রেজাউল করিম খোকন
নতুন বছরেও রাজধানীতে টিসিবির ট্রাক থেকে কয়েক ধরনের পণ্য ক্রয়ের জন্য লাইনে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সারির শেষের দিকে যারা থাকেন, তারা জানেন না শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য কিছু থাকবে কিনা। মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট মানুষের কিছুটা সাশ্রয়ী দামে পণ্য কেনার এই চেষ্টা এখনকার সাধারণ চিত্র। যে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে আসে, তার মূলে ছিল তরুণদের চাকরি না পাওয়ার হতাশা। নতুন বছরে এই তরুণরা চাইবেন একটি শোভন কাজ। গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এক অস্বস্তিকর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে একদিকে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ, অন্যদিকে চাকরির যথেষ্ঠ সুযোগ নেই। ফলে নতুন বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না। সরকারের বড় কাজ হবে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙা করা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে রীতিমতো হাঁসফাঁস করছে সাধারণ মানুষ। তারা স্বস্তি চায়। তরুণ প্রজন্ম চাইছেন কাজের সুযোগ, সুতরাং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেজন্য আবার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্রুত ঠিক করতে হবে ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
অর্থনীতির যেসব সংকট নিয়ে দেশ নতুন বছরে পা রেখেছে, সেগুলো নতুন নয়। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা, ব্যাংক লুটপাটÑ এসব নিয়েই শুরু হয়েছিল ২০২৪ সাল। নতুন বছরে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। কারণ, লুকিয়ে রাখা মন্দ ঋণ প্রকাশ্য হবে। ডলারের দাম কোথায় স্থির হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকবে। আর মূল্যস্ফীতিতে দ্রুত লাগাম টানা যাবেÑ এমন আশা কম। এক প্রতিবেদনে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ঋণমান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বিষণœ চিত্রই এঁকেছে। সরকারের ঋণমানের অবনমন করে মুডিস বলেছে, রাজনৈতিক ঝুঁকি ও কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে অন্তত তিনটি সমস্যা তৈরি হতে পারে। এগুলো হলোÑ কম রাজস্ব আয়, বহিস্থ খাতের দুর্বলতা ও ব্যাংক খাত সংক্রান্ত ঝুঁকি। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কিছুটা হলেও আশাবাদী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি মনে করছে, জুনে শেষ হওয়া চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশের তলানিতে নামলেও পরের অর্থবছরে তা ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উঠবে। মূল্যস্ফীতি নামবে ৫ শতাংশে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির উত্থান আর মূল্যস্ফীতি পতনের এই বহুল প্রত্যাশিত ঘটনা আসামি বছর থেকেই ঘটতে শুরু করবে। তবে আমূল সংস্কার না করতে পারলে নতুন বছরে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর লক্ষ্য পূরণ হবে না। নানা রকম দাবি-দাওয়ার মধ্যে দেশ যখন ‘বায়নাঘর’ হয়ে উঠেছে, তখন সরকার পরিচালনার খরচ বেড়ে যাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত। তাই রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে সরকারকে আসামি বছর ঋণের দিকে আরও বেশি ঝুঁকতে হবে।
রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চলমান অস্থিরতার মধ্যে উদ্যোক্তরা বেশ কঠিন সময় পার করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা কমেছে, ব্যবসা সম্প্রসারণ থমকে গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বেড়ে চলা সুদের হার, অবকাঠামোর ঘাটতি, অনিশ্চয়তা এসবের মধ্যে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা কম। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে, কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলাও। আসছে না বিদেশি বিনিয়োগ। আর এর পরিণামে কমছে কর্মসংস্থান। নতুন বছরে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা আছে। সরকার বদলের পর বন্ধ হয়েছে এমন কিছু কলকারখানা, যেগুলোর মালিকরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিংবা অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠ ছিলেন। গত জুন শেষে দেশে ২৬ লাখ ৪০ হাজার কর্মক্ষম মানুষ বেকার ছিলেন। কাজ হারিয়ে তাদের সঙ্গে নতুন বেকার যোগ হলে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি শুধু খারাপই হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা না করতে পারলে অথবা বিদেশি বিনিয়োগ না আনতে পারলে তরুণদের জন্য চাকরি দূরের স্বপ্ন হয়েই থাকবে। সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তার চিন্তা অত্যন্ত সংরক্ষণবাদী। হুমকি দিয়ে রেখেছেন, আমদানি করা পণ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক বসাবেন। তবে চীন কিংবা মেক্সিকোর মতো দেশের পণ্যে শুল্ক বসবে আরও উঁচু হারে। এ হুমকি বাস্তবে রূপ পেলে তা বাংলাদেশের জন্য সুযোগও বয়ে আনতে পারে। চীনের পণ্যে উচ্চ শুল্ক বসলে সে দেশ থেকে শিল্প অন্য দেশে যাবে। বাংলাদেশকে সেই সুযোগ গ্রহণ করতে হলে ব্যবসা সহজ করা, বন্দর আধুনিকায়ন ও বিনিয়োগপ্রক্রিয়া মসৃণ করতে হবে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। মাসের পর মাস সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর। উচ্চ খাদ্যমূল্যস্ফীতির কারণে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। নজর দিতে হবে সরবরাহব্যবস্থার দিকেও। জরুরি ভিত্তিতে রাজস্ব খাতের সংস্কার করতে হবে সরকারকে। শুধু আইএমএফের শর্ত পূরণ করা নয়, সরকারের ঋণনির্ভরতা কমাতে রাজস্ব আদায় বাড়ানো দরকার। সেক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে আরও বেশি ঋণ দেয়া সম্ভব হবে। দেশি কিংবা বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগই স্থবির হয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর অন্তর্র্বর্তী সরকারের সক্ষমতার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের আস্থার ঘাটতিতে রয়েছেন। বিনিয়োগ বাড়াতে একটি রাজনৈতিক রোডম্যাপ উদ্যোক্তাদের পরিষ্কার বার্তা দিতে পারে। সরকার পরিবর্তনের পরপরই শিল্পাঞ্চলে যে অস্থিরতা ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল, তার কিছুটা উপশম হয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সন্তোষজনক নয়। নতুন বছরে ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি আশা করবেন। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। দাম নিয়েও রয়েছে অন্তোষ।
অন্যান্য পরিষেবা ও অবকাঠামো উন্নতির দিকে এবার নজর দিতে হবে। প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করতে হচ্ছে, কিন্তু আমদানির উৎস সীমিত হওয়ার কারণে মাঝেমধ্যেই সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে। মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে হলে কৃষি খাত চাঙা করার মাধ্যমে স্থানীয় সরবরাহ বাড়াতে হবে। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারে ধুঁকছে। শেয়ারবাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে কারসাজি বন্ধ করে বাজারকে স্বাভাবিক করতে হবে। দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল অন্তর্র্বর্তী সরকার। তবে এখনো যোগাযোগে ঘাটতি রয়েছে। সাবেক সরকারের সময় গোষ্ঠীতন্ত্রের কারণে আর্থিক খাতে সুশাসন ছিল দূরের বিষয়। সে কারণে লুটপাটও করা গেছে নিশ্চিন্তে। এই পথ বন্ধ করতেই সুশাসন নিশ্চিত করে দুষ্টের পালন নীতির অবসান ঘটাতে হবে। সরকার আসামি ছয় মাস ও এক বছরে কী করতে চায়, তা নিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা করা দরকার। বাংলাদেশ যখন একটি নতুন বছরে প্রবেশ করেছে এবং চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতাগুলোকে গভীরভাবে মূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই মূল্যায়ন শুধু আর্থিক নীতি নির্ধারণে নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো ও কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্যও অপরিহার্য। বর্তমান অর্থনৈতিক পটভূমিতে এমন অনেক জটিল সমস্যা বিদ্যমান, যা সমন্বিত ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, বিনিয়োগের স্থবিরতা এবং শ্রমবাজারে অস্থিরতাÑ এই সব কটিই একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাধান দাবি করে।
[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]
রেজাউল করিম খোকন
সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫
নতুন বছরেও রাজধানীতে টিসিবির ট্রাক থেকে কয়েক ধরনের পণ্য ক্রয়ের জন্য লাইনে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সারির শেষের দিকে যারা থাকেন, তারা জানেন না শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য কিছু থাকবে কিনা। মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট মানুষের কিছুটা সাশ্রয়ী দামে পণ্য কেনার এই চেষ্টা এখনকার সাধারণ চিত্র। যে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে আসে, তার মূলে ছিল তরুণদের চাকরি না পাওয়ার হতাশা। নতুন বছরে এই তরুণরা চাইবেন একটি শোভন কাজ। গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এক অস্বস্তিকর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে একদিকে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ, অন্যদিকে চাকরির যথেষ্ঠ সুযোগ নেই। ফলে নতুন বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ কাটছে না। সরকারের বড় কাজ হবে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙা করা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে রীতিমতো হাঁসফাঁস করছে সাধারণ মানুষ। তারা স্বস্তি চায়। তরুণ প্রজন্ম চাইছেন কাজের সুযোগ, সুতরাং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেজন্য আবার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্রুত ঠিক করতে হবে ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
অর্থনীতির যেসব সংকট নিয়ে দেশ নতুন বছরে পা রেখেছে, সেগুলো নতুন নয়। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা, ব্যাংক লুটপাটÑ এসব নিয়েই শুরু হয়েছিল ২০২৪ সাল। নতুন বছরে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। কারণ, লুকিয়ে রাখা মন্দ ঋণ প্রকাশ্য হবে। ডলারের দাম কোথায় স্থির হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকবে। আর মূল্যস্ফীতিতে দ্রুত লাগাম টানা যাবেÑ এমন আশা কম। এক প্রতিবেদনে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ঋণমান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বিষণœ চিত্রই এঁকেছে। সরকারের ঋণমানের অবনমন করে মুডিস বলেছে, রাজনৈতিক ঝুঁকি ও কম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে অন্তত তিনটি সমস্যা তৈরি হতে পারে। এগুলো হলোÑ কম রাজস্ব আয়, বহিস্থ খাতের দুর্বলতা ও ব্যাংক খাত সংক্রান্ত ঝুঁকি। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে কিছুটা হলেও আশাবাদী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি মনে করছে, জুনে শেষ হওয়া চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশের তলানিতে নামলেও পরের অর্থবছরে তা ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উঠবে। মূল্যস্ফীতি নামবে ৫ শতাংশে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির উত্থান আর মূল্যস্ফীতি পতনের এই বহুল প্রত্যাশিত ঘটনা আসামি বছর থেকেই ঘটতে শুরু করবে। তবে আমূল সংস্কার না করতে পারলে নতুন বছরে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর লক্ষ্য পূরণ হবে না। নানা রকম দাবি-দাওয়ার মধ্যে দেশ যখন ‘বায়নাঘর’ হয়ে উঠেছে, তখন সরকার পরিচালনার খরচ বেড়ে যাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত। তাই রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে সরকারকে আসামি বছর ঋণের দিকে আরও বেশি ঝুঁকতে হবে।
রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চলমান অস্থিরতার মধ্যে উদ্যোক্তরা বেশ কঠিন সময় পার করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা কমেছে, ব্যবসা সম্প্রসারণ থমকে গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বেড়ে চলা সুদের হার, অবকাঠামোর ঘাটতি, অনিশ্চয়তা এসবের মধ্যে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা কম। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে, কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলাও। আসছে না বিদেশি বিনিয়োগ। আর এর পরিণামে কমছে কর্মসংস্থান। নতুন বছরে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা আছে। সরকার বদলের পর বন্ধ হয়েছে এমন কিছু কলকারখানা, যেগুলোর মালিকরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিংবা অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠ ছিলেন। গত জুন শেষে দেশে ২৬ লাখ ৪০ হাজার কর্মক্ষম মানুষ বেকার ছিলেন। কাজ হারিয়ে তাদের সঙ্গে নতুন বেকার যোগ হলে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি শুধু খারাপই হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা না করতে পারলে অথবা বিদেশি বিনিয়োগ না আনতে পারলে তরুণদের জন্য চাকরি দূরের স্বপ্ন হয়েই থাকবে। সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তার চিন্তা অত্যন্ত সংরক্ষণবাদী। হুমকি দিয়ে রেখেছেন, আমদানি করা পণ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক বসাবেন। তবে চীন কিংবা মেক্সিকোর মতো দেশের পণ্যে শুল্ক বসবে আরও উঁচু হারে। এ হুমকি বাস্তবে রূপ পেলে তা বাংলাদেশের জন্য সুযোগও বয়ে আনতে পারে। চীনের পণ্যে উচ্চ শুল্ক বসলে সে দেশ থেকে শিল্প অন্য দেশে যাবে। বাংলাদেশকে সেই সুযোগ গ্রহণ করতে হলে ব্যবসা সহজ করা, বন্দর আধুনিকায়ন ও বিনিয়োগপ্রক্রিয়া মসৃণ করতে হবে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। মাসের পর মাস সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর। উচ্চ খাদ্যমূল্যস্ফীতির কারণে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। নজর দিতে হবে সরবরাহব্যবস্থার দিকেও। জরুরি ভিত্তিতে রাজস্ব খাতের সংস্কার করতে হবে সরকারকে। শুধু আইএমএফের শর্ত পূরণ করা নয়, সরকারের ঋণনির্ভরতা কমাতে রাজস্ব আদায় বাড়ানো দরকার। সেক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে আরও বেশি ঋণ দেয়া সম্ভব হবে। দেশি কিংবা বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগই স্থবির হয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর অন্তর্র্বর্তী সরকারের সক্ষমতার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের আস্থার ঘাটতিতে রয়েছেন। বিনিয়োগ বাড়াতে একটি রাজনৈতিক রোডম্যাপ উদ্যোক্তাদের পরিষ্কার বার্তা দিতে পারে। সরকার পরিবর্তনের পরপরই শিল্পাঞ্চলে যে অস্থিরতা ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল, তার কিছুটা উপশম হয়েছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সন্তোষজনক নয়। নতুন বছরে ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি আশা করবেন। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। দাম নিয়েও রয়েছে অন্তোষ।
অন্যান্য পরিষেবা ও অবকাঠামো উন্নতির দিকে এবার নজর দিতে হবে। প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করতে হচ্ছে, কিন্তু আমদানির উৎস সীমিত হওয়ার কারণে মাঝেমধ্যেই সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে। মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে হলে কৃষি খাত চাঙা করার মাধ্যমে স্থানীয় সরবরাহ বাড়াতে হবে। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারে ধুঁকছে। শেয়ারবাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে কারসাজি বন্ধ করে বাজারকে স্বাভাবিক করতে হবে। দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল অন্তর্র্বর্তী সরকার। তবে এখনো যোগাযোগে ঘাটতি রয়েছে। সাবেক সরকারের সময় গোষ্ঠীতন্ত্রের কারণে আর্থিক খাতে সুশাসন ছিল দূরের বিষয়। সে কারণে লুটপাটও করা গেছে নিশ্চিন্তে। এই পথ বন্ধ করতেই সুশাসন নিশ্চিত করে দুষ্টের পালন নীতির অবসান ঘটাতে হবে। সরকার আসামি ছয় মাস ও এক বছরে কী করতে চায়, তা নিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা করা দরকার। বাংলাদেশ যখন একটি নতুন বছরে প্রবেশ করেছে এবং চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতাগুলোকে গভীরভাবে মূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই মূল্যায়ন শুধু আর্থিক নীতি নির্ধারণে নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামো ও কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্যও অপরিহার্য। বর্তমান অর্থনৈতিক পটভূমিতে এমন অনেক জটিল সমস্যা বিদ্যমান, যা সমন্বিত ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, বিনিয়োগের স্থবিরতা এবং শ্রমবাজারে অস্থিরতাÑ এই সব কটিই একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাধান দাবি করে।
[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]