বাবুল দে
স্মরণ
বাংলাদেশে একদিকে সাংবাদিকতা অন্যদিকে রাজনীতিÑ দুই ক্ষেত্রেই আহমদুল কবির ছিলেন একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশে পঞ্চশের দশকের মধ্যভাগে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার মূলধারা গড়ে তুলেছিলেন যে ক্ষণজন্মা কয়েকজন সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব, তার মধ্যে একজন ছিলেন আহমদুল কবির। আবার রাজনীতি ক্ষেত্রে তিনি সেই চল্লিশের দশক থেকে প্রগতিশীল আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেরই দীক্ষাগুরু হয়ে আছেন। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির একজন আদর্শ পুরুষ। বনেদি জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি সাধারণ মানুষের জন্য সাংবাদিকতা এবং রাজনীতির আদর্শবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজকে সম্পৃক্ত করেছিলেন যা বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির অন্য অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়নি।
জীবদ্দশায় আহমদুল কবির একাধারে ছিলেন সাংবাদিক-সম্পাদক এবং রাজনীতিবিদ। আর জোর দিয়ে বলা যায়, দুই ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, বস্তুনিষ্ঠ ও আদর্শবাদী। এক্ষেত্রে আমাদের মতো ছোট মাপের রাজনীতির কর্মীদের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছু তিনি রেখে গেছেন। তার রাজনীতির আদর্শবাদী কর্মী হয়ে লক্ষ্য করেছি তার সাংবাদিকতার আদর্শ ছিল সব শ্রেণী-পেশার সাধারণ মানুষের জন্য সত্য-বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশন এবং রাজনৈতিক আদর্শ ছিল দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের প্রগতিশীল-সত্যনিষ্ঠ আদর্শ ধারণ করে নিরলস কাজ করে যাওয়া।
আহমদুল কবির কী সাংবাদিকতা কী রাজনীতি ক্ষেত্রে তিনি বিশ্বাস করতেন এ অঞ্চলের মানুষের জন্য সাংবাদিকতা এবং রাজনীতি হতে হবে জনবান্ধব এবং জনকল্যাণমুখী। এটা তিনি শুধু বিশ্বাস করতেনই না তিনি তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাও চালিয়েছেন। তার এসব কর্মকা-ের ফসল হচ্ছে দৈনিক সংবাদ এবং সাম্যবাদী আদর্শের রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রী পার্টি গড়ে তোলা। তিনি সাংবাদিকতায় অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং বস্তুনিষ্ঠতার ক্ষেত্রে ছিলেন আপসহীন। একইভাবে তিনি রাজনীতিতে ছিলেন উদার গণতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী ধারায় দেশ ও মানুষের উন্নয়নচিন্তার ধারক-বাহক, যা তিনি আমাদের মতো নবীন রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে প্রবাহিত করতে কার্যকরভাবে সক্ষম হয়ে ছিলেন। আমরা যখন আহমদুল কবিরের সাংবাদিকতা এবং রাজনৈতিক জীবন ও কর্ম পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ করি তবে এই এ বিষয়টিই আমাদের সামনে উঠে আসে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন কালপর্বে সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক কর্মীÑ যারা আহমদুল কবিরকে কাছ থেকে দেখেছেন, যারা তার সঙ্গে কাজ করেছেনÑ সাংবাদিকতা এবং রাজনীতি ক্ষেত্রে, তারা জানেন কতটা সহজ-সরল মানুষ ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে বিভিন্ন কাজে সস্পৃক্ত হয়ে তাকে, রাজনীতিক এবং সম্পাদিকতার বাইরেও তাকে একজন প-িত ব্যক্তি মনে হয়েছে। তার সময়ে সমসাময়িক, কী সাংবাদিকতা, কী রাজনীতি বিষয়ে, তিনি যেসব বক্তব্য-মতামত দিতেন তাতে তাকে একজন প-িত ব্যক্তি না ভেবে কোন উপায় ছিল না। এসব কথা বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিক বা রাজনীতিকরা হয়তো আমাদের মতো অনুভব করবেন না, কিন্তু ইতিহাস পাঠের পর তা অস্বীকারও করতে পারবেন না।
আহমদুল কবির দৈনিক সংবাদ প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝিতে, ১৯৫৪ সালে। এর আগে সংবাদ ছিল তখনকার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের দলীয় সংবাদপত্র। মুসলিম লীগের মুখপত্র হিসেবে সংবাদ বেশিদূর এগোতে পারেনি। ১৯৫১ সালে সংবাদ প্রকাশ করে ১৯৫৪ সালে রণেভঙ্গ দেয় মুসলিম লীগ। এ সময় সংবাদ কিনে নেন আহমদুল কবির। তারপরই পাল্টে যায় সংবাদ-এর নীতি-আদর্শ। তার হাতে আসার পর সংবাদ হয়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিশীল আদর্শের সংবাদপত্র। আহমদুল কবির সংবাদের এই রূপ সম্পূর্ণ পাল্টে দেন। তার হাতে আসার পরই দৈনিক সংবাদ তখনকার পাকিস্তানে এবং পরে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং অসাম্প্রদায়িক আদর্শের একটি সংবাদপত্র হিসেবে পাঠকের মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়। আর এটা সম্ভব হয়েছিল আহমদুল কবিরের বস্তুনিষ্ঠ এবং সৃজনশীল প্রয়াসের কারণে।
দৈনিক সংবাদ-এর দায়িত্ব নেয়ার পরপরই আহমদুল কবির নতুন এর চরিত্র পুনঃনির্মাণ করেন। তার হাতে আসার পর সংবাদের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক শাসন-শোষণ ও বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংবাদ ছিল আপসহীন। এ আদর্শের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশেও সামরিক স্বৈরাচারী অপশাসনের বিরুদ্ধে সব সময়ই সোচ্চার ছিল দৈনিক সংবাদ। ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার বিরুদ্ধে সংবাদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। আর এ ভূমিকার কারণে দাঙ্গাকারীরা সেদিন আহমদুল কবিরের ঘোড়াশালের বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু আহমদুল কবির আপস করেননি। তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার কোন পরিবর্তন হয়নি। সে ধারা সংবাদ এখনো বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে তার আদর্শের ধারাবাহিকতায়।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আঘাতের কালো হাত সংবাদকেও স্পর্শ করে। ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর পুড়িয়ে দেয়া হয় বংশালে দৈনিক সংবাদ কার্যালয়। বিধ্বস্ত সংবাদ-এর সঙ্গেই ভস্মীভূত হন তখনকার সংবাদের প্রতিভাবান সাংবাদিক শহীদ সাবের। সংবাদ কার্যালয় ধ্বংস করে দিলেও বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিকÑ এমনটা বোঝানোর জন্য দৈনিক সংবাদ পুনঃপ্রকাশের জন্য পাকিস্তানিরা প্রবল চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আহমদুল কবির পাকিস্তানের কোন চাপের কাছেই নতি স্বীকার করেননি। জীবন যেতে পারে কিন্তু সংবাদ প্রকাশ করব নাÑ এমন সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি। ফলে নানা প্রলোভন ও হুমকির মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘সংবাদ’ আর প্রকাশিত হয়নি। সংবাদের সাংবাদিকদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ভারতের চলে যান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন, মুক্তিযুদ্ধের পর সেদিন প্রথম সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর মধ্য দিয়ে সংবাদ আহমদুল কবিরের সাংবাদিকতা ও রাজনীতির আদর্শকে আরো বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার ব্রত ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করে।
আহমদুল কবির ছিলেন অত্যন্ত সৃষ্টিশীল মানুষ। বাংলাদেশে সাংবাদিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা ছিল তুলনাহীন সৃজনশীল এবং পারঙ্গম। এক্ষেত্রে তিনি সংবাদকে গড়ে তোলেন, শুধু একটি পত্রিকা নয়, একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা এবং ব্যবস্থাপনার আধুনিক ধারা তিনিই প্রথম প্রবর্তন করে। পরবর্তীতে অন্য সংবাদপত্র তা অনুসরণ করে, আরো অনেক কিছু যোগ করে সংবাদপত্র প্রকাশের ধারণাকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন। আজ আহমদুল কবিরের ২১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধা।
[লেখক : গণতন্ত্রী পার্টির কর্মী]
বাবুল দে
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
স্মরণ
বাংলাদেশে একদিকে সাংবাদিকতা অন্যদিকে রাজনীতিÑ দুই ক্ষেত্রেই আহমদুল কবির ছিলেন একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশে পঞ্চশের দশকের মধ্যভাগে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার মূলধারা গড়ে তুলেছিলেন যে ক্ষণজন্মা কয়েকজন সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব, তার মধ্যে একজন ছিলেন আহমদুল কবির। আবার রাজনীতি ক্ষেত্রে তিনি সেই চল্লিশের দশক থেকে প্রগতিশীল আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেরই দীক্ষাগুরু হয়ে আছেন। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির একজন আদর্শ পুরুষ। বনেদি জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি সাধারণ মানুষের জন্য সাংবাদিকতা এবং রাজনীতির আদর্শবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজকে সম্পৃক্ত করেছিলেন যা বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির অন্য অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়নি।
জীবদ্দশায় আহমদুল কবির একাধারে ছিলেন সাংবাদিক-সম্পাদক এবং রাজনীতিবিদ। আর জোর দিয়ে বলা যায়, দুই ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, বস্তুনিষ্ঠ ও আদর্শবাদী। এক্ষেত্রে আমাদের মতো ছোট মাপের রাজনীতির কর্মীদের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছু তিনি রেখে গেছেন। তার রাজনীতির আদর্শবাদী কর্মী হয়ে লক্ষ্য করেছি তার সাংবাদিকতার আদর্শ ছিল সব শ্রেণী-পেশার সাধারণ মানুষের জন্য সত্য-বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশন এবং রাজনৈতিক আদর্শ ছিল দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের প্রগতিশীল-সত্যনিষ্ঠ আদর্শ ধারণ করে নিরলস কাজ করে যাওয়া।
আহমদুল কবির কী সাংবাদিকতা কী রাজনীতি ক্ষেত্রে তিনি বিশ্বাস করতেন এ অঞ্চলের মানুষের জন্য সাংবাদিকতা এবং রাজনীতি হতে হবে জনবান্ধব এবং জনকল্যাণমুখী। এটা তিনি শুধু বিশ্বাস করতেনই না তিনি তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাও চালিয়েছেন। তার এসব কর্মকা-ের ফসল হচ্ছে দৈনিক সংবাদ এবং সাম্যবাদী আদর্শের রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রী পার্টি গড়ে তোলা। তিনি সাংবাদিকতায় অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং বস্তুনিষ্ঠতার ক্ষেত্রে ছিলেন আপসহীন। একইভাবে তিনি রাজনীতিতে ছিলেন উদার গণতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী ধারায় দেশ ও মানুষের উন্নয়নচিন্তার ধারক-বাহক, যা তিনি আমাদের মতো নবীন রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে প্রবাহিত করতে কার্যকরভাবে সক্ষম হয়ে ছিলেন। আমরা যখন আহমদুল কবিরের সাংবাদিকতা এবং রাজনৈতিক জীবন ও কর্ম পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ করি তবে এই এ বিষয়টিই আমাদের সামনে উঠে আসে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন কালপর্বে সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক কর্মীÑ যারা আহমদুল কবিরকে কাছ থেকে দেখেছেন, যারা তার সঙ্গে কাজ করেছেনÑ সাংবাদিকতা এবং রাজনীতি ক্ষেত্রে, তারা জানেন কতটা সহজ-সরল মানুষ ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে বিভিন্ন কাজে সস্পৃক্ত হয়ে তাকে, রাজনীতিক এবং সম্পাদিকতার বাইরেও তাকে একজন প-িত ব্যক্তি মনে হয়েছে। তার সময়ে সমসাময়িক, কী সাংবাদিকতা, কী রাজনীতি বিষয়ে, তিনি যেসব বক্তব্য-মতামত দিতেন তাতে তাকে একজন প-িত ব্যক্তি না ভেবে কোন উপায় ছিল না। এসব কথা বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিক বা রাজনীতিকরা হয়তো আমাদের মতো অনুভব করবেন না, কিন্তু ইতিহাস পাঠের পর তা অস্বীকারও করতে পারবেন না।
আহমদুল কবির দৈনিক সংবাদ প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝিতে, ১৯৫৪ সালে। এর আগে সংবাদ ছিল তখনকার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের দলীয় সংবাদপত্র। মুসলিম লীগের মুখপত্র হিসেবে সংবাদ বেশিদূর এগোতে পারেনি। ১৯৫১ সালে সংবাদ প্রকাশ করে ১৯৫৪ সালে রণেভঙ্গ দেয় মুসলিম লীগ। এ সময় সংবাদ কিনে নেন আহমদুল কবির। তারপরই পাল্টে যায় সংবাদ-এর নীতি-আদর্শ। তার হাতে আসার পর সংবাদ হয়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিশীল আদর্শের সংবাদপত্র। আহমদুল কবির সংবাদের এই রূপ সম্পূর্ণ পাল্টে দেন। তার হাতে আসার পরই দৈনিক সংবাদ তখনকার পাকিস্তানে এবং পরে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং অসাম্প্রদায়িক আদর্শের একটি সংবাদপত্র হিসেবে পাঠকের মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়। আর এটা সম্ভব হয়েছিল আহমদুল কবিরের বস্তুনিষ্ঠ এবং সৃজনশীল প্রয়াসের কারণে।
দৈনিক সংবাদ-এর দায়িত্ব নেয়ার পরপরই আহমদুল কবির নতুন এর চরিত্র পুনঃনির্মাণ করেন। তার হাতে আসার পর সংবাদের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল অসাম্প্রদায়িকতা। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক শাসন-শোষণ ও বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংবাদ ছিল আপসহীন। এ আদর্শের ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশেও সামরিক স্বৈরাচারী অপশাসনের বিরুদ্ধে সব সময়ই সোচ্চার ছিল দৈনিক সংবাদ। ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার বিরুদ্ধে সংবাদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। আর এ ভূমিকার কারণে দাঙ্গাকারীরা সেদিন আহমদুল কবিরের ঘোড়াশালের বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু আহমদুল কবির আপস করেননি। তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার কোন পরিবর্তন হয়নি। সে ধারা সংবাদ এখনো বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে তার আদর্শের ধারাবাহিকতায়।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আঘাতের কালো হাত সংবাদকেও স্পর্শ করে। ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর পুড়িয়ে দেয়া হয় বংশালে দৈনিক সংবাদ কার্যালয়। বিধ্বস্ত সংবাদ-এর সঙ্গেই ভস্মীভূত হন তখনকার সংবাদের প্রতিভাবান সাংবাদিক শহীদ সাবের। সংবাদ কার্যালয় ধ্বংস করে দিলেও বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিকÑ এমনটা বোঝানোর জন্য দৈনিক সংবাদ পুনঃপ্রকাশের জন্য পাকিস্তানিরা প্রবল চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আহমদুল কবির পাকিস্তানের কোন চাপের কাছেই নতি স্বীকার করেননি। জীবন যেতে পারে কিন্তু সংবাদ প্রকাশ করব নাÑ এমন সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি। ফলে নানা প্রলোভন ও হুমকির মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘সংবাদ’ আর প্রকাশিত হয়নি। সংবাদের সাংবাদিকদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ভারতের চলে যান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন, মুক্তিযুদ্ধের পর সেদিন প্রথম সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর মধ্য দিয়ে সংবাদ আহমদুল কবিরের সাংবাদিকতা ও রাজনীতির আদর্শকে আরো বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার ব্রত ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করে।
আহমদুল কবির ছিলেন অত্যন্ত সৃষ্টিশীল মানুষ। বাংলাদেশে সাংবাদিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা ছিল তুলনাহীন সৃজনশীল এবং পারঙ্গম। এক্ষেত্রে তিনি সংবাদকে গড়ে তোলেন, শুধু একটি পত্রিকা নয়, একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা এবং ব্যবস্থাপনার আধুনিক ধারা তিনিই প্রথম প্রবর্তন করে। পরবর্তীতে অন্য সংবাদপত্র তা অনুসরণ করে, আরো অনেক কিছু যোগ করে সংবাদপত্র প্রকাশের ধারণাকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন। আজ আহমদুল কবিরের ২১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধা।
[লেখক : গণতন্ত্রী পার্টির কর্মী]