ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের অভ্যন্তরীণ জনশক্তির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। বিএমইটি বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য দেশের জনশক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৌশল ও সামগ্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে আসছে। এর অধীনে রয়েছে ৪২টি জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, চারটি বিভাগীয় কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, ৪৭টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, চারটি ইনস্টিটিউট অফ মেরিন টেকনোলজি এবং তিনটি শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ অফিস।
প্রবাসী কর্মীদের জন্য কিছু সুবিধা রয়েছে; যেমন কোনো প্রবাসী কর্মী মারা গেলে তার পরিবার লাশ পরিবহন ও দাফনের জন্য কিছু আর্থিক সহায়তা পান। এছাড়া ক্ষতিপূরণ হিসেবেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়। তবে যে দেশে তিনি মারা যান, সেখানে কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু হলে কী ধরনের ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় বা তা আদায়ে কী করণীয়, তা জানতে এবং বাস্তবায়নে সরকারি সহযোগিতার অভাব রয়েছে। প্রবাসীদের একটি সাধারণ অভিযোগ হলো, বিদেশে বিপদে পড়লে, আইনি ঝামেলায় জড়ালে কিংবা আহত বা অসুস্থ হয়ে পড়লে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো থেকে প্রায় কোনো সহায়তা পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, মিসর, লিবিয়া, মরক্কোসহ অনেক দেশে বাংলাদেশি শ্রমিক ও পেশাজীবীরা কাজ করছেন। এছাড়া নিকট ও দূরপ্রাচ্যের মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতেও বাংলাদেশিরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও বহু বাংলাদেশি চাকরি ও ব্যবসায় জড়িত। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিএমইটি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল ৪.৭৮ লক্ষ, এবং তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৮,২০৫.০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তুলনায়, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৯,৬৮৯ মিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০০৮ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রাপ্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম, যা ২০০৯ সালে ৮ম স্থানে উন্নীত হয়। এ সময় সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে ছিল। উল্লেখ্য, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিশ্ব মন্দা পরিস্থিতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে না পড়ার অন্যতম কারণ ছিল প্রবাসীদের পাঠানো বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স। (উৎস : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০)
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের জন্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- আরও গতিশীল হবে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের জন্য বন্ড ইস্যু করে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে প্রবাসীরা তাদের পাঠানো অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে দেশের জন্য বেশি লাভজনক ফল আনতে পারবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বাংলাদেশ যে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়, তাতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। প্রবাসীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের অর্থনীতির দ্রুত উন্নতিতে সহায়ক হবে।
বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল স্থাপনের মতো উন্নয়নমূলক কাজেও এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচন ও জীবনমান উন্নয়নে রেমিট্যান্সের ভূমিকা অতুলনীয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় ৬৩ শতাংশ দৈনন্দিন খরচে ব্যয় হয়, যা পরিবারগুলোকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে সহায়তা করে। রেমিট্যান্স পাওয়ার পর একটি পরিবারের আয় আগের তুলনায় গড়ে ৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তবে বিনিয়োগের মাধ্যমে রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারে। প্রবাসীদের অধিকাংশ পরিবার গ্রামে বসবাস করে। ফলে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় ও সঞ্চয় বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতির কর্মকা-ে গতিশীলতা বাড়ছে।
রেমিট্যান্স বৃদ্ধির জন্য দক্ষ কর্মী অপরিহার্য। দক্ষ কর্মী তৈরিতে কোনো ছাড় দেয়া উচিত নয়। প্রথমত, কর্মীদের যোগ্যতা মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি তাদের প্রণোদনা দেয়ার মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। তবুও এর একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে আসে। প্রণোদনা বাড়িয়েও অবৈধ হুন্ডি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য কর্মীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। কর্মীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হলে বৈধ পথে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়বে এবং হুন্ডির প্রবণতা কমে আসবে। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। এখান থেকেই সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে। সৌদিতে চলমান মেগাপ্রকল্পগুলোতে প্রচুর দক্ষ কর্মীর চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী পাঠানো গেলে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে।
জীবনমান উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে প্রতি বছর বহু বাংলাদেশি বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তাদের অধিকাংশই অদক্ষ শ্রমিক। তারা কঠোর পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করছেন এবং বৈদেশিক রিজার্ভ সমৃদ্ধ করছেন। তবে যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই শ্রমিকদের দক্ষ করে বিদেশে পাঠানো গেলে তারা উচ্চ বেতনে চাকরি পেতে পারবেন, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে। তুলনায়, প্রতিবেশী ভারত বিশ্বের শীর্ষ রেমিট্যান্স আয়কারী দেশ। এরপর রয়েছে চীন। এসব দেশ প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি পাঠিয়ে রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষে অবস্থান করছে।
প্রবাসজীবনের নানা কষ্ট, আনন্দ-বেদনা, পাওয়া-না পাওয়ার মাঝে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জনের ভালোবাসা ত্যাগ করে হাজার মাইল দূরে থেকে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান। তারা নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে শুধু পরিবারের কথা ভাবেন। কিন্তু প্রায়শই পরিবারের সদস্যরা মাস শেষ না হতেই নানা চাহিদা নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন। অনেক সময় বিদেশে যাওয়ার জন্য ধার-দেনা করে পাড়ি জমাতে হয় এই খেটে খাওয়া মানুষদের। বিদেশে গিয়ে পরিবারের খরচ পাঠানোর পর ভিসা-পাসপোর্ট নবায়নের জন্যও হিমশিম খেতে হয় তাদের। কখনো দালালের খপ্পরে পড়ে সব হারাতে হয়। আবার দূতাবাসের সঠিক ও সময়মতো সহযোগিতা না পাওয়ায় সাধারণ প্রবাসীরা ভোগান্তির শিকার হন।
বিশ্ব শ্রমবাজারে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত, চীন, নেপাল, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা। তুলনামূলক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এসব দেশের শ্রমিকরা আমাদের তুলনায় বেশি দক্ষ। বিশ্ব শ্রমবাজারে টিকে থাকতে হলে আমাদের দক্ষ শ্রমিক তৈরি ও নিয়োগে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়েছে। দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি হলে প্রবাসী আয় বর্তমানের তুলনায় অনেক বাড়বে। অভিবাসনের ক্ষেত্রে দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রতি বছর ৭ থেকে ৮ লাখ কর্মী বিদেশে চাকরি নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু দক্ষতার অভাবে তারা কম বেতনে চাকরি করছেন, যেখানে অন্য দেশের দক্ষ কর্মীরা বেশি বেতন পাচ্ছেন। দেশের প্রায় এক কোটি কর্মী বিদেশে থাকলেও রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না।
করোনাকালীন বিশ্ব মন্দায় অনেক প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। অনেকের সঞ্চিত অর্থ খরচ হয়ে গেছে এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় তারা পুনরায় বিদেশে যেতে পারেননি। বিদেশগামীদের অধিকাংশ অদক্ষ হওয়ায় তারা কঠোর পরিশ্রম করেও ন্যায্য বেতন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রবাসীরা প্রায়ই শোষণ, অবহেলা ও নিগ্রহের শিকার হন। কখনো নির্যাতনের শিকার হন, আবার কখনো ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। কিছু দেশের কারাগারে বাংলাদেশিরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন। শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে তারা যাতে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার না হন, সেজন্য দেশে-বিদেশে সরকারি তদারকি জোরদার করা প্রয়োজন। অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশ যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে অনেক বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে অসংখ্য গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। টেকসই উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসে বৈশ্বিক অভিবাসন বাজারে নিরবচ্ছিন্নভাবে জনশক্তি পাঠাতে এবং নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে সরকারি মনিটরিং ব্যবস্থা আরও কার্যকর করতে হবে।
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি বৈদেশিক রেমিট্যান্সের গুরুত্ব বিবেচনা করে জনশক্তি রপ্তানি খাতে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। জনসংখ্যার সমস্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারলে বেকারত্ব নিরসনের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির বিকাশে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য প্রতি জেলায় একটি করে বিশেষায়িত কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার জন্য সহজ শর্তে সরকারি ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো আর্থিক সংকট। এটি দূর করতে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। একটি সমন্বিত পরিকল্পনা ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এমন নীতিমালা প্রবাসীদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স প্রবাহকে আরও শক্তিশালী করবে।
[ লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি ]
ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের অভ্যন্তরীণ জনশক্তির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। বিএমইটি বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য দেশের জনশক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৌশল ও সামগ্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে আসছে। এর অধীনে রয়েছে ৪২টি জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, চারটি বিভাগীয় কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, ৪৭টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, চারটি ইনস্টিটিউট অফ মেরিন টেকনোলজি এবং তিনটি শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ অফিস।
প্রবাসী কর্মীদের জন্য কিছু সুবিধা রয়েছে; যেমন কোনো প্রবাসী কর্মী মারা গেলে তার পরিবার লাশ পরিবহন ও দাফনের জন্য কিছু আর্থিক সহায়তা পান। এছাড়া ক্ষতিপূরণ হিসেবেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয়। তবে যে দেশে তিনি মারা যান, সেখানে কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু হলে কী ধরনের ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় বা তা আদায়ে কী করণীয়, তা জানতে এবং বাস্তবায়নে সরকারি সহযোগিতার অভাব রয়েছে। প্রবাসীদের একটি সাধারণ অভিযোগ হলো, বিদেশে বিপদে পড়লে, আইনি ঝামেলায় জড়ালে কিংবা আহত বা অসুস্থ হয়ে পড়লে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো থেকে প্রায় কোনো সহায়তা পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, মিসর, লিবিয়া, মরক্কোসহ অনেক দেশে বাংলাদেশি শ্রমিক ও পেশাজীবীরা কাজ করছেন। এছাড়া নিকট ও দূরপ্রাচ্যের মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতেও বাংলাদেশিরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও বহু বাংলাদেশি চাকরি ও ব্যবসায় জড়িত। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিএমইটি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল ৪.৭৮ লক্ষ, এবং তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৮,২০৫.০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তুলনায়, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৯,৬৮৯ মিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০০৮ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রাপ্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম, যা ২০০৯ সালে ৮ম স্থানে উন্নীত হয়। এ সময় সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে ছিল। উল্লেখ্য, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিশ্ব মন্দা পরিস্থিতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে না পড়ার অন্যতম কারণ ছিল প্রবাসীদের পাঠানো বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স। (উৎস : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০)
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের জন্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- আরও গতিশীল হবে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের জন্য বন্ড ইস্যু করে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে প্রবাসীরা তাদের পাঠানো অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে দেশের জন্য বেশি লাভজনক ফল আনতে পারবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বাংলাদেশ যে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়, তাতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। প্রবাসীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের অর্থনীতির দ্রুত উন্নতিতে সহায়ক হবে।
বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল স্থাপনের মতো উন্নয়নমূলক কাজেও এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচন ও জীবনমান উন্নয়নে রেমিট্যান্সের ভূমিকা অতুলনীয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় ৬৩ শতাংশ দৈনন্দিন খরচে ব্যয় হয়, যা পরিবারগুলোকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে সহায়তা করে। রেমিট্যান্স পাওয়ার পর একটি পরিবারের আয় আগের তুলনায় গড়ে ৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তবে বিনিয়োগের মাধ্যমে রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারে। প্রবাসীদের অধিকাংশ পরিবার গ্রামে বসবাস করে। ফলে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় ও সঞ্চয় বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতির কর্মকা-ে গতিশীলতা বাড়ছে।
রেমিট্যান্স বৃদ্ধির জন্য দক্ষ কর্মী অপরিহার্য। দক্ষ কর্মী তৈরিতে কোনো ছাড় দেয়া উচিত নয়। প্রথমত, কর্মীদের যোগ্যতা মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি তাদের প্রণোদনা দেয়ার মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। তবুও এর একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে আসে। প্রণোদনা বাড়িয়েও অবৈধ হুন্ডি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য কর্মীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। কর্মীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হলে বৈধ পথে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়বে এবং হুন্ডির প্রবণতা কমে আসবে। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। এখান থেকেই সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে। সৌদিতে চলমান মেগাপ্রকল্পগুলোতে প্রচুর দক্ষ কর্মীর চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী পাঠানো গেলে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে।
জীবনমান উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে প্রতি বছর বহু বাংলাদেশি বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তাদের অধিকাংশই অদক্ষ শ্রমিক। তারা কঠোর পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করছেন এবং বৈদেশিক রিজার্ভ সমৃদ্ধ করছেন। তবে যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই শ্রমিকদের দক্ষ করে বিদেশে পাঠানো গেলে তারা উচ্চ বেতনে চাকরি পেতে পারবেন, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে। তুলনায়, প্রতিবেশী ভারত বিশ্বের শীর্ষ রেমিট্যান্স আয়কারী দেশ। এরপর রয়েছে চীন। এসব দেশ প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি পাঠিয়ে রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষে অবস্থান করছে।
প্রবাসজীবনের নানা কষ্ট, আনন্দ-বেদনা, পাওয়া-না পাওয়ার মাঝে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জনের ভালোবাসা ত্যাগ করে হাজার মাইল দূরে থেকে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান। তারা নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে শুধু পরিবারের কথা ভাবেন। কিন্তু প্রায়শই পরিবারের সদস্যরা মাস শেষ না হতেই নানা চাহিদা নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন। অনেক সময় বিদেশে যাওয়ার জন্য ধার-দেনা করে পাড়ি জমাতে হয় এই খেটে খাওয়া মানুষদের। বিদেশে গিয়ে পরিবারের খরচ পাঠানোর পর ভিসা-পাসপোর্ট নবায়নের জন্যও হিমশিম খেতে হয় তাদের। কখনো দালালের খপ্পরে পড়ে সব হারাতে হয়। আবার দূতাবাসের সঠিক ও সময়মতো সহযোগিতা না পাওয়ায় সাধারণ প্রবাসীরা ভোগান্তির শিকার হন।
বিশ্ব শ্রমবাজারে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত, চীন, নেপাল, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা। তুলনামূলক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এসব দেশের শ্রমিকরা আমাদের তুলনায় বেশি দক্ষ। বিশ্ব শ্রমবাজারে টিকে থাকতে হলে আমাদের দক্ষ শ্রমিক তৈরি ও নিয়োগে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়েছে। দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি হলে প্রবাসী আয় বর্তমানের তুলনায় অনেক বাড়বে। অভিবাসনের ক্ষেত্রে দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রতি বছর ৭ থেকে ৮ লাখ কর্মী বিদেশে চাকরি নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু দক্ষতার অভাবে তারা কম বেতনে চাকরি করছেন, যেখানে অন্য দেশের দক্ষ কর্মীরা বেশি বেতন পাচ্ছেন। দেশের প্রায় এক কোটি কর্মী বিদেশে থাকলেও রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না।
করোনাকালীন বিশ্ব মন্দায় অনেক প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। অনেকের সঞ্চিত অর্থ খরচ হয়ে গেছে এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় তারা পুনরায় বিদেশে যেতে পারেননি। বিদেশগামীদের অধিকাংশ অদক্ষ হওয়ায় তারা কঠোর পরিশ্রম করেও ন্যায্য বেতন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রবাসীরা প্রায়ই শোষণ, অবহেলা ও নিগ্রহের শিকার হন। কখনো নির্যাতনের শিকার হন, আবার কখনো ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। কিছু দেশের কারাগারে বাংলাদেশিরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন। শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে তারা যাতে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার না হন, সেজন্য দেশে-বিদেশে সরকারি তদারকি জোরদার করা প্রয়োজন। অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশ যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে অনেক বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে অসংখ্য গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। টেকসই উন্নয়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসে বৈশ্বিক অভিবাসন বাজারে নিরবচ্ছিন্নভাবে জনশক্তি পাঠাতে এবং নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে সরকারি মনিটরিং ব্যবস্থা আরও কার্যকর করতে হবে।
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি বৈদেশিক রেমিট্যান্সের গুরুত্ব বিবেচনা করে জনশক্তি রপ্তানি খাতে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। জনসংখ্যার সমস্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারলে বেকারত্ব নিরসনের পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির বিকাশে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য প্রতি জেলায় একটি করে বিশেষায়িত কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের বিদেশে যাওয়ার জন্য সহজ শর্তে সরকারি ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো আর্থিক সংকট। এটি দূর করতে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। একটি সমন্বিত পরিকল্পনা ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এমন নীতিমালা প্রবাসীদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স প্রবাহকে আরও শক্তিশালী করবে।
[ লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি ]