alt

উপ-সম্পাদকীয়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

মনিরুজ্জামান মনির

: বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তিক শ্রমিক সংগঠন, অব্যবহৃত শ্রম আইন এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে আটকে থাকা কোটি শ্রমজীবী মানুষের করুণ বাস্তবতায় মহান মে দিবস আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

ইতিহাসের পটভূমি : শিকাগো থেকে আজকের ঢাকা

১৮৮৬ সালের ১ মে। শিকাগো শহরের হে মার্কেটে হাজারও শ্রমিক জড়ো হয়েছিলেন আট ঘণ্টা কর্মদিবস প্রতিষ্ঠার দাবিতে। শান্তিপূর্ণ সেই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে রক্তাক্ত হয় শ্রমিকরা। এই আত্মত্যাগের মাধ্যমেই বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আন্দোলনে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। সেই দিনটির স্মরণেই বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবসÑ মে দিবস।

বাংলাদেশেও এ দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়। থাকে র‍্যালি, আলোচনা, ছুটি; কিন্তু বাস্তবতা হলোÑএই দেশে শ্রমিক শ্রেণির একটি বিশাল অংশ এখনও কোনো ধরনের শ্রম অধিকার ভোগ করে না। শিকাগোর আত্মত্যাগ আজ ঢাকার কলকারখানার বাস্তবতায় নির্বাসিত।

বাংলাদেশের শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী : সংখ্যায় বিশাল, মর্যাদায় ক্ষুদ্র

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ (২০২২) অনুসারে, দেশে আনুমানিক ৬.৮ কোটি শ্রমজীবী মানুষ রয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৮৫% কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে, যেখানে নেই কোনো লিখিত চুক্তি, স্বাস্থ্যবীমা, কিংবা পেনশন সুবিধা। গার্মেন্টস, নির্মাণ, পরিবহন ও কৃষিখাতের শ্রমিকরা অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা, নিম্নমজুরি এবং অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হন। ২০২৩ সালে গাজীপুরে এক পোশাক কারখানায় আগুনে নিহত হন ১০ জন শ্রমিক। তদন্তে বেরিয়ে আসে, সেফটি এক্সিট তালাবদ্ধ ছিল। অথচ আইন অনুযায়ী, এটি একটি গুরুতর অপরাধ।

শ্রম আইন : আইন আছে, প্রয়োগ নেই

২০০৬ সালে প্রণীত এবং ২০১৩ সালে সংশোধিত বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার, ধর্মঘটের অধিকার, ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তাছাড়া ২০১৮ সালে শ্রম আইন পুনরায় সংশোধনের সময় আইএলওর সাথে সামঞ্জস্য রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। তবে বাস্তবে এসব অধিকার প্রায় অকার্যকর। শ্রমিক সংগঠন করতে গিয়ে বহু শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। আদালতে শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তিতে গড়ায় ৩-৫ বছর। আইএলও কমপ্লেইন্টস ডেটাবেইজে বাংলাদেশ ২০১৪ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত অন্তত ১২ বার শ্রম অধিকারের লঙ্ঘনের অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে।

রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির শিকার শ্রমিক সংগঠন : বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দলের নিজস্ব শ্রমিক শাখা রয়েছে। ফলে শ্রমিক সংগঠনগুলো স্বতন্ত্রভাবে শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে নয়, বরং দলের স্বার্থে পরিচালিত হয়।

১৯৮০-এর দশকে যেখানে একটি শক্তিশালী শ্রমিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল, বর্তমানে তা ভেঙে পড়েছে অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিভাজন ও নেতাদের সুবিধাবাদীতার কারণে। একই কারখানায় আজ তিনটি সংগঠন। একটির নেতৃত্বে আওয়ামী ঘরানার, অন্যটি বিএনপি, তৃতীয়টি বাম। এই বিভক্তির ফাঁকে শ্রমিকরা হারায় তাদের কণ্ঠস্বর।

পরিসংখ্যান যা অস্বস্তিকর বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি : আইএলও (২০২৩) : বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতে ৪৮% শ্রমিক অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য হন। বিলস রিপোর্ট (২০২২) : গড়ে প্রতি মাসে একজন শ্রমিক কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মারা যান। লেবার ফোর্স সার্ভে: প্রায় ৩.৫ কোটি নারী শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ১২% মাতৃত্বকালীন ছুটি পান। ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রার অফিস (২০২৩) : শ্রমিকদের ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদনের ৪৩% অগ্রাহ্য করা হয় রাজনৈতিক কারণে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে মে দিবসের তাৎপর্য কোথায়? প্রতি বছর মে দিবসে শোভাযাত্রা হয়, ফুলের তোড়া দেওয়া হয় শহীদ মিনারে, উচ্চারিত হয় শ্রমিক সংহতির প্রতিশ্রুতি; কিন্তু এরপর? বাকিটা বছর চলে শ্রমিক নিপীড়নের চক্র। শ্রমিকরা নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি ও স্বাস্থ্যসেবার অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করেন। অথচ এই শ্রমিকদের ঘামেই দাঁড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত থেকেই আসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮২%। অথচ এই খাতের শ্রমিকরাই সবচেয়ে অবহেলিত।

সমাধানের পথ কী?

শ্রম আইন বাস্তবায়নে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু আইন থাকা নয়, তার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। শ্রম আদালতের সংস্কার ও ডিজিটালাইজেশন প্রয়োজন। দ্রুত বিচার নিশ্চিতে সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, স্বতন্ত্র শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলা জরুরি। নিবন্ধনের প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য একটি বিশেষ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে তাদের স্বাস্থ্য, আবাসন ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ বাস্তবায়নে একটি নিরপেক্ষ মনিটরিং সেল গঠন করা উচিত। যেখানে থাকবে সরকার, শ্রমিক প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ।

মে দিবস যেন স্মারকই না হয়, হয় শপথের দিন : মে দিবস শুধু অতীতের গৌরব নয়, এটি ভবিষ্যতের প্রেরণাও। বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ আজও রক্ত ঝরাচ্ছে অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে; কিন্তু তাদের কণ্ঠ আজও চাপা পড়ে রাজনৈতিক লাঠিয়াল বাহিনীর নিচে। এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার আইন দিয়ে, নীতি দিয়ে; কিন্তু সবচেয়ে বেশি দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা দিয়ে।

আমাদের প্রজন্ম যদি শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নের শপথ না নেয়, তাহলে মে দিবস আমাদের কাছে শুধু একটি ইতিহাস হবে; যা আমরা প্রতি বছর স্মরণ করবো, কিন্তু তার শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবো।

[লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি]

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মে দিবসের চেতনা বনাম বাস্তবতা

মনিরুজ্জামান মনির

বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তিক শ্রমিক সংগঠন, অব্যবহৃত শ্রম আইন এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে আটকে থাকা কোটি শ্রমজীবী মানুষের করুণ বাস্তবতায় মহান মে দিবস আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

ইতিহাসের পটভূমি : শিকাগো থেকে আজকের ঢাকা

১৮৮৬ সালের ১ মে। শিকাগো শহরের হে মার্কেটে হাজারও শ্রমিক জড়ো হয়েছিলেন আট ঘণ্টা কর্মদিবস প্রতিষ্ঠার দাবিতে। শান্তিপূর্ণ সেই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে রক্তাক্ত হয় শ্রমিকরা। এই আত্মত্যাগের মাধ্যমেই বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আন্দোলনে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। সেই দিনটির স্মরণেই বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবসÑ মে দিবস।

বাংলাদেশেও এ দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়। থাকে র‍্যালি, আলোচনা, ছুটি; কিন্তু বাস্তবতা হলোÑএই দেশে শ্রমিক শ্রেণির একটি বিশাল অংশ এখনও কোনো ধরনের শ্রম অধিকার ভোগ করে না। শিকাগোর আত্মত্যাগ আজ ঢাকার কলকারখানার বাস্তবতায় নির্বাসিত।

বাংলাদেশের শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী : সংখ্যায় বিশাল, মর্যাদায় ক্ষুদ্র

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ (২০২২) অনুসারে, দেশে আনুমানিক ৬.৮ কোটি শ্রমজীবী মানুষ রয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৮৫% কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে, যেখানে নেই কোনো লিখিত চুক্তি, স্বাস্থ্যবীমা, কিংবা পেনশন সুবিধা। গার্মেন্টস, নির্মাণ, পরিবহন ও কৃষিখাতের শ্রমিকরা অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা, নিম্নমজুরি এবং অনিরাপদ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হন। ২০২৩ সালে গাজীপুরে এক পোশাক কারখানায় আগুনে নিহত হন ১০ জন শ্রমিক। তদন্তে বেরিয়ে আসে, সেফটি এক্সিট তালাবদ্ধ ছিল। অথচ আইন অনুযায়ী, এটি একটি গুরুতর অপরাধ।

শ্রম আইন : আইন আছে, প্রয়োগ নেই

২০০৬ সালে প্রণীত এবং ২০১৩ সালে সংশোধিত বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার, ধর্মঘটের অধিকার, ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তাছাড়া ২০১৮ সালে শ্রম আইন পুনরায় সংশোধনের সময় আইএলওর সাথে সামঞ্জস্য রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। তবে বাস্তবে এসব অধিকার প্রায় অকার্যকর। শ্রমিক সংগঠন করতে গিয়ে বহু শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। আদালতে শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তিতে গড়ায় ৩-৫ বছর। আইএলও কমপ্লেইন্টস ডেটাবেইজে বাংলাদেশ ২০১৪ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত অন্তত ১২ বার শ্রম অধিকারের লঙ্ঘনের অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে।

রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির শিকার শ্রমিক সংগঠন : বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দলের নিজস্ব শ্রমিক শাখা রয়েছে। ফলে শ্রমিক সংগঠনগুলো স্বতন্ত্রভাবে শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে নয়, বরং দলের স্বার্থে পরিচালিত হয়।

১৯৮০-এর দশকে যেখানে একটি শক্তিশালী শ্রমিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল, বর্তমানে তা ভেঙে পড়েছে অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিভাজন ও নেতাদের সুবিধাবাদীতার কারণে। একই কারখানায় আজ তিনটি সংগঠন। একটির নেতৃত্বে আওয়ামী ঘরানার, অন্যটি বিএনপি, তৃতীয়টি বাম। এই বিভক্তির ফাঁকে শ্রমিকরা হারায় তাদের কণ্ঠস্বর।

পরিসংখ্যান যা অস্বস্তিকর বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি : আইএলও (২০২৩) : বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতে ৪৮% শ্রমিক অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য হন। বিলস রিপোর্ট (২০২২) : গড়ে প্রতি মাসে একজন শ্রমিক কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মারা যান। লেবার ফোর্স সার্ভে: প্রায় ৩.৫ কোটি নারী শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ১২% মাতৃত্বকালীন ছুটি পান। ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রার অফিস (২০২৩) : শ্রমিকদের ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদনের ৪৩% অগ্রাহ্য করা হয় রাজনৈতিক কারণে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে মে দিবসের তাৎপর্য কোথায়? প্রতি বছর মে দিবসে শোভাযাত্রা হয়, ফুলের তোড়া দেওয়া হয় শহীদ মিনারে, উচ্চারিত হয় শ্রমিক সংহতির প্রতিশ্রুতি; কিন্তু এরপর? বাকিটা বছর চলে শ্রমিক নিপীড়নের চক্র। শ্রমিকরা নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি ও স্বাস্থ্যসেবার অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করেন। অথচ এই শ্রমিকদের ঘামেই দাঁড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত থেকেই আসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮২%। অথচ এই খাতের শ্রমিকরাই সবচেয়ে অবহেলিত।

সমাধানের পথ কী?

শ্রম আইন বাস্তবায়নে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু আইন থাকা নয়, তার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। শ্রম আদালতের সংস্কার ও ডিজিটালাইজেশন প্রয়োজন। দ্রুত বিচার নিশ্চিতে সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, স্বতন্ত্র শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলা জরুরি। নিবন্ধনের প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য একটি বিশেষ নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে তাদের স্বাস্থ্য, আবাসন ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ বাস্তবায়নে একটি নিরপেক্ষ মনিটরিং সেল গঠন করা উচিত। যেখানে থাকবে সরকার, শ্রমিক প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ।

মে দিবস যেন স্মারকই না হয়, হয় শপথের দিন : মে দিবস শুধু অতীতের গৌরব নয়, এটি ভবিষ্যতের প্রেরণাও। বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ আজও রক্ত ঝরাচ্ছে অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে; কিন্তু তাদের কণ্ঠ আজও চাপা পড়ে রাজনৈতিক লাঠিয়াল বাহিনীর নিচে। এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার আইন দিয়ে, নীতি দিয়ে; কিন্তু সবচেয়ে বেশি দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা দিয়ে।

আমাদের প্রজন্ম যদি শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নের শপথ না নেয়, তাহলে মে দিবস আমাদের কাছে শুধু একটি ইতিহাস হবে; যা আমরা প্রতি বছর স্মরণ করবো, কিন্তু তার শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবো।

[লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি]

back to top