আয়শা আক্তার
ইতিহাসে যে কয়েকজন বাঙালি বিজ্ঞানীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে তার মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু অন্যতম। ১৯২৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বোস- আইনস্টাইন’ সংখ্যায়ন তত্ত্ব প্রকাশিত হয়। যা পদার্থবিজ্ঞানের জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে। ইতোমধ্যে এই তত্ত্বের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি কলকাতার গোয়া বাগানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সুরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন পূর্ব ভারতীয় রেলওয়ের হিসাবরক্ষক এবং মাতা আমোদিনী দেবী ছিলেন আলিপুরের খ্যাতনামা ব্যবহারজীবী মতিলাল রায়চৌধুরীর কন্যা। উষাবতী বসু ছিলেন তার জীবনসঙ্গী। তিনি ছিলেন সাত ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়। তিনি তার জীবনের প্রায় সবটুকু সময় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় কাটিয়েছেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে পরবর্তীতে তিনি এখানে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক ছিল পদার্থবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। ১৮৯৭ সালে জে জে টমসনের ইলেকট্রন আবিষ্কার, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব, আইনস্টাইনের ফোটনের ধারণা একে একে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে অভূতপূর্ব সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছিল। তবে এর মধ্যে একটি সমস্যা দেখা দিয়ে ছিল। এত দিন পদার্থবিদ্যার তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে চিরায়ত বলবিদ্যা ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের পারমাণবিক আবিষ্কারগুলো এই চিরায়ত বলবিদ্যার সাহায্যে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। এমনকি আইনস্টাইনও এই বিষয়ে কোন সমাধান দিতে পারছিলেন না। তখনই আশার আলো হয়ে ধরা দিলেন বাঙালির গর্ব সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনি তার তত্ত্বে নতুন এক বস্তুকণার কথা চিন্তা করলেন। প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের ধারণা থেকে তিনি নতুন এক সূত্র বা ফর্মুলার আবিষ্কার করলেন। যা প্রায় দুই যুগ ধরে চলমান তত্ত্ব বিজ্ঞানের বন্ধ্যত্বের অবসান ঘটাল।
বসু তার তত্ত্বে নতুন এক বস্তুকণার কথা চিন্তা করলেন। তা হলো কণাটির ঘূর্ণন থাকবে, কিন্তু তার আপেক্ষিক মান হবে ০, ১, ২, ৩ এবং যথারীতি পূর্ণসংখ্যা। এরই মধ্য দিয়ে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যা এক অনন্য জগতে প্রবেশ করল। তবে তিনি ব্রিটিশ জার্নাল ‘ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিনে’ প্রবন্ধটি পাঠালেও তারা এটিকে প্রকাশযোগ্য মনে না করায় তিনি বাধ্য হয়ে আইনস্টাইনের কাছে প্রবন্ধটি পাঠালেন। পরবর্তীতে আইনস্টাইন প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ‘প্ল্যাঙ্কের সূত্র ও আলোক কণিকার সঠিক অনুমান’ নামে ১৯২৪ সালে সাইটশ্রিফট ফুয়র ফিজিক জার্নালে পাঠালে প্রবন্ধটি ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়।
যদিও প্রবন্ধটির একমাত্র লেখক ছিলেন বোস কিন্তু আইনস্টাইনের সংশ্লিষ্টতা থাকায় তত্ত্বটি ‘বোস-আইনস্টাইন’ তত্ত্ব নামে পরিচিতি লাভ করে। ২০১২ সালে জেনেভার বিজ্ঞানীরা একযোগে গবেষণা করে খুঁজে পেলেন বহু দিনের অধরা কণিকা হিগ্স বোসনকে, যা সারা দুনিয়ায় হৈচৈ ফেলে দিয়ে ছিল। পদার্থবিজ্ঞানে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বস্তুর ভর সৃষ্টিকারী কণার নামকরণ করা হয় বোসন কণা বা ঈশ্বর কণা। এছাড়া ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে সত্যেন বসু অধ্যাপক পথ চালু করে। তিনি একজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানীর পাশাপাশি একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিকও ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার সমর্থক এবং তিনি এই ধারাটিকে অব্যাহত রেখেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তার অমর উক্তি, যারা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হয় না, তারা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না। বিজ্ঞানচর্চা সম্পাদনা, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে তার অমূল্য অবদান রয়েছে। তার নেতৃত্বে কলকাতায় ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ গঠিত হয়। অবশেষে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় এই মহান নক্ষত্রের জীবনাবসান ঘটে।
গত ৭ নভেম্বর বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন তত্ত্বের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ এবং বোস সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি অ্যান্ড রিসার্চ ইন ন্যাচারাল সাইন্সেসের যৌথ উদ্যোগে ‘সেন্টেনিয়াল সেলিব্রেশন অব বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকস : এ লিগ্যাসি অব ঢাকা’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শুধু ঢাবিতেই নয় আবিষ্কারের গুরুত্বের কারণে পৃথিবীর নানা দেশে এই শতবার্ষিকী উদযাপন করা হয়েছে।
পদার্থ বিজ্ঞানের জগতে এত বিশাল সৃষ্টির শত বছর, তাও আবার এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাঙালি শিক্ষকের হাত ধরে, তা গর্ব করার মতোই বিষয়। বিজ্ঞানের জগতে এভাবে দেশের নাম আরও উজ্জ্বল করবে বহু বাংলাদেশি-এই আমাদের প্রত্যাশা।
[লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ]
আয়শা আক্তার
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
ইতিহাসে যে কয়েকজন বাঙালি বিজ্ঞানীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে তার মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু অন্যতম। ১৯২৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বোস- আইনস্টাইন’ সংখ্যায়ন তত্ত্ব প্রকাশিত হয়। যা পদার্থবিজ্ঞানের জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে। ইতোমধ্যে এই তত্ত্বের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি কলকাতার গোয়া বাগানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সুরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন পূর্ব ভারতীয় রেলওয়ের হিসাবরক্ষক এবং মাতা আমোদিনী দেবী ছিলেন আলিপুরের খ্যাতনামা ব্যবহারজীবী মতিলাল রায়চৌধুরীর কন্যা। উষাবতী বসু ছিলেন তার জীবনসঙ্গী। তিনি ছিলেন সাত ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়। তিনি তার জীবনের প্রায় সবটুকু সময় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় কাটিয়েছেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে পরবর্তীতে তিনি এখানে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক ছিল পদার্থবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। ১৮৯৭ সালে জে জে টমসনের ইলেকট্রন আবিষ্কার, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব, আইনস্টাইনের ফোটনের ধারণা একে একে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে অভূতপূর্ব সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছিল। তবে এর মধ্যে একটি সমস্যা দেখা দিয়ে ছিল। এত দিন পদার্থবিদ্যার তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে চিরায়ত বলবিদ্যা ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের পারমাণবিক আবিষ্কারগুলো এই চিরায়ত বলবিদ্যার সাহায্যে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। এমনকি আইনস্টাইনও এই বিষয়ে কোন সমাধান দিতে পারছিলেন না। তখনই আশার আলো হয়ে ধরা দিলেন বাঙালির গর্ব সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনি তার তত্ত্বে নতুন এক বস্তুকণার কথা চিন্তা করলেন। প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের ধারণা থেকে তিনি নতুন এক সূত্র বা ফর্মুলার আবিষ্কার করলেন। যা প্রায় দুই যুগ ধরে চলমান তত্ত্ব বিজ্ঞানের বন্ধ্যত্বের অবসান ঘটাল।
বসু তার তত্ত্বে নতুন এক বস্তুকণার কথা চিন্তা করলেন। তা হলো কণাটির ঘূর্ণন থাকবে, কিন্তু তার আপেক্ষিক মান হবে ০, ১, ২, ৩ এবং যথারীতি পূর্ণসংখ্যা। এরই মধ্য দিয়ে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যা এক অনন্য জগতে প্রবেশ করল। তবে তিনি ব্রিটিশ জার্নাল ‘ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিনে’ প্রবন্ধটি পাঠালেও তারা এটিকে প্রকাশযোগ্য মনে না করায় তিনি বাধ্য হয়ে আইনস্টাইনের কাছে প্রবন্ধটি পাঠালেন। পরবর্তীতে আইনস্টাইন প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ‘প্ল্যাঙ্কের সূত্র ও আলোক কণিকার সঠিক অনুমান’ নামে ১৯২৪ সালে সাইটশ্রিফট ফুয়র ফিজিক জার্নালে পাঠালে প্রবন্ধটি ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়।
যদিও প্রবন্ধটির একমাত্র লেখক ছিলেন বোস কিন্তু আইনস্টাইনের সংশ্লিষ্টতা থাকায় তত্ত্বটি ‘বোস-আইনস্টাইন’ তত্ত্ব নামে পরিচিতি লাভ করে। ২০১২ সালে জেনেভার বিজ্ঞানীরা একযোগে গবেষণা করে খুঁজে পেলেন বহু দিনের অধরা কণিকা হিগ্স বোসনকে, যা সারা দুনিয়ায় হৈচৈ ফেলে দিয়ে ছিল। পদার্থবিজ্ঞানে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বস্তুর ভর সৃষ্টিকারী কণার নামকরণ করা হয় বোসন কণা বা ঈশ্বর কণা। এছাড়া ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে সত্যেন বসু অধ্যাপক পথ চালু করে। তিনি একজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানীর পাশাপাশি একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিকও ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার সমর্থক এবং তিনি এই ধারাটিকে অব্যাহত রেখেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তার অমর উক্তি, যারা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হয় না, তারা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না। বিজ্ঞানচর্চা সম্পাদনা, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে তার অমূল্য অবদান রয়েছে। তার নেতৃত্বে কলকাতায় ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ গঠিত হয়। অবশেষে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় এই মহান নক্ষত্রের জীবনাবসান ঘটে।
গত ৭ নভেম্বর বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন তত্ত্বের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ এবং বোস সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি অ্যান্ড রিসার্চ ইন ন্যাচারাল সাইন্সেসের যৌথ উদ্যোগে ‘সেন্টেনিয়াল সেলিব্রেশন অব বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকস : এ লিগ্যাসি অব ঢাকা’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শুধু ঢাবিতেই নয় আবিষ্কারের গুরুত্বের কারণে পৃথিবীর নানা দেশে এই শতবার্ষিকী উদযাপন করা হয়েছে।
পদার্থ বিজ্ঞানের জগতে এত বিশাল সৃষ্টির শত বছর, তাও আবার এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাঙালি শিক্ষকের হাত ধরে, তা গর্ব করার মতোই বিষয়। বিজ্ঞানের জগতে এভাবে দেশের নাম আরও উজ্জ্বল করবে বহু বাংলাদেশি-এই আমাদের প্রত্যাশা।
[লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ]