কানন পুরকায়স্থ
এরিক হফার, একজন আমেরিকান দার্শনিকÑ একবার প্রস্তাব করেন যে, ভবিষ্যৎকে গঠন করার ক্ষমতা থাকলেই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। এই ক্ষমতা সীমিত কারণ আমরা বিশৃঙ্খলার তত্ত্ব থেকে জানতে পারি, নাসিম নিকোলাস তালেবের ভাষায়, ‘যদি বিশ্ব সম্পর্কে একটি নিখুঁত মডেল থাকত ভবিষ্যতের ঘটনাগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য, তাহলে এই মডেলের অসীম নির্ভুলতা প্রয়োজন। তাছাড়া আর্থ-রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ঘটনা বিবেচনা করে মডেলের ব্যবহার করা সম্পর্কে আমাদের সেরকম কিছু নেই।’ যাই হোক, প্রতি বছর আমরা বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত এবং পরিবেশগত অগ্রগতি সম্পর্কে পূর্বাভাস দিয়ে থাকি। ২০২৫ সালে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং পরিবেশ সম্পর্কে কেমন উন্নয়ন দেখতে পাব, সেই সম্পর্কে এই প্রবন্ধে আলোকপাত করব।
মহাকাশ শিল্পে আমরা ২০২৫ সালে কিছু অগ্রগতি দেখতে পাব। নভোচারীরা অর্ধ শতাব্দী পর ২০২৫ সালে চাঁদে ফিরে আসার পরিকল্পনা করছেন। এটি ২০২৪ সালে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ওরিয়ন মহাকাশযানের হিট শিল্ড এবং লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের কারণে প্রোগ্রাম বিলম্বিত হয়েছে। ২০২৫ সালে ভারত দেশীয়ভাবে তৈরি রকেটে মহাকাশে মহাকাশচারী পাঠাতে রাশিয়া, আমেরিকা এবং চীনের সাথে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। আর্টেমিসের মতো, ভারতের মহাকাশ সংস্থা ওঝজঙ রিপোর্ট করেছে যে, গঙ্গায়ন মানব মহাকাশ ফ্লাইট প্রোগ্রামের আওতায় পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে মহাকাশচারী পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
উল্লেখ্য, হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড স্থানীয়ভাবে ক্রু মডিউল তৈরি করেছে। চীন একটি গ্রহাণুকে অনুসরণ করার জন্য একটি ক্রুবিহীন মিশনের পরিকল্পনা করেছে, যা ২০২৫ সালের মে মাসে পৃথিবীর খুব কাছাকাছি প্রদক্ষিণ করবে। ডিসেম্বর ২০২৫ সালে বুধ গ্রহে অনুসন্ধান চালানোর জন্য ‘বেপিকলোম্বো‘ নামে একটি যৌথ ইউরোপীয়-জাপান মিশনের পরিকল্পনা রয়েছে। ইউরোপীয় মহাকাশ এজেন্সি (ইএসএ) মহাকাশে একটি ‘স্পেস রাইডার‘ পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে, যা মহাকাশে বিভিন্ন পরীক্ষা চালানোর জন্য একটি রোবোটিক স্পেস ল্যাবরেটরি। একটি বেসরকারি-পাবলিক অংশীদারিত্ব ২০২৫ সালে নতুন গতি অর্জন করবে। স্পেস এক্স, একটি নতুন প্রাইভেট স্পেস কোম্পানি আরও পরীক্ষামূলক ফ্লাইট পরিচালনা করবে এবং মহাকাশে হাজার হাজার উপগ্রহের একটি নক্ষত্রম-ল স্থাপন করবে, যা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করতে পারে। স্পেস এক্স দ্বারা ব্যক্তিগত অর্থায়নে চাঁদে সাধারণ মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বেসরকারি খাতের উদ্যোগের কারণে ২০২৫ সালে ফিউশন জ্বালানি বাস্তবতার কাছাকাছি আসবে বলে ধারণা করা যায়। এমআইটিভিত্তিক কোম্পানি ইতোমধ্যে হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটোপ, ডিউটেরিয়াম এবং ট্রিটিয়ামের ফিউশন ব্যবহার করে কিছু অগ্রগতি করেছে, যা হিলিয়াম, নিউট্রন এবং প্রচুর শক্তিকে মুক্ত করে। যদি একটি মেশিন এমন একটি বিন্দুতে পৌঁছায় যেখানে একটি চুল্লি শক্তি ব্যবহারের চেয়ে বেশি শক্তি নির্গত করে, তবে সাফল্য শীঘ্রই আসবে। এই ক্ষেত্রে আরেকটি চীনা উদ্যোগ হচ্ছে হাইড্রোজেন এবং বোরন ব্যবহার করে একটি ফিউশন চুল্লি তৈরি করা। আমরা ২০২৫ সালে এই ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি দেখতে পাব।
জলবায়ু মডেল থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা এখন গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মডেলটি চরম আবহাওয়ার ঘটনার পূর্বাভাস দিতে পারে, যা প্রশমন এবং অভিযোজনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সুইডিশ বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস প্রথম পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এবং বায়ুম-লে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন। যাইহোক, সম্প্রতি আন্তঃসরকারি প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ওচঈঈ) রিপোর্ট করেছে যে কার্বন ডাই অক্সাইড দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার ‘খুবই সম্ভাবনা’ রয়েছে। ২০২৫ সালে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে জলবায়ু বিজ্ঞানের অগ্রগতি সাধিত হবে, যা জলবায়ু মডেলের অনিশ্চয়তা কমাতে সাহায্য করতে পারে। বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা জানি যে বেশিরভাগ অনিশ্চয়তা অ্যারোসল এবং মেঘের আচরণ থেকে উদ্ভূত হয়, কারণ উভয়ের ক্ষেত্রেই হয় সূর্যালোক প্রতিফলিত করে শীতল প্রভাব বা তাপ শোষণ করে উষ্ণতার প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে জেনারেটিভ এআই মডেল ব্যবহার করা যেতে পারে, যা ভালোভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবে এবং অনিশ্চয়তার মাত্রা কমাতে পারবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক গবেষণা বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রে ভালোভাবে এগিয়ে চলেছে। ২০২০ সালে, গুগল-এর মালিকানাধীন ডিপ মাইন্ডের তৈরি একটি মডেল আলফা ফোল্ড মানবদেহের প্রতিটি প্রোটিনের গঠন সম্পর্কে সঠিকভাবে পূর্বাভাস দিয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাসে আলফা ফোল্ড-৩ অন্যান্য অণু যেমন ডিএনএ, আরএনএ এবং ছোট অণুর গঠন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা এআইয়ের আরও অগ্রগতি এবং ২০২৫ সালে ওষুধ আবিষ্কার সম্পর্কিত গবেষণায় এর ব্যবহার দেখতে পাব। ওপেন এআই-এর এচঞ-৫ প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে এচঞ মানে, জেনারেটিভ প্রাক-প্রশিক্ষিত ট্রান্সফরমার, যা একটি বড় ভাষার মডেল। মানুষ যেভাবে চিন্তা করতে সময় নেয় এবং সমস্যার উত্তর দেয় সেভাবে এআই কাজ করবে বলে ধারণা করা যায়। এআই গবেষকরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন যে প্রশ্নটির উত্তর কিভাবে দেওয়া যায় তা দেখার জন্য যুক্তির প্রয়োজন। নিউ মেক্সিকোর সান্তা ফে ইনস্টিটিউটের গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, ‘আমাদের কী যুক্তি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। এ বিষয়ে একটি শক্তিশালী উপায় এআই এখনো জয় করেনি।’
মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তি হলো একটি অণুর অনুলিপি ব্যবহার করে একটি অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে এবং রোগ প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করার জন্য ব্যবহার করা। ২০২৫ সালে আমরা ক্যান্সারের ভ্যাকসিন তৈরি করতে গজঘঅ এর ব্যবহার দেখতে পাব। গড়ফবৎহধ এবং গবৎপশ দ্বারা ইতিমধ্যেই তৈরি করা মেলানোমা ভ্যাকসিন এখনও পর্যন্ত পরীক্ষায় ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। ২০২৫ সালে যদি আমেরিকান ড্রাগ রেগুলেটর ভ্যাকসিনটি অনুমোদন করে, তবে এটি ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যুক্তরাজ্যে