আনোয়ারুল হক
ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা খুবই স্পষ্ট
মাত্র ছ’মাস আগে আমাদের চোখের সামনে মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়ে গেল। অযৌক্তিক হারে আরোপিত কোটা প্রথাকে যুক্তিসংগতভাবে সংস্কার করার দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনকে নির্মম ও পৈশাচিকভাবে দমনের প্রচেষ্টায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হতে থাকলে শিক্ষক, অভিভাবক শ্রমজীবী, বিরোধী রাজনৈতিকদলসহ দেশবাসী রাস্তায় নেমে আসে। সারাদেশের মানুসের মাঝে তৈরি হয় স্বজন হত্যার প্রতিবাদে অভূতপূর্ব এক সংগ্রাম এবং দূরাচার স্বৈরাচার প্রতিরোধের সংকল্প। এই গণঅভ্যুত্থান বিশেষ করে তারুণ্যের জাগরণ এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়, যেখানে সুস্পষ্টভাবে বিভাজনের বাংলাদেশকে পেছনে রেখে বৈষম্যমুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক এক সমাজের স্বপ্ন আঁকে আমাদের নতুন প্রজন্ম। জাতীয় পতাকাকে শিরস্ত্রাণ বানিয়ে, আর কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা.. ’ বা ‘এমন দেশটি কোথাও..’ রণধ্বনি তুলে সারাদেশে হাজারো লাখো ছাত্র-ছাত্রী যে অভূতপূর্ব এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুমে ফিরে যাওয়ার পরে সমন্বয়করা কি পথ হারিয়ে ফেললেন! সেদিনের আকুতি আর স্বপ্নের সঙ্গে আজকের সমন্বয়কদের কথাবার্তায় কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
পতিত প্রধানমন্ত্রী পলায়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সেই জয়ধ্বনি অল্প সময়েই থমকে দাঁড়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সেই রক্তাক্ত দিনগুলোতে যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞে শামিল হয়েছিল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাদের আস্ফালন দেখে। আবার অনেকেই আশা করেছিলেন ওরা ৭১-এর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে এবং তাদের কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন এক উদার নৈতিক রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে শামিল হবেন। কিন্ত না, কয়েকদিন যেতে না যেতেই তারা তাদের পুরনো অবস্থানের পক্ষেই সাফাই গাইতে শুরু করে। তারা বলতে শুরু করেন আজকের পরিস্থিতি প্রমাণ করছে, ১৯৭১-এ পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষায় জামায়াতে ইসলামের ভূমিকা সঠিক ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত ইসলাম পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভায় ৪ জন মন্ত্রী নিয়ে সরকারে থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সব গণহত্যার সহযোগী ছিল। আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, নারী নির্যাতনে নেতৃত্ব দিয়েছে। সেদিন জামায়াত আমির গোলাম আজম ঘোষণা করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াত এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একমাত্র দেশপ্রেমিক দায়িত্ব পালন করছে। সেই দেশপ্রেমিক জামায়াতের বর্তমান আমিরও বলছেন বাংলাদেশে এখন দুটি মাত্র দেশপ্রেমিক শক্তিÑ সেনাবাহিনী ও জামায়াতে ইসলাম। সেনা দপ্তরের জনসংযোগ বিভাগ এ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করায় দেশবাসী হতবাক। এদিকে এসব দেখে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইশাক দার তো ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশকে তাদের ‘হারিয়ে যাওয়া ভাই’ বলেই সম্বোধন করে বসলেন। দেশবাসীর সব স্বপ্ন কি চুরি হয়ে গেল!
ছাত্র সমন্বয়কদের একাংশও প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে জামাতকে সমর্থন দিয়ে নিজেদের সাধারণ ছাত্র সমাজ ও আমজনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন এবং যত বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন তত এই ফ্যাসিস্ট ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ওপর তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। তাদের আসকারা পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর ইসলামী ছাত্র সংঘ পরিবর্তিত নামকরণে যে রগকাটা ছাত্র শিবির তারাও গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শিবির তাদের মুখপত্রে লিখছে, ‘সে সময়ের সব ইসলামী রাজনীতিবিদরা বুঝেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের যারা কুশীলব তাদের মূল আক্রোশ ইসলামের সঙ্গে। সে সময়ে অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলÑ এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করুন।’ ১৯৭১ সালেও জামায়াত আমির গোলাম আজম বলেছিলেন, কোন ভালো মুসলমান তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে না।’ এরপর আর কী বলবেন! দেশে কি কোন সরকার আছে? থাকলে তো শিবিরওয়ালাদেরও এতক্ষণে কারাগারে সালমান এফ রহমান, আনিসুল হকদের পাশের কোন কক্ষে জায়গা হওয়ার কথা!
এরপর অবশ্য হঠাৎ করে অন্তর্বর্তী সরকারের মাস্টারমাইন্ড ৩৬০ ডিগ্রি পল্টি খেয়ে এক ফেসবুক পোস্টে লিখলেন ‘মুক্তিযুদ্ধ মানে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু সে সবই হবে মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল আপামর জনগণের লড়াই.. বাংলাদেশপন্থীদের অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধপন্থী হতে হবে’, ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ দুদিন আগে তিনি লক্ষ্মীপুরে যে সংবর্ধনা গ্রহণ করলেন তখন সরকারি কর্মকর্তা ছাড়া তার পাশে শুধু দেখা গেল স্থানীয় জামায়াত ও ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের নেতাদের। এবং তাদের পাশে নিয়েই তিনি ঘোষণা দিলেন কারা বাংলাদেশে থাকতে পারবেন আর কারা থাকতে পারবেন না। তাকে কে ম্যান্ডেট দিল এটা নির্ধারণের। আবার তাদের নতুন দলের নিউক্লিয়াস নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক বলছেন, আওয়ামী লীগ আর জামায়াত দিল্লির এক্সটেনশন। রাজনৈতিক পুঁজি সংগ্রহে তারা বেসামাল হয়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন। আর এটা তো এখন খুবই স্পষ্ট যে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে নানা কৌশলে ব্যবহার করেই তারা নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে তুলছেন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া সাক্ষাৎকারেও এটা অস্পষ্ট নয় যে এই দল গঠন প্রক্রিয়ায় তার শুধু সায় নয় মদদও রয়েছে।
শেখ হাসিনার সময় আমরা তার জমিদারিতে থাকতাম। তিনি পিতৃসূত্রে জমিদার, আমরা প্রজা! শেখ হাসিনার হাত থেকে অনেক কষ্টে ফসকে যেতে পেরেছি। লাভ কিছু হলো না! বরং ক্ষতি হয়েছে। প্রজা ছিলাম এখনো প্রজাই আছি। বরং জমিদারের শাসন থেকে নায়েবের শাসনে নেমে গেছি। ড. ইউনূসের জমিদারি চলছে তার নায়েবের ইশারায়। আবার নায়েবের তত্ত্বাবধানে যে সমন্বয়করা চলছেন মাত্র ছয় মাসে অনেক ক্ষেত্রেই তারা ছাত্রলীগকে ‘পরাজিত’ করার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন! তাদের হেলিকপ্টার ও গাড়িবিলাস, নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্বাচনী এলাকায় শত শত অভ্যর্থনা তোরণ আর গাড়িবহর নিয়ে প্রশাসনের সহায়তায় সভা-সমাবেশ, সচিবালয় থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে পদায়ন, পদোন্নতি, বদলিতে হস্তক্ষেপ এমনকি অমুক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে ‘জুলাই-আগস্টের স্প্রিটকে’ সমুন্নত রাখতে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন স্থানে দেয়া চিঠিÑ এমন নানা বিষয়ের যে চিত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে তার কিছুটা সত্য হলেও পরিস্থিতি তো ভয়াবহ। এতো মৃত্যু, এত রক্ত, এত বড় গণঅভ্যুত্থানের পরে এসব কাহিনী শুনলে শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। তাহলে কি ফ্যাসিবাদ পরাজিত হয়নি!
মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের পড়ুয়ারা যখন বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে রাজপথের লড়াইয়ে সমন্বয়ক নামে নেতৃত্ব দেয় এমন মানুষ সাম্য সম্প্রীতির এক মানবিক সমাজের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু শুধু স্বপ্ন দেখেই তো ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বিরোধী মানবিক সমাজ গড়ে তোলা যায় না। ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বা স্বৈরাচারকে পরাজিত করার উপায় হলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, শক্তিশালী সংসদীয় ব্যবস্থা এবং সাংবিধানিক অধিকারগুলোর সুরক্ষা। স্বচ্ছ নির্বাচন এবং জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া সমাজের নানা অংশের মাঝে বিশেষত আন্দোলনে বিজয়ীদের মাঝেও ফ্যাসিবাদী প্রবণতার যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাকে সামাল দেয়া সম্ভব নয়।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে, জাতি ও ধর্মগত সব সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করে, আর্থিক-সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণসহ বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের যে বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক উদ্যোগ ও শক্তি সমাবেশের অভাবে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অন্ধকারের শক্তি যত আস্ফালন করছে পতিত শক্তি ততই মুচকি হাসছে। আয়নায় মুখ না দেখে, কোন রকম অনুশোচনা ছাড়াই বিনাশ্রমে শক্তি সঞ্চয় করছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যে বিপুল সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল, তা অনেকটা কমতে শুরু করেছে বলে মনে করছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)ও। অন্তর্বর্তীকালীন নির্দলীয় সরকার রাজনৈতিক দল গঠনে পৃষ্ঠপোষকতা করে তাদের ক্ষমতায় থাকার নৈতিক ভিত্তিকেও নড়বড়ে করে তুলছেন। তাই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার গঠনে অহেতুক বিলম্ব দেশকে নতুন করে আবার এক সংকট ও অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দিতে পারে। রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আকাশটাকে কালো মেঘে ঢেকে দিতে পারে। রাজনীতির মাঠ যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি কখনো তা নির্মম ক্ষেত্রও বটে! মনে রাখা প্রয়োজন :
‘পালটায় মন, পালটায় বিশ্বাস/ স্লোগান পালটে হয়ে যায় ফিসফাস/ ফিসফাসটাও পালটে যেতে পারে/ হঠাৎ কারও প্রচ- চিৎকারে।’
[লেখক : সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন]
আনোয়ারুল হক
ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা খুবই স্পষ্ট
মঙ্গলবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
মাত্র ছ’মাস আগে আমাদের চোখের সামনে মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়ে গেল। অযৌক্তিক হারে আরোপিত কোটা প্রথাকে যুক্তিসংগতভাবে সংস্কার করার দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনকে নির্মম ও পৈশাচিকভাবে দমনের প্রচেষ্টায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হতে থাকলে শিক্ষক, অভিভাবক শ্রমজীবী, বিরোধী রাজনৈতিকদলসহ দেশবাসী রাস্তায় নেমে আসে। সারাদেশের মানুসের মাঝে তৈরি হয় স্বজন হত্যার প্রতিবাদে অভূতপূর্ব এক সংগ্রাম এবং দূরাচার স্বৈরাচার প্রতিরোধের সংকল্প। এই গণঅভ্যুত্থান বিশেষ করে তারুণ্যের জাগরণ এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়, যেখানে সুস্পষ্টভাবে বিভাজনের বাংলাদেশকে পেছনে রেখে বৈষম্যমুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক এক সমাজের স্বপ্ন আঁকে আমাদের নতুন প্রজন্ম। জাতীয় পতাকাকে শিরস্ত্রাণ বানিয়ে, আর কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা.. ’ বা ‘এমন দেশটি কোথাও..’ রণধ্বনি তুলে সারাদেশে হাজারো লাখো ছাত্র-ছাত্রী যে অভূতপূর্ব এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুমে ফিরে যাওয়ার পরে সমন্বয়করা কি পথ হারিয়ে ফেললেন! সেদিনের আকুতি আর স্বপ্নের সঙ্গে আজকের সমন্বয়কদের কথাবার্তায় কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
পতিত প্রধানমন্ত্রী পলায়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সেই জয়ধ্বনি অল্প সময়েই থমকে দাঁড়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সেই রক্তাক্ত দিনগুলোতে যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞে শামিল হয়েছিল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাদের আস্ফালন দেখে। আবার অনেকেই আশা করেছিলেন ওরা ৭১-এর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে এবং তাদের কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন এক উদার নৈতিক রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে শামিল হবেন। কিন্ত না, কয়েকদিন যেতে না যেতেই তারা তাদের পুরনো অবস্থানের পক্ষেই সাফাই গাইতে শুরু করে। তারা বলতে শুরু করেন আজকের পরিস্থিতি প্রমাণ করছে, ১৯৭১-এ পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষায় জামায়াতে ইসলামের ভূমিকা সঠিক ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত ইসলাম পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভায় ৪ জন মন্ত্রী নিয়ে সরকারে থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সব গণহত্যার সহযোগী ছিল। আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, নারী নির্যাতনে নেতৃত্ব দিয়েছে। সেদিন জামায়াত আমির গোলাম আজম ঘোষণা করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াত এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একমাত্র দেশপ্রেমিক দায়িত্ব পালন করছে। সেই দেশপ্রেমিক জামায়াতের বর্তমান আমিরও বলছেন বাংলাদেশে এখন দুটি মাত্র দেশপ্রেমিক শক্তিÑ সেনাবাহিনী ও জামায়াতে ইসলাম। সেনা দপ্তরের জনসংযোগ বিভাগ এ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করায় দেশবাসী হতবাক। এদিকে এসব দেখে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইশাক দার তো ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশকে তাদের ‘হারিয়ে যাওয়া ভাই’ বলেই সম্বোধন করে বসলেন। দেশবাসীর সব স্বপ্ন কি চুরি হয়ে গেল!
ছাত্র সমন্বয়কদের একাংশও প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে জামাতকে সমর্থন দিয়ে নিজেদের সাধারণ ছাত্র সমাজ ও আমজনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন এবং যত বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন তত এই ফ্যাসিস্ট ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ওপর তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। তাদের আসকারা পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর ইসলামী ছাত্র সংঘ পরিবর্তিত নামকরণে যে রগকাটা ছাত্র শিবির তারাও গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শিবির তাদের মুখপত্রে লিখছে, ‘সে সময়ের সব ইসলামী রাজনীতিবিদরা বুঝেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের যারা কুশীলব তাদের মূল আক্রোশ ইসলামের সঙ্গে। সে সময়ে অনেক মুসলিম না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলÑ এটা তাদের ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতা ছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করুন।’ ১৯৭১ সালেও জামায়াত আমির গোলাম আজম বলেছিলেন, কোন ভালো মুসলমান তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে না।’ এরপর আর কী বলবেন! দেশে কি কোন সরকার আছে? থাকলে তো শিবিরওয়ালাদেরও এতক্ষণে কারাগারে সালমান এফ রহমান, আনিসুল হকদের পাশের কোন কক্ষে জায়গা হওয়ার কথা!
এরপর অবশ্য হঠাৎ করে অন্তর্বর্তী সরকারের মাস্টারমাইন্ড ৩৬০ ডিগ্রি পল্টি খেয়ে এক ফেসবুক পোস্টে লিখলেন ‘মুক্তিযুদ্ধ মানে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু সে সবই হবে মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল আপামর জনগণের লড়াই.. বাংলাদেশপন্থীদের অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধপন্থী হতে হবে’, ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ দুদিন আগে তিনি লক্ষ্মীপুরে যে সংবর্ধনা গ্রহণ করলেন তখন সরকারি কর্মকর্তা ছাড়া তার পাশে শুধু দেখা গেল স্থানীয় জামায়াত ও ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের নেতাদের। এবং তাদের পাশে নিয়েই তিনি ঘোষণা দিলেন কারা বাংলাদেশে থাকতে পারবেন আর কারা থাকতে পারবেন না। তাকে কে ম্যান্ডেট দিল এটা নির্ধারণের। আবার তাদের নতুন দলের নিউক্লিয়াস নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক বলছেন, আওয়ামী লীগ আর জামায়াত দিল্লির এক্সটেনশন। রাজনৈতিক পুঁজি সংগ্রহে তারা বেসামাল হয়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন। আর এটা তো এখন খুবই স্পষ্ট যে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে নানা কৌশলে ব্যবহার করেই তারা নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে তুলছেন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া সাক্ষাৎকারেও এটা অস্পষ্ট নয় যে এই দল গঠন প্রক্রিয়ায় তার শুধু সায় নয় মদদও রয়েছে।
শেখ হাসিনার সময় আমরা তার জমিদারিতে থাকতাম। তিনি পিতৃসূত্রে জমিদার, আমরা প্রজা! শেখ হাসিনার হাত থেকে অনেক কষ্টে ফসকে যেতে পেরেছি। লাভ কিছু হলো না! বরং ক্ষতি হয়েছে। প্রজা ছিলাম এখনো প্রজাই আছি। বরং জমিদারের শাসন থেকে নায়েবের শাসনে নেমে গেছি। ড. ইউনূসের জমিদারি চলছে তার নায়েবের ইশারায়। আবার নায়েবের তত্ত্বাবধানে যে সমন্বয়করা চলছেন মাত্র ছয় মাসে অনেক ক্ষেত্রেই তারা ছাত্রলীগকে ‘পরাজিত’ করার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন! তাদের হেলিকপ্টার ও গাড়িবিলাস, নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্বাচনী এলাকায় শত শত অভ্যর্থনা তোরণ আর গাড়িবহর নিয়ে প্রশাসনের সহায়তায় সভা-সমাবেশ, সচিবালয় থেকে শুরু করে প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে পদায়ন, পদোন্নতি, বদলিতে হস্তক্ষেপ এমনকি অমুক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে ‘জুলাই-আগস্টের স্প্রিটকে’ সমুন্নত রাখতে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন স্থানে দেয়া চিঠিÑ এমন নানা বিষয়ের যে চিত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে তার কিছুটা সত্য হলেও পরিস্থিতি তো ভয়াবহ। এতো মৃত্যু, এত রক্ত, এত বড় গণঅভ্যুত্থানের পরে এসব কাহিনী শুনলে শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। তাহলে কি ফ্যাসিবাদ পরাজিত হয়নি!
মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের পড়ুয়ারা যখন বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে রাজপথের লড়াইয়ে সমন্বয়ক নামে নেতৃত্ব দেয় এমন মানুষ সাম্য সম্প্রীতির এক মানবিক সমাজের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু শুধু স্বপ্ন দেখেই তো ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বিরোধী মানবিক সমাজ গড়ে তোলা যায় না। ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বা স্বৈরাচারকে পরাজিত করার উপায় হলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, শক্তিশালী সংসদীয় ব্যবস্থা এবং সাংবিধানিক অধিকারগুলোর সুরক্ষা। স্বচ্ছ নির্বাচন এবং জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া সমাজের নানা অংশের মাঝে বিশেষত আন্দোলনে বিজয়ীদের মাঝেও ফ্যাসিবাদী প্রবণতার যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাকে সামাল দেয়া সম্ভব নয়।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে, জাতি ও ধর্মগত সব সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করে, আর্থিক-সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণসহ বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের যে বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক উদ্যোগ ও শক্তি সমাবেশের অভাবে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অন্ধকারের শক্তি যত আস্ফালন করছে পতিত শক্তি ততই মুচকি হাসছে। আয়নায় মুখ না দেখে, কোন রকম অনুশোচনা ছাড়াই বিনাশ্রমে শক্তি সঞ্চয় করছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যে বিপুল সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল, তা অনেকটা কমতে শুরু করেছে বলে মনে করছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)ও। অন্তর্বর্তীকালীন নির্দলীয় সরকার রাজনৈতিক দল গঠনে পৃষ্ঠপোষকতা করে তাদের ক্ষমতায় থাকার নৈতিক ভিত্তিকেও নড়বড়ে করে তুলছেন। তাই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার গঠনে অহেতুক বিলম্ব দেশকে নতুন করে আবার এক সংকট ও অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দিতে পারে। রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আকাশটাকে কালো মেঘে ঢেকে দিতে পারে। রাজনীতির মাঠ যেমন বৈচিত্র্যময় তেমনি কখনো তা নির্মম ক্ষেত্রও বটে! মনে রাখা প্রয়োজন :
‘পালটায় মন, পালটায় বিশ্বাস/ স্লোগান পালটে হয়ে যায় ফিসফাস/ ফিসফাসটাও পালটে যেতে পারে/ হঠাৎ কারও প্রচ- চিৎকারে।’
[লেখক : সাবেক সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন]