কাজী সালমান শীশ
প্রথমে আসা যাক সাধারণ পর্যায়ে ইতিহাসের গুরুত্ব বিষয়ে। ব্যবহারিক জ্ঞানের জন্য মানুষের ইতিহাস জানার প্রয়োজন পড়ে। সেই জ্ঞান কাজে লাগে নিত্যদিনের সমাজে টিকে থাকা বা অর্থ উপার্জনের জন্য। যে কোনো বিষয়ের পটভূমি সম্পর্কে জানা থাকলে বিষয়টি বোঝাপড়া করতে সুবিধা হয়। এর জন্য যে খুব ইতিহাস পড়তে হয় তা না। চোখ-কান খোলা থাকলেই মানুষের ভেতর অজান্তেই প্রবেশ করে ইতিহাস। তবে কাজের জন্য যেমন-তেমনভাবে একটা বিষয় সম্পর্কে জানা আর আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা করে ইতিহাস জানা অবশ্যই এককথা না। ইতিহাস বলতে আমরা বুঝি অতীতের ঘটনা বা সত্য ঘটনা। অতীতের কাল্পনিক ঘটনাকে আমরা পুরাণ (গুঃয) বলি, ইতিহাস না। এখন কোন ইতিহাস আসলে সত্য, কোনটা আংশিক সত্য, কোনটা মিথ্যা সেটা রহস্যঘেরা ব্যাপার। ছাপার অক্ষরে যা লেখা আছে বা ক্যামেরায় ছবি তোলা আছে, সেসব বিষয় সবসময় সত্য কথা বলে না। লিখিত ইতিহাস সাধারণত ক্ষমতায় জয়ীদের ইতিহাস বলে। পাশাপাশি আরেকদল ইতিহাসে অংশগ্রহণ করে যারা বিল্পবী। ইতিহাসকে নিরপেক্ষভাবে দেখার সুযোগ আছে নিশ্চয়ই, তবে প্রায়শই তাতে বাধা পড়ে। একপক্ষের দেয়া ইতিহাস সামনে আসে, বাকিটুকু অস্পষ্ট হয়ে যায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঘটে যাওয়া অনেক ইতিহাসই সে কারণে প্রশ্নবিদ্ধ ও প্রমাণসাপেক্ষ। গত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া বড় দুটি ঘটনার মধ্যে নিশ্চয়ই দুটি বিশ্বযুদ্ধ পড়ে। লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর নির্দেশে সংগঠিত যুদ্ধের কারণে। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে এটম বোমা ফেলাও নিশ্চয়ই জরুরি ইতিহাসের অংশবিশেষ। চেরনোবিলের পারমাণবিক বিদ্যুৎ বিস্ফোরণও উল্লেখযোগ্য দুঃখজনক ইতিহাস। যুদ্ধের কথা লিখলে আরো অনেক যুদ্ধ হয়েছে এবং হচ্ছেÑ মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায়। বিভিন্ন নতুন রোগের ইতিহাস সামনে এসেছে, পাশাপাশি আবিষ্কার হয়েছে সেগুলোর প্রতিষেধক। বহু দেশ ভাগ হয়ে গেছে, বহু জায়গায় সন্ধান পাওয়া গেছে তেল, স্বর্ণ বা হীরার খনির। ঘোড়ার পিঠে চড়ে আসা দস্যুরা বিদায় নিয়েছে; এসেছে আধুনিক গাড়ি, ট্যাঙ্ক, বোমারু বিমান, সাবমেরিন ও নানা দস্যু যান। অর্থনৈতিক লেনদেন ও জমা রাখার জন্য একছত্র অবস্থান নিয়েছে ‘ব্যাংক’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান। বার্তা পাঠানোর মাধ্যম হিসেবে টেলিগ্রাম, মানি অর্ডার, চিঠি আদান-প্রদানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে স্যাটেলাইট টেকনোলজি। এসেছে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপÑ সঙ্গে ইন্টারনেট যুক্ত হয়ে তা পরিণত হয়েছে তথ্য জমা রাখার ভিন্ন একটা ব্যাংক হিসেবে। পৃথিবীতে যত মানুষ প্রতিদিন মোবাইলে কথা বলে, চলমান ছবি দেখে এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করেÑ তার সবকিছু জমা থাকে কোনো শক্তিশালী প্রযুক্তিসম্পন্ন ডিভাইসে। একশ বছর পর কোনো মানুষের ইতিহাস জানতে চাইলে, তার সম্পর্কে প্রায় সব তথ্য বের করে নেয়া কঠিন হবে না। আধুনিক সময়ের মানুষকে সবসময়ই ট্র্যাক করে চলেছে পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটি। টেকনোলজির অভাবনীয় উন্নতি রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। কোনো মানুষের মস্তিষ্ক যদি গত পঞ্চাশ বছর ঘুমিয়ে থেকে হঠাৎ জেগে উঠত, নিশ্চয়ই তার বিস্ময়ের শেষ থাকত না! ব্যাপারগুলো সত্য ইতিহাস নাকি কল্পনাপ্রসূত ভ্রম, তা বুঝতে বুঝতে চলে যেত আরেকটি জীবন। কামান থেকে মিসাইল, বই থেকে ই-বুক, ফিল্ম থেকে ভিডিও ক্লিপ, টাইপ রাইটার থেকে কম্পিউটার, টেলিফোন থেকে সেল্যুলার ফোন, হেলিকপ্টার থেকে ড্রোন, লাইব্রেরি থেকে ইন্টারনেটÑ এমন হাজারো বস্তুগত বিষয় নিত্যদিনে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, যার ইতিহাসের পরিধি ১০০ বছরেরও কম। প্রযুক্তির প্রবাহকে আটকে রাখা যায় না, এর চেষ্টা করাও উচিত নয়। আধুনিক প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার অনেক সময়ই সৃষ্টি করে বিব্রতকর পরিস্থিতি। স্যোশাল মিডিয়ার কথাই ধরা যাক। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক থেকে শুরু করে ইউটিউব, যে সমস্ত মাধ্যমে মানুষ অবলীলায় লিখতে বা ছবি প্রকাশ করতে পারে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর জানা-পড়ার সঙ্গে মিশে যায় ভুল ও বিকৃত তথ্য। প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ হয়, কখনো হয় আক্রমণ। মানুষের মনে গেঁথে রাখার মতো ঘটনার থেকে ঠুনকো ঘটনা ছড়াছড়ি স্যোশাল মিডিয়ায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও লোকজন ২-৩ দিনের বেশি মনে রাখতে পারে না। এসে যায় নতুন মুখোরচক খবর। একজন স্কুলপড়ুয়া কিশোর ততটুকু ইতিহাসই মনে রাখছে, যা তার পরীক্ষায় পাস করার জন্য লাগছে। ফলে ইতিহাস ব্যাপারটা খুব হালকা হয়ে যাচ্ছে। আগ্রহ না থাকলে জোর করে কাউকে সামগ্রিক ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া কি সম্ভব? যদি সম্ভবও হয়, সেই জ্ঞান কি আদৌ কাজে আসে? মনে হয় না। শুধু তোতাপাখির মতো ইতিহাস পড়লে কাজ হবে না, কারণ তা আত্মস্থ করার ব্যাপার আছে। আর মূল্যবোধের এত আমূল পরিবর্তন হয়েছে, এক যুগ সময়ে যে পুরনো ঘরানার মানুষের হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। পৃথিবীটা যেন তৈরি হয়েছে সস্তা একপ্রকার প্লাস্টিক দিয়ে, যা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মুখে দেয়ামাত্রই মিলিয়ে যায়। মিষ্টি স্বাদটা এসেই চলে যায়। ইতিহাস শুধু অতীতের কথা বলে না, ইতিহাস বর্তমানে বিদ্যমান এবং ভবিষ্যৎ নির্ধারণের প্রধান উপাদান। আজকে যে ছোট্ট বীজ, একশ বছর পর সে একটা বিশাল গাছ হয়ে উঠবে। জানলা দিয়ে যে বিশাল বটগাছটা দেখা যাচ্ছে সে ১৯৭০ সালেও এখানে ছিল, হয়তো ২০৫০ এ-ও থাকবে। সেই গাছ ও গাছের পাশের নদী কয়েক যুগের ইতিহাসের সাক্ষী। নানা রঙের হাজারো পাখিরা উড়ে চলে গেছে, এসেছে নানা রঙের মটোরযান ও চিরতরে বিদায় নিয়েছে অনেক রাজা-প্রজা, গাছটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মানুষগুলো আগে হাঁটতে হাঁটতে এদিক-ওদিক তাকাত, এখন তারা রোবটের মতো হেঁটে যায় কানে হেডফোন লাগিয়ে। বাতাসের অক্সিজেনের বিশুদ্ধতা কমে সেখানে যুক্ত হয়েছে বিষাক্ত গ্যাস। আগের মতো আর বৃষ্টি হয় না, তবে সূর্যের আলো আসে। ভাগ্যিস মানুষের ক্ষমতায় সূর্যালোক আটকানোর শক্তি নেই। হয়তো একসময় প্রযুক্তিগত উন্নয়নে তা-ও সম্ভব হবে। তখন আর গাছের পাতা সবুজ রং দেবে না। পৃথিবী নামক গ্রহটা পরিণত হবে তপ্ত পাথুরে তলে, তার ওপর চলাফেরা করবে শুধু লোহার যানবাহন আর হেলমেট পরা বিশেষ মানবসম্প্রদায়। মাথায় পরা সেই উন্নত হেলমেটই হয়তো পূরণ করবে মানুষের সব মৌলিক চাহিদা। খাদ্য বা অক্সিজেন গ্রহণের জন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হবে না। এইভাবে কিছুকাল চলার পর একসময় মানুষকে বিদায় নিতে হবে। আবার ধীরে ধীরে সবুজ ঘাসের আভা দেখা যাবে পাথুরে ভূমিতে। পৃথিবী আবার খুঁজে পেতে থাকবে নতুন প্রাণের সন্ধান। এমনিতেও মানুষের ইতিহাস খুব বেশি সময়ের নয়, অন্যান্য অনেক প্রাণীদের তুলনায়। নৃ-বিজ্ঞানের ইতিহাস তাই বলে।
অতীতের সবকিছু ইতিহাস হলেও বোঝার সুবিধার্থে একে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। যুগের ইতিহাস, প্রাণীর ইতিহাস, সাম্রাজ্যের ইতিহাস, বিজ্ঞানের ইতিহাস, ভূগোলের ইতিহাস থেকে শুরু করে করে চাকা, আগুন, অস্ত্র, পোশাক, চাষাবাদ, বাসস্থান, শিল্প সবকিছুরই ইতিহাস রয়েছে। আগ্রহের বিষয় অনুযায়ী মানুষ তার ইতিহাসের জ্ঞান বৃদ্ধি করেÑ বই পড়ে, ছবি দেখে বা গল্প শুনে। যে বিজ্ঞানী আগ্নেয়াস্ত্র তৈরিতে উৎসাহী, সে অবশ্যই পূর্বের মারাণাস্ত্র তৈরির ইতিহাস বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবে। চাষাবাদের ইতিহাস সম্পর্কে তার আগ্রহ না-ই থাকতে পারে। আবার যার ঝোঁক পাহাড়ে ওঠা, সে কোনোদিন হিমালয়ের কাছে যেতে পারুক বা না পারুকÑ জানতে ইচ্ছুক হবে পর্বত, আগ্নেয়গীরী ও উঁচু অঞ্চলের প্রাণীদের জীবনধারণের ইতিহাস সম্বন্ধে। শখ ও উচ্চাকাক্সক্ষার কোনো পরিসীমা টানা থেকে না। গ্রামের একজন দরিদ্র কিশোরেরও ইচ্ছা করতে পারে চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার। চাঁদে যেতে পারার সম্ভাবনা তার যে প্রায় শূন্য, সেটা জেনেও সে মহাকাশ ভ্রমণ সম্পর্কে লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়ে বা ছবি দেখে। জ্ঞান অর্জন এভাবেই হয়।
আর নিত্যদিনের চলার জন্য যে জ্ঞান লাগে, সেটা তো থাকতে হয়ই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অনেক সময় নতুন পথ দেখাতে সাহায্য করে, সন্দেহ নেই; তবে কার বাঁশি বাজানোতে আগ্রহ আর কে ক্যান্সারের প্রতিষেধক তৈরি করতে চায়, তা নিশ্চয়ই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করে দিতে পারে না? পারে কি? একথা ঠিক যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কিছু ধনী দেশ বাচ্চাদের উদ্দীপনার দিক বিবেচনা করে তাদের গাইড করে। ফুটবল খেলায় আগ্রহ থাকলে তার অংক শেখায় শিথিলতা থাকে। রান্না করা নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগও আছে কোথাও কোথাও; ছবি আঁকায় সৃজলশীলতার চিহ্ন রাখলে ছাত্রটিকে ঘুরতে পাঠায় বিশ্বের নানা মিউজিয়ামে। ব্যবস্থাগুলো প্রতিষ্ঠানই করে থাকে। কিন্তু এই ধরনের বিলাসী শিক্ষাগ্রহণ ব্যবস্থা মুষ্টিমেয় কিছু ধনী দেশের জন্যই প্রযোজ্য। সেই পদ্ধতি যতই উন্নত হোক না কেন সারাবিশ্বের বিদ্যালয়গুলো এভাবে চলতে পারে না। ভুলে গেলে চলবে না এখনো সারাবিশ্বের বিশাল সংখ্যক জনগণ রাতে না খেয়ে রাতে ঘুমাতে যায়। যুদ্ধে নিপীড়িত দেশ, লাখ লাখ বঞ্চিত জনগণের খবর রোজই খবরের কাগজে বের হয়। বেঁচে থাকাই যেখানে দুরূহ সেখানে শখ ও স্বপ্ন আর কি থাকতে পারে! আফ্রিকার অনেক দেশের খনিজ সম্পদ শুষে নিয়ে গেছে তাবড় তাবড় ক্ষমতাশীল দেশগুলো, প্রকৃত ভূমি বা খনির মালিকদের হত্যা করে। মালিকদের বংশধররা বেঁচে থাকে ক্ষুধা নিয়ে ও মরে পুষ্টিহীনতায়। মানুষের কৌশল ও দখলদারীর ইতিহাস বড়ই নির্মম।
আরেকভাবে দেখলে ইতিহাস মানেই জমাকৃত অভিজ্ঞতা। অসংখ্য অভিজ্ঞতা থাকে যা প্রত্যক্ষভাবে নিজের জীবনে পরখ করা, আর বাকিগুলো অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে ধার করা। বড় অর্থে দুইটাই ইতিহাসের অংশ। প্রত্যেকটা প্রাণীই তার অভিজ্ঞতার সমান অভিজ্ঞ। কেউ কেউ তা প্রকাশ করতে সমর্থ হয় তাদের কাজ, কথা বা লেখার মধ্য দিয়ে, বাকিদেরটা অপ্রকাশিতই থেকে যায়। প্রকাশ না পেয়ে থাকলে তার হয়ত কোনো প্রমাণ থাকে না, কিন্তু ইতিহাস রচনা হয়েই যায় মহাকালের আকাশে-বাতাসে। মানুষ নবীন থেকে প্রবীণ হয়। প্রবীণ হওয়া মানে শুধু তার চেহারা আর শারীরিক কিছু পরিবর্তন নয়। প্রবীণের সবচেয়ে বড় শক্তি অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা যে সবসময় ইতিবাচক হবে তা না। নবীনের থেকে একজন প্রবীণ ব্যক্তি অনেক বেশি মাথা খেলিয়ে কাজ সম্পন্ন করতে পারে, যে কারণে শক্ত-সামর্থ্য তরুণের থেকে বয়ষ্ক বৃদ্ধ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অধিক দূরদর্শী হয়। যুবক যদি ১০০-এর মধ্যে ৩০ পর্যন্ত দেখতে পায়, প্রবীণ দেখতে পায় ৭০/৭৫ পর্যন্ত। তবে ব্যতিক্রম তো আছেই। ব্যবহারিক জগতে সেই অভিজ্ঞতা সরাসরি কাজে লাগুক বা অনিষ্ট করুক এর প্রভাব স্বীকার করতেই হবে। অভিজ্ঞতা আসে অতীত থেকে। আর অতীতই হচ্ছে ইতিহাস। ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে কিছুই ঘটতে পারে না। ঘড়ির কাঁটা যে ঘুরছে এর প্রত্যেকটা
সেকেন্ডও যেন লেখা হয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের পাতায়। উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো দাগ কেটে যায়, মনে থাকে, লিখিত ইতিহাসে জায়গা পায়। যে সমস্ত ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ না, সেগুলো থাকে নিশ্চুপ, নির্মোহ, নির্জীব ইতিহাস হয়ে।
ধরা যাক এক ব্যক্তি আন্টার্কটিকা ঘুরে এসে, আইসবার্গ দেখার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করল। আরেক ব্যক্তি পুরো ঘটনাটা টেলিভিশনের পর্দায় দেখে ঘটনাটা জানল। কিছুটা বুঝতে পারল। অভিযাত্রীর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে একরকম অভিজ্ঞতা লাভ করল। পরোক্ষভাবে জানা এই ইতিহাসকেই ধার করা ইতিহাস বলে লিখছি ভাষায় প্রকাশের জন্যে। তবে সেক্ষেত্রে দেখা যাবে সাধারণ অর্থে ইতিহাস বলতে আমরা যা বুঝি তার বেশিরভাগই পরোক্ষ ইতিহাস। এক যুগ আগেও আমার ধারণা ছিল ইতিহাস জানার প্রধানতর মাধ্যম বই। পরে দেখলাম প্রযুক্তিনির্ভর অনেক ভিডিও ক্লিপ ও অডিও পডকাস্ট থেকেও ইতিহাস জানা সম্ভব। ব্যক্তিগতভাবে আমি সেগুলো থেকেও জ্ঞান আহরণ করেছি আনন্দের সঙ্গে, তবে এখনো বিশ্বাস করি কাগজের পাতায় লেখা ইতিহাসই সর্ববৃহৎ প্রভাব রাখে। ছাপার অক্ষরে নিজের কল্পনা করার স্বাধীনতা আপনা-আপনিই বেশি থাকে। মুঘল সম্রাটদের জীবনী ইতিহাস বইয়ে পড়ে যতটা গভীরভাবে কল্পনা করতে পেরেছি, তা চলচ্চিত্র বা ইন্টারনেট ক্লিপ থেকে পারিনি। এখনকার প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অনেক কম বই পড়ে।
অধিকাংশই অভ্যস্ত আরেকজনের তৈরি করা ভিডিও দেখে। ভিডিও চিত্রকে তারা ছাপার অক্ষরের থেকে বেশি গুরুত্ব দিতেই পারে। আমি তাদের সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে অশ্রদ্ধা করছি না, তবে আবারও বলছি ফিকশন হোক বা সত্য ইতিহাস পড়ার সময় আমাদের মন কল্পনা করে নেয় বাদশাহ হুমায়ুন কেমন বা মাদার তেরেসা কেমন ছিলেন। যখন কেউ তাদের ছবি ও সংলাপ দিয়ে ভিডিও চিত্র তৈরি করে দেবে, আর সবাই তা মোবাইলের স্ক্রিনে দেখবে, সেখানে কল্পনার সুযোগ নিশ্চয়ই কম।
পাশাপাশি ইতিহাস জানার জন্য সব রকম মাধ্যমই খোলা রাখা উচিৎ। ঝর্ণার শীতল পানি ছুঁয়ে দেখতে পারলে সবচেয়ে ভালো। যদি ছুঁয়ে দেখা সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত তার ছবি দেখি, ঝিরঝির শব্দ শুনি। অনুভব করা না গেলেও একটা ধারণা পাওয়া যাবে ঝর্ণা সম্পর্কে।
জয়ীদের কথায় ফিরে আসা যাক।
সারাবিশ্বে শাসক ও ক্ষমতাশীলদের অধিকাংশ সময়ই নির্মম হতে দেখা গেছে। পৃথিবীতে যুগের পর যুগ ধরে শান্তি বিরাজ করেছে। এমনটা ইতিহাসে নেই। ইতিহাস বলে ছোট্ট একটা বিষয়কে ঘিরে দ্বন্দ্ব শুরু হয় যার পরিণতি গড়ায় যুদ্ধে গিয়ে। রাক্ষসের ন্যায় রাষ্ট্রপ্রধান এডলফ হিটলারকে যেমন আমরা জার্মানির একজন স্বৈরশাসক হিসেবে জানি, ঠিক তেমনি মিত্রবাহিনী বলে খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা যুদ্ধের তা-ব সম্পর্কেও সারাবিশ্ব অবগত। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি, দখল ও অস্ত্র বিক্রির প্রতাপে ভিয়েতনাম, ইরাক, প্যালেস্টাইন থেকে শুরু আফগানিস্তান, লিবিয়ার লাখ লাখ নিরীহ মানুষ প্রাণ দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকের ভূমিকায় তারা বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করে এবং নির্বিচারে চালায় হত্যাযজ্ঞ। এরপর তাদের নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে জাতিসংঘের মানবাধিকার রক্ষাকারী সংগঠন! বিপুল প্রাণহানির থেকে সৃষ্টি হয় কখনো বিল্পবী, কখনো জঙ্গি বাহিনী। শুরু হয় সহিংস লড়াই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এভাবেই চলে আসছিল। এখন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে রাশিয়া। ইউক্রেনে বোম্বিং করছে রাশিয়া, এদিকে ইউক্রেনকে পাল্টা আক্রমণ করার জন্য বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রের যোগান দিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা।
অর্থাৎ আবার সেই রক্তপাতের ইতিহাস! মানব সভ্যতা গড়ে ওঠার ইতিহাস এত নিষ্ঠুর যা উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। পিঁপড়ার মত দলগতভাবে যুদ্ধ করে যায় মানুষ। অর্থের মূল্যের কাছে পরাজিত হয় মানুষের জীবন। মহাবুদ্ধিমান, জটিল প্রাণী মানুষ সমষ্টিগতভাবে শান্তিতে থাকতে পারে না। এই মানুষই বলে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব! স্বজাতিকে নিঃশেষ করে দিয়ে, স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ জীব আমরা মানুষ।
দৈহিক গঠন ও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পুরুষরা আদিকাল থেকে আধিপত্য দেখিয়ে আসছে। শিকার যুগে গুহায় আঁকা চিত্রকর্ম দেখে ধারণা করা যায়Ñখাদ্যের সন্ধানে যখন মানুষ দল বেঁধে বাইসন বা ষাঁড়ের পালকে আক্রমণ করত, তখন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকত পুরুষরা। নারীদের দেখা যায় পশুর চামড়া দিয়ে শীতবস্ত্র তৈরি করতে বা গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করতে। বাইরের পেশি শক্তিনির্ভর কাজে নিয়োজিত পুরুষরা নিজেদের সুবিধার্থে তৈরি করে গেছে নিয়মনীতি। মহামানব যারা এসেছেন তাদেরও সিংহভাগ পুরুষ। মেয়েদের পুরুষরা বিবেচনা করেছে কখনো সেবিকা, কখনো সৌন্দর্যের আসবাব হিসেবে। নারী-পুরুষ সমান অধিকার পেলে নিশ্চয়ই আরও অনেক মহৎ মানবীর নাম আমরা জানতাম। একবিংশ শতাব্দীতেও বহু দেশের, বহু পরিবারে ধরে নেয়া হয় নারীর কাজ ঘরে, পুরুষের কাজ বাইরে! আসলে আদিযুগ থেকে বর্তমানে শক্তি প্রয়োগ ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের শুধু রূপ পরিবর্তন হয়েছে। মূল বিষয় প্রায় একই রয়ে গেছে।
বিবর্তন ও বুদ্ধির জোরে মানুষের উন্নতি খুব দ্রুত হয়েছে, তাই পতনও সন্নিকটে। তেলাপোকা, ইঁদুর, সাপ, ব্যাঙ বা পাখি টিকে যাবে আরও বহু শতাব্দী, চলে যাবে মানুষ। ইতিহাস বিবেচনায় সেই লক্ষণই দেখা যায়। তবে শারীরিক গঠনে পরিবর্তন এনে অন্যভাবে মানুষ টিকে থাকতে পারে, প্রযুক্তিগত কারণে। আমাদের হয়তবা হাঁটতে হবে না, খেতে হবে, নিঃশ্বাস নিতে হবে না। জন্ম নেয়ার পরপরই মস্তিষ্ককে বসিয়ে দেয়া হবে কোনো সুপার কম্পিউটারে। সেই কৃত্রিম কম্পিউটারই হয়তো নিয়ন্ত্রণ করবে মানুষের অস্তিত্বকে। সেইভাবে টিকে থাকা মানুষকে ‘মানুষ’ বলা যাবে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন।
ইতিহাসের অবস্থান অনেক শক্ত আর ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে অনুমানের বিকল্প নেই। ভবিষ্যতের কোনো ইতিহাস হয় না।
সরল জীবনযাপন যত ব্যাহত হবে, মানসিক অশান্তি তত বাড়বে। ভুটান বা নিউজিল্যান্ডের মতো নিরীহ রাষ্ট্র কখনোই খুব বেশি সংখ্যক থাকতে পারে না। জনসংখ্যা, আদর্শ, আত্মতুষ্টি, সক্ষমতা, ন্যায়-নীতি ধরনের অনেক বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। শীতপ্রধান মহাদেশ ইউরোপ যেমন মধ্যযুগে ধর্মযুদ্ধ করেছে, উষ্ণ অঞ্চলজুড়েও লড়াই হয়েছে ক্ষমতার আধিপত্য নিয়ে। অন্ধভাবে ধর্মকে মানার জন্য বলির শিকার হতে হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। সমাজে শান্তি-অশান্তির ভারসাম্য রাখতে প্রবর্তন করা হয়েছে বিভিন্ন বিধিবিধান ও নিয়ম-কানুন। সেই নিয়ম আবার সবার জন্য সমান নয়। প্রজা, দরিদ্র মানুষ বা সাধারণদের জন্য নিয়ম অনেক কঠোর, যা কখনোই প্রযোজ্য না রাজা, জমিদার বা মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে। ইতিহাস থেকে ধারণা করা যায় একজন বিজ্ঞানী, আইন-প্রণেতা, ব্যবসায়ী, শিল্পী, পুরোহিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করে ক্ষমতাবান কোনো ব্যক্তি বা দল। আইনে যদি লেখাও থাকে ‘একজন মানুষকে হত্যা করলে, প্রাপ্তবয়ষ্ক খুনির ফাঁসি হবে’ বাস্তবে তা হয় না। আমাদের মত দুর্নিতীগ্রস্ত দেশে তো হয়ই না, অধিকাংশ উন্নত দেশেও হয় না। নানা কায়দা করে, ঘুষ দিয়ে, হুমকি দিয়ে, উকিল নিয়োগ করে বেঁচে যায় আসামি। আর বৃহৎ পরিসরে হত্যা করলে তো কথাই নেই। যে সব রাষ্ট্রপ্রধানদের হুকুমে ষাট লাখ ইহুদি মরে বা ফিলিস্তিনবাসী নিহত হয় কিংবা ত্রিশ লাখ বাঙালি জীবন দেয় সেই শক্তিধর নেতাদের বিশ্ববাসী স্যালুট দেয়! বিচার তো অনেক দূরের কথা। লিখিত আইনের ইতিহাস কাগজে কলমে সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়ায়, বাস্তবচিত্র একেবারেই ভিন্ন। বিচার হোক বা না হোক, ইতিহাস সত্য এবং বহুকাল পরে হলেও তা আংশিক প্রকাশ পায়। মৃত্যুর পর অন্য কোনো জগতে যারা বিশ্বাস করেন, তারা নিশ্চয়ই এর ফলাফলে বিশ্বাসী। চারপাশের জগৎ দেখলে অবশ্য তা মনে হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ম ও ইহকাল-পরকালের ধারণাকে ব্যবহার করা হয় রাজনীতির ফায়দা লুটতে। মন থেকে পরকালে বিশ্বাস রাখতে পারলে অসাধুতা নিশ্চয়ই কমে যেত। হিসাব তো তাই বলে।
ইতিহাস নিয়ে সংশয় ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকবে, এর অনেক নেতিবাচক দিকও থাকবে। তবে ইতিহাসের ইতিবাচক ব্যাপারগুলো তুলে ধরা খুব জরুরি। বিদ্যালয়ে অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যখন ইতিহাস পড়েছি তখন তা সত্য বলেই ধরে নিয়েছি। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের কথা বলছি। আমার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল যে ছাপার অক্ষরে লেখা সবকিছুই সত্য। তারপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলো বাংলাদেশের। নব্বইয়ের প্রথমভাগে এবং ছিয়ানব্বইয়ে ভিন্নধর্মী দুটি দল ক্ষমতায় এলো যথাক্রমে। পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস অংশে পরিবর্তন হতে থাকলো। পারিবারিক শিক্ষা থেকে বুঝতে পারলাম যা পড়ছি তার সবটা সত্য নাও হতে পারে। তারপর তো একের পর এক ঘটনা এমনভাবে আসতে থাকল যে ২+২=৪ কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশের চিন্তা মাথায় এলো! তবে কম জেনে সংশয়বাদী হওয়া ঠিক নয়, যেরকম সপ্তম শ্রেণীর বালকের মেধা নিয়ে নাস্তিক হওয়া সমীচীন নয়। সে যাক, অন্ধভাবে ছাপার অক্ষরের ইতিহাসকে বিশ্বাস করারও ইতিবাচক দিক রয়েছে। বইয়ের ওপর ভক্তি-শ্রদ্ধা থেকেই সব কিছু সত্য বলে ধরে নেয়া হতো। তিন যুগ পরে এখন শিশুদের মূল্যবোধে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। কাগজের বই, বলপেন ব্যাপারগুলো অনেকের কাছে খুব খেলো। তারা জন্মের পর থেকেই মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব ইত্যাদি ব্যবহার করে অভ্যস্ত। অনেক শিশুরা নানারকম বিষয়াদী শিখছে, তথ্য গ্রহণ করছে ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে। কিশোর হলেই হারিয়ে ফেলছে শ্রদ্ধাবোধ। বই, মা বা ঈশ্বর কোনো কিছুর প্রতিই তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা সেইভাবে নেই। আধুনিকতার নামে বাচ্চারা ইতিহাস বা পূর্বের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পারছে না। সবকিছুর প্রতিই ধারণাগুলো ভাসা ভাসা। দীর্ঘসময় পর এর ফলাফল দুঃখজনক হতে পারে।
ইতিহাসের ইতিবাচক দিক লিখে লেখাটা শেষ করা যাক।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অবশ্যই খাদ্য, সমাজে চলার জন্য বস্ত্র, আশ্রয়ের জন্য বাসস্থান মৌলিক প্রয়োজন, যা অন্যান্য পশুপাখির মধ্যেও রয়েছে কমবেশি। এছাড়া মানুষের আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন পড়ে। একটা চড়–ই পাখি বা ইলিশ মাছের পক্ষে পূর্বপুরুষের ইতিহাস জানার সুযোগ নেই। তারা ইতিহাসকে বহন করে অস্তিত্বের সঙ্গে, হয়ত ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে। মানুষ ইতিহাস জানে অনেকটাই নিখুঁতভাবে। ৩০০০ বছর আগের কোনো মানুষ এখন বেঁচে নেই, কিন্তু আমরা জানতে পারি মুসা নবী, জেসাস ক্রাইস্ট, হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রমুখ মহামানবদের কর্মের কথা। জানতে পারি ৫০০০ বছর আগের মিসর ও চীনের সভ্যতা সম্পর্কে। বিশ্বাস রাখলে আরও আগের অর্থাৎ ৬ কোটি বছর আগে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া ডাইনোসরদের সম্পর্কেও ধারণা রাখতে পারি। বিজ্ঞানীদের হিসাবে সৌরজগতের জন্ম ৪৬০ কোটি বছর পূর্বে। আমরা মানুষরা এই সব তথ্য জানতে পারি ইতিহাস পড়ে। মানুষ যে শুধু তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইতিহাস লিখেছে তা কিন্তু না। ইতিহাস উদ্ধারের পেছনে রয়েছে লাখ লাখ মেধাবী মানুষের গবেষণা, শ্রম ও অনুমান। বৈজ্ঞানিক, লেখক, শিল্পী, দার্শনিক, নেতা সবাই দূর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে গিয়ে ফিরে গেছেন অতীত চিন্তায়। অনুসন্ধান করে বের করেছেন বহুকিছু। ভবিষ্যৎ সবসময়ই অনিশ্চিত, আর অতীত না জানলে ভবিষ্যৎ অনুমান করা প্রায় অসম্ভব। মানুষের কৌতূহলী মন অনেক কিছুই করে, তার মধ্যে অন্যতম বিষয় হচ্ছে জ্ঞান আহরণ। নতুন দেশের খোঁজে মানুষ যেমন সমুদ্রে নৌকা ভাসিয়ে দেয়, তেমনি সময়ের হিসাব রাখতে আবিষ্কার করে ঘড়ি। এই জ্ঞানের পিপাসা কোনোদিন মিটবে না, তাই নতুন কিছুর জানার আগ্রহও কমবে না। আলো-অন্ধকার, খারাপ-ভালো, অতীত-ভবিষ্যৎ এরা নিছক বিপরীত শব্দ নয়, একে অপরের পরিপূরকও। অন্ধকার অনুভব না করলে আলোর প্রকৃত গুরুত্ব বোঝা সম্ভব নয়।
আমাদের পার করে আসা প্রতিটা দিনই ইতিহাস। সব ইতিহাস বইয়ের পাতায় বা জাদুঘরে জমা থাকে না। ইতিহাস ছড়িয়ে থাকে সমগ্র পরিম-লে। বহুকাল পরে হয়ত কেউ আবিষ্কার করবে সেই অলিখিত ইতিহাস। পৃথিবী তো জন্ম থেকেই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, কিন্তু মানুষ সেই তথ্য আবিষ্কার করেছে মাত্র কয়েক শতক আগে। বাতাসে ভাসতে থাকা ইতিহাসকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে, আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে কিছু মনীষী। মানুষ হয়ে জন্মানোর অন্যতম সার্থকতা তার জ্ঞান। মস্তিষ্কের ইতিবাচক প্রয়োগ ও অভিজ্ঞতার কল্যাণমুখী ব্যবহারের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষ আসলেই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। যতই যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি, দখলদারি থাকুক; ইতিহাসের আরেকদিক বলে মানুষ অত্যন্ত আত্মত্যাগী, পরোপকারী ও দয়ালু প্রাণী। কত শত মা-বাবা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে গেছেন সন্তানদের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য, পৃথিবীর জন্য। ইতিহাসকে গভীরভাবে আলোকিত করেছেন কার্ল মার্কস, গৌতম বুদ্ধ, মাদার তেরেসা, লালন ফকির, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ন্যায় হাজারো মনীষী। ২৭ বছর কারাভোগ করে, আপসহীন নেতা নেলসন মেন্ডেলা দেখে যেতে পেরেছেন একটি স্বাধীন দেশ এমন ঘটনাও লেখা রয়েছে ইতিহাসের ভা-ারে। সবকিছুর শুরু বা শেষ আছে কিন্তু ইতিহাসের নেই। সময়ের মতো ইতিহাসও অমর।
ইতিহাস চিরজীবী হোক অবিকৃতভাবে, দর্শন টিকে থাকুক চেতনায়, বিজ্ঞান ব্যবহৃত হোক প্রাণের কল্যাণে তা হলেই পৃথিবীটা হবে শোভন ও বাসযোগ্য।
[লেখক : চিত্রকর, চলচ্চিত্র শিক্ষক ]
কাজী সালমান শীশ
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
প্রথমে আসা যাক সাধারণ পর্যায়ে ইতিহাসের গুরুত্ব বিষয়ে। ব্যবহারিক জ্ঞানের জন্য মানুষের ইতিহাস জানার প্রয়োজন পড়ে। সেই জ্ঞান কাজে লাগে নিত্যদিনের সমাজে টিকে থাকা বা অর্থ উপার্জনের জন্য। যে কোনো বিষয়ের পটভূমি সম্পর্কে জানা থাকলে বিষয়টি বোঝাপড়া করতে সুবিধা হয়। এর জন্য যে খুব ইতিহাস পড়তে হয় তা না। চোখ-কান খোলা থাকলেই মানুষের ভেতর অজান্তেই প্রবেশ করে ইতিহাস। তবে কাজের জন্য যেমন-তেমনভাবে একটা বিষয় সম্পর্কে জানা আর আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা করে ইতিহাস জানা অবশ্যই এককথা না। ইতিহাস বলতে আমরা বুঝি অতীতের ঘটনা বা সত্য ঘটনা। অতীতের কাল্পনিক ঘটনাকে আমরা পুরাণ (গুঃয) বলি, ইতিহাস না। এখন কোন ইতিহাস আসলে সত্য, কোনটা আংশিক সত্য, কোনটা মিথ্যা সেটা রহস্যঘেরা ব্যাপার। ছাপার অক্ষরে যা লেখা আছে বা ক্যামেরায় ছবি তোলা আছে, সেসব বিষয় সবসময় সত্য কথা বলে না। লিখিত ইতিহাস সাধারণত ক্ষমতায় জয়ীদের ইতিহাস বলে। পাশাপাশি আরেকদল ইতিহাসে অংশগ্রহণ করে যারা বিল্পবী। ইতিহাসকে নিরপেক্ষভাবে দেখার সুযোগ আছে নিশ্চয়ই, তবে প্রায়শই তাতে বাধা পড়ে। একপক্ষের দেয়া ইতিহাস সামনে আসে, বাকিটুকু অস্পষ্ট হয়ে যায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঘটে যাওয়া অনেক ইতিহাসই সে কারণে প্রশ্নবিদ্ধ ও প্রমাণসাপেক্ষ। গত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া বড় দুটি ঘটনার মধ্যে নিশ্চয়ই দুটি বিশ্বযুদ্ধ পড়ে। লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর নির্দেশে সংগঠিত যুদ্ধের কারণে। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে এটম বোমা ফেলাও নিশ্চয়ই জরুরি ইতিহাসের অংশবিশেষ। চেরনোবিলের পারমাণবিক বিদ্যুৎ বিস্ফোরণও উল্লেখযোগ্য দুঃখজনক ইতিহাস। যুদ্ধের কথা লিখলে আরো অনেক যুদ্ধ হয়েছে এবং হচ্ছেÑ মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায়। বিভিন্ন নতুন রোগের ইতিহাস সামনে এসেছে, পাশাপাশি আবিষ্কার হয়েছে সেগুলোর প্রতিষেধক। বহু দেশ ভাগ হয়ে গেছে, বহু জায়গায় সন্ধান পাওয়া গেছে তেল, স্বর্ণ বা হীরার খনির। ঘোড়ার পিঠে চড়ে আসা দস্যুরা বিদায় নিয়েছে; এসেছে আধুনিক গাড়ি, ট্যাঙ্ক, বোমারু বিমান, সাবমেরিন ও নানা দস্যু যান। অর্থনৈতিক লেনদেন ও জমা রাখার জন্য একছত্র অবস্থান নিয়েছে ‘ব্যাংক’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান। বার্তা পাঠানোর মাধ্যম হিসেবে টেলিগ্রাম, মানি অর্ডার, চিঠি আদান-প্রদানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে স্যাটেলাইট টেকনোলজি। এসেছে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপÑ সঙ্গে ইন্টারনেট যুক্ত হয়ে তা পরিণত হয়েছে তথ্য জমা রাখার ভিন্ন একটা ব্যাংক হিসেবে। পৃথিবীতে যত মানুষ প্রতিদিন মোবাইলে কথা বলে, চলমান ছবি দেখে এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করেÑ তার সবকিছু জমা থাকে কোনো শক্তিশালী প্রযুক্তিসম্পন্ন ডিভাইসে। একশ বছর পর কোনো মানুষের ইতিহাস জানতে চাইলে, তার সম্পর্কে প্রায় সব তথ্য বের করে নেয়া কঠিন হবে না। আধুনিক সময়ের মানুষকে সবসময়ই ট্র্যাক করে চলেছে পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটি। টেকনোলজির অভাবনীয় উন্নতি রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। কোনো মানুষের মস্তিষ্ক যদি গত পঞ্চাশ বছর ঘুমিয়ে থেকে হঠাৎ জেগে উঠত, নিশ্চয়ই তার বিস্ময়ের শেষ থাকত না! ব্যাপারগুলো সত্য ইতিহাস নাকি কল্পনাপ্রসূত ভ্রম, তা বুঝতে বুঝতে চলে যেত আরেকটি জীবন। কামান থেকে মিসাইল, বই থেকে ই-বুক, ফিল্ম থেকে ভিডিও ক্লিপ, টাইপ রাইটার থেকে কম্পিউটার, টেলিফোন থেকে সেল্যুলার ফোন, হেলিকপ্টার থেকে ড্রোন, লাইব্রেরি থেকে ইন্টারনেটÑ এমন হাজারো বস্তুগত বিষয় নিত্যদিনে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, যার ইতিহাসের পরিধি ১০০ বছরেরও কম। প্রযুক্তির প্রবাহকে আটকে রাখা যায় না, এর চেষ্টা করাও উচিত নয়। আধুনিক প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার অনেক সময়ই সৃষ্টি করে বিব্রতকর পরিস্থিতি। স্যোশাল মিডিয়ার কথাই ধরা যাক। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক থেকে শুরু করে ইউটিউব, যে সমস্ত মাধ্যমে মানুষ অবলীলায় লিখতে বা ছবি প্রকাশ করতে পারে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর জানা-পড়ার সঙ্গে মিশে যায় ভুল ও বিকৃত তথ্য। প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ হয়, কখনো হয় আক্রমণ। মানুষের মনে গেঁথে রাখার মতো ঘটনার থেকে ঠুনকো ঘটনা ছড়াছড়ি স্যোশাল মিডিয়ায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও লোকজন ২-৩ দিনের বেশি মনে রাখতে পারে না। এসে যায় নতুন মুখোরচক খবর। একজন স্কুলপড়ুয়া কিশোর ততটুকু ইতিহাসই মনে রাখছে, যা তার পরীক্ষায় পাস করার জন্য লাগছে। ফলে ইতিহাস ব্যাপারটা খুব হালকা হয়ে যাচ্ছে। আগ্রহ না থাকলে জোর করে কাউকে সামগ্রিক ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া কি সম্ভব? যদি সম্ভবও হয়, সেই জ্ঞান কি আদৌ কাজে আসে? মনে হয় না। শুধু তোতাপাখির মতো ইতিহাস পড়লে কাজ হবে না, কারণ তা আত্মস্থ করার ব্যাপার আছে। আর মূল্যবোধের এত আমূল পরিবর্তন হয়েছে, এক যুগ সময়ে যে পুরনো ঘরানার মানুষের হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। পৃথিবীটা যেন তৈরি হয়েছে সস্তা একপ্রকার প্লাস্টিক দিয়ে, যা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মুখে দেয়ামাত্রই মিলিয়ে যায়। মিষ্টি স্বাদটা এসেই চলে যায়। ইতিহাস শুধু অতীতের কথা বলে না, ইতিহাস বর্তমানে বিদ্যমান এবং ভবিষ্যৎ নির্ধারণের প্রধান উপাদান। আজকে যে ছোট্ট বীজ, একশ বছর পর সে একটা বিশাল গাছ হয়ে উঠবে। জানলা দিয়ে যে বিশাল বটগাছটা দেখা যাচ্ছে সে ১৯৭০ সালেও এখানে ছিল, হয়তো ২০৫০ এ-ও থাকবে। সেই গাছ ও গাছের পাশের নদী কয়েক যুগের ইতিহাসের সাক্ষী। নানা রঙের হাজারো পাখিরা উড়ে চলে গেছে, এসেছে নানা রঙের মটোরযান ও চিরতরে বিদায় নিয়েছে অনেক রাজা-প্রজা, গাছটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। মানুষগুলো আগে হাঁটতে হাঁটতে এদিক-ওদিক তাকাত, এখন তারা রোবটের মতো হেঁটে যায় কানে হেডফোন লাগিয়ে। বাতাসের অক্সিজেনের বিশুদ্ধতা কমে সেখানে যুক্ত হয়েছে বিষাক্ত গ্যাস। আগের মতো আর বৃষ্টি হয় না, তবে সূর্যের আলো আসে। ভাগ্যিস মানুষের ক্ষমতায় সূর্যালোক আটকানোর শক্তি নেই। হয়তো একসময় প্রযুক্তিগত উন্নয়নে তা-ও সম্ভব হবে। তখন আর গাছের পাতা সবুজ রং দেবে না। পৃথিবী নামক গ্রহটা পরিণত হবে তপ্ত পাথুরে তলে, তার ওপর চলাফেরা করবে শুধু লোহার যানবাহন আর হেলমেট পরা বিশেষ মানবসম্প্রদায়। মাথায় পরা সেই উন্নত হেলমেটই হয়তো পূরণ করবে মানুষের সব মৌলিক চাহিদা। খাদ্য বা অক্সিজেন গ্রহণের জন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হবে না। এইভাবে কিছুকাল চলার পর একসময় মানুষকে বিদায় নিতে হবে। আবার ধীরে ধীরে সবুজ ঘাসের আভা দেখা যাবে পাথুরে ভূমিতে। পৃথিবী আবার খুঁজে পেতে থাকবে নতুন প্রাণের সন্ধান। এমনিতেও মানুষের ইতিহাস খুব বেশি সময়ের নয়, অন্যান্য অনেক প্রাণীদের তুলনায়। নৃ-বিজ্ঞানের ইতিহাস তাই বলে।
অতীতের সবকিছু ইতিহাস হলেও বোঝার সুবিধার্থে একে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। যুগের ইতিহাস, প্রাণীর ইতিহাস, সাম্রাজ্যের ইতিহাস, বিজ্ঞানের ইতিহাস, ভূগোলের ইতিহাস থেকে শুরু করে করে চাকা, আগুন, অস্ত্র, পোশাক, চাষাবাদ, বাসস্থান, শিল্প সবকিছুরই ইতিহাস রয়েছে। আগ্রহের বিষয় অনুযায়ী মানুষ তার ইতিহাসের জ্ঞান বৃদ্ধি করেÑ বই পড়ে, ছবি দেখে বা গল্প শুনে। যে বিজ্ঞানী আগ্নেয়াস্ত্র তৈরিতে উৎসাহী, সে অবশ্যই পূর্বের মারাণাস্ত্র তৈরির ইতিহাস বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবে। চাষাবাদের ইতিহাস সম্পর্কে তার আগ্রহ না-ই থাকতে পারে। আবার যার ঝোঁক পাহাড়ে ওঠা, সে কোনোদিন হিমালয়ের কাছে যেতে পারুক বা না পারুকÑ জানতে ইচ্ছুক হবে পর্বত, আগ্নেয়গীরী ও উঁচু অঞ্চলের প্রাণীদের জীবনধারণের ইতিহাস সম্বন্ধে। শখ ও উচ্চাকাক্সক্ষার কোনো পরিসীমা টানা থেকে না। গ্রামের একজন দরিদ্র কিশোরেরও ইচ্ছা করতে পারে চাঁদে বা মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার। চাঁদে যেতে পারার সম্ভাবনা তার যে প্রায় শূন্য, সেটা জেনেও সে মহাকাশ ভ্রমণ সম্পর্কে লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়ে বা ছবি দেখে। জ্ঞান অর্জন এভাবেই হয়।
আর নিত্যদিনের চলার জন্য যে জ্ঞান লাগে, সেটা তো থাকতে হয়ই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অনেক সময় নতুন পথ দেখাতে সাহায্য করে, সন্দেহ নেই; তবে কার বাঁশি বাজানোতে আগ্রহ আর কে ক্যান্সারের প্রতিষেধক তৈরি করতে চায়, তা নিশ্চয়ই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করে দিতে পারে না? পারে কি? একথা ঠিক যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কিছু ধনী দেশ বাচ্চাদের উদ্দীপনার দিক বিবেচনা করে তাদের গাইড করে। ফুটবল খেলায় আগ্রহ থাকলে তার অংক শেখায় শিথিলতা থাকে। রান্না করা নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগও আছে কোথাও কোথাও; ছবি আঁকায় সৃজলশীলতার চিহ্ন রাখলে ছাত্রটিকে ঘুরতে পাঠায় বিশ্বের নানা মিউজিয়ামে। ব্যবস্থাগুলো প্রতিষ্ঠানই করে থাকে। কিন্তু এই ধরনের বিলাসী শিক্ষাগ্রহণ ব্যবস্থা মুষ্টিমেয় কিছু ধনী দেশের জন্যই প্রযোজ্য। সেই পদ্ধতি যতই উন্নত হোক না কেন সারাবিশ্বের বিদ্যালয়গুলো এভাবে চলতে পারে না। ভুলে গেলে চলবে না এখনো সারাবিশ্বের বিশাল সংখ্যক জনগণ রাতে না খেয়ে রাতে ঘুমাতে যায়। যুদ্ধে নিপীড়িত দেশ, লাখ লাখ বঞ্চিত জনগণের খবর রোজই খবরের কাগজে বের হয়। বেঁচে থাকাই যেখানে দুরূহ সেখানে শখ ও স্বপ্ন আর কি থাকতে পারে! আফ্রিকার অনেক দেশের খনিজ সম্পদ শুষে নিয়ে গেছে তাবড় তাবড় ক্ষমতাশীল দেশগুলো, প্রকৃত ভূমি বা খনির মালিকদের হত্যা করে। মালিকদের বংশধররা বেঁচে থাকে ক্ষুধা নিয়ে ও মরে পুষ্টিহীনতায়। মানুষের কৌশল ও দখলদারীর ইতিহাস বড়ই নির্মম।
আরেকভাবে দেখলে ইতিহাস মানেই জমাকৃত অভিজ্ঞতা। অসংখ্য অভিজ্ঞতা থাকে যা প্রত্যক্ষভাবে নিজের জীবনে পরখ করা, আর বাকিগুলো অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে ধার করা। বড় অর্থে দুইটাই ইতিহাসের অংশ। প্রত্যেকটা প্রাণীই তার অভিজ্ঞতার সমান অভিজ্ঞ। কেউ কেউ তা প্রকাশ করতে সমর্থ হয় তাদের কাজ, কথা বা লেখার মধ্য দিয়ে, বাকিদেরটা অপ্রকাশিতই থেকে যায়। প্রকাশ না পেয়ে থাকলে তার হয়ত কোনো প্রমাণ থাকে না, কিন্তু ইতিহাস রচনা হয়েই যায় মহাকালের আকাশে-বাতাসে। মানুষ নবীন থেকে প্রবীণ হয়। প্রবীণ হওয়া মানে শুধু তার চেহারা আর শারীরিক কিছু পরিবর্তন নয়। প্রবীণের সবচেয়ে বড় শক্তি অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা যে সবসময় ইতিবাচক হবে তা না। নবীনের থেকে একজন প্রবীণ ব্যক্তি অনেক বেশি মাথা খেলিয়ে কাজ সম্পন্ন করতে পারে, যে কারণে শক্ত-সামর্থ্য তরুণের থেকে বয়ষ্ক বৃদ্ধ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অধিক দূরদর্শী হয়। যুবক যদি ১০০-এর মধ্যে ৩০ পর্যন্ত দেখতে পায়, প্রবীণ দেখতে পায় ৭০/৭৫ পর্যন্ত। তবে ব্যতিক্রম তো আছেই। ব্যবহারিক জগতে সেই অভিজ্ঞতা সরাসরি কাজে লাগুক বা অনিষ্ট করুক এর প্রভাব স্বীকার করতেই হবে। অভিজ্ঞতা আসে অতীত থেকে। আর অতীতই হচ্ছে ইতিহাস। ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে কিছুই ঘটতে পারে না। ঘড়ির কাঁটা যে ঘুরছে এর প্রত্যেকটা
সেকেন্ডও যেন লেখা হয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের পাতায়। উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো দাগ কেটে যায়, মনে থাকে, লিখিত ইতিহাসে জায়গা পায়। যে সমস্ত ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ না, সেগুলো থাকে নিশ্চুপ, নির্মোহ, নির্জীব ইতিহাস হয়ে।
ধরা যাক এক ব্যক্তি আন্টার্কটিকা ঘুরে এসে, আইসবার্গ দেখার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করল। আরেক ব্যক্তি পুরো ঘটনাটা টেলিভিশনের পর্দায় দেখে ঘটনাটা জানল। কিছুটা বুঝতে পারল। অভিযাত্রীর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে একরকম অভিজ্ঞতা লাভ করল। পরোক্ষভাবে জানা এই ইতিহাসকেই ধার করা ইতিহাস বলে লিখছি ভাষায় প্রকাশের জন্যে। তবে সেক্ষেত্রে দেখা যাবে সাধারণ অর্থে ইতিহাস বলতে আমরা যা বুঝি তার বেশিরভাগই পরোক্ষ ইতিহাস। এক যুগ আগেও আমার ধারণা ছিল ইতিহাস জানার প্রধানতর মাধ্যম বই। পরে দেখলাম প্রযুক্তিনির্ভর অনেক ভিডিও ক্লিপ ও অডিও পডকাস্ট থেকেও ইতিহাস জানা সম্ভব। ব্যক্তিগতভাবে আমি সেগুলো থেকেও জ্ঞান আহরণ করেছি আনন্দের সঙ্গে, তবে এখনো বিশ্বাস করি কাগজের পাতায় লেখা ইতিহাসই সর্ববৃহৎ প্রভাব রাখে। ছাপার অক্ষরে নিজের কল্পনা করার স্বাধীনতা আপনা-আপনিই বেশি থাকে। মুঘল সম্রাটদের জীবনী ইতিহাস বইয়ে পড়ে যতটা গভীরভাবে কল্পনা করতে পেরেছি, তা চলচ্চিত্র বা ইন্টারনেট ক্লিপ থেকে পারিনি। এখনকার প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অনেক কম বই পড়ে।
অধিকাংশই অভ্যস্ত আরেকজনের তৈরি করা ভিডিও দেখে। ভিডিও চিত্রকে তারা ছাপার অক্ষরের থেকে বেশি গুরুত্ব দিতেই পারে। আমি তাদের সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে অশ্রদ্ধা করছি না, তবে আবারও বলছি ফিকশন হোক বা সত্য ইতিহাস পড়ার সময় আমাদের মন কল্পনা করে নেয় বাদশাহ হুমায়ুন কেমন বা মাদার তেরেসা কেমন ছিলেন। যখন কেউ তাদের ছবি ও সংলাপ দিয়ে ভিডিও চিত্র তৈরি করে দেবে, আর সবাই তা মোবাইলের স্ক্রিনে দেখবে, সেখানে কল্পনার সুযোগ নিশ্চয়ই কম।
পাশাপাশি ইতিহাস জানার জন্য সব রকম মাধ্যমই খোলা রাখা উচিৎ। ঝর্ণার শীতল পানি ছুঁয়ে দেখতে পারলে সবচেয়ে ভালো। যদি ছুঁয়ে দেখা সম্ভব না হয় তাহলে অন্তত তার ছবি দেখি, ঝিরঝির শব্দ শুনি। অনুভব করা না গেলেও একটা ধারণা পাওয়া যাবে ঝর্ণা সম্পর্কে।
জয়ীদের কথায় ফিরে আসা যাক।
সারাবিশ্বে শাসক ও ক্ষমতাশীলদের অধিকাংশ সময়ই নির্মম হতে দেখা গেছে। পৃথিবীতে যুগের পর যুগ ধরে শান্তি বিরাজ করেছে। এমনটা ইতিহাসে নেই। ইতিহাস বলে ছোট্ট একটা বিষয়কে ঘিরে দ্বন্দ্ব শুরু হয় যার পরিণতি গড়ায় যুদ্ধে গিয়ে। রাক্ষসের ন্যায় রাষ্ট্রপ্রধান এডলফ হিটলারকে যেমন আমরা জার্মানির একজন স্বৈরশাসক হিসেবে জানি, ঠিক তেমনি মিত্রবাহিনী বলে খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা যুদ্ধের তা-ব সম্পর্কেও সারাবিশ্ব অবগত। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি, দখল ও অস্ত্র বিক্রির প্রতাপে ভিয়েতনাম, ইরাক, প্যালেস্টাইন থেকে শুরু আফগানিস্তান, লিবিয়ার লাখ লাখ নিরীহ মানুষ প্রাণ দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকের ভূমিকায় তারা বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করে এবং নির্বিচারে চালায় হত্যাযজ্ঞ। এরপর তাদের নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে জাতিসংঘের মানবাধিকার রক্ষাকারী সংগঠন! বিপুল প্রাণহানির থেকে সৃষ্টি হয় কখনো বিল্পবী, কখনো জঙ্গি বাহিনী। শুরু হয় সহিংস লড়াই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এভাবেই চলে আসছিল। এখন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে রাশিয়া। ইউক্রেনে বোম্বিং করছে রাশিয়া, এদিকে ইউক্রেনকে পাল্টা আক্রমণ করার জন্য বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রের যোগান দিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা।
অর্থাৎ আবার সেই রক্তপাতের ইতিহাস! মানব সভ্যতা গড়ে ওঠার ইতিহাস এত নিষ্ঠুর যা উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। পিঁপড়ার মত দলগতভাবে যুদ্ধ করে যায় মানুষ। অর্থের মূল্যের কাছে পরাজিত হয় মানুষের জীবন। মহাবুদ্ধিমান, জটিল প্রাণী মানুষ সমষ্টিগতভাবে শান্তিতে থাকতে পারে না। এই মানুষই বলে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব! স্বজাতিকে নিঃশেষ করে দিয়ে, স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ জীব আমরা মানুষ।
দৈহিক গঠন ও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পুরুষরা আদিকাল থেকে আধিপত্য দেখিয়ে আসছে। শিকার যুগে গুহায় আঁকা চিত্রকর্ম দেখে ধারণা করা যায়Ñখাদ্যের সন্ধানে যখন মানুষ দল বেঁধে বাইসন বা ষাঁড়ের পালকে আক্রমণ করত, তখন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকত পুরুষরা। নারীদের দেখা যায় পশুর চামড়া দিয়ে শীতবস্ত্র তৈরি করতে বা গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করতে। বাইরের পেশি শক্তিনির্ভর কাজে নিয়োজিত পুরুষরা নিজেদের সুবিধার্থে তৈরি করে গেছে নিয়মনীতি। মহামানব যারা এসেছেন তাদেরও সিংহভাগ পুরুষ। মেয়েদের পুরুষরা বিবেচনা করেছে কখনো সেবিকা, কখনো সৌন্দর্যের আসবাব হিসেবে। নারী-পুরুষ সমান অধিকার পেলে নিশ্চয়ই আরও অনেক মহৎ মানবীর নাম আমরা জানতাম। একবিংশ শতাব্দীতেও বহু দেশের, বহু পরিবারে ধরে নেয়া হয় নারীর কাজ ঘরে, পুরুষের কাজ বাইরে! আসলে আদিযুগ থেকে বর্তমানে শক্তি প্রয়োগ ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের শুধু রূপ পরিবর্তন হয়েছে। মূল বিষয় প্রায় একই রয়ে গেছে।
বিবর্তন ও বুদ্ধির জোরে মানুষের উন্নতি খুব দ্রুত হয়েছে, তাই পতনও সন্নিকটে। তেলাপোকা, ইঁদুর, সাপ, ব্যাঙ বা পাখি টিকে যাবে আরও বহু শতাব্দী, চলে যাবে মানুষ। ইতিহাস বিবেচনায় সেই লক্ষণই দেখা যায়। তবে শারীরিক গঠনে পরিবর্তন এনে অন্যভাবে মানুষ টিকে থাকতে পারে, প্রযুক্তিগত কারণে। আমাদের হয়তবা হাঁটতে হবে না, খেতে হবে, নিঃশ্বাস নিতে হবে না। জন্ম নেয়ার পরপরই মস্তিষ্ককে বসিয়ে দেয়া হবে কোনো সুপার কম্পিউটারে। সেই কৃত্রিম কম্পিউটারই হয়তো নিয়ন্ত্রণ করবে মানুষের অস্তিত্বকে। সেইভাবে টিকে থাকা মানুষকে ‘মানুষ’ বলা যাবে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন।
ইতিহাসের অবস্থান অনেক শক্ত আর ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে অনুমানের বিকল্প নেই। ভবিষ্যতের কোনো ইতিহাস হয় না।
সরল জীবনযাপন যত ব্যাহত হবে, মানসিক অশান্তি তত বাড়বে। ভুটান বা নিউজিল্যান্ডের মতো নিরীহ রাষ্ট্র কখনোই খুব বেশি সংখ্যক থাকতে পারে না। জনসংখ্যা, আদর্শ, আত্মতুষ্টি, সক্ষমতা, ন্যায়-নীতি ধরনের অনেক বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। শীতপ্রধান মহাদেশ ইউরোপ যেমন মধ্যযুগে ধর্মযুদ্ধ করেছে, উষ্ণ অঞ্চলজুড়েও লড়াই হয়েছে ক্ষমতার আধিপত্য নিয়ে। অন্ধভাবে ধর্মকে মানার জন্য বলির শিকার হতে হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। সমাজে শান্তি-অশান্তির ভারসাম্য রাখতে প্রবর্তন করা হয়েছে বিভিন্ন বিধিবিধান ও নিয়ম-কানুন। সেই নিয়ম আবার সবার জন্য সমান নয়। প্রজা, দরিদ্র মানুষ বা সাধারণদের জন্য নিয়ম অনেক কঠোর, যা কখনোই প্রযোজ্য না রাজা, জমিদার বা মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে। ইতিহাস থেকে ধারণা করা যায় একজন বিজ্ঞানী, আইন-প্রণেতা, ব্যবসায়ী, শিল্পী, পুরোহিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করে ক্ষমতাবান কোনো ব্যক্তি বা দল। আইনে যদি লেখাও থাকে ‘একজন মানুষকে হত্যা করলে, প্রাপ্তবয়ষ্ক খুনির ফাঁসি হবে’ বাস্তবে তা হয় না। আমাদের মত দুর্নিতীগ্রস্ত দেশে তো হয়ই না, অধিকাংশ উন্নত দেশেও হয় না। নানা কায়দা করে, ঘুষ দিয়ে, হুমকি দিয়ে, উকিল নিয়োগ করে বেঁচে যায় আসামি। আর বৃহৎ পরিসরে হত্যা করলে তো কথাই নেই। যে সব রাষ্ট্রপ্রধানদের হুকুমে ষাট লাখ ইহুদি মরে বা ফিলিস্তিনবাসী নিহত হয় কিংবা ত্রিশ লাখ বাঙালি জীবন দেয় সেই শক্তিধর নেতাদের বিশ্ববাসী স্যালুট দেয়! বিচার তো অনেক দূরের কথা। লিখিত আইনের ইতিহাস কাগজে কলমে সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়ায়, বাস্তবচিত্র একেবারেই ভিন্ন। বিচার হোক বা না হোক, ইতিহাস সত্য এবং বহুকাল পরে হলেও তা আংশিক প্রকাশ পায়। মৃত্যুর পর অন্য কোনো জগতে যারা বিশ্বাস করেন, তারা নিশ্চয়ই এর ফলাফলে বিশ্বাসী। চারপাশের জগৎ দেখলে অবশ্য তা মনে হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ম ও ইহকাল-পরকালের ধারণাকে ব্যবহার করা হয় রাজনীতির ফায়দা লুটতে। মন থেকে পরকালে বিশ্বাস রাখতে পারলে অসাধুতা নিশ্চয়ই কমে যেত। হিসাব তো তাই বলে।
