, না মানলে বাংলাদেশই বলুন আর ‘নতুন বাংলাদেশ’ই বলুন- সেটা আপনার নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানে আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য নয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য দেখে, ১৫ আগস্টে ৩২নং বাড়ির সামনে আনন্দ নৃত্য দেখে মনে প্রশ্ন জাগে সেই রাতের সেই ঘৃণিত ঘাতকেরাই কি জিতে যাবে শেষে!
এই বিশাল বাংলাদেশে মতিয়া চৌধুরীর মতো রাজনীতিবিদের নিজের জন্য আলাদা করে কবরের জায়গা হলো না, পেলেন না মুক্তিযোদ্ধার অন্তিম সম্মান। হতে পারে তিনি আওয়ামী লীগের নেত্রী ছিলেন; কিন্তু আওয়ামী লীগ তো শুধু মাত্র দুর্বৃত্ত আর লুটেরাদের দল নয়। মতিয়া চৌধুরীর মতো ব্যক্তি জীবনে বহু সৎ মানুষও এই দল করেন এখনো দলকে ভালোবাসেন।
অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীকে স্বৈরাচারের পাশে দেখে আমরা ব্যথিত হই; কিন্তু ভুল হোক শুদ্ধ হোক সেটা তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কোন সুবিধা প্রাপ্তির আশায় তিনি বাম আদর্শ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেননি। আমি পাঁচ বছর তার প্রতিবেশী ছিলাম। তিনি তখন মন্ত্রী। আমি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কেরানি হয়েও থাকতাম ১২০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে। আর মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী থাকতেন ৬০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে। মতিয়া চৌধুরীর মতো রাজনীতিবিদকে সম্মান না জানিয়ে
ইউনূস সরকারই ছোট মনের পরিচয় দিলেন।
ড. জাফর ইকবাল ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনলজি ও বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চে ১৮ বছর কাজ করার পর দেশে ফিরে এসে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ওই বিভাগটিকে দেশ সেরা বিভাগ হিসেবে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। তার লেখা শিশু কিশোর উপযোগী মুক্তিযুদ্ধের
কাহিনীভিত্তিক বই সমূহ নতুন প্রজন্মকে মুক্তি যুদ্ধের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখে। আর এ কারণে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জঙ্গি সংগঠনগুলো কয়েকবার তাকে আক্রমণ করে হত্যা চেষ্টা চালায়।
পত্রিকায় দেখলাম তাকে আসামি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। ছাত্র আন্দোলনের আবেগপ্রসূত এক সেøাগানকে ভুল বুঝে তিনিও আবেগপ্রসূত এক মন্তব্য করেছিলেন। ব্যাস হয়ে গেলেন হত্যা মামলার আসামি।
ড. ইউনূস তো বলেছিলেন, এখন থেকে সবাই মুক্তভাবে কথা বলতে পারবে। বলেছিলেনÑ ‘সমালোচনা করেন, নাহলে জানব কিভাবে কী হচ্ছে, কী হচ্ছে না’ কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছেÑ মুক্তভাবে কথা বলতে গেলেই মনে হয় হত্যা মামলার আসামি না হয়ে যাই!
শেখ হাসিনা দেশে ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছিলেন। এমনকি তার নিজ দলের মাঝে যারা ভিন্নমত পোষণ করতেন তারাও ভয়ে তা প্রকাশ্যে বলতেন না। আর বুদ্ধিজীবী সমাজের বড অংশ তো তোষামোদি করে গোটা জাতিকে হতাশ করেছেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। শেখ হাসিনা নৃশংসতায়, ঔদ্ধত্যে, অগনন মৃত্যুতে জাতির মুখে রক্তচিহ্ন একে দেয়ার পরেও আমাদের রবীন্দ্র ভক্তদের কেউ একজনও স্বৈরাচারের দেওয়া পদক ছুড়ে ফেলার সাহস দেখাতে পারেননি। সেটা করতে পারলে আজ রাজনৈতিক ভারসাম্য কিছুটা ভিন্ন চেহারা নিত। এখন শুধু আফসোস ও আক্ষেপমূলক ও মৌলবাদের বিপদের কথা বলে কিছু হবে না। পতিত শাসকগোষ্ঠী জেদ, দম্ভ এবং স্বৈরাচারের যে বিপজ্জনক ককটেল বানিয়ে দেশ শাসন করে আসছিল তার থেকে মোহ মুক্তি না হলে শুধু ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ খুঁজে উগ্র মৌলবাদী উত্থানকে মোকাবেলা করা যাবে না।
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলের কর্মকা-ে পতিত স্বৈরাচারের পরিবর্তিত রূপ দেখলে, মানুষ কিন্তু ভিন্ন কথা বলা শুরু করবে। শেখ হাসিনা অনেক ক্ষেত্রেই সংকীর্নতা ও ক্ষুদ্র মনের পরিচয় দিয়েছেন; সেই সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতার ছায়া অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তা ও শারীরিক ভাব-ভঙ্গিতে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই হলো, বিজয় হলো। বিজয়ীদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং কথাবার্তা আচরণেও যদি ফ্যাসিবাদী প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় এরপর মানুষ যাবে কোথায়?
ড. ইউনূস বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তি। ধারণা করি রাজনৈতিক বিশ্বাসে মধ্যডানপন্থী হলেও উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি প্রবাসে বাংলাদেশের
সংহতি আন্দোলনের সাথে ছিলেন। মাত্র এক মাসে এক হাজারেরও বেশি মৃত্যু আর ৩০ হাজারের মতো আহত হওয়ার মতো বিশাল ছাত্র-গণআন্দোলনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। দ্রুততার সাথে দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের দায়িত্ব তার কাঁধে। আর এ কাজে সফল হতে হলে তার প্রয়োজন দেশবাসীর অকুন্ঠ সমর্থন। সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতা কিন্তু জনসমর্থনকে সংকুচিত করে ফেলবে। ক্ষুদ্রতা আর সংকীর্ণতায় পূর্ণতা আসে না। তাই যে গুরুদায়িত্ব এই সরকারের ওপর বর্তেছে তা পূর্ণ করতে হলে ক্ষুদ্রতার মন্দিরে নিজেদের বসানো যাবে না। পতিত সরকার ছোট মনের পরিচয় দিয়ে থাকলেও গণঅভ্যুথানের সরকার ছোট হবে কেন?
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন]
আনোয়ারুল হক
মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ আটটি জাতীয় দিবস বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমেই অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানাই এ কারণে যে, তারা এ যাত্রায় ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরকে রেহাই দিয়েছেন! আটটি দিবসের মধ্যে ৩-৪টি দলীয় বা পারিবারিকভাবে পালনযোগ্য দিবস। জাতীয় দিবস থেকে বাদ দেওয়ার জন্যও তারা ধন্যবাদ পেতে পারেন। এসব দিবসসহ কয়েকটি দিবস যে জাতীয় দিবস তা এ অধমও জানতো না। এই সংবাদ থেকেই প্রথম জানলাম।
শেখ হাসিনা সরকারের এই যে জোর করে যা খুশি চাপিয়ে দেয়ার স্বেচ্ছাচারী মনোভাব তার খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা পর্বের ঐতিহাসিক দিনসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজডিত সব কিছুকেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজের ও আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পত্তি বানিয়ে,নিজেকে তার একমাত্র উত্তরাধিকারী বানিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অবিসংবাদী নেতাকে পরিচিত করেছিলেন তারই প্রতীক হিসেবে। শেখ হাসিনা পরাজিত হয়েছেন। স্বতঃস্ফূর্ত এবং বৈচিত্র্যময় এক ছাত্র-গণঅভ্যুথানের মুখে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। ফলশ্রুতিতে এক অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছে, যার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে তার মতো করে দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা রেখে চলছিলেন। সেই আশির দশকে যখন পর্যন্ত গ্রামে কৃষি ছাডা অর্থনীতির অন্য কোন খাত বিকশিত হয়নি, দেশে
গার্মেন্টস শিল্পও তখন পর্যন্ত প্রায় গড়ে ওঠার পর্যায়েÑ সেই সময়ে গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে আর্থিক কর্মকা-ে সংগঠিত করে নারী ক্ষমতায়নে গ্রামীণ ব্যাংক এক যুগান্তকারী
ভূমিকা রাখে। এ কর্মসূচি তিনি ছড়িয়ে দেন সারা দেশে এমনকি বহির্বিশ্বে। এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাÑ তিন সরকারের আমলেই গ্রামীণ ব্যাংক সরকারি আনুকল্য পেয়েছে। তবে জামায়াতিসহ কট্টর ইসলামী মৌলবাদীরা গ্রামীণ ব্যাংকের সমালোচনা করতো নারীকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসায় এবং পুরুষের সাথে একত্রে আর্থিক কর্মকা-ে সংযুক্ত করায়। ড.ইউনূসকে ইসলামপন্থীরা সুদখোর বলে গালি দিত। দেশের বহু স্থানে ওই সময় গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মী ও গ্রাহকরা জামায়াতিদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন; কিন্তু দেশে-বিদেশে গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস প্রশংসিত হয়েছেন। ইউনূস তার ক্যারিশম্যাটিক গুণাবলী দ্বারা বিশ্বের বহু রাষ্ট্র নায়ক, প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পপতি, ধনকুবেরদের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রয়াসে নিবেদিত একজন সমাজকর্মী হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হন।
কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল! ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল প্রাপ্তির পর থেকে শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন। বিশেষত এক-এগারোর সরকারের সময়ে তার রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা পরিত্যাগ করার পরেও ২০০৯ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ড.ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেন। একের পর এক প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে থাকেন এবং তাকে জেলে আটকে ফেলার পরিকল্পনাও প্রায় সমাপ্তির পথে ছিল। ছাত্র-গণঅভ্যুথান সব কিছু ওলট পালট করে দেয়।
ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পূর্বে ঢাকা বিমানবন্দরে প্রথম এ কথাই বলেছিলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিলে আমার কথা শুনতে হবে।’ সেই বক্তব্য অনুযায়ী এবং প্রধান উপদেষ্টার যে নির্বাহী ক্ষমতা সে অনুযায়ী এখন যা যা ঘটছে এবং সরকারি সিদ্ধান্ত হচ্ছে তার প্রধান দায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। সরকারি কিছু সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে তিনিও কি প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে গেলেন?
তবে তফাত হচ্ছে হাসিনা অকথা-কুকথা (যেমন সুদখোর, পদ্মা সেতু থেকে টুক করে ফেলে দেয়া, চুবিয়ে উঠিয়ে আনা) সরাসরি নিজে বলতেনÑ ইউনূস নিজে বলছেন না। অন্যকে বলার অনুমতি দিচ্ছেন। সরকারের কোন কোন উপদেষ্টা ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, শোকের ১৫ আগস্ট ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যা বলছেন তা কিন্তু অনেকটা অকথা-কুকথার পর্যায়েই পড়ে। তাদের নেতা মাহফুজ আলমের ‘দায় ও দরদের সমাজ ও
রাজনীতির’ সাথে সেসব কথা যায় না।
শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্ব জানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা কে। মানুষ মাত্রই নিখুঁত নয়। শেখ মুজিবও নন। তবু তিনিই স্বাধীনতার নেতা। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন- শেখ মুজিব একা নন, স্বাধীনতা সংগ্রামে আরো অনেকের অবদান আছে। অবশ্যই আছে। নজরুল, তাজউদ্দীন, ভাসানী, মোজাফফর, মনি সিংহ, ফরহাদ, ওসমানী, জিয়া, খালেদ মোশারফ, আওয়ামী লীগের ভেতরের নিউক্লিয়াস সেল এবং আরো অনেকে আছেন।
আন্তর্জাতিকভাবেও অনেক চরিত্র আছে। যেমন ইন্দিরা গান্ধী, পোদগর্নি যাদের সহায়তা ছাডা স্বাধীনতা অর্জন আরো কঠিন হতো; কিন্তু এসবই পার্শ্ব চরিত্র। প্রধান ও কেন্দ্রীয় চরিত্র শেখ মুজিবুর রহমান। তার গগনচুম্বি ও সর্বোপরি ভূমিকাই গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার মরণপণ লড়াইয়ে। ৭ মার্চ তর্জনী উত্তোলন করে তার সেই ঘোষণাÑ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’- এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পথ নির্দেশ।
শেখ মুজিবই আমাদের স্বাধীনতার নেতা। মানলে ভালো, না মানলে বাংলাদেশই বলুন আর ‘নতুন বাংলাদেশ’ই বলুন- সেটা আপনার নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো মানে আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য নয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য দেখে, ১৫ আগস্টে ৩২নং বাড়ির সামনে আনন্দ নৃত্য দেখে মনে প্রশ্ন জাগে সেই রাতের সেই ঘৃণিত ঘাতকেরাই কি জিতে যাবে শেষে!
এই বিশাল বাংলাদেশে মতিয়া চৌধুরীর মতো রাজনীতিবিদের নিজের জন্য আলাদা করে কবরের জায়গা হলো না, পেলেন না মুক্তিযোদ্ধার অন্তিম সম্মান। হতে পারে তিনি আওয়ামী লীগের নেত্রী ছিলেন; কিন্তু আওয়ামী লীগ তো শুধু মাত্র দুর্বৃত্ত আর লুটেরাদের দল নয়। মতিয়া চৌধুরীর মতো ব্যক্তি জীবনে বহু সৎ মানুষও এই দল করেন এখনো দলকে ভালোবাসেন।
অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীকে স্বৈরাচারের পাশে দেখে আমরা ব্যথিত হই; কিন্তু ভুল হোক শুদ্ধ হোক সেটা তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কোন সুবিধা প্রাপ্তির আশায় তিনি বাম আদর্শ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেননি। আমি পাঁচ বছর তার প্রতিবেশী ছিলাম। তিনি তখন মন্ত্রী। আমি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কেরানি হয়েও থাকতাম ১২০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে। আর মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী থাকতেন ৬০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে। মতিয়া চৌধুরীর মতো রাজনীতিবিদকে সম্মান না জানিয়ে
ইউনূস সরকারই ছোট মনের পরিচয় দিলেন।
ড. জাফর ইকবাল ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনলজি ও বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চে ১৮ বছর কাজ করার পর দেশে ফিরে এসে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ওই বিভাগটিকে দেশ সেরা বিভাগ হিসেবে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। তার লেখা শিশু কিশোর উপযোগী মুক্তিযুদ্ধের
কাহিনীভিত্তিক বই সমূহ নতুন প্রজন্মকে মুক্তি যুদ্ধের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখে। আর এ কারণে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জঙ্গি সংগঠনগুলো কয়েকবার তাকে আক্রমণ করে হত্যা চেষ্টা চালায়।
পত্রিকায় দেখলাম তাকে আসামি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। ছাত্র আন্দোলনের আবেগপ্রসূত এক সেøাগানকে ভুল বুঝে তিনিও আবেগপ্রসূত এক মন্তব্য করেছিলেন। ব্যাস হয়ে গেলেন হত্যা মামলার আসামি।
ড. ইউনূস তো বলেছিলেন, এখন থেকে সবাই মুক্তভাবে কথা বলতে পারবে। বলেছিলেনÑ ‘সমালোচনা করেন, নাহলে জানব কিভাবে কী হচ্ছে, কী হচ্ছে না’ কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছেÑ মুক্তভাবে কথা বলতে গেলেই মনে হয় হত্যা মামলার আসামি না হয়ে যাই!
শেখ হাসিনা দেশে ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছিলেন। এমনকি তার নিজ দলের মাঝে যারা ভিন্নমত পোষণ করতেন তারাও ভয়ে তা প্রকাশ্যে বলতেন না। আর বুদ্ধিজীবী সমাজের বড অংশ তো তোষামোদি করে গোটা জাতিকে হতাশ করেছেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। শেখ হাসিনা নৃশংসতায়, ঔদ্ধত্যে, অগনন মৃত্যুতে জাতির মুখে রক্তচিহ্ন একে দেয়ার পরেও আমাদের রবীন্দ্র ভক্তদের কেউ একজনও স্বৈরাচারের দেওয়া পদক ছুড়ে ফেলার সাহস দেখাতে পারেননি। সেটা করতে পারলে আজ রাজনৈতিক ভারসাম্য কিছুটা ভিন্ন চেহারা নিত। এখন শুধু আফসোস ও আক্ষেপমূলক ও মৌলবাদের বিপদের কথা বলে কিছু হবে না। পতিত শাসকগোষ্ঠী জেদ, দম্ভ এবং স্বৈরাচারের যে বিপজ্জনক ককটেল বানিয়ে দেশ শাসন করে আসছিল তার থেকে মোহ মুক্তি না হলে শুধু ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ খুঁজে উগ্র মৌলবাদী উত্থানকে মোকাবেলা করা যাবে না।
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলের কর্মকা-ে পতিত স্বৈরাচারের পরিবর্তিত রূপ দেখলে, মানুষ কিন্তু ভিন্ন কথা বলা শুরু করবে। শেখ হাসিনা অনেক ক্ষেত্রেই সংকীর্নতা ও ক্ষুদ্র মনের পরিচয় দিয়েছেন; সেই সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতার ছায়া অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তা ও শারীরিক ভাব-ভঙ্গিতে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই হলো, বিজয় হলো। বিজয়ীদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং কথাবার্তা আচরণেও যদি ফ্যাসিবাদী প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় এরপর মানুষ যাবে কোথায়?
ড. ইউনূস বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তি। ধারণা করি রাজনৈতিক বিশ্বাসে মধ্যডানপন্থী হলেও উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি প্রবাসে বাংলাদেশের
সংহতি আন্দোলনের সাথে ছিলেন। মাত্র এক মাসে এক হাজারেরও বেশি মৃত্যু আর ৩০ হাজারের মতো আহত হওয়ার মতো বিশাল ছাত্র-গণআন্দোলনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। দ্রুততার সাথে দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের দায়িত্ব তার কাঁধে। আর এ কাজে সফল হতে হলে তার প্রয়োজন দেশবাসীর অকুন্ঠ সমর্থন। সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতা কিন্তু জনসমর্থনকে সংকুচিত করে ফেলবে। ক্ষুদ্রতা আর সংকীর্ণতায় পূর্ণতা আসে না। তাই যে গুরুদায়িত্ব এই সরকারের ওপর বর্তেছে তা পূর্ণ করতে হলে ক্ষুদ্রতার মন্দিরে নিজেদের বসানো যাবে না। পতিত সরকার ছোট মনের পরিচয় দিয়ে থাকলেও গণঅভ্যুথানের সরকার ছোট হবে কেন?
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন]