জিয়াউদ্দীন আহমেদ
আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় থাকেন লন্ডনে। তিনি মূলত সাংবাদিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকেই সাংবাদিকতা করে আসছেন; প্রথমে প্রিন্ট মিডিয়ায়, পরে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, শুধু সংশ্লিষ্ট বললে ঠিক হবে না, বিএনপির অন্ধভক্তও। জিয়াউর রহমানের ওপর একটি বইও লিখেছেন। তবে অন্ধ হলেও আমার আত্মীয়টি অবিবেচক নন, বিবেক-বুদ্ধি আছে। সামাজিক সম্পর্ক ব্যাপক, সারা পৃথিবীর প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের সঙ্গে সে জড়িত। লন্ডন থেকে ঢাকায় এলে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টকশোতে অংশগ্রহণ করেন।
টকশো দেখার জন্য তিনি কখনো আমাদের আগাম বলে রাখেন না; তবে তার স্ত্রী মাঝে মাঝে আমাদের খবর দেয়। বর্তমানের টকশো অসহনীয় বিরক্তিকর, একাধিক ব্যক্তির অংশগ্রহণ থাকলেও সবাই এক সুরে কথা বলেÑ একতরফা, একচেটিয়া স্বৈরাচার আর ফ্যাসিবাদের কাহিনী। অবশ্য এখন ভিন্নমতের কারো সাহস নেই ভিন্নমত পোষণ করার। ভিন্নমত প্রকাশ পেলেই আওয়ামী লীগের ট্যাগ লাগানো হয়। ‘রাজাকার’ নাম দিয়ে বিরোধীদের একই ট্যাগ লাগানো হতো আওয়ামী লীগ আমলে। ট্যাগ লাগলে এখন কী হয় তা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর দরকার আছে বলে মনে হয় না। স্বয়ং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা থানায় থানায় গিয়ে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়ে এসেছেন; পুলিশ ব্যবস্থা না নিলে তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। ‘মব ভায়োলেন্স’ তো আছেই। তাই টকশোতে ভিন্নমতের প্রত্যাশা আপাতত স্থগিত রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টকশোতে আওয়ামী লীগকে হারপিক দিয়ে ধুয়ে ফেলা হতো। আজ যারা বাকপটু বক্তা তারা এই গুণ অর্জন করেছেন আওয়ামী লীগ আমলেই। দেশের বাইরে অবস্থান করে যারা ইউটিউব চ্যানেলে কথা বলেছেন তাদের কথা বলছি না, বলছি দেশের অভ্যন্তরে বসে যারা আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচনা করেছেন তাদের কথা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা ছাড়াও যারা আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক ছিলেন তাদের কেউ কেউ আজ অন্তর্বর্তী সরকারেরও সমালোচনা করছেন, তবে সংখ্যায় তিন-চারজনের বেশি নয়। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে অংশীজন ছিলেন বলেই কথা বলতে পারছেন, নতুবা সারা মিডিয়া আজ মব ভায়োলেন্সের ভয়ে শাসকের সভাকবিতে পরিণত হয়েছে।
সমস্যা হয়ে গেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের, আমলাতন্ত্রে তাদের নিজস্ব কোন লোক নেই, সব দখল করে নিয়েছে এবং নিচ্ছে বিএনপি আর জামায়াতে ইসলাম। এটা স্বাভাবিক; কারণ জাতীয় নাগরিক পার্টি হয়েছে মাত্র কয়েক দিন আগে। তাদের একমাত্র অভিভাবক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাই ড. ইউনূসকে বারবার ঐক্যের কথা বলতে হয়, বলতে হয় এক পরিবারের কথা। ড. ইউনূস জানেন বিএনপি বিরোধিতা করলে শুধু জামায়াতে ইসলামের সহযোগিতায় অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘদিন টিকে থাকা কঠিন হবে। তবে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও ঐক্য রক্ষায় তার খুব বেশি কৃতিত্ব নেই, কৃতিত্ব আছে আওয়ামী লীগের। হেফাজতে ইসলাম, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলাম আওয়ামী লীগকে শুধু প্রতিপক্ষ নয়, শত্রুও মনে করে। তাই কেবল আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন রোধে এরা ড. ইউনূসের আহ্বান ছাড়াই ঐক্যবদ্ধ থাকবে।
কখন নির্বাচন হবে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিএনপির ধারণা নির্বাচন দিলে তারা ক্ষমতায় আসবে। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের শূন্যতায় বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামের জনভিত্তি ব্যাপক হলেও বিএনপির জনভিত্তি তুলনামূলক বিচারে আরেকটু বেশি। তাই বিএনপি নির্বাচনের জন্য তাড়াহুড়ো করছে। এই তাড়াহুড়ো যে কোন জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের জন্য স্বাভাবিক। কারণ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই বিএনপি রাজনীতি করে। তারা আরও কয়েকবার ক্ষমতায় ছিল, তাই বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি বলার সুযোগ পেয়েছে, ‘এক দুর্নীতিবাজ সরকারকে সরিয়ে আরেক দুর্নীতিবাজ সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য গণআন্দোলন হয়নি’। জনগণের কিয়দংশ কথাটি বিশ্বাস করে, এবং বিশ্বাস করে বলেই অনেকে ইদানীং নতুন করে জামায়াত এবং ড. ইউনূসের সমর্থক হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপর সারা দেশে বিএনপির কর্মীরা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়ে নিজেদের মালিকানা স্বত্ব কায়েম করেছে। এতে কোন সমস্যা নেই, কারণ সরকার পরিবর্তন হলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দখলদারিত্বের পরিবর্তন হয়, জনগণের কাছে এই বিষয়টি পরিচিত। কিন্তু ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপির কর্মীদের চাঁদাবাজি এবার নির্যাতনে পর্যবসিত হয়েছে, যা বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ছিল ৯০ দিন। কিন্তু ২০০৭ সালে এক-এগারোর পর জরুরি অবস্থার সরকার ক্ষমতায় ছিল দুই বছর। এই দুই বছর মেয়াদের পক্ষে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বক্তব্য দিয়ে সেনা-সমর্থিত ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের সরকারকে জায়েজ ও হালাল করে দিয়েছিলেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কথা হচ্ছে, বিপ্লব আর গণঅভ্যুত্থানে আইন মানার দরকার হয় না; তাই জনসমর্থন আর সেনা সমর্থন থাকলে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা কোন সমস্যা নয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সামরিক শাসন জায়েজ করতে আজ পর্যন্ত কোন সমস্যা হয়নি। পাকিস্তান সব সামরিক শাসনকে ‘ডকট্রিন অব ন্যাসেসিটি’ দ্বারা জায়েজ করে নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি প্রচারণা জোরসে চলছে, তা হচ্ছে ড. ইউনূসকে আরও সময় দেয়া হোক। বিএনপি নির্বাচনের জন্য বললেও ড. ইউনূসকে কিছু সময় দিতে তারা অকৃপণ বলে মনে হয় না। কারণ আছে।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যত মামলা-হামলা হচ্ছে তার দায় অন্তর্বর্তী সরকারের, এই দায় পরবর্তীকালে বিএনপি বা জামায়াত কারো ওপর বর্তাবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে সব মামলায় বিএনপির নেতাদের শাস্তি হয়েছে, সে সব মামলার অধিকাংশ দায়ের হয়েছিল ড. ফখরউদ্দীনের শাসনামলে, আওয়ামী লীগ তার দায় নেয়নি। দ্বিতীয়ত, বিএনপি এবং জামায়াত সূক্ষ্ম কৌশলে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে তাদের নেতাকর্মীদের সব মামলা খারিজ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মন্দ কী। কেউ বলতে পারবে না যে, বিএনপি বা জামায়াত ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সব মামলা উইথড্র করে নিয়েছে, ড. ইউনূসের নিজের মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে এখন সবাই যা বলছে। তাদের মামলা উইথড্র করতে গড়িমসি হলে ‘নির্বাচনের হুমকি’ তো আছেই। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগে তাদের লোক রয়েছে, যা দলীয় সরকার করে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই দুটি রাজনৈতিক দল সব পেয়েছে, শুধু ক্ষমতা ছাড়া। ক্ষমতা তারা দুদিন পরে হলেও পাবে, কারণ তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাঠে থাকতে দেয়া হবে বলে মনে হয় না।
নির্বাচন করলেই যে দেশের আমূল পরিবর্তন হবে তা অনেকেই মনে করেন না। কারণ অতীতে বহু নির্বাচন হয়েছে। দেখা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকেও পরাজিত দল মেনে নেয়নি। শুধু তাই নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর বিরোধী দল সংসদ বয়কট করেছে। তারপরও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচন চায়। বিএনপি চায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, আর আওয়ামী লীগের নির্যাতিত কর্মীরা চায় বাঁচার জন্য। যে যা-ই বলুক না কেন, নির্বাচন কখন হবে তা নির্ভর করছে বিএনপির মর্জির ওপর, ড. ইউনূসের সিদ্ধান্তের ওপর নয়। বিএনপি চাপ দিলে তা সামলানোর ক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। চাপ কড়া হলে আওয়ামী লীগের অভ্যুদয় ঠেকানো যাবে নাÑ তাই বিএনপিও নির্বাচন নিয়ে আপোষ করবে। এছাড়া ঐক্যও নষ্ট করবে না, করলে গণঅভ্যুত্থানের গোমর ফাঁস করার হুমকি আসতেই থাকবে। তাই নির্বাচন নির্বাচন খেলা আরও কিছুদিন চলার সম্ভাবনা রয়েছে।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ০৩ মে ২০২৫
আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় থাকেন লন্ডনে। তিনি মূলত সাংবাদিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকেই সাংবাদিকতা করে আসছেন; প্রথমে প্রিন্ট মিডিয়ায়, পরে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, শুধু সংশ্লিষ্ট বললে ঠিক হবে না, বিএনপির অন্ধভক্তও। জিয়াউর রহমানের ওপর একটি বইও লিখেছেন। তবে অন্ধ হলেও আমার আত্মীয়টি অবিবেচক নন, বিবেক-বুদ্ধি আছে। সামাজিক সম্পর্ক ব্যাপক, সারা পৃথিবীর প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের সঙ্গে সে জড়িত। লন্ডন থেকে ঢাকায় এলে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টকশোতে অংশগ্রহণ করেন।
টকশো দেখার জন্য তিনি কখনো আমাদের আগাম বলে রাখেন না; তবে তার স্ত্রী মাঝে মাঝে আমাদের খবর দেয়। বর্তমানের টকশো অসহনীয় বিরক্তিকর, একাধিক ব্যক্তির অংশগ্রহণ থাকলেও সবাই এক সুরে কথা বলেÑ একতরফা, একচেটিয়া স্বৈরাচার আর ফ্যাসিবাদের কাহিনী। অবশ্য এখন ভিন্নমতের কারো সাহস নেই ভিন্নমত পোষণ করার। ভিন্নমত প্রকাশ পেলেই আওয়ামী লীগের ট্যাগ লাগানো হয়। ‘রাজাকার’ নাম দিয়ে বিরোধীদের একই ট্যাগ লাগানো হতো আওয়ামী লীগ আমলে। ট্যাগ লাগলে এখন কী হয় তা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর দরকার আছে বলে মনে হয় না। স্বয়ং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা থানায় থানায় গিয়ে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়ে এসেছেন; পুলিশ ব্যবস্থা না নিলে তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। ‘মব ভায়োলেন্স’ তো আছেই। তাই টকশোতে ভিন্নমতের প্রত্যাশা আপাতত স্থগিত রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টকশোতে