alt

উপ-সম্পাদকীয়

গাছে পেরেক ঠোকা

আব্দুল মান্নান খান

: মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫

গাছে পেরেক ঠোকা নিয়ে কথা উঠেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গাছ থেকে পোস্টারের সাথে পেরেক উপড়ে ফেলতেও দেখা যাচ্ছে। অভিনন্দন তাদের। গাছে পেরেক ঠোকা মানে গাছের প্রতি এক ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ করা। আমরা ভুলে যাই ওদেরও প্রাণ আছে, ওরাও খায়-দায় বাঁচে-মরে। আমাদেরও বাঁচিয়ে রাখে অক্সিজেন দিয়ে, খাবারাদি দিয়ে, ঝড়ঝঞ্ঝা দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। সেই গাছের ক্ষতি করা কষ্ট দেয়া আমাদের কাজ হতে পারে না। মানুষের কাজ হতে পারে না।

খবরটা চোখে পড়তেই চট-জলদি মনে পড়ে গেল শ্রদ্ধেয় প্রয়াত দ্বিজেন শর্মার কথা। এ দেশে দ্বিজেন শর্মা একজনই ছিলেন এখনও একজনই আছেন (১৯২৯Ñ২০১৭)। ‘প্রকৃতিপুত্র’ অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা বেঁচে আছেন আমাদের প্রকৃতিতে, বেঁচে আছেন আমাদের নিসর্গপ্রেমীদের মাঝে। বেঁচে থাকবেন বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতিবিষয়ক তার সৃষ্টিতেও। এই গাছে পেরেক ঠোকা নিয়ে তার বলা কিছু কথা এবং আমি কিভাবে এই মহৎপ্রাণ মানুষটাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেলাম সেটা আগে একটু বলতে হবে।

‘২০০০ সালে ১৯৭১ : এক সাধারণ লোকের কাহিনী’ নামে আমার একটি বই প্রকাশিত হয়। প্রকাশের কিছুদিন পর দেখি সংবাদপত্রে দ্বিজেন শর্মা বইটা নিয়ে লিখেছেন। সাধারণত পুস্তক সমালোচনা যেভাবে দেখা তার লেখাটা ঠিক তেমন ছিল না। আমি তো দেখে হতবাক। পরে শুনেছি বইটির প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএল থেকে বইটা তাকে দেয়া হয়েছিল। বলি হতবাক কেন হবো নাÑ শুরুতেই তিনি বলেছেন, ‘১৯৭১ : এক সাধারণ লোকের কাহিনী’ মুক্তিযুদ্ধের শরিক সকলের কাহিনী, আপামর বাঙালির মরণপণ যুদ্ধের কাহিনী। লেখক বয়সের হিসাবে আমার ছাত্রতুল্য, একাত্তরের বিচরণ ক্ষেত্রও আমাদের পৃথক তবু বইটা পড়তে পড়তে মনে হয় যেন আমরা একই সঙ্গে ছিলাম অনেক দিন, নইলে এতগুলো ঘটনা আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত হলো কিভাবে? আর একাত্তরই বলি কেন, ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোতেও যেন আমরা পাশাপাশি থেকেছি ৩১ জানুয়ারির কারফিউ ভাঙার মিছিলে, ২৩ ফেব্রুয়ারি মুজিবের গণসংবর্ধনায় যেখানে তিনি ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে এবং ৭ মার্চের জনসমুদ্রে। এমন সন্নিপাত বিস্ময়কর মনে হতে পারে, এমনটি মানবেতিহাসে সচরাচর ঘটে না, ঘটে কেবল জনযুদ্ধে আর একাত্তরের সংগ্রাম ছিল তেমনই একটি ঘটনা। জনযুদ্ধে কিছু দালাল ছাড়া গোটা জাতির নিবিড় বিজড়ন ঘটে বলেই দুজন অচেনা, দূরস্থ মানুষ, আমি ও মান্নান খান এতা ঘনিষ্ঠ, আমাদের স্মৃতি এতা অভিন্ন। অধিকন্তু প্রভূত সুযোগ সত্ত্বেও আমরা দুজনের কেউই অস্ত্র ধরিনি এক ধরনের হ্যমলেটীও ‘টু বি অর নট টু বি’ দ্বন্দ্বে নিরন্তর ভুগেছি আর মান্নান তো লেভ টলস্থয়ের ‘ওয়ার এ্যান্ড পিস উপন্যাসের নায়ক পিয়েতরের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন : পিয়েতর নেপোলিয়নের দিকে পিস্তল তাক করেও ঘোড়া টেপেননি, মান্নান বন্দুক উঁচিয়ে ওতপেতে থেকে রাজাকার খতমে ব্যর্থ হয়েছেন। একে ভীরুতা বলা যাবে না, এটি যুদ্ধকালীন বাস্থবতার আরেকটা দিক। মান্নান অস্ত্র ধারণ না করেও সমান বিপজ্জনক অনেক কাজ করেছেন, তার গোটা সত্তা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আশরীর আহিত।’

তার এই লেখা পড়ার পরে নিজেকে কোথায় লুকাব দিশে পাচ্ছিলাম না। কারণ আমি ওই বইটির লেখক এবং খুব একজন সাধারণ মানুষ। তার কথাগুলো আমাকে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়। তখন আমি আমার ক্ষুদ্রজ্ঞান নিয়ে তাকে জানতে চেষ্টা করি। কিছু বইও পড়ে ফেলি তার। যত জানতে চেষ্টা করি ততই বিস্মিত হতে থাকি। এত বড় মাপের এ মানুষটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার এ সাধারণ কাহিনীকে এভাবে মূল্যায়ন করলেন! এ কেমন দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধকে দেখলেন তিনি! এতে ক্রমেই তার প্রতি মুগ্ধ হয়েছি, শ্রদ্ধাবনত হয়েছি কিন্তু প্রচন্ড আগ্রহ-আবেগ নিয়ে তার সামনে যে ছুটে যাওয়া সেটা থেকে কেন যেন আমি বিরত থেকেছি। এর প্রায় এক দশক পরের কথাÑ পত্রিকায় একটা ছোট্ট খবর একদিন চোখে পড়ল। ‘তরুপল্লবের আয়োজনে কাল শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটায় রাজধানীর রমনা পার্কের রমনা বটমূলে ষষ্ঠগাছ দেখা গাছ চেনা কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। গাছ চেনানোর জন্য সেখানে উপস্থিত থাকবেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। উপস্থিত থাকবেন নিসর্গী বিপ্রদাস বড়–য়া, মোকারম হোসেন আরো অনেকে।

যথাসময়ে রমনার বটমূলে উপস্থিত হলাম। লোকসমাগম ভালোই। দ্বিজেন শর্মাকে দেখতে অনেকে আগ্রহ নিয়ে এসেছেন বোঝা গেল। আমি পিছনে দাঁড়িয়ে। একজন এসে আমার কাছে জানতে চাইলেন, দ্বিজেন শর্মা কোন জন। অনেক সাংবাদিক-সাহিত্যিকের আগমন ঘটলো। যারা পরিবেশ প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেনÑচিন্তাভাবনা করেন জানতে আগ্রহী অনুষ্ঠানটা তাদেরই। বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা জনাব ইনাম আল হক, প্রককৃতিপ্রেমিক শরীফ খানসহ আরো কয়েকজনকে চেনা হলো। শুভেচ্ছা বিনিময়ও হলো একটু। অনুষ্ঠান পরিচালনায় থাকলেন নিসর্গী মোকারম হোসেন। তারপর শুরু হলো গাছের কাছে গিয়ে ওই গাছের পরিচিতি সবার সামনে তুলে ধরা। ‘গাছ না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে না’ বিশেষ বিশেষ গাছের পরিচয় তুলে ধরার মাঝে একথাটি শর্মাজী বারবার বলে গেলেন। রমনা পার্কে উনার নিজের হাতের লাগানো কিছু গাছ সেদিন প্রথম দেখা হলো আমার। অন্য বিশেষজ্ঞদের কথার মাঝেও তিনি কিছু কিছু কথা যুক্ত করে সেসব বৃক্ষের পরিচিতিকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে লাগলেন। উপস্থিত কত ছাত্র কত প্রকৃতিপ্রেমীর কত প্রশ্নের জবাব কত সহজভাবে কত সরলতার সাথে তিনি দিয়ে গেলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা তাকে চেনেন দেখেছেন তার লেখা পড়েছেন তারা সবাই তা জেনে থাকবেন। পরিবেশ প্রকৃতির সাথে দেশের রাজনীতির সম্পর্ক নিয়েও কথার ফাঁকে দুই-একটা কথা বললেন। মানুষটা বেশ হাস্যরসের। প্রাণবন্ত তো বটেই। দেখলাম সবাই তার প্রতি কত বিনম্র শ্রদ্ধাশীল। আমার মনে হলো তিনি নিজেই যেন প্রকৃতির এক চলন্ত অভিধান। বলার অপেক্ষা রাখে না আমি তখন এ মানুষটার সাথে কথা বলার সুযোগের অপেক্ষায় ঘুরছি।

তরুপল্ল¬ব, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক সংগঠনটি তার হাতে গড়া। এর সম্পাদক মোকারম হোসেন এর উদ্যোগে সামান্য চা বিস্কুটের ব্যবস্থা রাখা ছিল। এপর্বে বিশেষ বিশেষ জনেরা উনাকে ঘিরে বসেছেন ছায়তলে। চা-চক্র শেষে এক সুযোগে কাছে গেলাম। হাত তুলে সম্মান জানিয়ে বললাম, দাদা আমি কি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি। ‘কেন পারো না’। বললাম, প্রায় বছর দশেক আগে মুক্তিযুদ্ধের পরে লেখা একটি বই নিয়ে আপনি লিখেছিলেনÑ বইটির নাম ১৯৭১ : এক সাধারণ লোকের কাহিনী, আপনার কি মনে আছে। ‘খুব মনে আছে’। বললাম, আমি সেই বইয়ের লেখক আমার নাম আব্দুল মান্নান খান। ‘ও তুমি সেই লোক, তা এতক্ষণ কথা কও না যে’।

এরপর দ্বীজেনদার জীবদ্দশায় যতগুলো ‘গাছ দেখা গাছ চেনা’ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে আমি গিয়েছি। কথা হয়েছে। একদিন বললাম দাদা, এসব গাছের কাছে কত মানুষ আসে-বসেÑদেখে এর একটা ছোট্ট পরিচিতি গাছের গায়ে লটকায়ে রাখা যায় না। বললেন, ‘খুব যায়’। পাশেই ছিলেন মোকারম সাহেব। তিনি বললেন, ‘রাখা যায় না। টোকাইরা তুলে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়। যা পায় তাই ওদের লাভ’। এরপর পেরেক মেরে রাখার কথা উঠলে তিনি বললেন, না, এটা করা যায় না’। ওদেরও প্রাণ আছে। গাছের জন্য ক্ষতি শুধু না এটা হবে অমানবিক। তারপর বললেন, যায় তো অনেক কিছু করা, পেরেক না পেরে তার দিয়েও তো পেঁচিয়ে রাখা যায় কিন্তু পাহারা দেবে কে’। আরেক দিন তিনি বললেন, এই যে বড় বড় গাছের গোড়ায় সান বাঁধানো বেদি করা হয় মানুষ বসে আরাম করবে বলে, এটা যে গাছটার জন্য কত ক্ষতিকর তা কেউ একবার দেখে না।

কথাটা এখানে একটু বলতেই হয়, একবার কলকাতায় গিয়ে বোটানিকেল গার্ডেন দেখতে গিয়েছিলাম যার নাম ‘আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বোস ভারতীয় উদ্ভিদ উদ্যান’। ওখানে চোখে পড়লো এরকম একটা গাছের পরিচিতি জিআই তার দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা। সেদিকে তাকিয়েই মুহূর্তে আমার দ্বিজেনদার কথা মনে পড়লো। উনি তো একথাটাই বলেছিলেন সেদিন। কত মানুষ প্রতিদিন ওই বোটানিকেল গার্ডেনে যায় তার লেখাযোখা হিসাব ওদের কাছে আছে। শুনলে হয়তো বিস্মিতই হতে হবে। কাজেই দ্বিজেনদা যে পাহারার কথা উলে¬খ করেছিলেন তা কত প্রসঙ্গিক তা মনে হলো তখন। ওখানে কোন গাছের একটা পাতাও কেউ ছিঁড়তে পারে না বা ছেড়ে না। কত গাছ শুকিয়ে গেছে কত গাছ কাত হয়ে পড়ে আছে। আছে। ওরা ওদের মতো আছে। যতেœর ছাপ অন্যভাবে আছে। কেটে ফেলে সরিয়ে নিয়ে বা দিনরাত ডালপালা টানাহেঁচড়া করে নয়। মাঝে মাঝেই রয়েছে ছোট বড় জলাশয়। ওই সময়ের দিকে পড়া একটা খবর বলি। আমাদের সুন্দরবনের এক জায়গায় সুন্দরী গাছের পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলেন, যে গাছটার পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে তাকে কেটে ফেলার। আবার শুধু ওটা কাটলেই হবে না সংক্রমণ রোধ করতে পাশেরটাও কেটে ফেলতে হবে।

যাই হোক, ২০০ বছর বয়সের বিশ্বের বৃহত্তম ওখানকার (আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বোস ভারতীয় উদ্ভিদ উদ্যান) বটবৃক্ষটির কথা একটু বলতে হয়। এই মহাবৃক্ষটি শক্ত খোলামেলা একটি বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। নতুন শাখা-প্রশাখাকে আগবাড়তে ঠেকনা লাগিয়ে, সার-পানি দিয়ে যেভাবে চারদিকে বিস্তৃত হতে সহযোগিতা করা হচ্ছে তা কারো চোখে না পড়ে যায় না। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মল্লি¬কপুরের বটগাছটির ওরকম যতœ নিলে আমরাই বিশ্বের বৃহত্তম বটবৃক্ষের মালিক হতে পারতাম এতে আমার অন্তত কোনো সন্দেহ নেই যেটা এখনও করা যায়।

যাহোক কথা একটাই, গাছে পেরেক ঠুকে পোস্টার ঝুলিয়ে কোনো প্রচার চালানো যাবে না। গাছকে সুস্থ থাকতে দিতে হবে। ‘গাছ না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে না’।

এ জন্য সক্রিয় হতে হবে সবাইকে বিশেষ করে ‘তরুপল্লব’-এর মতো কোনো সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা]

মানুষ ও বন্য হাতি

আলুর চাষ, বীজ উৎপাদন ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

অখণ্ড বাংলা তত্ত্ব : বাইনারিজম থেকে মুক্তির পথ

রূপকথার মতো মনে হলেও তিনি ছিলেন বাস্তবেরই নায়ক

গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইন প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্ত মত প্রকাশের গুরুত্ব

নিরাপদ অভিবাসন ও রেমিট্যান্স প্রবাহ

ভারতব্যাপী সংঘ : বিজেপির নয়া কৌশল

আর্থিক খাত নিয়ে অবিমৃষ্যকারী বক্তব্য

ভূমিকম্পের আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে

নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে

মনে কী দ্বিধা রেখে নতুন প্রত্যাশায় নতুন দল!

ছবি

উন্নত বিশ্বের নাগরিকত্ব ও দুর্নীতি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির নিচে ছাত্র

নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন

আদালতের ভেতরে ভিডিও ধারণের আইনি দিক

আইনের শাসন না গণপিটুনি?

নারীর ভূমি ও কৃষি অধিকার : ন্যায়বিচারের পথে কতদূর?

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের হালচাল

জনতুষ্টিবাদীরা এগিয়ে আছে যেদিক থেকে

ভিক্ষাবৃত্তি : প্রয়োজন নাকি পেশা?

ছবি

বিনিময় কৌশল নাকি বাণিজ্য যুদ্ধ?

শিশু আদালতের বিচার-প্রক্রিয়ার আইনি ও বাস্তবিক দিক

জনদুর্ভোগের অপসংস্কৃতি ও জনশিক্ষা : আগামীর দিকনির্দেশনা

প্রসঙ্গ : নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি

হরিজনদের পদবি : ঐক্যের পথে বাধা

এল নিনো : দেশের কৃষির চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়?

স্বপ্ন ভাঙল সাঁওতাল মুংলু বেসরার

কোনো স্কুলই খারাপ না

ঢাকার যানজটের টেকসই সমাধান কী

বই কেন পড়বেন

ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়ায় তামাক ও ধূমপান

জাতীয় বিমা দিবস

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা

ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়া ভুল হয়ে থাকলে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা সঠিক ছিল!

শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনে শিক্ষকের মূল্যায়ন

tab

উপ-সম্পাদকীয়

গাছে পেরেক ঠোকা

আব্দুল মান্নান খান

মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫

গাছে পেরেক ঠোকা নিয়ে কথা উঠেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গাছ থেকে পোস্টারের সাথে পেরেক উপড়ে ফেলতেও দেখা যাচ্ছে। অভিনন্দন তাদের। গাছে পেরেক ঠোকা মানে গাছের প্রতি এক ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ করা। আমরা ভুলে যাই ওদেরও প্রাণ আছে, ওরাও খায়-দায় বাঁচে-মরে। আমাদেরও বাঁচিয়ে রাখে অক্সিজেন দিয়ে, খাবারাদি দিয়ে, ঝড়ঝঞ্ঝা দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। সেই গাছের ক্ষতি করা কষ্ট দেয়া আমাদের কাজ হতে পারে না। মানুষের কাজ হতে পারে না।

খবরটা চোখে পড়তেই চট-জলদি মনে পড়ে গেল শ্রদ্ধেয় প্রয়াত দ্বিজেন শর্মার কথা। এ দেশে দ্বিজেন শর্মা একজনই ছিলেন এখনও একজনই আছেন (১৯২৯Ñ২০১৭)। ‘প্রকৃতিপুত্র’ অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা বেঁচে আছেন আমাদের প্রকৃতিতে, বেঁচে আছেন আমাদের নিসর্গপ্রেমীদের মাঝে। বেঁচে থাকবেন বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতিবিষয়ক তার সৃষ্টিতেও। এই গাছে পেরেক ঠোকা নিয়ে তার বলা কিছু কথা এবং আমি কিভাবে এই মহৎপ্রাণ মানুষটাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেলাম সেটা আগে একটু বলতে হবে।

‘২০০০ সালে ১৯৭১ : এক সাধারণ লোকের কাহিনী’ নামে আমার একটি বই প্রকাশিত হয়। প্রকাশের কিছুদিন পর দেখি সংবাদপত্রে দ্বিজেন শর্মা বইটা নিয়ে লিখেছেন। সাধারণত পুস্তক সমালোচনা যেভাবে দেখা তার লেখাটা ঠিক তেমন ছিল না। আমি তো দেখে হতবাক। পরে শুনেছি বইটির প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএল থেকে বইটা তাকে দেয়া হয়েছিল। বলি হতবাক কেন হবো নাÑ শুরুতেই তিনি বলেছেন, ‘১৯৭১ : এক সাধারণ লোকের কাহিনী’ মুক্তিযুদ্ধের শরিক সকলের কাহিনী, আপামর বাঙালির মরণপণ যুদ্ধের কাহিনী। লেখক বয়সের হিসাবে আমার ছাত্রতুল্য, একাত্তরের বিচরণ ক্ষেত্রও আমাদের পৃথক তবু বইটা পড়তে পড়তে মনে হয় যেন আমরা একই সঙ্গে ছিলাম অনেক দিন, নইলে এতগুলো ঘটনা আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত হলো কিভাবে? আর একাত্তরই বলি কেন, ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলোতেও যেন আমরা পাশাপাশি থেকেছি ৩১ জানুয়ারির কারফিউ ভাঙার মিছিলে, ২৩ ফেব্রুয়ারি মুজিবের গণসংবর্ধনায় যেখানে তিনি ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে এবং ৭ মার্চের জনসমুদ্রে। এমন সন্নিপাত বিস্ময়কর মনে হতে পারে, এমনটি মানবেতিহাসে সচরাচর ঘটে না, ঘটে কেবল জনযুদ্ধে আর একাত্তরের সংগ্রাম ছিল তেমনই একটি ঘটনা। জনযুদ্ধে কিছু দালাল ছাড়া গোটা জাতির নিবিড় বিজড়ন ঘটে বলেই দুজন অচেনা, দূরস্থ মানুষ, আমি ও মান্নান খান এতা ঘনিষ্ঠ, আমাদের স্মৃতি এতা অভিন্ন। অধিকন্তু প্রভূত সুযোগ সত্ত্বেও আমরা দুজনের কেউই অস্ত্র ধরিনি এক ধরনের হ্যমলেটীও ‘টু বি অর নট টু বি’ দ্বন্দ্বে নিরন্তর ভুগেছি আর মান্নান তো লেভ টলস্থয়ের ‘ওয়ার এ্যান্ড পিস উপন্যাসের নায়ক পিয়েতরের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন : পিয়েতর নেপোলিয়নের দিকে পিস্তল তাক করেও ঘোড়া টেপেননি, মান্নান বন্দুক উঁচিয়ে ওতপেতে থেকে রাজাকার খতমে ব্যর্থ হয়েছেন। একে ভীরুতা বলা যাবে না, এটি যুদ্ধকালীন বাস্থবতার আরেকটা দিক। মান্নান অস্ত্র ধারণ না করেও সমান বিপজ্জনক অনেক কাজ করেছেন, তার গোটা সত্তা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আশরীর আহিত।’

তার এই লেখা পড়ার পরে নিজেকে কোথায় লুকাব দিশে পাচ্ছিলাম না। কারণ আমি ওই বইটির লেখক এবং খুব একজন সাধারণ মানুষ। তার কথাগুলো আমাকে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়। তখন আমি আমার ক্ষুদ্রজ্ঞান নিয়ে তাকে জানতে চেষ্টা করি। কিছু বইও পড়ে ফেলি তার। যত জানতে চেষ্টা করি ততই বিস্মিত হতে থাকি। এত বড় মাপের এ মানুষটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার এ সাধারণ কাহিনীকে এভাবে মূল্যায়ন করলেন! এ কেমন দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধকে দেখলেন তিনি! এতে ক্রমেই তার প্রতি মুগ্ধ হয়েছি, শ্রদ্ধাবনত হয়েছি কিন্তু প্রচন্ড আগ্রহ-আবেগ নিয়ে তার সামনে যে ছুটে যাওয়া সেটা থেকে কেন যেন আমি বিরত থেকেছি। এর প্রায় এক দশক পরের কথাÑ পত্রিকায় একটা ছোট্ট খবর একদিন চোখে পড়ল। ‘তরুপল্লবের আয়োজনে কাল শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটায় রাজধানীর রমনা পার্কের রমনা বটমূলে ষষ্ঠগাছ দেখা গাছ চেনা কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। গাছ চেনানোর জন্য সেখানে উপস্থিত থাকবেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। উপস্থিত থাকবেন নিসর্গী বিপ্রদাস বড়–য়া, মোকারম হোসেন আরো অনেকে।

যথাসময়ে রমনার বটমূলে উপস্থিত হলাম। লোকসমাগম ভালোই। দ্বিজেন শর্মাকে দেখতে অনেকে আগ্রহ নিয়ে এসেছেন বোঝা গেল। আমি পিছনে দাঁড়িয়ে। একজন এসে আমার কাছে জানতে চাইলেন, দ্বিজেন শর্মা কোন জন। অনেক সাংবাদিক-সাহিত্যিকের আগমন ঘটলো। যারা পরিবেশ প্রকৃতি নিয়ে কাজ করেনÑচিন্তাভাবনা করেন জানতে আগ্রহী অনুষ্ঠানটা তাদেরই। বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা জনাব ইনাম আল হক, প্রককৃতিপ্রেমিক শরীফ খানসহ আরো কয়েকজনকে চেনা হলো। শুভেচ্ছা বিনিময়ও হলো একটু। অনুষ্ঠান পরিচালনায় থাকলেন নিসর্গী মোকারম হোসেন। তারপর শুরু হলো গাছের কাছে গিয়ে ওই গাছের পরিচিতি সবার সামনে তুলে ধরা। ‘গাছ না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে না’ বিশেষ বিশেষ গাছের পরিচয় তুলে ধরার মাঝে একথাটি শর্মাজী বারবার বলে গেলেন। রমনা পার্কে উনার নিজের হাতের লাগানো কিছু গাছ সেদিন প্রথম দেখা হলো আমার। অন্য বিশেষজ্ঞদের কথার মাঝেও তিনি কিছু কিছু কথা যুক্ত করে সেসব বৃক্ষের পরিচিতিকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে লাগলেন। উপস্থিত কত ছাত্র কত প্রকৃতিপ্রেমীর কত প্রশ্নের জবাব কত সহজভাবে কত সরলতার সাথে তিনি দিয়ে গেলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা তাকে চেনেন দেখেছেন তার লেখা পড়েছেন তারা সবাই তা জেনে থাকবেন। পরিবেশ প্রকৃতির সাথে দেশের রাজনীতির সম্পর্ক নিয়েও কথার ফাঁকে দুই-একটা কথা বললেন। মানুষটা বেশ হাস্যরসের। প্রাণবন্ত তো বটেই। দেখলাম সবাই তার প্রতি কত বিনম্র শ্রদ্ধাশীল। আমার মনে হলো তিনি নিজেই যেন প্রকৃতির এক চলন্ত অভিধান। বলার অপেক্ষা রাখে না আমি তখন এ মানুষটার সাথে কথা বলার সুযোগের অপেক্ষায় ঘুরছি।

তরুপল্ল¬ব, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক সংগঠনটি তার হাতে গড়া। এর সম্পাদক মোকারম হোসেন এর উদ্যোগে সামান্য চা বিস্কুটের ব্যবস্থা রাখা ছিল। এপর্বে বিশেষ বিশেষ জনেরা উনাকে ঘিরে বসেছেন ছায়তলে। চা-চক্র শেষে এক সুযোগে কাছে গেলাম। হাত তুলে সম্মান জানিয়ে বললাম, দাদা আমি কি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি। ‘কেন পারো না’। বললাম, প্রায় বছর দশেক আগে মুক্তিযুদ্ধের পরে লেখা একটি বই নিয়ে আপনি লিখেছিলেনÑ বইটির নাম ১৯৭১ : এক সাধারণ লোকের কাহিনী, আপনার কি মনে আছে। ‘খুব মনে আছে’। বললাম, আমি সেই বইয়ের লেখক আমার নাম আব্দুল মান্নান খান। ‘ও তুমি সেই লোক, তা এতক্ষণ কথা কও না যে’।

এরপর দ্বীজেনদার জীবদ্দশায় যতগুলো ‘গাছ দেখা গাছ চেনা’ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে আমি গিয়েছি। কথা হয়েছে। একদিন বললাম দাদা, এসব গাছের কাছে কত মানুষ আসে-বসেÑদেখে এর একটা ছোট্ট পরিচিতি গাছের গায়ে লটকায়ে রাখা যায় না। বললেন, ‘খুব যায়’। পাশেই ছিলেন মোকারম সাহেব। তিনি বললেন, ‘রাখা যায় না। টোকাইরা তুলে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয়। যা পায় তাই ওদের লাভ’। এরপর পেরেক মেরে রাখার কথা উঠলে তিনি বললেন, না, এটা করা যায় না’। ওদেরও প্রাণ আছে। গাছের জন্য ক্ষতি শুধু না এটা হবে অমানবিক। তারপর বললেন, যায় তো অনেক কিছু করা, পেরেক না পেরে তার দিয়েও তো পেঁচিয়ে রাখা যায় কিন্তু পাহারা দেবে কে’। আরেক দিন তিনি বললেন, এই যে বড় বড় গাছের গোড়ায় সান বাঁধানো বেদি করা হয় মানুষ বসে আরাম করবে বলে, এটা যে গাছটার জন্য কত ক্ষতিকর তা কেউ একবার দেখে না।

কথাটা এখানে একটু বলতেই হয়, একবার কলকাতায় গিয়ে বোটানিকেল গার্ডেন দেখতে গিয়েছিলাম যার নাম ‘আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বোস ভারতীয় উদ্ভিদ উদ্যান’। ওখানে চোখে পড়লো এরকম একটা গাছের পরিচিতি জিআই তার দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা। সেদিকে তাকিয়েই মুহূর্তে আমার দ্বিজেনদার কথা মনে পড়লো। উনি তো একথাটাই বলেছিলেন সেদিন। কত মানুষ প্রতিদিন ওই বোটানিকেল গার্ডেনে যায় তার লেখাযোখা হিসাব ওদের কাছে আছে। শুনলে হয়তো বিস্মিতই হতে হবে। কাজেই দ্বিজেনদা যে পাহারার কথা উলে¬খ করেছিলেন তা কত প্রসঙ্গিক তা মনে হলো তখন। ওখানে কোন গাছের একটা পাতাও কেউ ছিঁড়তে পারে না বা ছেড়ে না। কত গাছ শুকিয়ে গেছে কত গাছ কাত হয়ে পড়ে আছে। আছে। ওরা ওদের মতো আছে। যতেœর ছাপ অন্যভাবে আছে। কেটে ফেলে সরিয়ে নিয়ে বা দিনরাত ডালপালা টানাহেঁচড়া করে নয়। মাঝে মাঝেই রয়েছে ছোট বড় জলাশয়। ওই সময়ের দিকে পড়া একটা খবর বলি। আমাদের সুন্দরবনের এক জায়গায় সুন্দরী গাছের পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলেন, যে গাছটার পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে তাকে কেটে ফেলার। আবার শুধু ওটা কাটলেই হবে না সংক্রমণ রোধ করতে পাশেরটাও কেটে ফেলতে হবে।

যাই হোক, ২০০ বছর বয়সের বিশ্বের বৃহত্তম ওখানকার (আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বোস ভারতীয় উদ্ভিদ উদ্যান) বটবৃক্ষটির কথা একটু বলতে হয়। এই মহাবৃক্ষটি শক্ত খোলামেলা একটি বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। নতুন শাখা-প্রশাখাকে আগবাড়তে ঠেকনা লাগিয়ে, সার-পানি দিয়ে যেভাবে চারদিকে বিস্তৃত হতে সহযোগিতা করা হচ্ছে তা কারো চোখে না পড়ে যায় না। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মল্লি¬কপুরের বটগাছটির ওরকম যতœ নিলে আমরাই বিশ্বের বৃহত্তম বটবৃক্ষের মালিক হতে পারতাম এতে আমার অন্তত কোনো সন্দেহ নেই যেটা এখনও করা যায়।

যাহোক কথা একটাই, গাছে পেরেক ঠুকে পোস্টার ঝুলিয়ে কোনো প্রচার চালানো যাবে না। গাছকে সুস্থ থাকতে দিতে হবে। ‘গাছ না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে না’।

এ জন্য সক্রিয় হতে হবে সবাইকে বিশেষ করে ‘তরুপল্লব’-এর মতো কোনো সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা]

back to top