ইতিহাস নিয়ে সংশয় ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকবে, এর অনেক নেতিবাচক দিকও থাকবে। তবে ইতিহাসের ইতিবাচক ব্যাপারগুলো তুলে ধরা খুব জরুরি। বিদ্যালয়ে অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যখন ইতিহাস পড়েছি তখন তা সত্য বলেই ধরে নিয়েছি। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের কথা বলছি। আমার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল যে ছাপার অক্ষরে লেখা সবকিছুই সত্য। তারপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলো বাংলাদেশের। নব্বইয়ের প্রথমভাগে এবং ছিয়ানব্বইয়ে ভিন্নধর্মী দুটি দল ক্ষমতায় এলো যথাক্রমে। পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস অংশে পরিবর্তন হতে থাকলো। পারিবারিক শিক্ষা থেকে বুঝতে পারলাম যা পড়ছি তার সবটা সত্য নাও হতে পারে। তারপর তো একের পর এক ঘটনা এমনভাবে আসতে থাকল যে ২+২=৪ কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশের চিন্তা মাথায় এলো! তবে কম জেনে সংশয়বাদী হওয়া ঠিক নয়, যেরকম সপ্তম শ্রেণীর বালকের মেধা নিয়ে নাস্তিক হওয়া সমীচীন নয়। সে যাক, অন্ধভাবে ছাপার অক্ষরের ইতিহাসকে বিশ্বাস করারও ইতিবাচক দিক রয়েছে। বইয়ের ওপর ভক্তি-শ্রদ্ধা থেকেই সব কিছু সত্য বলে ধরে নেয়া হতো। তিন যুগ পরে এখন শিশুদের মূল্যবোধে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। কাগজের বই, বলপেন ব্যাপারগুলো অনেকের কাছে খুব খেলো। তারা জন্মের পর থেকেই মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব ইত্যাদি ব্যবহার করে অভ্যস্ত। অনেক শিশুরা নানারকম বিষয়াদী শিখছে, তথ্য গ্রহণ করছে ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে। কিশোর হলেই হারিয়ে ফেলছে শ্রদ্ধাবোধ। বই, মা বা ঈশ্বর কোনো কিছুর প্রতিই তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা সেইভাবে নেই। আধুনিকতার নামে বাচ্চারা ইতিহাস বা পূর্বের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পারছে না। সবকিছুর প্রতিই ধারণাগুলো ভাসা ভাসা। দীর্ঘসময় পর এর ফলাফল দুঃখজনক হতে পারে।
ইতিহাসের ইতিবাচক দিক লিখে লেখাটা শেষ করা যাক।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অবশ্যই খাদ্য, সমাজে চলার জন্য বস্ত্র, আশ্রয়ের জন্য বাসস্থান মৌলিক প্রয়োজন, যা অন্যান্য পশুপাখির মধ্যেও রয়েছে কমবেশি। এছাড়া মানুষের আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন পড়ে। একটা চড়–ই পাখি বা ইলিশ মাছের পক্ষে পূর্বপুরুষের ইতিহাস জানার সুযোগ নেই। তারা ইতিহাসকে বহন করে অস্তিত্বের সঙ্গে, হয়ত ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে। মানুষ ইতিহাস জানে অনেকটাই নিখুঁতভাবে। ৩০০০ বছর আগের কোনো মানুষ এখন বেঁচে নেই, কিন্তু আমরা জানতে পারি মুসা নবী, জেসাস ক্রাইস্ট, হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রমুখ মহামানবদের কর্মের কথা। জানতে পারি ৫০০০ বছর আগের মিসর ও চীনের সভ্যতা সম্পর্কে। বিশ্বাস রাখলে আরও আগের অর্থাৎ ৬ কোটি বছর আগে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া ডাইনোসরদের সম্পর্কেও ধারণা রাখতে পারি। বিজ্ঞানীদের হিসাবে সৌরজগতের জন্ম ৪৬০ কোটি বছর পূর্বে। আমরা মানুষরা এই সব তথ্য জানতে পারি ইতিহাস পড়ে। মানুষ যে শুধু তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইতিহাস লিখেছে তা কিন্তু না। ইতিহাস উদ্ধারের পেছনে রয়েছে লাখ লাখ মেধাবী মানুষের গবেষণা, শ্রম ও অনুমান। বৈজ্ঞানিক, লেখক, শিল্পী, দার্শনিক, নেতা সবাই দূর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে গিয়ে ফিরে গেছেন অতীত চিন্তায়। অনুসন্ধান করে বের করেছেন বহুকিছু। ভবিষ্যৎ সবসময়ই অনিশ্চিত, আর অতীত না জানলে ভবিষ্যৎ অনুমান করা প্রায় অসম্ভব। মানুষের কৌতূহলী মন অনেক কিছুই করে, তার মধ্যে অন্যতম বিষয় হচ্ছে জ্ঞান আহরণ। নতুন দেশের খোঁজে মানুষ যেমন সমুদ্রে নৌকা ভাসিয়ে দেয়, তেমনি সময়ের হিসাব রাখতে আবিষ্কার করে ঘড়ি। এই জ্ঞানের পিপাসা কোনোদিন মিটবে না, তাই নতুন কিছুর জানার আগ্রহও কমবে না। আলো-অন্ধকার, খারাপ-ভালো, অতীত-ভবিষ্যৎ এরা নিছক বিপরীত শব্দ নয়, একে অপরের পরিপূরকও। অন্ধকার অনুভব না করলে আলোর প্রকৃত গুরুত্ব বোঝা সম্ভব নয়।
আমাদের পার করে আসা প্রতিটা দিনই ইতিহাস। সব ইতিহাস বইয়ের পাতায় বা জাদুঘরে জমা থাকে না। ইতিহাস ছড়িয়ে থাকে সমগ্র পরিম-লে। বহুকাল পরে হয়ত কেউ আবিষ্কার করবে সেই অলিখিত ইতিহাস। পৃথিবী তো জন্ম থেকেই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, কিন্তু মানুষ সেই তথ্য আবিষ্কার করেছে মাত্র কয়েক শতক আগে। বাতাসে ভাসতে থাকা ইতিহাসকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে, আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে কিছু মনীষী। মানুষ হয়ে জন্মানোর অন্যতম সার্থকতা তার জ্ঞান। মস্তিষ্কের ইতিবাচক প্রয়োগ ও অভিজ্ঞতার কল্যাণমুখী ব্যবহারের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষ আসলেই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। যতই যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি, দখলদারি থাকুক; ইতিহাসের আরেকদিক বলে মানুষ অত্যন্ত আত্মত্যাগী, পরোপকারী ও দয়ালু প্রাণী। কত শত মা-বাবা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে গেছেন সন্তানদের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য, পৃথিবীর জন্য। ইতিহাসকে গভীরভাবে আলোকিত করেছেন কার্ল মার্কস, গৌতম বুদ্ধ, মাদার তেরেসা, লালন ফকির, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ন্যায় হাজারো মনীষী। ২৭ বছর কারাভোগ করে, আপসহীন নেতা নেলসন মেন্ডেলা দেখে যেতে পেরেছেন একটি স্বাধীন দেশ এমন ঘটনাও লেখা রয়েছে ইতিহাসের ভা-ারে। সবকিছুর শুরু বা শেষ আছে কিন্তু ইতিহাসের নেই। সময়ের মতো ইতিহাসও অমর।
ইতিহাস চিরজীবী হোক অবিকৃতভাবে, দর্শন টিকে থাকুক চেতনায়, বিজ্ঞান ব্যবহৃত হোক প্রাণের কল্যাণে তা হলেই পৃথিবীটা হবে শোভন ও বাসযোগ্য।
[লেখক : চিত্রকর, চলচ্চিত্র শিক্ষক ]