alt

উপ-সম্পাদকীয়

অতীতটা হয়ে যাক দূর

গাজী তারেক আজিজ

: শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪

কালজয়ী কণ্ঠশিল্পী কিশোর কুমারের গানটির একটি লাইন ‘অতীতটা হয়ে যাক দূর’। আমরা চাইলেই অতীতকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারি না। ভুলেও যেতে পারি না। পারি না বলেই বারবার ফিরে আসে অতীত। নিকট অতীত কিংবা দূরবর্তী অতীত। সে অতীত কখনো ভালো। কখনো দুর্বিষহ! ভালোর ভালো আমরা আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই। অনেকটা জোর করে। থাকতে চাই রোমাঞ্চকর অনুভব নিয়ে। যুগ থেকে যুগান্ত র বয়ে বেড়াতে চাই। অতীতের মায়ায় জড়িয়ে নিজেকে সঁপে দিতে চাই।

গানটিতে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের মেলবন্ধন খুঁজতে গিয়ে বর্তমান সময়েও সুরবদ্ধ গানটির কথা ও গায়কী বেশ নাড়া দিয়ে যায়। অমলিন থাকে সুর ও ছন্দের কাব্যিক দ্যোতনা। এত সাবলীল কথার গান অথচ মর্মস্পর্শী একবার শুনলে বারবার শুনতে মন চাইবে। যা শ্রোতার মনের কথা হয়ে মুখ ফুটে বের হয় অবচেতন মনে। মানুষ কখনো কাজের চাপ প্রশমন করতে গান শোনে। যদিও একেকজন একেক ভাবে তার মানসিক প্রশান্তি পেতে চায়। কেউ নামাজ পড়ে। কেউ আড্ডায়। কেউ ঘুরেফিরে। আবার কেউ একা থেকে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে মানুষজন থেকে দূরে সরিয়েও ভালো থাকতে চায়। আদতে মানুষ সব ব্যতিব্যস্ততার ভিতরও নিজেকে নিয়ে ভাবনার অতলে হারাতে চায়।

বর্তমান সময়ে দেশের পটপরিবর্তন মানুষজনকে ভাবতে শিখিয়েছে আমরা কি গৌরবময় অতীত ভুলে থেকে নিকট অতীতের কাছে নিজেকে বিলীন হতে দেব? নাকি আমরা শুধু সময়কে ধারণ করে চলতে শিখবো? যদি বর্তমানই আমাদের সব হয় তবে এমন করেই একদিন আজকের অর্জনও সময়ের আবর্তে বিলীন করে দিয়ে আরেক নতুন ঠাঁই করে নিবে। আমাদের অতীত আছে। সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। সবকিছুর মিশেলে আছে ঐতিহ্যের প্রাচুর্যে ভরপুর ধারাবাহিক অর্জন ও সাফল্য। তারপরও কেন আমরা অতীত মুছে দিতে চাই? আমাদের কি অতীত দরকার পড়বে না? আমাদের অতীত কি শুধুই বিস্মৃতির?

মানুষই তো অতীতের সুখকর স্মৃতি হাতড়ে পুলকিত হয়। সাম্প্রতিক দুর্বিষহ অতীত মুছে ফেলেও পুরাতন ভালোকে বিস্তৃত জায়গাজুড়ে স্থান করে দেয়। আমরা সবসময় যা চাই তা হয়তো নিজের মতো করে পেতে চাই। কখনো হয় আবার কখনো হয় না। হলে কখনো তা অর্জন হিসেবে ধরে নিয়ে বেশ গর্ববোধ করি। না হলে সেক্ষেত্রে ভাগ্যের ওপর দায় চাপিয়ে সোজাসাপ্টা নির্ভার থাকতে চাই। আর চাই বলেই আমরা মানুষ। আমাদেরও আছে হেয়ালি মনোভাবের বিস্তার! তাই আমাদের মতো মানুষেরও মৌলিক কিছু ছেদ আছে; যা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবার চিন্তা অমূলক। তবে কখনো কখনো ছেদ আরও পোক্ত হতে সহায়তা দিয়ে থাকে।

রাজনীতিতে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব বেশ জটিল। পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় কখনো উপলক্ষ্যহীন প্রাপ্তির ভূমিকা অগ্রগণ্য। দেখা যায় লড়াই সংগ্রাম করতে করতে জেল-জুলুম, হামলা-মামলায় জর্জরিত মানুষটার হয়তো রাজনীতি থেকে কিছুই পাওয়া হয়ে ওঠে না। আবার জুলিয়াস সিজারের বিখ্যাত উক্তি ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ এর মতো করে অনেকের অনেক কিছু পাওয়া হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘপথ কণ্টকাকীর্ণ পাড়ি দিয়েও অনেককে আসতে হয়। অবশ্য আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সবসময় তা না হয়ে ভিন্নভাবেও ধরা দেয়। যেমন- যে যেই কাজের জন্য উপযুক্ত নয়, সে সেই কাজে সফল হয়ে যায়। এটাকেও আমরা অলীক বলে থাকি। তবে পেয়ে হারানোর কষ্ট কেউই মানতে চায় না। যদি প্রত্যাশিত জিনিস না পায় যতটুকু কষ্ট লাগে তার চেয়ে ঢের বেশি কষ্ট পেয়ে থাকে একান্ত চেনা পরিচিতজন পেয়ে গেলে কষ্ট আরও দ্বিগুণ হয়ে বিঁধে।

এ নিয়েও একটা কৌতুক আছে। একটা দৈত্য এসে হাজির হয়ে এক মহিলাকে বললোÑ তুই আমার কাছে যা চাস তা-ই পাবি। তখন মহিলাটি খুশিতে গদগদ হয়ে যখনই সেই দৈত্যের কাছে দাবি জানাতে যাবে জিন তখন বলে উঠলো, তবে শর্ত আছে। মহিলা তখন বললো কি সেই শর্ত? দৈত্য তখন বললোÑ তুই যা চাইবি তোর প্রতিবেশীকে তার দ্বিগুণ দেয়া হবে! মহিলা বেশ চিন্তা করে বুদ্ধি খাটিয়ে বলে উঠলোÑ হ্যাঁ দিন আমার এক চোখ অন্ধ করে দিন! তখন দৈত্য তার এক চোখ অন্ধ করে দিল। আর প্রতিবেশীর দুই চোখ অন্ধ করতে গিয়ে দৈত্য দেখে সেই প্রতিবেশী এক্সিডেন্টে মারা গেছে পুরো পরিবারের সঙ্গে। সেই পরিবারে ছিল স্বামী-স্ত্রী দুইজন। তখন দৈত্য ফিরে এসে আগের এক চোখ নেয়া মহিলাকে মেরে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখলো। এভাবেই হিংসা-প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে যেয়ে মানুষ কখনো নিজের বিপদ ডেকে আনে।

আমরা কৌতুকের সে মহিলা কিংবা দৈত্য উপদ্রুত সময়কে ধারণ করতে চাই না। আমরা হিংসা প্রতিহিংসার বেড়াজালে থেকে বিদ্বেষে জড়াতে চাই না। আমরা এমন অতীত সামনে আনতে চাই না, যে অতীত ভবিষ্যতের পথরুদ্ধ করে সামনে এগোতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা আমাদের গৌরব মনে রাখতে চাই। মানুষ হয়তো সবসময় যা চায় তা পায় না। আবার যা না চায় তা-ই পেয়ে যায়। সেই পাওয়ার কাল ক্ষণস্থায়ী হয়ে আবার বিষাদে ভাসিয়ে দেয়। হয়তো কাক্সিক্ষত না পাওয়াই মানুষকে বেশি কষ্ট দেয়। মানুষ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হয়ে যায় বেসামাল। তারও বেশি হলে অপ্রকৃতস্থ হয়ে স্বজনদের বাড়তি বোঝারূপে আবির্ভূত হয়। এটা প্রিয়জন হারিয়েও হতে পারে। প্রিয়জন হারিয়ে মনের ভেতর যে কষ্ট বয়ে বেড়ায় তা থেকে উত্তরণে অনেকেই নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়ার নজিরও অগডুত। তারপরও মানুষ অতীতকে দূরে সরাতে পারে না।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানের যে চিত্র উঠে এসেছে মিডিয়ার বরাতে, তা কারো জন্যই সুখকর ছিল না। বয়ে বেড়াতে হবে ক্ষতচিহ্ন! যুগের পর যুগ। বংশপরম্পরায় তাড়িয়ে বেড়াবে সদ্য অতীত; যা ছিল দৃশ্যমান। এভাবে পরবর্তী প্রজন্ম জানবে ইতিহাসের পাঠ। এই ইতিহাস চাইলেও কেউ ভুলে যেতে পারবে না।

ইতিহাসের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আরও ইতিহাস গড়ে। তবু ভোলা যায় না। সে অর্থে বলতে পারি ভালো হোক আর খারাপ হোক অতীত দূরে যায় না। ছায়ার মতো লেপ্টে থাকে। যেমন কোনকিছুর ছায়া শুধু অন্ধকারেই মিলিয়ে যায়। তেমনি আরও কোন ক্ষত বিষাদ কষ্ট হলেই সে অতীত কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়। আমরা ইতিহাসের ১৭৫৭, ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৯০ এবং হালের ২০২৪ সালেও এসে ভুলতে পারিনি। এ যেন জ্বলজ্বলে ইতিহাস। আমরা ধারণ করে চলেছি। এরই মধ্যে আরও কত শত স্মৃতিতে মলিন থেকেছি।

রাজনীতির ঘটনা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই ৩য় বিশ্ব কবে যে স্থিতিশীল হবে তা-ও অজানা। আমরা যেন কারো হাতের পুতুল হয়ে খেলছি। এ অবস্থা বুঝতে পারার আগে অনেক কিছু বিলিয়ে দিতে হয়। তবুও কেন বুঝতে পারি না আমরা।

আমরা দেখেছি দোর্দ-প্রতাপশালী রাজাকে টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামাতে। দেখেছি প্রবল পরাক্রমশালী সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে দেশ ছেড়ে যেতে। আমরা এটাও দেখেছি বিনাযুদ্ধে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে যেতে। দেখেছি ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির ধ্বংসে তা-বলীলা। সব দেখার ভেতর দেখেছি ইতিহাস লুট হয়ে যেতে। তা-ও কি শান্তি এসেছে পৃথিবীতে? আমরা শান্তি র জন্য পুরষ্কার বা স্বীকৃতি পাই। সে স্বীকৃতিও কতটুকু কাজে আসে?

আমরা তেমন অতীত দূরে সরাতে চাই যে অতীত আমাদের নিজেদের বাঁচার পথে অন্ত রায় হয়ে দাঁড়ায়। আমরা ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে নতুন করে গড়তে চাই আসামির স্বপ্নের বিশ্ব। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ দেশের গাছ বন নদী আলো হাওয়া যে বলতে শিখিয়েছে এ দেশ আমাদের। আমরাই বাসযোগ্য করে গড়ে তুলব এই ভূমি।

আমরা ভিনদেশী পরাশক্তির পুতুল হয়ে নয়, নিজেদের বুদ্ধিমত্তা শক্তিমত্তা ও উদ্যোম কাজে লাগিয়ে অদম্য ইচ্ছাশক্তির মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচাতে চাই। যেখানে থাকবে শুধু ই সুখকর অতীত। সে অতীত কেউ-ই দূরে সরাতে চাই না। শুধু-ই বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে যাওয়া অতীত দূরে সরিয়ে নয়, ঝেটিয়ে বিদায় করতে চাইব। তারপর আহ্বান জানাব নিরাপদ পৃথিবী বাসযোগ্য পৃথিবীর।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন

ধনিক শ্রেণীর চলমান সংকট

ছবি

বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য এবং আমাদের প্রান্তিক মানুষ

বায়ু দূষণের কারণে বাড়ছে ওষুধের ব্যবহার

শুভ বড়দিন

উগান্ডায় নতুন ভাইরাস ডিঙ্গা ডিঙ্গা

পরিবেশবান্ধব ঢাকা চাই

বনভূমি রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন

ছবি

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা : ফ্যাসিবাদী প্রবণতা সৃষ্টির প্রথম ভ্রুণ

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভূমিকা

প্রগতিতে অগ্রগতি

পরিবারতন্ত্র ও পরিবারতত্ত্ব : উত্তরণের উপায়

উপেক্ষিত উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা

সরিষার তেল গবেষণায় সাফল্য

সিরিয়ায় রাজনৈতিক পালাবদল : কার লাভ, কার ক্ষতি?

অতীত থেকে মুক্তি এবং ইতিবাচক জীবনযাপন

মুক্তি সংগ্রামে তিনটি ধারা

বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা কেন পিছিয়ে

শুধু নিচেই নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

উপেক্ষিত আটকে পড়া পাকিস্তানিরা

রম্যগদ্য : সিন্দাবাদের বুড়ো ও আমরা

নেই কেনো সেই পাখি

বায়ুদূষণ থেকে মুক্তি কোন পথে

পরিবারতত্ত্ব ও পরিবারতন্ত্র : রাষ্ট্র সংস্কারের দুর্গম পথ

পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র

বিজয়ের প্রেরণা

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার পুনর্বীক্ষণ

সিদরাত জেবিনের মৃত্যু অথবা প্রশ্নহীন বায়ুদূষণ

বিজয়ের গৌরব ও সম্ভাবনাময় তরুণ সমাজ

ছবি

মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান

ছবি

বিজয় সংগ্রামের সূচনার সন্ধানে

মানসম্মত কনটেন্ট ও টিআরপির দ্বৈরথ

জিকা ভাইরাস রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবার গুরুত্ব

ঢাকার বাতাস বিষাক্ত কেন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অতীতটা হয়ে যাক দূর

গাজী তারেক আজিজ

শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪

কালজয়ী কণ্ঠশিল্পী কিশোর কুমারের গানটির একটি লাইন ‘অতীতটা হয়ে যাক দূর’। আমরা চাইলেই অতীতকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারি না। ভুলেও যেতে পারি না। পারি না বলেই বারবার ফিরে আসে অতীত। নিকট অতীত কিংবা দূরবর্তী অতীত। সে অতীত কখনো ভালো। কখনো দুর্বিষহ! ভালোর ভালো আমরা আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই। অনেকটা জোর করে। থাকতে চাই রোমাঞ্চকর অনুভব নিয়ে। যুগ থেকে যুগান্ত র বয়ে বেড়াতে চাই। অতীতের মায়ায় জড়িয়ে নিজেকে সঁপে দিতে চাই।

গানটিতে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের মেলবন্ধন খুঁজতে গিয়ে বর্তমান সময়েও সুরবদ্ধ গানটির কথা ও গায়কী বেশ নাড়া দিয়ে যায়। অমলিন থাকে সুর ও ছন্দের কাব্যিক দ্যোতনা। এত সাবলীল কথার গান অথচ মর্মস্পর্শী একবার শুনলে বারবার শুনতে মন চাইবে। যা শ্রোতার মনের কথা হয়ে মুখ ফুটে বের হয় অবচেতন মনে। মানুষ কখনো কাজের চাপ প্রশমন করতে গান শোনে। যদিও একেকজন একেক ভাবে তার মানসিক প্রশান্তি পেতে চায়। কেউ নামাজ পড়ে। কেউ আড্ডায়। কেউ ঘুরেফিরে। আবার কেউ একা থেকে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে মানুষজন থেকে দূরে সরিয়েও ভালো থাকতে চায়। আদতে মানুষ সব ব্যতিব্যস্ততার ভিতরও নিজেকে নিয়ে ভাবনার অতলে হারাতে চায়।

বর্তমান সময়ে দেশের পটপরিবর্তন মানুষজনকে ভাবতে শিখিয়েছে আমরা কি গৌরবময় অতীত ভুলে থেকে নিকট অতীতের কাছে নিজেকে বিলীন হতে দেব? নাকি আমরা শুধু সময়কে ধারণ করে চলতে শিখবো? যদি বর্তমানই আমাদের সব হয় তবে এমন করেই একদিন আজকের অর্জনও সময়ের আবর্তে বিলীন করে দিয়ে আরেক নতুন ঠাঁই করে নিবে। আমাদের অতীত আছে। সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। সবকিছুর মিশেলে আছে ঐতিহ্যের প্রাচুর্যে ভরপুর ধারাবাহিক অর্জন ও সাফল্য। তারপরও কেন আমরা অতীত মুছে দিতে চাই? আমাদের কি অতীত দরকার পড়বে না? আমাদের অতীত কি শুধুই বিস্মৃতির?

মানুষই তো অতীতের সুখকর স্মৃতি হাতড়ে পুলকিত হয়। সাম্প্রতিক দুর্বিষহ অতীত মুছে ফেলেও পুরাতন ভালোকে বিস্তৃত জায়গাজুড়ে স্থান করে দেয়। আমরা সবসময় যা চাই তা হয়তো নিজের মতো করে পেতে চাই। কখনো হয় আবার কখনো হয় না। হলে কখনো তা অর্জন হিসেবে ধরে নিয়ে বেশ গর্ববোধ করি। না হলে সেক্ষেত্রে ভাগ্যের ওপর দায় চাপিয়ে সোজাসাপ্টা নির্ভার থাকতে চাই। আর চাই বলেই আমরা মানুষ। আমাদেরও আছে হেয়ালি মনোভাবের বিস্তার! তাই আমাদের মতো মানুষেরও মৌলিক কিছু ছেদ আছে; যা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবার চিন্তা অমূলক। তবে কখনো কখনো ছেদ আরও পোক্ত হতে সহায়তা দিয়ে থাকে।

রাজনীতিতে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব বেশ জটিল। পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় কখনো উপলক্ষ্যহীন প্রাপ্তির ভূমিকা অগ্রগণ্য। দেখা যায় লড়াই সংগ্রাম করতে করতে জেল-জুলুম, হামলা-মামলায় জর্জরিত মানুষটার হয়তো রাজনীতি থেকে কিছুই পাওয়া হয়ে ওঠে না। আবার জুলিয়াস সিজারের বিখ্যাত উক্তি ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ এর মতো করে অনেকের অনেক কিছু পাওয়া হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘপথ কণ্টকাকীর্ণ পাড়ি দিয়েও অনেককে আসতে হয়। অবশ্য আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সবসময় তা না হয়ে ভিন্নভাবেও ধরা দেয়। যেমন- যে যেই কাজের জন্য উপযুক্ত নয়, সে সেই কাজে সফল হয়ে যায়। এটাকেও আমরা অলীক বলে থাকি। তবে পেয়ে হারানোর কষ্ট কেউই মানতে চায় না। যদি প্রত্যাশিত জিনিস না পায় যতটুকু কষ্ট লাগে তার চেয়ে ঢের বেশি কষ্ট পেয়ে থাকে একান্ত চেনা পরিচিতজন পেয়ে গেলে কষ্ট আরও দ্বিগুণ হয়ে বিঁধে।

এ নিয়েও একটা কৌতুক আছে। একটা দৈত্য এসে হাজির হয়ে এক মহিলাকে বললোÑ তুই আমার কাছে যা চাস তা-ই পাবি। তখন মহিলাটি খুশিতে গদগদ হয়ে যখনই সেই দৈত্যের কাছে দাবি জানাতে যাবে জিন তখন বলে উঠলো, তবে শর্ত আছে। মহিলা তখন বললো কি সেই শর্ত? দৈত্য তখন বললোÑ তুই যা চাইবি তোর প্রতিবেশীকে তার দ্বিগুণ দেয়া হবে! মহিলা বেশ চিন্তা করে বুদ্ধি খাটিয়ে বলে উঠলোÑ হ্যাঁ দিন আমার এক চোখ অন্ধ করে দিন! তখন দৈত্য তার এক চোখ অন্ধ করে দিল। আর প্রতিবেশীর দুই চোখ অন্ধ করতে গিয়ে দৈত্য দেখে সেই প্রতিবেশী এক্সিডেন্টে মারা গেছে পুরো পরিবারের সঙ্গে। সেই পরিবারে ছিল স্বামী-স্ত্রী দুইজন। তখন দৈত্য ফিরে এসে আগের এক চোখ নেয়া মহিলাকে মেরে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখলো। এভাবেই হিংসা-প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে যেয়ে মানুষ কখনো নিজের বিপদ ডেকে আনে।

আমরা কৌতুকের সে মহিলা কিংবা দৈত্য উপদ্রুত সময়কে ধারণ করতে চাই না। আমরা হিংসা প্রতিহিংসার বেড়াজালে থেকে বিদ্বেষে জড়াতে চাই না। আমরা এমন অতীত সামনে আনতে চাই না, যে অতীত ভবিষ্যতের পথরুদ্ধ করে সামনে এগোতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা আমাদের গৌরব মনে রাখতে চাই। মানুষ হয়তো সবসময় যা চায় তা পায় না। আবার যা না চায় তা-ই পেয়ে যায়। সেই পাওয়ার কাল ক্ষণস্থায়ী হয়ে আবার বিষাদে ভাসিয়ে দেয়। হয়তো কাক্সিক্ষত না পাওয়াই মানুষকে বেশি কষ্ট দেয়। মানুষ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হয়ে যায় বেসামাল। তারও বেশি হলে অপ্রকৃতস্থ হয়ে স্বজনদের বাড়তি বোঝারূপে আবির্ভূত হয়। এটা প্রিয়জন হারিয়েও হতে পারে। প্রিয়জন হারিয়ে মনের ভেতর যে কষ্ট বয়ে বেড়ায় তা থেকে উত্তরণে অনেকেই নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়ার নজিরও অগডুত। তারপরও মানুষ অতীতকে দূরে সরাতে পারে না।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানের যে চিত্র উঠে এসেছে মিডিয়ার বরাতে, তা কারো জন্যই সুখকর ছিল না। বয়ে বেড়াতে হবে ক্ষতচিহ্ন! যুগের পর যুগ। বংশপরম্পরায় তাড়িয়ে বেড়াবে সদ্য অতীত; যা ছিল দৃশ্যমান। এভাবে পরবর্তী প্রজন্ম জানবে ইতিহাসের পাঠ। এই ইতিহাস চাইলেও কেউ ভুলে যেতে পারবে না।

ইতিহাসের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আরও ইতিহাস গড়ে। তবু ভোলা যায় না। সে অর্থে বলতে পারি ভালো হোক আর খারাপ হোক অতীত দূরে যায় না। ছায়ার মতো লেপ্টে থাকে। যেমন কোনকিছুর ছায়া শুধু অন্ধকারেই মিলিয়ে যায়। তেমনি আরও কোন ক্ষত বিষাদ কষ্ট হলেই সে অতীত কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়। আমরা ইতিহাসের ১৭৫৭, ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৯০ এবং হালের ২০২৪ সালেও এসে ভুলতে পারিনি। এ যেন জ্বলজ্বলে ইতিহাস। আমরা ধারণ করে চলেছি। এরই মধ্যে আরও কত শত স্মৃতিতে মলিন থেকেছি।

রাজনীতির ঘটনা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এই ৩য় বিশ্ব কবে যে স্থিতিশীল হবে তা-ও অজানা। আমরা যেন কারো হাতের পুতুল হয়ে খেলছি। এ অবস্থা বুঝতে পারার আগে অনেক কিছু বিলিয়ে দিতে হয়। তবুও কেন বুঝতে পারি না আমরা।

আমরা দেখেছি দোর্দ-প্রতাপশালী রাজাকে টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামাতে। দেখেছি প্রবল পরাক্রমশালী সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে দেশ ছেড়ে যেতে। আমরা এটাও দেখেছি বিনাযুদ্ধে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে যেতে। দেখেছি ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির ধ্বংসে তা-বলীলা। সব দেখার ভেতর দেখেছি ইতিহাস লুট হয়ে যেতে। তা-ও কি শান্তি এসেছে পৃথিবীতে? আমরা শান্তি র জন্য পুরষ্কার বা স্বীকৃতি পাই। সে স্বীকৃতিও কতটুকু কাজে আসে?

আমরা তেমন অতীত দূরে সরাতে চাই যে অতীত আমাদের নিজেদের বাঁচার পথে অন্ত রায় হয়ে দাঁড়ায়। আমরা ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে নতুন করে গড়তে চাই আসামির স্বপ্নের বিশ্ব। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ দেশের গাছ বন নদী আলো হাওয়া যে বলতে শিখিয়েছে এ দেশ আমাদের। আমরাই বাসযোগ্য করে গড়ে তুলব এই ভূমি।

আমরা ভিনদেশী পরাশক্তির পুতুল হয়ে নয়, নিজেদের বুদ্ধিমত্তা শক্তিমত্তা ও উদ্যোম কাজে লাগিয়ে অদম্য ইচ্ছাশক্তির মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচাতে চাই। যেখানে থাকবে শুধু ই সুখকর অতীত। সে অতীত কেউ-ই দূরে সরাতে চাই না। শুধু-ই বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে যাওয়া অতীত দূরে সরিয়ে নয়, ঝেটিয়ে বিদায় করতে চাইব। তারপর আহ্বান জানাব নিরাপদ পৃথিবী বাসযোগ্য পৃথিবীর।

[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

back to top