অমৃত চিছাম
পৃথিবী পৃষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগ জল ও এক ভাগ স্থল। সমুদ্রের এ বিশাল অংশের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অপার সম্ভাবনা। জলরাশির অফুরন্ত একটি রতœভা-ার হলো সমুদ্র। সমুদ্র পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সমুদ্র পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জীববৈচিত্র্যের আধার এবং আমাদের পরিবেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সমুদ্র পৃথিবীর প্রায় ৮০% জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল। সমুদ্র কেবল পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের একটি বড় অংশের আবাসস্থল নয়, বরং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বর্তমানে অতিরিক্ত শোষণ, দূষণ এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের সম্পদ হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।
শুরুতেই ছোট করে জেনে নেয়া যাক সমুদ্রসম্পদ বিষয়টি আসলে কী? সমুদ্রসম্পদ বলতে বোঝানো হয় সমুদ্রের ভেতরে এবং আশপাশে থাকা প্রাকৃতিক ও জীবজ সম্পদ, যা মানুষের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়নে মহাগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বব্যাপী প্রোটিনের চাহিদার প্রায় ২০% পূরণ করা হয় সমুদ্রজাত খাবার থেকে। প্রাচীন সভ্যতাগুলো সমুদ্রের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল; যেমন- ফিনিসীয় এবং গ্রিকরা সমুদ্রপথে বাণিজ্য পরিচলনা করত। তারা মাছ ধরার পাশাপাশি সমুদ্রের মাধ্যমে বাণিজ্য পরিচালনা করত। সমুদ্রের মধ্য দিয়ে বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল এবং এই পথে বহু মূল্যবান সামগ্রী, যেমন- মসলা, রেশম এবং স্বর্ণ, এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাঠানো হতো। ১৭শ শতকের দিকে ইউরোপীয় দেশগুলো সমুদ্রসম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি গভীর মনোযোগ দেয়। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা নতুন অঞ্চল থেকে সম্পদ আহরণ করতে শুরু করেছিল, যেমন- তামা, স্বর্ণ, রেশম এবং চিনি। এই সময়ে মাছ ধরার পাশাপাশি তেল এবং গ্যাস অনুসন্ধানও শুরু হয়েছিল। ২০ শতকের মাঝামাঝি থেকে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, এবং মিনারেল খনিজসম্পদ সমুদ্র থেকে আহরণ করা শুরু হয়। বিশেষ করে ১৯৫০-৬০ দশক থেকে ডিপওয়টার ড্রিলিং এবং সি-বেড মাইনিং বৃদ্ধি পেয়েছে। সমুদ্র পরিবহন এবং বাণিজ্যিক মাছ ধরার পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিশ্বের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে। সমুদ্রের প্রবালপ্রাচীর, সামুদ্রিক গাছপালা এবং মাছসহ অন্যান্য জীব সারা বিশ্বের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে। এই জীববৈচিত্র্য নষ্ট হলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে তা সহজেই অনুমেয়। সমুদ্র পৃথিবীর কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে ও পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের প্রায় ৫০-৮০% আসে সমুদ্র থেকে, যা প্রধানত ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন নামক সামুদ্রিক অনুজীব দ্বারা উৎপন্ন হয়। সমুদ্র প্রতি বছর প্রায় ৯৩০ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে। কিন্তু দূষণ এবং অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে এই কার্যক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
সমুদ্র পৃথিবীর জলচক্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি বৃষ্টিপাত, মিঠাপানির প্রাপ্যতা এবং স্থলজ জীববৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলে। সমুদ্রের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা বাড়ে। উন্নত প্রযুক্তি ও টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক জীবের আহরণ বাড়নো যায়, যা জেলেদের আয় বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ২০০ মিলিয়ন টন মাছ ধরার মধ্যে ৭৫% এর বেশি সামুদ্রিক মাছ, আর বাকি মাছ অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে আহরণ করা হয়। বিশ্ব মৎস্য শিল্পের বার্ষিক আয় প্রায় ৪০৭ বিলিয়ন ডলার। সমুদ্রতল থেকে তেল ও গ্যাস উত্তোলন করে জ্বালানি নিরাপত্তা ও রপ্তানি আয় বাড়ানো যায়।
২০২১ সালে, সমুদ্রের তলদেশ থেকে বিশ্বের প্রাকৃতিক গ্যাসের ৩০% এবং তেলের ২৫% সংগ্রহ করা হয়েছিল। সমুদ্রের তলদেশে প্রায় ৮৪ বিলিয়ন টন তেল ও গ্যাস রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। সুন্দর সমুদ্রসৈকত ও উপকূলীয় এলাকা পর্যটকদের আকর্ষণ করে, যা পর্যটন খাতের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। নীল অর্থনীতির একটি বড় অংশ হলো সামুদ্রিক পর্যটন। বিশ্ব পর্যটন শিল্পের প্রায় ১০% অর্থ আসে সামুদ্রিক পর্যটন থেকে। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন করে বাণিজ্য বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করা যায়। প্রতি বছর বিশ্বের ৯০% পণ্য সমুদ্রপথে পরিবহন করা হয়। এটি পৃথিবীর মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ ট্রিলিয়ন ডলার। টেকসইভাবে সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহারে পরিবেশ রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সম্ভব, যা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। বর্তমানে সমুদ্রের গভীর অংশ থেকে খনিজ আহরণের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে; যেমন- ম্যাঙ্গানিজ, কপার, এবং নিকেল সমৃদ্ধ খনিজ খনির জন্য বিভিন্ন দেশ সমুদ্র থেকে সম্পদ আহরণ করছে।
সমুদ্রের এত এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক হারে সমুদ্রদূষণের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। প্রতি বছর প্রায় ৮-১০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সমুদ্রে জমা হয়। এই প্লাস্টিক দূষণের ফলে প্রায় ১০০,০০০ সামুদ্রিক প্রাণী এবং ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি প্রতি বছর মারা যায়। বিশ্বজুড়ে বছরে প্রায় ১.৩ মিলিয়ন টন তেল দুর্ঘটনার কারণে সমুদ্রে পড়ে যায়। সমুদ্রের ৪০০টিরও বেশি ডেড জোন (অক্সিজেন শূন্য এলাকা) রয়েছে, যা প্রায় ২৪৫,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। নাইট্রেট ও ফসফেটের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে পানিতে শৈবালের বিস্তার ঘটে, যা সামুদ্রিক প্রাণের জন্য ক্ষতিকর।
সমুদ্রদূষণের প্রভাবে ব্যাপক হারে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে। ১৯৭১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা প্রায় ০.১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। ১৯০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সমুদ্রের স্তর প্রতি বছর গড়ে ১.৩ মিমি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এই হার প্রায় ৩.৭ মিমি/বছর। ২০৫০ সালের মধ্যে বর্তমান প্রবালপ্রাচীরের ৯০% ধ্বংস হতে পারে যদি গ্লোবাল ওয়ার্মিং ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে। তবে আশার কথা হলো এই যে, বর্তমানে সারাবিশ্ব সমুদ্রের প্রায় ৭.৯৩% অংশ মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া হিসেবে সংরক্ষিত। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৩০% করার লক্ষ্য রয়েছে। সামুদ্রিক বায়ু শক্তি উৎপাদন ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫৬ গিগাওয়াট হয়েছিল, যা ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এর আওতায় লক্ষ্যমাত্রা ১৪ গৃহীত হয়, যা পরবর্তীতে সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
সমুদ্রের সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলোÑ
১. জাতিসংঘ সমুদ্র আইন কনভেনশন, ১৯৮২ এটি সমুদ্রের সংবিধান হিসেবে পরিচিত। এই কনভেনশন আন্তর্জাতিকভাবে সমুদ্রের ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং সীমান্ত নির্ধারণে আইনগত কাঠামো প্রদান করে। ২. লন্ডন কনভেনশন (১৯৭২) ও লন্ডন প্রোটোকল (১৯৯৬) সমুদ্রে বর্জ্য ফেলা এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে এই কনভেনশন গৃহীত হয়। ৩. গঅজচঙখ কনভেনশন (১৯৭৩/১৯৭৮) আন্তর্জাতিক সমুদ্রদূষণ প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইন। জাহাজ থেকে তেল, রাসায়নিক ও প্লাস্টিক দূষণ রোধে কঠোর বিধান প্রদান করে।
৪. সিটেস (১৯৭৩) বিপন্ন সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষত হাঙ্গর, কচ্ছপ, প্রবাল, তিমি ইত্যাদির অনিয়ন্ত্রিত শিকার ও ব্যবসা বন্ধ করতে কাজ করে।
৫. বাসেল কনভেনশন (১৯৮৯) বিপজ্জনক বর্জ্য সামগ্রীর আন্তর্জাতিক পরিবহন ও নিষ্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করে। সমুদ্রে বর্জ্য ফেলার ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিরোধে কাজ করে।
৬. প্যারিস চুক্তি (২০১৫) ও জলবায়ু পরিবর্তনসম্পর্কিত অন্যান্য আইন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
৭. রামসার কনভেনশন (১৯৭১) সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। ৮. ঋঅঙ-এর দায়িত্বশীল মৎস্যচাষ নীতিমালা অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ রোধ, বৈজ্ঞানিক উপায়ে সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর সংরক্ষণ নিশ্চিত করা হয়। ৯.আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশন এর আইন সামুদ্রিক পরিবহন ও নৌযান থেকে দূষণ প্রতিরোধে কাজ করে।
সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণে আইন ও নীতিমালার যথাযথ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, টেকসই মৎস্য আহরণ, খনিজ উত্তোলন এবং পরিবেশবান্ধব জাহাজ নির্মাণে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, সাধারণ মানুষের মধ্যে সমুদ্রের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, সীমান্ত পেরিয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধি, সর্বোপরি শিল্পবর্জ্য এবং প্লাস্টিক দূষণ রোধে কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সমুদ্রসম্পদ শুধু বর্তমান প্রজন্মের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কিত এবং সমুদ্রসম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা ছাড়া এই ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব নয়। তাই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, নীতি এবং জনসচেতনতার সমন্বয় করে সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
[লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয় ত্রিশাল]
অমৃত চিছাম
শনিবার, ০৩ মে ২০২৫
পৃথিবী পৃষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগ জল ও এক ভাগ স্থল। সমুদ্রের এ বিশাল অংশের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অপার সম্ভাবনা। জলরাশির অফুরন্ত একটি রতœভা-ার হলো সমুদ্র। সমুদ্র পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সমুদ্র পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জীববৈচিত্র্যের আধার এবং আমাদের পরিবেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সমুদ্র পৃথিবীর প্রায় ৮০% জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল। সমুদ্র কেবল পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের একটি বড় অংশের আবাসস্থল নয়, বরং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বর্তমানে অতিরিক্ত শোষণ, দূষণ এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের সম্পদ হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।
শুরুতেই ছোট করে জেনে নেয়া যাক সমুদ্রসম্পদ বিষয়টি আসলে কী? সমুদ্রসম্পদ বলতে বোঝানো হয় সমুদ্রের ভেতরে এবং আশপাশে থাকা প্রাকৃতিক ও জীবজ সম্পদ, যা মানুষের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়নে মহাগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বব্যাপী প্রোটিনের চাহিদার প্রায় ২০% পূরণ করা হয় সমুদ্রজাত খাবার থেকে। প্রাচীন সভ্যতাগুলো সমুদ্রের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল; যেমন- ফিনিসীয় এবং গ্রিকরা সমুদ্রপথে বাণিজ্য পরিচলনা করত। তারা মাছ ধরার পাশাপাশি সমুদ্রের মাধ্যমে বাণিজ্য পরিচালনা করত। সমুদ্রের মধ্য দিয়ে বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল এবং এই পথে বহু মূল্যবান সামগ্রী, যেমন- মসলা, রেশম এবং স্বর্ণ, এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাঠানো হতো। ১৭শ শতকের দিকে ইউরোপীয় দেশগুলো সমুদ্রসম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি গভীর মনোযোগ দেয়। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা নতুন অঞ্চল থেকে সম্পদ আহরণ করতে শুরু করেছিল, যেমন- তামা, স্বর্ণ, রেশম এবং চিনি। এই সময়ে মাছ ধরার পাশাপাশি তেল এবং গ্যাস অনুসন্ধানও শুরু হয়েছিল। ২০ শতকের মাঝামাঝি থেকে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, এবং মিনারেল খনিজসম্পদ সমুদ্র থেকে আহরণ করা শুরু হয়। বিশেষ করে ১৯৫০-৬০ দশক থেকে ডিপওয়টার ড্রিলিং এবং সি-বেড মাইনিং বৃদ্ধি পেয়েছে। সমুদ্র পরিবহন এবং বাণিজ্যিক মাছ ধরার পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিশ্বের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছে। সমুদ্রের প্রবালপ্রাচীর, সামুদ্রিক গাছপালা এবং মাছসহ অন্যান্য জীব সারা বিশ্বের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে। এই জীববৈচিত্র্য নষ্ট হলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে তা সহজেই অনুমেয়। সমুদ্র পৃথিবীর কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে ও পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের প্রায় ৫০-৮০% আসে সমুদ্র থেকে, যা প্রধানত ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন নামক সামুদ্রিক অনুজীব দ্বারা উৎপন্ন হয়। সমুদ্র প্রতি বছর প্রায় ৯৩০ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে। কিন্তু দূষণ এবং অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে এই কার্যক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
সমুদ্র পৃথিবীর জলচক্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি বৃষ্টিপাত, মিঠাপানির প্রাপ্যতা এবং স্থলজ জীববৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলে। সমুদ্রের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা বাড়ে। উন্নত প্রযুক্তি ও টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক জীবের আহরণ বাড়নো যায়, যা জেলেদের আয় বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ২০০ মিলিয়ন টন মাছ ধরার মধ্যে ৭৫% এর বেশি সামুদ্রিক মাছ, আর বাকি মাছ অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে আহরণ করা হয়। বিশ্ব মৎস্য শিল্পের বার্ষিক আয় প্রায় ৪০৭ বিলিয়ন ডলার। সমুদ্রতল থেকে তেল ও গ্যাস উত্তোলন করে জ্বালানি নিরাপত্তা ও রপ্তানি আয় বাড়ানো যায়।
২০২১ সালে, সমুদ্রের তলদেশ থেকে বিশ্বের প্রাকৃতিক গ্যাসের ৩০% এবং তেলের ২৫% সংগ্রহ করা হয়েছিল। সমুদ্রের তলদেশে প্রায় ৮৪ বিলিয়ন টন তেল ও গ্যাস রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। সুন্দর সমুদ্রসৈকত ও উপকূলীয় এলাকা পর্যটকদের আকর্ষণ করে, যা পর্যটন খাতের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। নীল অর্থনীতির একটি বড় অংশ হলো সামুদ্রিক পর্যটন। বিশ্ব পর্যটন শিল্পের প্রায় ১০% অর্থ আসে সামুদ্রিক পর্যটন থেকে। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন করে বাণিজ্য বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করা যায়। প্রতি বছর বিশ্বের ৯০% পণ্য সমুদ্রপথে পরিবহন করা হয়। এটি পৃথিবীর মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ ট্রিলিয়ন ডলার। টেকসইভাবে সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহারে পরিবেশ রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সম্ভব, যা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। বর্তমানে সমুদ্রের গভীর অংশ থেকে খনিজ আহরণের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে; যেমন- ম্যাঙ্গানিজ, কপার, এবং নিকেল সমৃদ্ধ খনিজ খনির জন্য বিভিন্ন দেশ সমুদ্র থেকে সম্পদ আহরণ করছে।
সমুদ্রের এত এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক হারে সমুদ্রদূষণের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। প্রতি বছর প্রায় ৮-১০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সমুদ্রে জমা হয়। এই প্লাস্টিক দূষণের ফলে প্রায় ১০০,০০০ সামুদ্রিক প্রাণী এবং ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি প্রতি বছর মারা যায়। বিশ্বজুড়ে বছরে প্রায় ১.৩ মিলিয়ন টন তেল দুর্ঘটনার কারণে সমুদ্রে পড়ে যায়। সমুদ্রের ৪০০টিরও বেশি ডেড জোন (অক্সিজেন শূন্য এলাকা) রয়েছে, যা প্রায় ২৪৫,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। নাইট্রেট ও ফসফেটের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে পানিতে শৈবালের বিস্তার ঘটে, যা সামুদ্রিক প্রাণের জন্য ক্ষতিকর।
সমুদ্রদূষণের প্রভাবে ব্যাপক হারে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে। ১৯৭১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা প্রায় ০.১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। ১৯০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সমুদ্রের স্তর প্রতি বছর গড়ে ১.৩ মিমি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এই হার প্রায় ৩.৭ মিমি/বছর। ২০৫০ সালের মধ্যে বর্তমান প্রবালপ্রাচীরের ৯০% ধ্বংস হতে পারে যদি গ্লোবাল ওয়ার্মিং ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে। তবে আশার কথা হলো এই যে, বর্তমানে সারাবিশ্ব সমুদ্রের প্রায় ৭.৯৩% অংশ মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া হিসেবে সংরক্ষিত। ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৩০% করার লক্ষ্য রয়েছে। সামুদ্রিক বায়ু শক্তি উৎপাদন ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫৬ গিগাওয়াট হয়েছিল, যা ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এর আওতায় লক্ষ্যমাত্রা ১৪ গৃহীত হয়, যা পরবর্তীতে সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
সমুদ্রের সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলোÑ
১. জাতিসংঘ সমুদ্র আইন কনভেনশন, ১৯৮২ এটি সমুদ্রের সংবিধান হিসেবে পরিচিত। এই কনভেনশন আন্তর্জাতিকভাবে সমুদ্রের ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং সীমান্ত নির্ধারণে আইনগত কাঠামো প্রদান করে। ২. লন্ডন কনভেনশন (১৯৭২) ও লন্ডন প্রোটোকল (১৯৯৬) সমুদ্রে বর্জ্য ফেলা এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে এই কনভেনশন গৃহীত হয়। ৩. গঅজচঙখ কনভেনশন (১৯৭৩/১৯৭৮) আন্তর্জাতিক সমুদ্রদূষণ প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইন। জাহাজ থেকে তেল, রাসায়নিক ও প্লাস্টিক দূষণ রোধে কঠোর বিধান প্রদান করে।
৪. সিটেস (১৯৭৩) বিপন্ন সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষত হাঙ্গর, কচ্ছপ, প্রবাল, তিমি ইত্যাদির অনিয়ন্ত্রিত শিকার ও ব্যবসা বন্ধ করতে কাজ করে।
৫. বাসেল কনভেনশন (১৯৮৯) বিপজ্জনক বর্জ্য সামগ্রীর আন্তর্জাতিক পরিবহন ও নিষ্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করে। সমুদ্রে বর্জ্য ফেলার ক্ষতিকর প্রভাব প্রতিরোধে কাজ করে।
৬. প্যারিস চুক্তি (২০১৫) ও জলবায়ু পরিবর্তনসম্পর্কিত অন্যান্য আইন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
৭. রামসার কনভেনশন (১৯৭১) সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। ৮. ঋঅঙ-এর দায়িত্বশীল মৎস্যচাষ নীতিমালা অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ রোধ, বৈজ্ঞানিক উপায়ে সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর সংরক্ষণ নিশ্চিত করা হয়। ৯.আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশন এর আইন সামুদ্রিক পরিবহন ও নৌযান থেকে দূষণ প্রতিরোধে কাজ করে।
সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণে আইন ও নীতিমালার যথাযথ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, টেকসই মৎস্য আহরণ, খনিজ উত্তোলন এবং পরিবেশবান্ধব জাহাজ নির্মাণে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, সাধারণ মানুষের মধ্যে সমুদ্রের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, সীমান্ত পেরিয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধি, সর্বোপরি শিল্পবর্জ্য এবং প্লাস্টিক দূষণ রোধে কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সমুদ্রসম্পদ শুধু বর্তমান প্রজন্মের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কিত এবং সমুদ্রসম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা ছাড়া এই ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব নয়। তাই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, নীতি এবং জনসচেতনতার সমন্বয় করে সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
[লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয় ত্রিশাল]