আওয়ামী লীগকে হারপিক দিয়ে ধুয়ে ফেলা হতো। আজ যারা বাকপটু বক্তা তারা এই গুণ অর্জন করেছেন আওয়ামী লীগ আমলেই। দেশের বাইরে অবস্থান করে যারা ইউটিউব চ্যানেলে কথা বলেছেন তাদের কথা বলছি না, বলছি দেশের অভ্যন্তরে বসে যারা আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচনা করেছেন তাদের কথা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা ছাড়াও যারা আওয়ামী লীগের কট্টর সমালোচক ছিলেন তাদের কেউ কেউ আজ অন্তর্বর্তী সরকারেরও সমালোচনা করছেন, তবে সংখ্যায় তিন-চারজনের বেশি নয়। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে অংশীজন ছিলেন বলেই কথা বলতে পারছেন, নতুবা সারা মিডিয়া আজ মব ভায়োলেন্সের ভয়ে শাসকের সভাকবিতে পরিণত হয়েছে।
সমস্যা হয়ে গেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের, আমলাতন্ত্রে তাদের নিজস্ব কোন লোক নেই, সব দখল করে নিয়েছে এবং নিচ্ছে বিএনপি আর জামায়াতে ইসলাম। এটা স্বাভাবিক; কারণ জাতীয় নাগরিক পার্টি হয়েছে মাত্র কয়েক দিন আগে। তাদের একমাত্র অভিভাবক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাই ড. ইউনূসকে বারবার ঐক্যের কথা বলতে হয়, বলতে হয় এক পরিবারের কথা। ড. ইউনূস জানেন বিএনপি বিরোধিতা করলে শুধু জামায়াতে ইসলামের সহযোগিতায় অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘদিন টিকে থাকা কঠিন হবে। তবে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও ঐক্য রক্ষায় তার খুব বেশি কৃতিত্ব নেই, কৃতিত্ব আছে আওয়ামী লীগের। হেফাজতে ইসলাম, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলাম আওয়ামী লীগকে শুধু প্রতিপক্ষ নয়, শত্রুও মনে করে। তাই কেবল আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন রোধে এরা ড. ইউনূসের আহ্বান ছাড়াই ঐক্যবদ্ধ থাকবে।
কখন নির্বাচন হবে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিএনপির ধারণা নির্বাচন দিলে তারা ক্ষমতায় আসবে। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের শূন্যতায় বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামের জনভিত্তি ব্যাপক হলেও বিএনপির জনভিত্তি তুলনামূলক বিচারে আরেকটু বেশি। তাই বিএনপি নির্বাচনের জন্য তাড়াহুড়ো করছে। এই তাড়াহুড়ো যে কোন জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের জন্য স্বাভাবিক। কারণ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই বিএনপি রাজনীতি করে। তারা আরও কয়েকবার ক্ষমতায় ছিল, তাই বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি বলার সুযোগ পেয়েছে, ‘এক দুর্নীতিবাজ সরকারকে সরিয়ে আরেক দুর্নীতিবাজ সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য গণআন্দোলন হয়নি’। জনগণের কিয়দংশ কথাটি বিশ্বাস করে, এবং বিশ্বাস করে বলেই অনেকে ইদানীং নতুন করে জামায়াত এবং ড. ইউনূসের সমর্থক হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপর সারা দেশে বিএনপির কর্মীরা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়ে নিজেদের মালিকানা স্বত্ব কায়েম করেছে। এতে কোন সমস্যা নেই, কারণ সরকার পরিবর্তন হলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দখলদারিত্বের পরিবর্তন হয়, জনগণের কাছে এই বিষয়টি পরিচিত। কিন্তু ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপির কর্মীদের চাঁদাবাজি এবার নির্যাতনে পর্যবসিত হয়েছে, যা বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ছিল ৯০ দিন। কিন্তু ২০০৭ সালে এক-এগারোর পর জরুরি অবস্থার সরকার ক্ষমতায় ছিল দুই বছর। এই দুই বছর মেয়াদের পক্ষে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বক্তব্য দিয়ে সেনা-সমর্থিত ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের সরকারকে জায়েজ ও হালাল করে দিয়েছিলেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কথা হচ্ছে, বিপ্লব আর গণঅভ্যুত্থানে আইন মানার দরকার হয় না; তাই জনসমর্থন আর সেনা সমর্থন থাকলে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা কোন সমস্যা নয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সামরিক শাসন জায়েজ করতে আজ পর্যন্ত কোন সমস্যা হয়নি। পাকিস্তান সব সামরিক শাসনকে ‘ডকট্রিন অব ন্যাসেসিটি’ দ্বারা জায়েজ করে নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি প্রচারণা জোরসে চলছে, তা হচ্ছে ড. ইউনূসকে আরও সময় দেয়া হোক। বিএনপি নির্বাচনের জন্য বললেও ড. ইউনূসকে কিছু সময় দিতে তারা অকৃপণ বলে মনে হয় না। কারণ আছে।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যত মামলা-হামলা হচ্ছে তার দায় অন্তর্বর্তী সরকারের, এই দায় পরবর্তীকালে বিএনপি বা জামায়াত কারো ওপর বর্তাবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে সব মামলায় বিএনপির নেতাদের শাস্তি হয়েছে, সে সব মামলার অধিকাংশ দায়ের হয়েছিল ড. ফখরউদ্দীনের শাসনামলে, আওয়ামী লীগ তার দায় নেয়নি। দ্বিতীয়ত, বিএনপি এবং জামায়াত সূক্ষ্ম কৌশলে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে তাদের নেতাকর্মীদের সব মামলা খারিজ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মন্দ কী। কেউ বলতে পারবে না যে, বিএনপি বা জামায়াত ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সব মামলা উইথড্র করে নিয়েছে, ড. ইউনূসের নিজের মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে এখন সবাই যা বলছে। তাদের মামলা উইথড্র করতে গড়িমসি হলে ‘নির্বাচনের হুমকি’ তো আছেই। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগে তাদের লোক রয়েছে, যা দলীয় সরকার করে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এই দুটি রাজনৈতিক দল সব পেয়েছে, শুধু ক্ষমতা ছাড়া। ক্ষমতা তারা দুদিন পরে হলেও পাবে, কারণ তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাঠে থাকতে দেয়া হবে বলে মনে হয় না।
নির্বাচন করলেই যে দেশের আমূল পরিবর্তন হবে তা অনেকেই মনে করেন না। কারণ অতীতে বহু নির্বাচন হয়েছে। দেখা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকেও পরাজিত দল মেনে নেয়নি। শুধু তাই নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর বিরোধী দল সংসদ বয়কট করেছে। তারপরও বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচন চায়। বিএনপি চায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, আর আওয়ামী লীগের নির্যাতিত কর্মীরা চায় বাঁচার জন্য। যে যা-ই বলুক না কেন, নির্বাচন কখন হবে তা নির্ভর করছে বিএনপির মর্জির ওপর, ড. ইউনূসের সিদ্ধান্তের ওপর নয়। বিএনপি চাপ দিলে তা সামলানোর ক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। চাপ কড়া হলে আওয়ামী লীগের অভ্যুদয় ঠেকানো যাবে নাÑ তাই বিএনপিও নির্বাচন নিয়ে আপোষ করবে। এছাড়া ঐক্যও নষ্ট করবে না, করলে গণঅভ্যুত্থানের গোমর ফাঁস করার হুমকি আসতেই থাকবে। তাই নির্বাচন নির্বাচন খেলা আরও কিছুদিন চলার সম্ভাবনা রয়েছে।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক]