পাভেল পার্থ
গ্রামীণ নিম্ন বর্গের বর্ষপঞ্জিকা প্রাণ ও প্রকৃতির নির্দেশনাকে মেনেই গড়ে তুলেছিল নানা কৃত্য ও বাৎসরিক আয়োজন। সংক্রান্তি হলো বর্ষপঞ্জিকার এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। প্রতি মাসের শেষ হলো সংক্রান্তি আর প্রতি মাসের শুরু হলো মাস-পয়লা। ঋতুভিত্তিক পরিবর্তনে সমাজকে প্রস্তুত করবার সব আয়োজন গড়ে ওঠেছিল এ সময়টাতেই। এর ভেতর আবার চৈত্রসংক্রান্তি, ফাল্গুনসংক্রান্তি, পৌষসংক্রান্তি, ভাদ্রসংক্রান্তি, শ্রাবণসংক্রান্তি, কার্তিকসংক্রান্তির আয়োজন পার্বণময়। কারণ এ সময়গুলো মাস নয়, বদলে যায় প্রকৃতির ঋতুকাল। চলতি আলাপে আমরা বাঙালি ও আদিবাসী জীবনের অসুখ ও মহামারী সামাল দেয়ার সংক্রান্তিগুলো নিয়ে কথা বলব। আলাপের কেন্দ্রে রাখব বর্ষবিদায়ের সংক্রান্তিপরবগুলো। কারণ এ সময়টাতে সমাজ পরবর্তী ৩৬৫ দিনের জন্য সামগ্রিক প্রস্তুতি নেয় শরীর ও মনে। আর এখানেই চৈত্রসংক্রান্তির শক্তি এবং প্রকৃতিপাঠের এক অনন্য সমন্বয়।
চৈত্রসংক্রান্তি ও চইতপরব
প্রকৃতিতে তিতা জাতীয় শাকের উপস্থিতি জানান দেয় চৈত্র মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, বৈশাখ সমাগত। এটি বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সন্ধিস্থলের এক অনন্য চিহ্ন। তিতাশাক ছাড়া বাঙালি কী আদিবাসী সমাজে বর্ষবিদায়ের সংক্রান্তি কৃত্য হয় না। গিমা তিতা, নাইল্যা, গিমা, দন্ডকলস, আমরুল, থানকুনি, নিম, নিশিন্দা, তেলাকুচা, মালঞ্চ, কানশিরা এ রকমের ১৩ থেকে ২৯ রকমের তিতা স্বাদের শাক খাওয়ার চল আছে দেশের নানা জনপদে। আদিবাসী বেদিয়া-মাহাতোরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন বথুয়া, কাঁটাখুঁড়ে, গিমাসহ নানা জাতের তিতাশাক খায়। হাওরাঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তির দিন আয়োজিত এ কৃত্যের নাম ‘বেগুন পাতার বর্ত’। হাওরাঞ্চলে ব্রতকে ‘বর্ত’ বলে। এ দিনটিকে অনেকে ‘হার বিষুও’ বলেন, কেউ বলেন ‘চইত পরব’। চইত পরবে বর্তের আগ পর্যন্ত বাড়ির নারীরা উপবাস থাকেন। ভোররাতে ওঠে বাড়ি ঘর সাফসুতরো ও লেপামোছা করতে হয়। বেগুন পাতার বর্তের জন্য বাড়ির বিছরাখেতের (আঙ্গিনা বাগান) বেগুনগাছ থেকে ৫ থেকে ১৩টি পাতা সংগ্রহ করা হয়। পাতাগুলো ধুয়ে ১৩টি পাতায় ১৩ জাতের তরিতরকারি রান্না করে ভাতসহ দেয়া হয়। বর্ত শেষে বেগুন পাতাগুলো নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। চাকমারা এ সময় আয়োজন করে বিজু। ফুল বিজু, মূল বিজু ও গয্যাপয্যা দিন এ তিন পর্বে বিভক্ত বিজুর মূলে থাকে নানাপদের পাহাড়ি শাকসবজির তৈরি পাজোন। বান্দরবানের চাকরা সাংগ্রাইংয়ের সময় কাইনকো বা নাগেশ্বর ফুল সংগ্রহে মুখরিত হয়ে ওঠেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা এ সময় বিষু আয়োজন করেন। মারমা ও রাখাইনরা সাংগ্রাই আয়োজনে পবিত্র জল দিয়ে আগত সবাইকে ভিজিয়ে শুদ্ধ করেন। চৈত্রসংক্রান্তির আরেক অনবদ্য চিহ্ন হলো গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো গাজন বা চড়কের দল। লাল সালু কাপড় পরিধান করে এবং শিব-গৌরি সেজে, কেউবা মুখোশ চাপিয়ে মাগন সংগ্রহ করেন। আয়োজনে বৈচিত্র্য থাকলেও চৈত্রসংক্রান্তির মূলে আছে সুস্থতার জন্য প্রকৃতির তিতারস গ্রহণ ও চারপাশের পরিচ্ছন্নতা। অনাগত রোগ ও মহামারী থেকে আসন্ন বছরকে সুরক্ষিত করতেই চৈত্রসংক্রান্তির সব আয়োজন।
হাজরা ও বাইশাখী
রবিদাসদের ভেতর বাইশাখী পূজা ও হাজরা-কৃত্যের মাধ্যমে বর্ষবিদায় পালিত হয়। এদিন যবের ছাতু ও কাঁচা আম একত্রে মিশিয়ে আম-ছাতুয়া খাওয়া হয়। মৌসুমি ফল আমকে বর্ষবিদায়ের এ রীতির ভেতর দিয়েই সমাজ গ্রহণ করে রোগব্যাধি সামাল দেয়ার জন্য। বছরের প্রথম দিন ঘরের দেওকুড়ি নামের পবিত্রস্থলে কর্মের পূজা করা হয়। রবিদাসদের ভেতর যে যে কর্মপেশায় জড়িত তারা সেই কর্মের সাথে জড়িত আনুষঙ্গিক উপকরণগুলো দেওকুড়িতে রাখে। হাতুড়ি, কোদাল, শাবল, কাঁচি, ছুরি, বাটাল যার কর্মে যা লাগে সব। কেবল মানুষ নয় এ সময় পেশায় জড়িত সব উপকরণ ও গৃহস্থালী সব কিছু ধোয়ামোছা করতে হয়।
চইত বিশমা
দিনাজপুরের বিরলের কড়া আদিবাসীরা চৈত্রসংক্রান্তিতে আয়োজন করেন চইতবিশমা। সংক্রান্তির কয়েকদিন আগ থেকেই পাড়া গ্রাম পরিচ্ছন্ন করা হয়, বহিরাগতদের গ্রামে প্রবেশ সীমিত করা হয়। চইতবিশমার দিনে নিমপাতার কাঁচা রস ও নানাপদের তিতাশাক খাওয়া হয়। পেঁয়াজ-রসুন-শুকনো মরিচ ঝুলানো হয় ঘরের দরজায়। কড়াদের প্রতিটি বাড়িতে পিড়াঘার নামে এক পবিত্র পূজাস্থল থাকে। এখানে চইতবিশমা পূজা শেষে হাড়িয়া পান ও নৃত্যগীতের আয়োজন হয়।
বাহা
ফৗগুন (ফাল্গুন) মাস থেকেই শুরু হয় সাঁওতালি বর্ষ। বর্ষ বিদায় ও বরণের উৎসব বাহাও পালিত হয় এ মাসেই। এ সময় গাছে গাছে সারজম, ইচৗক, মুরুপ্ আর মহুয়া ফুল ফোটে। বাহা পরবের ভেতর দিয়েই সাঁওতাল সমাজ এসব ফুলের মধু পান ও ব্যবহারের অনুমতি প্রার্থনা করে প্রকৃতির কাছে। বাহার আগে এসব ফুলের ব্যবহার সামাজিকভাবে নিষেধ। বাহা পরবে রোগজরা নিরাময়ে নতুন ফুলের স্পর্শ গ্রহণের ভেতর দিয়ে প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করে সাঁওতাল সমাজ।
হেচড়া
গোপালগঞ্জ-মাদারীপুরের চান্দারবিল এলাকায় হেচড়া দেবী পূজিত হন বসন্তকালে খোস-পাঁচড়া, বসন্ত, চুলকানি নিরাময়ের মানতে। এদিনে গো-ফাল্গুন রীতিও পালন করা হয়। গোবরের দলায় বউন্যা (বরুণ) ও ভাটির (ভাঁট) ফুল গেঁথে দিয়ে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকাতে ফাল্গুন মাসে এবং কোথাও চৈত্রসংক্রান্তিতে ভাঁট এবং বরুণ ফুল দিয়ে এ কৃত্য পালিত হয়।
পঞ্চমদোল
ফাল্গুনসংক্রান্তিতে আয়োজিত পঞ্চমদোল উৎসব বেশ কয়েকটি পর্ব ও আচারকৃত্যে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলে। প্রথম দোলভিটে মেরামত, তারপর দোলপূর্ণিমার প্রথম দিন কুড়া পোড়ান পর্ব, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন দোলপূজা, চতুর্থ দিন হোলি, পঞ্চম দিন পূণ্যাহ বা সমাপ্তি। দোলভিটের সামনে পূবমুখী করে বগাঝোল, বাইল্যাবাত, মধুশাইল, নেপালদীঘা, ভাওয়াইল্যা, কইতরমণি, পোখরাজ এরকম স্থানীয় আমন ধানের পল (খড়) ও মুলী বাঁশ দিয়ে পুরুষেরা কুড়াঘর তৈরি করেন। পঞ্চমদোলের প্রথম দিন এই কুড়া পোড়ানো হয়। গ্রাম থেকে অশান্তি, রোগশোক ও অশুভ শক্তিকে দূর করার জন্য এই কৃত্য পালিত হয়।
শীতলা পূজা
বসন্তরোগবিনাশী দেবী শীতলা। সারা গায়ে গুটি বসন্তের দাগ। ফাল্গুন-চৈত্রে আয়োজিত শীতলা পূজা ঘিরে নরসিংদী, গাজীপুর, মৌলভীবাজার, সিলেট, সাতক্ষীরাসহ দেশের নানাপ্রান্তেই জমে ওঠে রকমভিন্ন আয়োজন ও মেলা। গ্রামে গ্রামে শ্যাওড়া, বট, অশ্বত্থ, পাকুড়, ষষ্ঠী বট, খেজুর, বকুল গাছতলায় গড়ে ওঠেছে শীতলাতলা ও শীতলাথান। শীতলা পূজায় ১০৮টি মাটির ছোট প্রদীপ লাগে। একটি দেবী ঘট, একটি ফুল-জলের হাড়ি লাগে। এতে দুধ-বাতাসা-বেলপাতা-তুলসীপাতা-ডাবের জল মিশানো হয়। পূজার পরে সবাইকেই এটি খেতে দেয়া হয়। কেউ কেউ এটি শরীরে মাখেন। শেষে হোম যঞ্জের কালি ও ঘি একত্রে মিশিয়ে সবার মাথা-কপালে লাগানো হয়। সাতক্ষীরার সুন্দরবন অঞ্চলে প্রতি বছর মানুষের হাম-বসন্ত-পাতলা পায়খানা-জ্বর হলে এবং গরু-ছাগলের পশ্চিমে-গায়ে গুটি বের হলে, সর্দি লাগলে-পাতলা পায়খানা করলে শীতলা পূজার মানসী (মানত) করা হয়।
সারুল
অসুখ ও অশুভশক্তি থেকে গ্রামকে মুক্ত রাখতে বসন্তকালে মুন্ডারা পালন করে সারুল/সারহুল কৃত্য। সুন্দরবন অঞ্চলে এ পূজায় সিন্ধ্রি (সুন্দরী) গাছের পাতা লাগে। মাটির থানে ও ঘরের ভেতর পূজা হয়। কৃত্যকালীন সময়ে কঠোরভাবে বহিরাগতদের গ্রামে প্রবেশ সীমিত করা হয়।
ঘাটাবান্ধাবর্ত
হাওরাঞ্চলে বসন্তকালীন রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে এই ব্রত পালিত হয়। চালতাপাতা দিয়ে ঘাটা বাঁধা হয় এবং ঘরবাড়ির চারপাশ, জমিন ও গৃহপ্রবেশের মুখে এসব স্থাপন করা হয় যেন কোনো ব্যাধি ও অশুভ কিছু প্রবেশ না করতে পারে। একইভাবে কমপক্ষে আট রকমের শাকসবজি দিয়ে আটআনাজবর্তও পালিত হয় যাতে মানুষের শরীরে কোনো জরাব্যাধি প্রবেশ না করতে পারে।
সংক্রান্তির শক্তি
ষড় ঋতুর বাংলাদেশ এখন কত ঋতুর দেশ তা আরেক লম্বা তর্কের তল। প্রতিটি ঋতুর সন্ধিক্ষণ হলো সংক্রান্তি। আর এই সময়টা জরা-ব্যাধি জয় করে নতুন আরেক বছরের জন্য সঞ্জিবনী সঞ্চয়ের সময়। গ্রামীণ নি¤œবর্গ অসুখ ও মহামারীকে সামাল দিতেই সংক্রান্তির সময়গুলোতে নিজেদের নানা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। খাদ্য থেকে শুরু করে চারপাশের পরিচ্ছন্নতা, সাময়িক বিচ্ছিন্নতা থেকে নানামুখী সঙ্গনিরোধ এসব মিলিয়েই আমাদের সংক্রান্তি আয়োজন। সংক্রান্তি কেবল গাজনের গীত বা তিতাশাকের পরব নয়। মহামারী থেকে বাঁচার এক সামষ্টিক স্থানীয় কায়দা। প্রকৃতিকে জানা-বোঝার জন্য এক সামাজিক আহ্বান। সংক্রান্তিতেই সমাজ প্রকৃতির বিশেষ কিছু বিশেষভাবে গ্রহণ করে ও সামাজিক বিধিনিষেধগুলোর পাবলিক চর্চা করে। মূলত এর ভেতর দিয়ে সমাজ জানাতে চায় প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ হিসেবে আমাদের কিছু করণীয় ও বিধি আছে। এসব বিধিগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতেই সংক্রান্তির নানা কৃত্য আয়োজন। বাঙালি জনপদে চৈত্র মাসে শিমুইর (শিম), ফাল্গুনে মূলা, শ্রাবণে কচু, আষাঢ়ে ওল, জ্যৈষ্ঠে গিমাতিতা শাক, কার্তিকে ওল খায় না অনেকেই। গ্রামের প্রবীণ অনেকেই এখনও মনে করেন বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসে কোনো শস্য ফসল লাগাতে হয় না, কারণ এতে জ্যেষ্ঠ সন্তানের অমঙ্গল হয়। শ্রাবণ মাসে কলা গাছ লাগানোর নিয়ম নেই। শ্রাবণ মাসে মনসাবর্ত হয় এবং এর সাথে জড়িত বেহুলা-লক্ষিন্দরের কাহিনিতে বেহুলা কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে ছিল বলেই শ্রাবণ মাসে কলাগাছ পোঁতার নিয়ম নেই। শনি ও মঙ্গলবারে সাধারণত: কোনো শস্যফসল লাগানোর নিয়ম নেই। ত্রিসন্ধ্যা, সন্ধ্যা, রাত ও ভোর রাতে কোনো কিছু লাগানোর নিয়ম নেই। সমতল অঞ্চলের বাঙালি মুসলিম পরিবারের অনেকেই বুধবারে বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটে না, কারণ তারা বুধবারকে মাদারিয়া বার হিসেবে দেখে। মাদার পীরের বারকে মাদারিয়া বার বলে। টাঙ্গাইলের চারান বিলের বাঙালি জেলে পরিবারে রাগা মাছ খাওয়া হয় না। অনেকে বিশ্বাস করেন এই মাছ সর্পদর্শনের পর ভেলায় ভাসমান লক্ষিন্দরের পায়ের টাখনুগিরা খেয়ে ফেলেছিল। ঠিক যেমন সিলেটসহ দেশের অনেক অঞ্চলের বাঙালি মুসলিম পরিবার হযরত শাহজালালের স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত বলে জালালি কবুতরের মাংস খান না। কিন্তু আমাদের তথাকথিত আধুনিক ও ‘সভ্য’ শহুরে সমাজে প্রতিদিন প্রকৃতির ব্যাকরণকে অমান্য ও তছনছ করা হয়। আমাদের নাগরিক জীবনে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ কোনো বিধিনিষেধ নেই। এখন সারা বছর বাজারমুখী শস্যফসল মেলে। কোনোকিছু দেখে বোঝার উপায় নেই এটা কোন ঋতু। আমরা তাহলে এমন করপোরেট ভোগবাদী উন্নয়ন দিয়ে কার লাভ আর কার ক্ষতি করছি? প্রকৃতির ধারাপাত চুরমার করে দিচ্ছি বলেই ইবোলা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনা নানা মহামারীতে দুনিয়া বিপর্যস্ত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের গ্রামীণ নি¤œবর্গের সংক্রান্তি পালনের ভেতর প্রকৃতির বিজ্ঞানকে মান্য করার এক অবিস্মরণীয় শক্তি ও দর্শন আছে। ব্যক্তি নয়, সমষ্টির অভিজ্ঞতা আর প্রকৃতির প্রতি নতজানু হওয়ার ভেতর দিয়েই সব সংকট থেকে মুক্তির জন্য লড়েছে নি¤œবর্গ। বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের পরবগুলোও সেই শক্তিই জানান দেয়।
[লেখক : গবেষক, পরিবেশ-প্রতিবেশ]
পাভেল পার্থ
রোববার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫
গ্রামীণ নিম্ন বর্গের বর্ষপঞ্জিকা প্রাণ ও প্রকৃতির নির্দেশনাকে মেনেই গড়ে তুলেছিল নানা কৃত্য ও বাৎসরিক আয়োজন। সংক্রান্তি হলো বর্ষপঞ্জিকার এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। প্রতি মাসের শেষ হলো সংক্রান্তি আর প্রতি মাসের শুরু হলো মাস-পয়লা। ঋতুভিত্তিক পরিবর্তনে সমাজকে প্রস্তুত করবার সব আয়োজন গড়ে ওঠেছিল এ সময়টাতেই। এর ভেতর আবার চৈত্রসংক্রান্তি, ফাল্গুনসংক্রান্তি, পৌষসংক্রান্তি, ভাদ্রসংক্রান্তি, শ্রাবণসংক্রান্তি, কার্তিকসংক্রান্তির আয়োজন পার্বণময়। কারণ এ সময়গুলো মাস নয়, বদলে যায় প্রকৃতির ঋতুকাল। চলতি আলাপে আমরা বাঙালি ও আদিবাসী জীবনের অসুখ ও মহামারী সামাল দেয়ার সংক্রান্তিগুলো নিয়ে কথা বলব। আলাপের কেন্দ্রে রাখব বর্ষবিদায়ের সংক্রান্তিপরবগুলো। কারণ এ সময়টাতে সমাজ পরবর্তী ৩৬৫ দিনের জন্য সামগ্রিক প্রস্তুতি নেয় শরীর ও মনে। আর এখানেই চৈত্রসংক্রান্তির শক্তি এবং প্রকৃতিপাঠের এক অনন্য সমন্বয়।
চৈত্রসংক্রান্তি ও চইতপরব
প্রকৃতিতে তিতা জাতীয় শাকের উপস্থিতি জানান দেয় চৈত্র মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে, বৈশাখ সমাগত। এটি বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সন্ধিস্থলের এক অনন্য চিহ্ন। তিতাশাক ছাড়া বাঙালি কী আদিবাসী সমাজে বর্ষবিদায়ের সংক্রান্তি কৃত্য হয় না। গিমা তিতা, নাইল্যা, গিমা, দন্ডকলস, আমরুল, থানকুনি, নিম, নিশিন্দা, তেলাকুচা, মালঞ্চ, কানশিরা এ রকমের ১৩ থেকে ২৯ রকমের তিতা স্বাদের শাক খাওয়ার চল আছে দেশের নানা জনপদে। আদিবাসী বেদিয়া-মাহাতোরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন বথুয়া, কাঁটাখুঁড়ে, গিমাসহ নানা জাতের তিতাশাক খায়। হাওরাঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তির দিন আয়োজিত এ কৃত্যের নাম ‘বেগুন পাতার বর্ত’। হাওরাঞ্চলে ব্রতকে ‘বর্ত’ বলে। এ দিনটিকে অনেকে ‘হার বিষুও’ বলেন, কেউ বলেন ‘চইত পরব’। চইত পরবে বর্তের আগ পর্যন্ত বাড়ির নারীরা উপবাস থাকেন। ভোররাতে ওঠে বাড়ি ঘর সাফসুতরো ও লেপামোছা করতে হয়। বেগুন পাতার বর্তের জন্য বাড়ির বিছরাখেতের (আঙ্গিনা বাগান) বেগুনগাছ থেকে ৫ থেকে ১৩টি পাতা সংগ্রহ করা হয়। পাতাগুলো ধুয়ে ১৩টি পাতায় ১৩ জাতের তরিতরকারি রান্না করে ভাতসহ দেয়া হয়। বর্ত শেষে বেগুন পাতাগুলো নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। চাকমারা এ সময় আয়োজন করে বিজু। ফুল বিজু, মূল বিজু ও গয্যাপয্যা দিন এ তিন পর্বে বিভক্ত বিজুর মূলে থাকে নানাপদের পাহাড়ি শাকসবজির তৈরি পাজোন। বান্দরবানের চাকরা সাংগ্রাইংয়ের সময় কাইনকো বা নাগেশ্বর ফুল সংগ্রহে মুখরিত হয়ে ওঠেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা এ সময় বিষু আয়োজন করেন। মারমা ও রাখাইনরা সাংগ্রাই আয়োজনে পবিত্র জল দিয়ে আগত সবাইকে ভিজিয়ে শুদ্ধ করেন। চৈত্রসংক্রান্তির আরেক অনবদ্য চিহ্ন হলো গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো গাজন বা চড়কের দল। লাল সালু কাপড় পরিধান করে এবং শিব-গৌরি সেজে, কেউবা মুখোশ চাপিয়ে মাগন সংগ্রহ করেন। আয়োজনে বৈচিত্র্য থাকলেও চৈত্রসংক্রান্তির মূলে আছে সুস্থতার জন্য প্রকৃতির তিতারস গ্রহণ ও চারপাশের পরিচ্ছন্নতা। অনাগত রোগ ও মহামারী থেকে আসন্ন বছরকে সুরক্ষিত করতেই চৈত্রসংক্রান্তির সব আয়োজন।
হাজরা ও বাইশাখী
রবিদাসদের ভেতর বাইশাখী পূজা ও হাজরা-কৃত্যের মাধ্যমে বর্ষবিদায় পালিত হয়। এদিন যবের ছাতু ও কাঁচা আম একত্রে মিশিয়ে আম-ছাতুয়া খাওয়া হয়। মৌসুমি ফল আমকে বর্ষবিদায়ের এ রীতির ভেতর দিয়েই সমাজ গ্রহণ করে রোগব্যাধি সামাল দেয়ার জন্য। বছরের প্রথম দিন ঘরের দেওকুড়ি নামের পবিত্রস্থলে কর্মের পূজা করা হয়। রবিদাসদের ভেতর যে যে কর্মপেশায় জড়িত তারা সেই কর্মের সাথে জড়িত আনুষঙ্গিক উপকরণগুলো দেওকুড়িতে রাখে। হাতুড়ি, কোদাল, শাবল, কাঁচি, ছুরি, বাটাল যার কর্মে যা লাগে সব। কেবল মানুষ নয় এ সময় পেশায় জড়িত সব উপকরণ ও গৃহস্থালী সব কিছু ধোয়ামোছা করতে হয়।
চইত বিশমা
দিনাজপুরের বিরলের কড়া আদিবাসীরা চৈত্রসংক্রান্তিতে আয়োজন করেন চইতবিশমা। সংক্রান্তির কয়েকদিন আগ থেকেই পাড়া গ্রাম পরিচ্ছন্ন করা হয়, বহিরাগতদের গ্রামে প্রবেশ সীমিত করা হয়। চইতবিশমার দিনে নিমপাতার কাঁচা রস ও নানাপদের তিতাশাক খাওয়া হয়। পেঁয়াজ-রসুন-শুকনো মরিচ ঝুলানো হয় ঘরের দরজায়। কড়াদের প্রতিটি বাড়িতে পিড়াঘার নামে এক পবিত্র পূজাস্থল থাকে। এখানে চইতবিশমা পূজা শেষে হাড়িয়া পান ও নৃত্যগীতের আয়োজন হয়।
বাহা
ফৗগুন (ফাল্গুন) মাস থেকেই শুরু হয় সাঁওতালি বর্ষ। বর্ষ বিদায় ও বরণের উৎসব বাহাও পালিত হয় এ মাসেই। এ সময় গাছে গাছে সারজম, ইচৗক, মুরুপ্ আর মহুয়া ফুল ফোটে। বাহা পরবের ভেতর দিয়েই সাঁওতাল সমাজ এসব ফুলের মধু পান ও ব্যবহারের অনুমতি প্রার্থনা করে প্রকৃতির কাছে। বাহার আগে এসব ফুলের ব্যবহার সামাজিকভাবে নিষেধ। বাহা পরবে রোগজরা নিরাময়ে নতুন ফুলের স্পর্শ গ্রহণের ভেতর দিয়ে প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করে সাঁওতাল সমাজ।
হেচড়া
গোপালগঞ্জ-মাদারীপুরের চান্দারবিল এলাকায় হেচড়া দেবী পূজিত হন বসন্তকালে খোস-পাঁচড়া, বসন্ত, চুলকানি নিরাময়ের মানতে। এদিনে গো-ফাল্গুন রীতিও পালন করা হয়। গোবরের দলায় বউন্যা (বরুণ) ও ভাটির (ভাঁট) ফুল গেঁথে দিয়ে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকাতে ফাল্গুন মাসে এবং কোথাও চৈত্রসংক্রান্তিতে ভাঁট এবং বরুণ ফুল দিয়ে এ কৃত্য পালিত হয়।
পঞ্চমদোল
ফাল্গুনসংক্রান্তিতে আয়োজিত পঞ্চমদোল উৎসব বেশ কয়েকটি পর্ব ও আচারকৃত্যে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলে। প্রথম দোলভিটে মেরামত, তারপর দোলপূর্ণিমার প্রথম দিন কুড়া পোড়ান পর্ব, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন দোলপূজা, চতুর্থ দিন হোলি, পঞ্চম দিন পূণ্যাহ বা সমাপ্তি। দোলভিটের সামনে পূবমুখী করে বগাঝোল, বাইল্যাবাত, মধুশাইল, নেপালদীঘা, ভাওয়াইল্যা, কইতরমণি, পোখরাজ এরকম স্থানীয় আমন ধানের পল (খড়) ও মুলী বাঁশ দিয়ে পুরুষেরা কুড়াঘর তৈরি করেন। পঞ্চমদোলের প্রথম দিন এই কুড়া পোড়ানো হয়। গ্রাম থেকে অশান্তি, রোগশোক ও অশুভ শক্তিকে দূর করার জন্য এই কৃত্য পালিত হয়।
শীতলা পূজা
বসন্তরোগবিনাশী দেবী শীতলা। সারা গায়ে গুটি বসন্তের দাগ। ফাল্গুন-চৈত্রে আয়োজিত শীতলা পূজা ঘিরে নরসিংদী, গাজীপুর, মৌলভীবাজার, সিলেট, সাতক্ষীরাসহ দেশের নানাপ্রান্তেই জমে ওঠে রকমভিন্ন আয়োজন ও মেলা। গ্রামে গ্রামে শ্যাওড়া, বট, অশ্বত্থ, পাকুড়, ষষ্ঠী বট, খেজুর, বকুল গাছতলায় গড়ে ওঠেছে শীতলাতলা ও শীতলাথান। শীতলা পূজায় ১০৮টি মাটির ছোট প্রদীপ লাগে। একটি দেবী ঘট, একটি ফুল-জলের হাড়ি লাগে। এতে দুধ-বাতাসা-বেলপাতা-তুলসীপাতা-ডাবের জল মিশানো হয়। পূজার পরে সবাইকেই এটি খেতে দেয়া হয়। কেউ কেউ এটি শরীরে মাখেন। শেষে হোম যঞ্জের কালি ও ঘি একত্রে মিশিয়ে সবার মাথা-কপালে লাগানো হয়। সাতক্ষীরার সুন্দরবন অঞ্চলে প্রতি বছর মানুষের হাম-বসন্ত-পাতলা পায়খানা-জ্বর হলে এবং গরু-ছাগলের পশ্চিমে-গায়ে গুটি বের হলে, সর্দি লাগলে-পাতলা পায়খানা করলে শীতলা পূজার মানসী (মানত) করা হয়।
সারুল
অসুখ ও অশুভশক্তি থেকে গ্রামকে মুক্ত রাখতে বসন্তকালে মুন্ডারা পালন করে সারুল/সারহুল কৃত্য। সুন্দরবন অঞ্চলে এ পূজায় সিন্ধ্রি (সুন্দরী) গাছের পাতা লাগে। মাটির থানে ও ঘরের ভেতর পূজা হয়। কৃত্যকালীন সময়ে কঠোরভাবে বহিরাগতদের গ্রামে প্রবেশ সীমিত করা হয়।
ঘাটাবান্ধাবর্ত
হাওরাঞ্চলে বসন্তকালীন রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে এই ব্রত পালিত হয়। চালতাপাতা দিয়ে ঘাটা বাঁধা হয় এবং ঘরবাড়ির চারপাশ, জমিন ও গৃহপ্রবেশের মুখে এসব স্থাপন করা হয় যেন কোনো ব্যাধি ও অশুভ কিছু প্রবেশ না করতে পারে। একইভাবে কমপক্ষে আট রকমের শাকসবজি দিয়ে আটআনাজবর্তও পালিত হয় যাতে মানুষের শরীরে কোনো জরাব্যাধি প্রবেশ না করতে পারে।
সংক্রান্তির শক্তি
ষড় ঋতুর বাংলাদেশ এখন কত ঋতুর দেশ তা আরেক লম্বা তর্কের তল। প্রতিটি ঋতুর সন্ধিক্ষণ হলো সংক্রান্তি। আর এই সময়টা জরা-ব্যাধি জয় করে নতুন আরেক বছরের জন্য সঞ্জিবনী সঞ্চয়ের সময়। গ্রামীণ নি¤œবর্গ অসুখ ও মহামারীকে সামাল দিতেই সংক্রান্তির সময়গুলোতে নিজেদের নানা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। খাদ্য থেকে শুরু করে চারপাশের পরিচ্ছন্নতা, সাময়িক বিচ্ছিন্নতা থেকে নানামুখী সঙ্গনিরোধ এসব মিলিয়েই আমাদের সংক্রান্তি আয়োজন। সংক্রান্তি কেবল গাজনের গীত বা তিতাশাকের পরব নয়। মহামারী থেকে বাঁচার এক সামষ্টিক স্থানীয় কায়দা। প্রকৃতিকে জানা-বোঝার জন্য এক সামাজিক আহ্বান। সংক্রান্তিতেই সমাজ প্রকৃতির বিশেষ কিছু বিশেষভাবে গ্রহণ করে ও সামাজিক বিধিনিষেধগুলোর পাবলিক চর্চা করে। মূলত এর ভেতর দিয়ে সমাজ জানাতে চায় প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ হিসেবে আমাদের কিছু করণীয় ও বিধি আছে। এসব বিধিগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতেই সংক্রান্তির নানা কৃত্য আয়োজন। বাঙালি জনপদে চৈত্র মাসে শিমুইর (শিম), ফাল্গুনে মূলা, শ্রাবণে কচু, আষাঢ়ে ওল, জ্যৈষ্ঠে গিমাতিতা শাক, কার্তিকে ওল খায় না অনেকেই। গ্রামের প্রবীণ অনেকেই এখনও মনে করেন বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসে কোনো শস্য ফসল লাগাতে হয় না, কারণ এতে জ্যেষ্ঠ সন্তানের অমঙ্গল হয়। শ্রাবণ মাসে কলা গাছ লাগানোর নিয়ম নেই। শ্রাবণ মাসে মনসাবর্ত হয় এবং এর সাথে জড়িত বেহুলা-লক্ষিন্দরের কাহিনিতে বেহুলা কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে ছিল বলেই শ্রাবণ মাসে কলাগাছ পোঁতার নিয়ম নেই। শনি ও মঙ্গলবারে সাধারণত: কোনো শস্যফসল লাগানোর নিয়ম নেই। ত্রিসন্ধ্যা, সন্ধ্যা, রাত ও ভোর রাতে কোনো কিছু লাগানোর নিয়ম নেই। সমতল অঞ্চলের বাঙালি মুসলিম পরিবারের অনেকেই বুধবারে বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটে না, কারণ তারা বুধবারকে মাদারিয়া বার হিসেবে দেখে। মাদার পীরের বারকে মাদারিয়া বার বলে। টাঙ্গাইলের চারান বিলের বাঙালি জেলে পরিবারে রাগা মাছ খাওয়া হয় না। অনেকে বিশ্বাস করেন এই মাছ সর্পদর্শনের পর ভেলায় ভাসমান লক্ষিন্দরের পায়ের টাখনুগিরা খেয়ে ফেলেছিল। ঠিক যেমন সিলেটসহ দেশের অনেক অঞ্চলের বাঙালি মুসলিম পরিবার হযরত শাহজালালের স্মৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত বলে জালালি কবুতরের মাংস খান না। কিন্তু আমাদের তথাকথিত আধুনিক ও ‘সভ্য’ শহুরে সমাজে প্রতিদিন প্রকৃতির ব্যাকরণকে অমান্য ও তছনছ করা হয়। আমাদের নাগরিক জীবনে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ কোনো বিধিনিষেধ নেই। এখন সারা বছর বাজারমুখী শস্যফসল মেলে। কোনোকিছু দেখে বোঝার উপায় নেই এটা কোন ঋতু। আমরা তাহলে এমন করপোরেট ভোগবাদী উন্নয়ন দিয়ে কার লাভ আর কার ক্ষতি করছি? প্রকৃতির ধারাপাত চুরমার করে দিচ্ছি বলেই ইবোলা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, করোনা নানা মহামারীতে দুনিয়া বিপর্যস্ত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের গ্রামীণ নি¤œবর্গের সংক্রান্তি পালনের ভেতর প্রকৃতির বিজ্ঞানকে মান্য করার এক অবিস্মরণীয় শক্তি ও দর্শন আছে। ব্যক্তি নয়, সমষ্টির অভিজ্ঞতা আর প্রকৃতির প্রতি নতজানু হওয়ার ভেতর দিয়েই সব সংকট থেকে মুক্তির জন্য লড়েছে নি¤œবর্গ। বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের পরবগুলোও সেই শক্তিই জানান দেয়।
[লেখক : গবেষক, পরিবেশ-প্রতিবেশ]