বায়োএনটেকের লক্ষ্য গজঘঅ ভিত্তিক ব্যক্তিগত ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু করা। ব্যক্তিগত ভ্যাকসিন মানে এটি একটি রোগী-নির্দিষ্ট মিউটেশনের জন্য তৈরি। যাইহোক, একটি সাধারণ ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়া চলছে যা একটি ‘অফ দ্য শেলফ‘ ভ্যাকসিন যা সাধারণ টিউমার চিহ্নিতকারীকে লক্ষ্য করে কাজ করে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন দেখতে পাব, তা হলো ইলন মাস্কের মালিকানাধীন ‘নিউরালিংক‘ নামে ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস কোম্পানির কার্যকলাপ। কোম্পানিটি ছোট ইমপ্লান্টেবল চিপ তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে; যা পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের তাদের মন দিয়ে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করতে দেয়।
উল্লেখ্য, আমরা যখন বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে সমর্থন করি, তখন আমাদের নৈতিক অগ্রগতিকেও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। কারণ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি মানবজাতির শক্তি বৃদ্ধি করে এবং সেই শক্তির অপব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন।
সুতরাং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং নৈতিকতার মধ্যে ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। তাই বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের আগামী বছরগুলোতে বিজ্ঞানের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
[লেখক : বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা ও অধ্যাপক, যুক্তরাজ্য]
কানন পুরকায়স্থ
শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
এরিক হফার, একজন আমেরিকান দার্শনিকÑ একবার প্রস্তাব করেন যে, ভবিষ্যৎকে গঠন করার ক্ষমতা থাকলেই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। এই ক্ষমতা সীমিত কারণ আমরা বিশৃঙ্খলার তত্ত্ব থেকে জানতে পারি, নাসিম নিকোলাস তালেবের ভাষায়, ‘যদি বিশ্ব সম্পর্কে একটি নিখুঁত মডেল থাকত ভবিষ্যতের ঘটনাগুলোর ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য, তাহলে এই মডেলের অসীম নির্ভুলতা প্রয়োজন। তাছাড়া আর্থ-রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ঘটনা বিবেচনা করে মডেলের ব্যবহার করা সম্পর্কে আমাদের সেরকম কিছু নেই।’ যাই হোক, প্রতি বছর আমরা বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত এবং পরিবেশগত অগ্রগতি সম্পর্কে পূর্বাভাস দিয়ে থাকি। ২০২৫ সালে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং পরিবেশ সম্পর্কে কেমন উন্নয়ন দেখতে পাব, সেই সম্পর্কে এই প্রবন্ধে আলোকপাত করব।
মহাকাশ শিল্পে আমরা ২০২৫ সালে কিছু অগ্রগতি দেখতে পাব। নভোচারীরা অর্ধ শতাব্দী পর ২০২৫ সালে চাঁদে ফিরে আসার পরিকল্পনা করছেন। এটি ২০২৪ সালে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ওরিয়ন মহাকাশযানের হিট শিল্ড এবং লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের কারণে প্রোগ্রাম বিলম্বিত হয়েছে। ২০২৫ সালে ভারত দেশীয়ভাবে তৈরি রকেটে মহাকাশে মহাকাশচারী পাঠাতে রাশিয়া, আমেরিকা এবং চীনের সাথে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। আর্টেমিসের মতো, ভারতের মহাকাশ সংস্থা ওঝজঙ রিপোর্ট করেছে যে, গঙ্গায়ন মানব মহাকাশ ফ্লাইট প্রোগ্রামের আওতায় পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে মহাকাশচারী পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
উল্লেখ্য, হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড স্থানীয়ভাবে ক্রু মডিউল তৈরি করেছে। চীন একটি গ্রহাণুকে অনুসরণ করার জন্য একটি ক্রুবিহীন মিশনের পরিকল্পনা করেছে, যা ২০২৫ সালের মে মাসে পৃথিবীর খুব কাছাকাছি প্রদক্ষিণ করবে। ডিসেম্বর ২০২৫ সালে বুধ গ্রহে অনুসন্ধান চালানোর জন্য ‘বেপিকলোম্বো‘ নামে একটি যৌথ ইউরোপীয়-জাপান মিশনের পরিকল্পনা রয়েছে। ইউরোপীয় মহাকাশ এজেন্সি (ইএসএ) মহাকাশে একটি ‘স্পেস রাইডার‘ পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে, যা মহাকাশে বিভিন্ন পরীক্ষা চালানোর জন্য একটি রোবোটিক স্পেস ল্যাবরেটরি। একটি বেসরকারি-পাবলিক অংশীদারিত্ব ২০২৫ সালে নতুন গতি অর্জন করবে। স্পেস এক্স, একটি নতুন প্রাইভেট স্পেস কোম্পানি আরও পরীক্ষামূলক ফ্লাইট পরিচালনা করবে এবং মহাকাশে হাজার হাজার উপগ্রহের একটি নক্ষত্রম-ল স্থাপন করবে, যা পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করতে পারে। স্পেস এক্স দ্বারা ব্যক্তিগত অর্থায়নে চাঁদে সাধারণ মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বেসরকারি খাতের উদ্যোগের কারণে ২০২৫ সালে ফিউশন জ্বালানি বাস্তবতার কাছাকাছি আসবে বলে ধারণা করা যায়। এমআইটিভিত্তিক কোম্পানি ইতোমধ্যে হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটোপ, ডিউটেরিয়াম এবং ট্রিটিয়ামের ফিউশন ব্যবহার করে কিছু অগ্রগতি করেছে, যা হিলিয়াম, নিউট্রন এবং প্রচুর শক্তিকে মুক্ত করে। যদি একটি মেশিন এমন একটি বিন্দুতে পৌঁছায় যেখানে একটি চুল্লি শক্তি ব্যবহারের চেয়ে বেশি শক্তি নির্গত করে, তবে সাফল্য শীঘ্রই আসবে। এই ক্ষেত্রে আরেকটি চীনা উদ্যোগ হচ্ছে হাইড্রোজেন এবং বোরন ব্যবহার করে একটি ফিউশন চুল্লি তৈরি করা। আমরা ২০২৫ সালে এই ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি দেখতে পাব।
জলবায়ু মডেল থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা এখন গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মডেলটি চরম আবহাওয়ার ঘটনার পূর্বাভাস দিতে পারে, যা প্রশমন এবং অভিযোজনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সুইডিশ বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস প্রথম পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এবং বায়ুম-লে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন। যাইহোক, সম্প্রতি আন্তঃসরকারি প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ওচঈঈ) রিপোর্ট করেছে যে কার্বন ডাই অক্সাইড দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার ‘খুবই সম্ভাবনা’ রয়েছে। ২০২৫ সালে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে জলবায়ু বিজ্ঞানের অগ্রগতি সাধিত হবে, যা জলবায়ু মডেলের অনিশ্চয়তা কমাতে সাহায্য করতে পারে। বৈজ্ঞানিকভাবে আমরা জানি যে বেশিরভাগ অনিশ্চয়তা অ্যারোসল এবং মেঘের আচরণ থেকে উদ্ভূত হয়, কারণ উভয়ের ক্ষেত্রেই হয় সূর্যালোক প্রতিফলিত করে শীতল প্রভাব বা তাপ শোষণ করে উষ্ণতার প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে জেনারেটিভ এআই মডেল ব্যবহার করা যেতে পারে, যা ভালোভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবে এবং অনিশ্চয়তার মাত্রা কমাতে পারবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক গবেষণা বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রে ভালোভাবে এগিয়ে চলেছে। ২০২০ সালে, গুগল-এর মালিকানাধীন ডিপ মাইন্ডের তৈরি একটি মডেল আলফা ফোল্ড মানবদেহের প্রতিটি প্রোটিনের গঠন সম্পর্কে সঠিকভাবে পূর্বাভাস দিয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাসে আলফা ফোল্ড-৩ অন্যান্য অণু যেমন ডিএনএ, আরএনএ এবং ছোট অণুর গঠন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা এআইয়ের আরও অগ্রগতি এবং ২০২৫ সালে ওষুধ আবিষ্কার সম্পর্কিত গবেষণায় এর ব্যবহার দেখতে পাব। ওপেন এআই-এর এচঞ-৫ প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে, যেখানে এচঞ মানে, জেনারেটিভ প্রাক-প্রশিক্ষিত ট্রান্সফরমার, যা একটি বড় ভাষার মডেল। মানুষ যেভাবে চিন্তা করতে সময় নেয় এবং সমস্যার উত্তর দেয় সেভাবে এআই কাজ করবে বলে ধারণা করা যায়। এআই গবেষকরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন যে প্রশ্নটির উত্তর কিভাবে দেওয়া যায় তা দেখার জন্য যুক্তির প্রয়োজন। নিউ মেক্সিকোর সান্তা ফে ইনস্টিটিউটের গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, ‘আমাদের কী যুক্তি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। এ বিষয়ে একটি শক্তিশালী উপায় এআই এখনো জয় করেনি।’
মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তি হলো একটি অণুর অনুলিপি ব্যবহার করে একটি অনাক্রম্য প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে এবং রোগ প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করার জন্য ব্যবহার করা। ২০২৫ সালে আমরা ক্যান্সারের ভ্যাকসিন তৈরি করতে গজঘঅ এর ব্যবহার দেখতে পাব। গড়ফবৎহধ এবং গবৎপশ দ্বারা ইতিমধ্যেই তৈরি করা মেলানোমা ভ্যাকসিন এখনও পর্যন্ত পরীক্ষায় ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। ২০২৫ সালে যদি আমেরিকান ড্রাগ রেগুলেটর ভ্যাকসিনটি অনুমোদন করে, তবে এটি ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যুক্তরাজ্যে বায়োএনটেকের লক্ষ্য গজঘঅ ভিত্তিক ব্যক্তিগত ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু করা। ব্যক্তিগত ভ্যাকসিন মানে এটি একটি রোগী-নির্দিষ্ট মিউটেশনের জন্য তৈরি। যাইহোক, একটি সাধারণ ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়া চলছে যা একটি ‘অফ দ্য শেলফ‘ ভ্যাকসিন যা সাধারণ টিউমার চিহ্নিতকারীকে লক্ষ্য করে কাজ করে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন দেখতে পাব, তা হলো ইলন মাস্কের মালিকানাধীন ‘নিউরালিংক‘ নামে ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস কোম্পানির কার্যকলাপ। কোম্পানিটি ছোট ইমপ্লান্টেবল চিপ তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে; যা পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের তাদের মন দিয়ে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করতে দেয়।
উল্লেখ্য, আমরা যখন বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে সমর্থন করি, তখন আমাদের নৈতিক অগ্রগতিকেও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। কারণ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি মানবজাতির শক্তি বৃদ্ধি করে এবং সেই শক্তির অপব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন।
সুতরাং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং নৈতিকতার মধ্যে ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। তাই বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের আগামী বছরগুলোতে বিজ্ঞানের নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
[লেখক : বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা ও অধ্যাপক, যুক্তরাজ্য]