জিল্লুর রহমান
খেজুরের রস ও গুড় পছন্দ করে না, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। এক সময় শীত আসলেই মায়ের হাতে বানানো হরেক রকমের পিঠা-পুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যেত। শীত মৌসুম এলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ বলে খ্যাত ‘খেজুর গাছ’কে ঘিরে জনপদে উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করত। শীত মৌসুমে খেজুর রস দিয়ে তৈরি গুড়, পাটালি, পিঠা, পায়েস ইত্যাদি নিয়ে গ্রামবাসীরা অতিথিদের আপ্যায়নে চেষ্টা করত। কিন্তু সেই খেজুরের রসের দানা গুড়, ঝোলা গুড়ের ঘ্রাণ এখন আর গ্রামের হাট বাজারে খুব একটা দেখা যায় না। সবাই শীতের ঐতিহ্য মিষ্টি খেজুরের রসের স্বাদ আজ ভুলতে বসেছে।
তবে ইদানিং বাণিজ্যিকভাবে খেজুর গুড়ের উৎপাদন ও বিপণন একটি সম্ভাবনায় লাভজনক পেশা হিসাবে গড়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খেজুর গুড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তরা মানসম্মত খেজুর গুড়ের উৎপাদন, বিপণন ও বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। এসব উদ্যোক্তাদের অনেকেই অন্যলাইনে ব্যবসার প্রসার ও বিস্তারের জন্য কাজ করছে। অবশ্য একসময় শীত মৌসুমে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে গাছিরা খেজুরগাছ থেকে রস নামানো ও গুড় তৈরির কাজটি নিজেরাই করতেন। রসের একটি অংশ নিতেন গাছি, একটি অংশ পেতেন গাছের মালিক। কিছুটা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাজার বন্দরে বিক্রি হতো। কয়েক বছর ধরে এই সনাতন ব্যবস্থা থেকে খেজুর গুড় উৎপাদন অনেকটা বাণিজ্যিক রূপ পেয়েছে। দেখা দিয়েছে নতুন বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। এখন মৌসুম এলেই খেজুরগাছ রীতিমতো ইজারা দেয়া হয়। কোনো কোনো এলাকায় খেজুরগাছ বাণিজ্যিকভাবে লাগানো হয়। এই প্রক্রিয়ায় রস নামানো ও গুড় তৈরির কাজটি কোথাও কোথাও মজুরি ভিত্তিক পেশা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও খুলনা জেলা বরাবরই খেজুরগাছ, গুড় ও রসের জন্য বিখ্যাত ছিল। এসব এলাকায় এক সময় অর্থকরী ফসল বলতে খেজুর গুড়ের বেশ কদর ছিল। যশোরের ঐতিহ্যবাহী গুড় পাটালির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। যশোরের খেজুরের রস ও গুড় স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয়। সাত-আট বছর আগেও শীতকালে এসব এলাকার গাছিরা খেজুর গাছের রস সংগ্রহে খুবই ব্যস্ত সময় কাটাতেন। তারা খেজুরের রস ও পাটালী গুড় বিক্রি করে বিপুল অংকের টাকা আয় করতেন। তবে সাম্প্রতিককালে খেজুর গুড়ের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, চাপাইনবাবগঞ্জ ইত্যাদি জেলায়ও বেশ কিছু উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। জানা যায়, শুধু বৃহত্তর রংপুরের পাঁচ জেলা- লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর ও নীলফামারীতে প্রায় ১০০টি পয়েন্টে খেজুরের গুড় তৈরি হচ্ছে। শীত মৌসুমে গুড় তৈরির অস্থায়ী কারখানাগুলোতে গড়ে প্রতিদিন ১৫ টন খেজুরের গুড় উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদিত বেশিরভাগ গুড় স্থানীয়রাই সরাসরি কারখানা থেকে কিনে নিচ্ছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ ও বিপণন করছে।
এ বছর রাজশাহীতে শীতের শুরু থেকেই গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহ শুরু করছে। সেই রস থেকে বিশেষ উপায়ে তৈরি হচ্ছে খেজুর গুড়। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা যায়, চলতি মৌসুমে (২০২৩-২৪) রাজশাহীতে মোট ১১ লাখ ৮ হাজার ১৮টি খেজুর গাছ থেকে (৫৪১ দশমিক ৩৭ হেক্টর জমিতে) ৮৮ লাখ ৬৪ হাজার ১৪৬ কেজি বা ৮ হাজার ৮৬৪ টন গুড় উৎপাদন হবে। আর বিক্রি হবে ১৪১ কোটি ২০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। অনলাইনের বাজার ধরলে মোট গুড় বিক্রি হবে ১৫০ কোটি টাকার বেশি। উক্ত তথ্যমতে, আম, পান যেমন রাজশাহীর অর্থনীতির চাকাকে বেশ সচল করেছে ঠিক তেমনি খেজুর গুড়। বর্তমানে হাট-বাজারগুলোতে বিক্রির পাশাপাশি শিক্ষিত যুব-সমাজ অনলাইনে গুড় বিক্রি করছে।
উপরোক্ত তথ্য সূত্রে আরও জানা যায়, দেশজুড়ে রাজশাহীর আমের যেমন খ্যাতি, তেমনই খেজুর গুড়ের সুখ্যাতি। জেলার গাছিরা শীতের মৌসুমে গাছ থেকে রস সংগ্রহের পরে প্রক্রিয়াজাত করে এ গুড় তৈরি করেন। উৎপাদিত গুড় কেনাবেচা হয় উপজেলার হাটগুলোতে। সেখান থেকে কিনে পাইকাররা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করেন। এসব গুড় বর্তমানে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। অর্জন হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। এ অঞ্চলের খেজুর গুড় খুবই সুস্বাদুও। জানা যায়, রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় প্রচুর খেজুর বাগান রয়েছে। এছাড়া সড়কপথ, পতিত জমি ও বাড়ির আঙিনাতেও রয়েছে খেজুর গাছ। শীতে এসব গাছ হয়ে ওঠে গাছিদের কর্মসংস্থানের উৎস। একজন গাছি প্রতিদিন ৪৫ থেকে ৫০টি খেজুর গাছের রস আহরণ করে। বিকেলে গাছে কোর (মাটির তৈরি হাড়ি) লাগিয়ে আসেন। আর সকালে রসভর্তি কোর নামান গাছিরা। তারা খেজুরের রস ও গুড় তৈরিকে কেন্দ্রে করে বছরের আড়াই থেকে তিন মাস ব্যস্ত থাকেন।
অন্যদিকে, যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, যশোরের খেজুরের গুড় একটি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ গুড়ের সুনাম দেশব্যাপী। কৃষি বিভাগের প্রচেষ্টায় বিগত বছরগুলোতে রস আহরণ ও গুড় উৎপাদন বেড়েছে। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় প্রায় ২৩ লাখ খেজুরের গাছ আছে এবং এর মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ গাছ থেকে রস আহরণ করে ৬ হাজার ৫০০ গাছি। ২০২৪ সালে ৩ হাজার ৪০ টন গুড় উৎপাদন হয়েছিল এবং চলতি বছর ৩ হাজার ১শ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বছর গুড়ের দাম বেশ ভালো, ফলে কৃষক লাভবান হবে বলে ধারণা করা হয়।
দেশে ও বিদেশে খেজুর রস ও এর গুড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পরিকল্পিত উপায়ে এর উৎপাদন বাড়াতে পারলে গ্রামীণ জনপদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এটি ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া, গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকারি উদ্যোগে এর বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ করা দরকার। তরুণ উদ্যোক্তাদের যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ ব্যবসায় যুক্ত করতে পারলে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মূদ্রাও অর্জন করা সম্ভব।
এক সময় দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে খেজুরের গুড় রপ্তানি হতো। এজন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বেশি বেশি খেজুর গাছ রোপণ করা প্রয়োজন এবং গাছালীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খেজুরের রসের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা দরকার। স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা ও কঠোর নজরদারির অভাবে ইটের ভাটায় অবাধে খেজুরগাছসহ ফলবান বৃক্ষ পোড়ানোর কারণে খেজুর বৃক্ষের বিরাট অংশ উজার হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় হয়তো খেজুর রসের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। খেজুরের রসের পিঠা পায়েশ তখন শুধুই স্মৃতির রোমন্থন হয়ে বেঁচে থাকবে। এজন্য খেজুর গাছ যাতে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে সেজন্য পরিকল্পিত উপায়ে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এ গাছের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব, ঐতিহ্য ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে বিবেচনা করে একে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
[ লেখক : ব্যাংকার ]
জিল্লুর রহমান
সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫
খেজুরের রস ও গুড় পছন্দ করে না, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। এক সময় শীত আসলেই মায়ের হাতে বানানো হরেক রকমের পিঠা-পুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যেত। শীত মৌসুম এলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ বলে খ্যাত ‘খেজুর গাছ’কে ঘিরে জনপদে উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করত। শীত মৌসুমে খেজুর রস দিয়ে তৈরি গুড়, পাটালি, পিঠা, পায়েস ইত্যাদি নিয়ে গ্রামবাসীরা অতিথিদের আপ্যায়নে চেষ্টা করত। কিন্তু সেই খেজুরের রসের দানা গুড়, ঝোলা গুড়ের ঘ্রাণ এখন আর গ্রামের হাট বাজারে খুব একটা দেখা যায় না। সবাই শীতের ঐতিহ্য মিষ্টি খেজুরের রসের স্বাদ আজ ভুলতে বসেছে।
তবে ইদানিং বাণিজ্যিকভাবে খেজুর গুড়ের উৎপাদন ও বিপণন একটি সম্ভাবনায় লাভজনক পেশা হিসাবে গড়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খেজুর গুড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু উদ্যোক্তা। উদ্যোক্তরা মানসম্মত খেজুর গুড়ের উৎপাদন, বিপণন ও বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। এসব উদ্যোক্তাদের অনেকেই অন্যলাইনে ব্যবসার প্রসার ও বিস্তারের জন্য কাজ করছে। অবশ্য একসময় শীত মৌসুমে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে গাছিরা খেজুরগাছ থেকে রস নামানো ও গুড় তৈরির কাজটি নিজেরাই করতেন। রসের একটি অংশ নিতেন গাছি, একটি অংশ পেতেন গাছের মালিক। কিছুটা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাজার বন্দরে বিক্রি হতো। কয়েক বছর ধরে এই সনাতন ব্যবস্থা থেকে খেজুর গুড় উৎপাদন অনেকটা বাণিজ্যিক রূপ পেয়েছে। দেখা দিয়েছে নতুন বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। এখন মৌসুম এলেই খেজুরগাছ রীতিমতো ইজারা দেয়া হয়। কোনো কোনো এলাকায় খেজুরগাছ বাণিজ্যিকভাবে লাগানো হয়। এই প্রক্রিয়ায় রস নামানো ও গুড় তৈরির কাজটি কোথাও কোথাও মজুরি ভিত্তিক পেশা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও খুলনা জেলা বরাবরই খেজুরগাছ, গুড় ও রসের জন্য বিখ্যাত ছিল। এসব এলাকায় এক সময় অর্থকরী ফসল বলতে খেজুর গুড়ের বেশ কদর ছিল। যশোরের ঐতিহ্যবাহী গুড় পাটালির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। যশোরের খেজুরের রস ও গুড় স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয়। সাত-আট বছর আগেও শীতকালে এসব এলাকার গাছিরা খেজুর গাছের রস সংগ্রহে খুবই ব্যস্ত সময় কাটাতেন। তারা খেজুরের রস ও পাটালী গুড় বিক্রি করে বিপুল অংকের টাকা আয় করতেন। তবে সাম্প্রতিককালে খেজুর গুড়ের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, চাপাইনবাবগঞ্জ ইত্যাদি জেলায়ও বেশ কিছু উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। জানা যায়, শুধু বৃহত্তর রংপুরের পাঁচ জেলা- লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর ও নীলফামারীতে প্রায় ১০০টি পয়েন্টে খেজুরের গুড় তৈরি হচ্ছে। শীত মৌসুমে গুড় তৈরির অস্থায়ী কারখানাগুলোতে গড়ে প্রতিদিন ১৫ টন খেজুরের গুড় উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদিত বেশিরভাগ গুড় স্থানীয়রাই সরাসরি কারখানা থেকে কিনে নিচ্ছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ ও বিপণন করছে।
এ বছর রাজশাহীতে শীতের শুরু থেকেই গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহ শুরু করছে। সেই রস থেকে বিশেষ উপায়ে তৈরি হচ্ছে খেজুর গুড়। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা যায়, চলতি মৌসুমে (২০২৩-২৪) রাজশাহীতে মোট ১১ লাখ ৮ হাজার ১৮টি খেজুর গাছ থেকে (৫৪১ দশমিক ৩৭ হেক্টর জমিতে) ৮৮ লাখ ৬৪ হাজার ১৪৬ কেজি বা ৮ হাজার ৮৬৪ টন গুড় উৎপাদন হবে। আর বিক্রি হবে ১৪১ কোটি ২০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। অনলাইনের বাজার ধরলে মোট গুড় বিক্রি হবে ১৫০ কোটি টাকার বেশি। উক্ত তথ্যমতে, আম, পান যেমন রাজশাহীর অর্থনীতির চাকাকে বেশ সচল করেছে ঠিক তেমনি খেজুর গুড়। বর্তমানে হাট-বাজারগুলোতে বিক্রির পাশাপাশি শিক্ষিত যুব-সমাজ অনলাইনে গুড় বিক্রি করছে।
উপরোক্ত তথ্য সূত্রে আরও জানা যায়, দেশজুড়ে রাজশাহীর আমের যেমন খ্যাতি, তেমনই খেজুর গুড়ের সুখ্যাতি। জেলার গাছিরা শীতের মৌসুমে গাছ থেকে রস সংগ্রহের পরে প্রক্রিয়াজাত করে এ গুড় তৈরি করেন। উৎপাদিত গুড় কেনাবেচা হয় উপজেলার হাটগুলোতে। সেখান থেকে কিনে পাইকাররা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করেন। এসব গুড় বর্তমানে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। অর্জন হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। এ অঞ্চলের খেজুর গুড় খুবই সুস্বাদুও। জানা যায়, রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় প্রচুর খেজুর বাগান রয়েছে। এছাড়া সড়কপথ, পতিত জমি ও বাড়ির আঙিনাতেও রয়েছে খেজুর গাছ। শীতে এসব গাছ হয়ে ওঠে গাছিদের কর্মসংস্থানের উৎস। একজন গাছি প্রতিদিন ৪৫ থেকে ৫০টি খেজুর গাছের রস আহরণ করে। বিকেলে গাছে কোর (মাটির তৈরি হাড়ি) লাগিয়ে আসেন। আর সকালে রসভর্তি কোর নামান গাছিরা। তারা খেজুরের রস ও গুড় তৈরিকে কেন্দ্রে করে বছরের আড়াই থেকে তিন মাস ব্যস্ত থাকেন।
অন্যদিকে, যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, যশোরের খেজুরের গুড় একটি জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ গুড়ের সুনাম দেশব্যাপী। কৃষি বিভাগের প্রচেষ্টায় বিগত বছরগুলোতে রস আহরণ ও গুড় উৎপাদন বেড়েছে। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় প্রায় ২৩ লাখ খেজুরের গাছ আছে এবং এর মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ গাছ থেকে রস আহরণ করে ৬ হাজার ৫০০ গাছি। ২০২৪ সালে ৩ হাজার ৪০ টন গুড় উৎপাদন হয়েছিল এবং চলতি বছর ৩ হাজার ১শ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বছর গুড়ের দাম বেশ ভালো, ফলে কৃষক লাভবান হবে বলে ধারণা করা হয়।
দেশে ও বিদেশে খেজুর রস ও এর গুড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পরিকল্পিত উপায়ে এর উৎপাদন বাড়াতে পারলে গ্রামীণ জনপদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এটি ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া, গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকারি উদ্যোগে এর বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ করা দরকার। তরুণ উদ্যোক্তাদের যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ ব্যবসায় যুক্ত করতে পারলে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মূদ্রাও অর্জন করা সম্ভব।
এক সময় দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে খেজুরের গুড় রপ্তানি হতো। এজন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বেশি বেশি খেজুর গাছ রোপণ করা প্রয়োজন এবং গাছালীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খেজুরের রসের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা দরকার। স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা ও কঠোর নজরদারির অভাবে ইটের ভাটায় অবাধে খেজুরগাছসহ ফলবান বৃক্ষ পোড়ানোর কারণে খেজুর বৃক্ষের বিরাট অংশ উজার হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় হয়তো খেজুর রসের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। খেজুরের রসের পিঠা পায়েশ তখন শুধুই স্মৃতির রোমন্থন হয়ে বেঁচে থাকবে। এজন্য খেজুর গাছ যাতে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে সেজন্য পরিকল্পিত উপায়ে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এ গাছের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব, ঐতিহ্য ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে বিবেচনা করে একে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
[ লেখক : ব্যাংকার ]