শেখর ভট্টাচার্য
তাজউদ্দীন আহমদকে কেউ বলেন ইতিহাসের রূপকার, কেউ বলেন ইতিহাসের নির্মোহ নির্মাতা। তাজউদ্দীন আহমদ নিজে ইতিহাসের অজানা, অচেনা কেউ হয়ে থাকতে চেয়েছেন। ইতিহাস তাকে দৃশ্যমান করুক, তাজউদ্দীন তা কখনো প্রত্যাশা করেননি। তাজউদ্দীন সজ্ঞানে বলে গেছেন, ‘তুমি ইতিহাসে এমনভাবে কাজ করো যেন ইতিহাসে কোথাও তোমাকে খুঁজে পাওয়া না যায়।’ ইতিহাসের এমন নির্মোহ, নিরাকার, প্রত্যাশাহীন নির্মাতার সংখ্যা পৃথিবীতে যে খুব বেশি নেই তা আমরা বলতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের যত গভীরে যাওয়া যায়, তাজউদ্দীন আহমদের অনন্য নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমীহের পরিমাণও তত বেড়ে যায়। তাজউদ্দীন আহমদ, এমন একজন নীরব ও নির্মোহ ইতিহাসের রূপকার যাকে ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে খুঁজে বের করে নিয়ে আসতে হয়। তিনি নিজে এসে উপস্থিত হননা। ছকে বাঁধা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় তাকে খুঁজে পাওয়া ভার। আমরা যখন তার অসীম সাহসী নেতৃত্ব, চরিত্রের দৃঢ়তা, উদ্দেশ্য লাভের জন্য আন্তরিক নিবেদন প্রত্যক্ষ করি তখন তাকে মনে হয়, ইতিহাসের ঘোর অন্ধকার থেকে আলোর পথে উত্তরণের একজন সাহসী ‘ত্রাতা’।
তাজউদ্দীন আহমদের মতো বিশাল মানুষকে উন্মোচন করার জন্য প্রচুর গবেষণার প্রয়োজন আছে। তা যে খুব বেশি পরিমাণে হচ্ছে না তা আমরা বলতে পারি। মুক্তিযুদ্ধকে জানার একটি ছক তৈরি হয়ে গেছে দেশে। সেই ছক বা বৃত্তের বাইরে কেউ যেতে ইচ্ছুক নন। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত আমরা ইতিহাসকে অনুসন্ধান করি দফাওয়ারি আন্দোলনের ভাঁজে। সেই ভাঁজের ভেতরে থাকে প্রধানত আন্দোলনের রুটিন বা ধারাবাহিক বর্ণনা। ইতিহাসের পেছনের ইতিহাসকে গবেষণা করে উন্মোচন করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় খুব কম।
২৫ মার্চ গভীর রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করার পর, জাতির ক্রান্তিলগ্নে নেতৃত্বের সব দায় অসীম সাহস নিয়ে গ্রহণ করেন তাজউদ্দীন আহমদ। জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় দুর্যোগ ও গৌরবের এই সময়ে তাজউদ্দীন যদি একটি মাত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল করতেন তাহলে আমাদের ইতিহাস ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হতে পারত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় তাকে একাই একটি সরু সুতার ওপর দিয়ে হাঁটতে হয়েছে যার নিচে ছিল অগ্নি স্ফুলিঙ্গ। তিনি জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য বানিয়ে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চে , পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর চোখ এড়িয়ে, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। জীবনকে আগাম উৎসর্গ করেছিলেন তিনি মাতৃভূমির জন্য। বাঙালি জাতির এই অচেনা, ভয়াবহ পথে এগিয়ে যাওয়ার সময় তিনি তার পরিবারকে কী বার্তা দিয়ে গিয়েছিলেন? তিনি একটি চিরকূটে তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন লিলিকে লিখেন ‘লিলি, আমি চলে গেলাম। যাওয়ার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিও। আবার কবে দেখা হবে জানি না’। তাজউদ্দীন আহমদ ব্যক্তিগত জীবনে আবেগকে তেমন প্রাধান্য দিতেন না, এর মানে এই নয় যে তিনি ছিলেন আবেগহীন।
তাজউদ্দীন আহমদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২৫ ইংরেজি সালে, বর্তমান ঢাকা জেলার, কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কারাগারে রাতের অন্ধকারে পাক-মার্কিন দোসর মোশতাক ও সামরিক বাহিনীর কিছুসংখ্যক পাক-মার্কিন এজেন্ট তাজউদ্দীনসহ জাতীয় চার নেতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। সেই হত্যাকা- ও এর পেছনের গল্প বলা আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়। আজকের লেখার উদ্দেশ্য, তাজউদ্দীন আহমদ যে কত বড় মহীরুহ ছিলেন সে সম্পর্কে সামান্য ঈঙ্গিত প্রদান করা। তাজউদ্দীনের এই সফল ও ত্যাগী জীবনকে চারটি পর্বে ভাগ করা যায়। ১৯২৫ থেকে পাকিস্তান অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত প্রথম পর্ব, পাকিস্তান অর্জনের পর থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্ব, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের মুহূর্ত পর্যন্ত তৃতীয় পর্ব এবং ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল থেকে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জীবনের শেষ পর্ব। তাকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হলে তার জীবনের এই চারটি পর্বকেই বিবেচনায় নিয়ে আসতে হয়। তবে তার নেতৃত্বের বিকশিত সময় প্রত্যক্ষ করতে হলে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন পর্যন্ত তার ভূমিকাকে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।
তাজউদ্দীন আহমদ যখন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন তাকে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে এবং ভারতের প্রভাবমুক্ত থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার এক বিশাল চ্যালেঞ্জের সামনে নিয়ে আসে। তিনি ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ৩০ মার্চ সীমান্ত পার হওয়ার পরেই তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তরক্ষী প্রধান ইন্সপেক্টর জেনারেল গোলোক মজুমদারের সঙ্গে। গোলক মজুমদারকে তাজউদ্দীন তার প্রখর ব্যক্তিত্ব ও স্বকীয় ধরনে জানিয়ে দেন ভারত সরকারের সঙ্গে তার আলোচনা হবে তখনই যখন সরকারের পক্ষ থেকে তিনি ও মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তিনি সুস্পষ্টভাবে গোলক মজুমদারকে অবগত করেন তিনি ও তার সহযোগী নেতারা স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতিনিধি।
তাজউদ্দীনের কথা শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন আইজি মজুমদার। তার রাষ্ট্রনায়কোচিত ব্যক্তিত্ব ও দূরদর্শিতার প্রমাণ পেয়েছিলেন তিনি এই দুরদর্শী প্রস্তাবে। তাজউদ্দীন আহমদের প্রস্তাব অনুযায়ী ভারত সরকার এপ্রিল ৩, ১৯৭১ সালে, তাজউদ্দীন আহমদকে আমন্ত্রণ জানায়। প্রথম সাক্ষাতে তাজউদ্দীন, একজন স্বাধীনতাকামী জাতির নেতা হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে কিছু বিষয় বিনয়ের সঙ্গে উপস্থাপন করেন। তাজউদ্দীনের সুস্পষ্ট বক্তব্য শুনে আমরা বিস্মিত হই। তাজউদ্দীন বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের যুদ্ধ। আমরা চাই ভারত এতে জড়াবে না। আমরা চাই না ভারত তার সৈন্য দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে আমাদের স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার লড়াই আমাদের নিজেদের এবং আমরা এটা নিজেরাই করতে চাই।’
১৯৭১ সালের জটিল ভূরাজনীতি বুঝতে না পারলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বুঝা কষ্টকর। ঠা-া যুদ্ধ চলছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ওয়ারশ জোট, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের মধ্যে। এটি ছিল আধিপত্য বজায়ের কঠিন লড়াই। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ছিল একটি বিরাট বাধা। এরকম একটি ভয়াবহ সময়ে তাজউদ্দীন আহমদ সাড়ে সাত কোটি মানুষের অদম্য দেশপ্রেমকে পুঁজি করে নিয়মতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যান।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দিশাহারা করার জন্য, পাক, মার্কিন, চিনের নানা কূট কৌশলকে মোকাবিলা করতে হয়েছে, এই সহিষ্ণূ, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতাকে। সুশিক্ষিত, মেধাবী তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে সবার সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। সরকার গঠনের পরপরই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বিশ্ববাসীকে নবজাত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান। দেশের মাটিতেই শপথগ্রহণ হবে, এই ছিল তার ইচ্ছা। সেই আকাক্সক্ষা অনুসারেই, ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এপ্রিল মাসে ভেতরেই বাংলাদেশ নামক দেশের গোড়া পত্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কর্মকা-, সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধরন অনুযায়ী তিনি সমাপ্ত করতে সক্ষম হন।
সরকার গঠনের পর থকেই তাকে বহুমুখী অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হয়। স্বাধীন বাংলা সরকারের মধ্যেই ছিল পাকিস্তানের পক্ষের ষড়যন্ত্রকারীরা। তাজউদ্দীন আহমদ এ-সমস্ত ষড়যন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হন। ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার বিষয়টিকে তার ভাষায় এভাবে ব্যাখ্যা করেন তাজউদ্দীন, ‘পাকিস্তান তার বন্ধুদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয়নিÑ সংগ্রামের একপর্যায়ে আমেরিকা প্রশ্ন তোলে, স্বাধীনতা চাও নাকি মুজিবকে চাও। এর উত্তরে আমি বলেছিলাম স্বাধীনতাও চাই, মুজিবকেও চাই।’ তাজউদ্দীন আহমদ এত নিবেদিত এবং শীতল মস্তিষ্কের নেতা ছিলেন, যিনি শত বাধার মুখেও লক্ষ্যে থেকে বিচ্যুত হননি।
নীতি, নৈতিকতার দিক থেকে এক অনন্য মানুষ ছিলেন তাজউদ্দীন। পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক বিষয়কে সঠিকভাবে আন্দাজ করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। কৌশলী নেতৃত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠা, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা প্রগতিশীল চিন্তার কারণে তার ভাষায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় সফল ‘ধাত্রির’ ভূমিকা তাজউদ্দীন পালন করতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, সমগ্র জাতির সামরিক, বেসামরিক বাহিনী, নানা মত, নানা পথের মানুষদের সংহত করে জাতীয় ঐক্যকে সুদৃঢ় রাখার কৃতিত্ব তাকে না দিলে অবিচার করা হয়। তাজউদ্দীনকে না জানলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা হয় না। তাকে না বুঝলে বাংলাদেশকে বোঝা অসমাপ্ত থেকে যায়। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে তাজউদ্দীন আহমদের জীবন দর্শন এবং নেতৃত্বের সৌন্দর্য জানা খুবই জরুরি।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
শেখর ভট্টাচার্য
শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪
তাজউদ্দীন আহমদকে কেউ বলেন ইতিহাসের রূপকার, কেউ বলেন ইতিহাসের নির্মোহ নির্মাতা। তাজউদ্দীন আহমদ নিজে ইতিহাসের অজানা, অচেনা কেউ হয়ে থাকতে চেয়েছেন। ইতিহাস তাকে দৃশ্যমান করুক, তাজউদ্দীন তা কখনো প্রত্যাশা করেননি। তাজউদ্দীন সজ্ঞানে বলে গেছেন, ‘তুমি ইতিহাসে এমনভাবে কাজ করো যেন ইতিহাসে কোথাও তোমাকে খুঁজে পাওয়া না যায়।’ ইতিহাসের এমন নির্মোহ, নিরাকার, প্রত্যাশাহীন নির্মাতার সংখ্যা পৃথিবীতে যে খুব বেশি নেই তা আমরা বলতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের যত গভীরে যাওয়া যায়, তাজউদ্দীন আহমদের অনন্য নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমীহের পরিমাণও তত বেড়ে যায়। তাজউদ্দীন আহমদ, এমন একজন নীরব ও নির্মোহ ইতিহাসের রূপকার যাকে ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে খুঁজে বের করে নিয়ে আসতে হয়। তিনি নিজে এসে উপস্থিত হননা। ছকে বাঁধা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় তাকে খুঁজে পাওয়া ভার। আমরা যখন তার অসীম সাহসী নেতৃত্ব, চরিত্রের দৃঢ়তা, উদ্দেশ্য লাভের জন্য আন্তরিক নিবেদন প্রত্যক্ষ করি তখন তাকে মনে হয়, ইতিহাসের ঘোর অন্ধকার থেকে আলোর পথে উত্তরণের একজন সাহসী ‘ত্রাতা’।
তাজউদ্দীন আহমদের মতো বিশাল মানুষকে উন্মোচন করার জন্য প্রচুর গবেষণার প্রয়োজন আছে। তা যে খুব বেশি পরিমাণে হচ্ছে না তা আমরা বলতে পারি। মুক্তিযুদ্ধকে জানার একটি ছক তৈরি হয়ে গেছে দেশে। সেই ছক বা বৃত্তের বাইরে কেউ যেতে ইচ্ছুক নন। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত আমরা ইতিহাসকে অনুসন্ধান করি দফাওয়ারি আন্দোলনের ভাঁজে। সেই ভাঁজের ভেতরে থাকে প্রধানত আন্দোলনের রুটিন বা ধারাবাহিক বর্ণনা। ইতিহাসের পেছনের ইতিহাসকে গবেষণা করে উন্মোচন করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় খুব কম।
২৫ মার্চ গভীর রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করার পর, জাতির ক্রান্তিলগ্নে নেতৃত্বের সব দায় অসীম সাহস নিয়ে গ্রহণ করেন তাজউদ্দীন আহমদ। জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় দুর্যোগ ও গৌরবের এই সময়ে তাজউদ্দীন যদি একটি মাত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল করতেন তাহলে আমাদের ইতিহাস ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হতে পারত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় তাকে একাই একটি সরু সুতার ওপর দিয়ে হাঁটতে হয়েছে যার নিচে ছিল অগ্নি স্ফুলিঙ্গ। তিনি জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য বানিয়ে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চে , পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর চোখ এড়িয়ে, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। জীবনকে আগাম উৎসর্গ করেছিলেন তিনি মাতৃভূমির জন্য। বাঙালি জাতির এই অচেনা, ভয়াবহ পথে এগিয়ে যাওয়ার সময় তিনি তার পরিবারকে কী বার্তা দিয়ে গিয়েছিলেন? তিনি একটি চিরকূটে তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন লিলিকে লিখেন ‘লিলি, আমি চলে গেলাম। যাওয়ার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিও। আবার কবে দেখা হবে জানি না’। তাজউদ্দীন আহমদ ব্যক্তিগত জীবনে আবেগকে তেমন প্রাধান্য দিতেন না, এর মানে এই নয় যে তিনি ছিলেন আবেগহীন।
তাজউদ্দীন আহমদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২৫ ইংরেজি সালে, বর্তমান ঢাকা জেলার, কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কারাগারে রাতের অন্ধকারে পাক-মার্কিন দোসর মোশতাক ও সামরিক বাহিনীর কিছুসংখ্যক পাক-মার্কিন এজেন্ট তাজউদ্দীনসহ জাতীয় চার নেতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। সেই হত্যাকা- ও এর পেছনের গল্প বলা আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়। আজকের লেখার উদ্দেশ্য, তাজউদ্দীন আহমদ যে কত বড় মহীরুহ ছিলেন সে সম্পর্কে সামান্য ঈঙ্গিত প্রদান করা। তাজউদ্দীনের এই সফল ও ত্যাগী জীবনকে চারটি পর্বে ভাগ করা যায়। ১৯২৫ থেকে পাকিস্তান অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত প্রথম পর্ব, পাকিস্তান অর্জনের পর থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্ব, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের মুহূর্ত পর্যন্ত তৃতীয় পর্ব এবং ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল থেকে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জীবনের শেষ পর্ব। তাকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হলে তার জীবনের এই চারটি পর্বকেই বিবেচনায় নিয়ে আসতে হয়। তবে তার নেতৃত্বের বিকশিত সময় প্রত্যক্ষ করতে হলে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন পর্যন্ত তার ভূমিকাকে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।
তাজউদ্দীন আহমদ যখন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন তাকে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে এবং ভারতের প্রভাবমুক্ত থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার এক বিশাল চ্যালেঞ্জের সামনে নিয়ে আসে। তিনি ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ৩০ মার্চ সীমান্ত পার হওয়ার পরেই তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তরক্ষী প্রধান ইন্সপেক্টর জেনারেল গোলোক মজুমদারের সঙ্গে। গোলক মজুমদারকে তাজউদ্দীন তার প্রখর ব্যক্তিত্ব ও স্বকীয় ধরনে জানিয়ে দেন ভারত সরকারের সঙ্গে তার আলোচনা হবে তখনই যখন সরকারের পক্ষ থেকে তিনি ও মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তিনি সুস্পষ্টভাবে গোলক মজুমদারকে অবগত করেন তিনি ও তার সহযোগী নেতারা স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতিনিধি।
তাজউদ্দীনের কথা শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন আইজি মজুমদার। তার রাষ্ট্রনায়কোচিত ব্যক্তিত্ব ও দূরদর্শিতার প্রমাণ পেয়েছিলেন তিনি এই দুরদর্শী প্রস্তাবে। তাজউদ্দীন আহমদের প্রস্তাব অনুযায়ী ভারত সরকার এপ্রিল ৩, ১৯৭১ সালে, তাজউদ্দীন আহমদকে আমন্ত্রণ জানায়। প্রথম সাক্ষাতে তাজউদ্দীন, একজন স্বাধীনতাকামী জাতির নেতা হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে কিছু বিষয় বিনয়ের সঙ্গে উপস্থাপন করেন। তাজউদ্দীনের সুস্পষ্ট বক্তব্য শুনে আমরা বিস্মিত হই। তাজউদ্দীন বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের যুদ্ধ। আমরা চাই ভারত এতে জড়াবে না। আমরা চাই না ভারত তার সৈন্য দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে আমাদের স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার লড়াই আমাদের নিজেদের এবং আমরা এটা নিজেরাই করতে চাই।’
১৯৭১ সালের জটিল ভূরাজনীতি বুঝতে না পারলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বুঝা কষ্টকর। ঠা-া যুদ্ধ চলছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ওয়ারশ জোট, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের মধ্যে। এটি ছিল আধিপত্য বজায়ের কঠিন লড়াই। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ছিল একটি বিরাট বাধা। এরকম একটি ভয়াবহ সময়ে তাজউদ্দীন আহমদ সাড়ে সাত কোটি মানুষের অদম্য দেশপ্রেমকে পুঁজি করে নিয়মতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যান।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে দিশাহারা করার জন্য, পাক, মার্কিন, চিনের নানা কূট কৌশলকে মোকাবিলা করতে হয়েছে, এই সহিষ্ণূ, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতাকে। সুশিক্ষিত, মেধাবী তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে সবার সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। সরকার গঠনের পরপরই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বিশ্ববাসীকে নবজাত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান। দেশের মাটিতেই শপথগ্রহণ হবে, এই ছিল তার ইচ্ছা। সেই আকাক্সক্ষা অনুসারেই, ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এপ্রিল মাসে ভেতরেই বাংলাদেশ নামক দেশের গোড়া পত্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কর্মকা-, সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধরন অনুযায়ী তিনি সমাপ্ত করতে সক্ষম হন।
সরকার গঠনের পর থকেই তাকে বহুমুখী অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হয়। স্বাধীন বাংলা সরকারের মধ্যেই ছিল পাকিস্তানের পক্ষের ষড়যন্ত্রকারীরা। তাজউদ্দীন আহমদ এ-সমস্ত ষড়যন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হন। ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার বিষয়টিকে তার ভাষায় এভাবে ব্যাখ্যা করেন তাজউদ্দীন, ‘পাকিস্তান তার বন্ধুদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয়নিÑ সংগ্রামের একপর্যায়ে আমেরিকা প্রশ্ন তোলে, স্বাধীনতা চাও নাকি মুজিবকে চাও। এর উত্তরে আমি বলেছিলাম স্বাধীনতাও চাই, মুজিবকেও চাই।’ তাজউদ্দীন আহমদ এত নিবেদিত এবং শীতল মস্তিষ্কের নেতা ছিলেন, যিনি শত বাধার মুখেও লক্ষ্যে থেকে বিচ্যুত হননি।
নীতি, নৈতিকতার দিক থেকে এক অনন্য মানুষ ছিলেন তাজউদ্দীন। পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক বিষয়কে সঠিকভাবে আন্দাজ করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। কৌশলী নেতৃত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠা, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা প্রগতিশীল চিন্তার কারণে তার ভাষায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় সফল ‘ধাত্রির’ ভূমিকা তাজউদ্দীন পালন করতে পেরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, সমগ্র জাতির সামরিক, বেসামরিক বাহিনী, নানা মত, নানা পথের মানুষদের সংহত করে জাতীয় ঐক্যকে সুদৃঢ় রাখার কৃতিত্ব তাকে না দিলে অবিচার করা হয়। তাজউদ্দীনকে না জানলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা হয় না। তাকে না বুঝলে বাংলাদেশকে বোঝা অসমাপ্ত থেকে যায়। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে তাজউদ্দীন আহমদের জীবন দর্শন এবং নেতৃত্বের সৌন্দর্য জানা খুবই জরুরি।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]