alt

উপ-সম্পাদকীয়

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

এম এ হোসাইন

: রোববার, ০৪ মে ২০২৫

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘মানবিক করিডর’ গঠনে বাংলাদেশের নীতিগত সম্মতির ঘোষণা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকে শুধু বিনীত সম্মতি নয়, বরং গভীর পর্যালোচনার আহ্বান জানানো উচিত। কারণ এমন উদ্যোগ, যতই মানবিক উদ্দেশ্যপ্রসূতই হোক না কেন, ভৌগোলিক জটিলতা, ভূ-রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সংঘাতে অনেক সময় আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির জন্ম দেয়।

মায়ানমারের সেনা দমন-পীড়ন থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার দীর্ঘদিনের অনিচ্ছুক আশ্রয়দাতা বাংলাদেশ এবার আরেক মানবিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে এবার আর শুধু শিকার নয়, বরং একধরনের সক্রিয় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছে ঢাকা। এই রূপান্তর যত মহৎই মনে হোক না কেন বহুমাত্রিক ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে, যার প্রতিটি দিক খোলা চোখে বিশ্লেষণ করা জরুরি।

প্রথমেই বলা উচিত, এই করিডর শুধুই ত্রাণ পরিবহনের রাস্তা নয়; ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, এটি একটি কূটনৈতিক বার্তা ও কৌশলগত প্রভাবের মাধ্যম হয়ে দাঁড়াবে। করিডর স্থাপনের যুক্তি আপাতদৃষ্টিতে মানবিক: রাখাইনে দুর্ভিক্ষসম অবস্থা, অর্থনীতির ধ্বংস এবং নতুন শরণার্থী ঢলের আশঙ্কা। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এক নির্মম চিত্র এঁকেছেÑ যেখানে খাদ্যের অভাব, যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা ও হতাশার বিস্তার রয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে মানবিক করিডরের দাবি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু ইতিহাস জানায়, এসব করিডর খুব কম ক্ষেত্রেই তাদের মূল উদ্দেশ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

চেচনিয়ার গ্রোজনি, সিরিয়ার আলেপ্পো কিংবা ইউক্রেনের দোনবাসÑ এসব স্থানে মানবিক করিডরগুলো কখনো নিরাপদ পথ হয়ে ওঠেনি, বরং সেগুলো পরিণত হয়েছে সংঘর্ষ, অস্ত্র পাচার ও কৌশলগত ব্যবহারের মঞ্চে। বাংলাদেশ কি এর ব্যতিক্রম হতে পারবে?

করিডরের ভৌগোলিক বাস্তবতাই ঢাকার নীতিনির্ধারকদের নির্ঘুম রাখার মতো। এটি এমন অঞ্চল দিয়ে যাবে, যেগুলো বর্তমানে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণেÑ যারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত। এদিকে, মায়ানমারের সামরিক জান্তা সব রকম পরিবহনপথ বন্ধ করে রেখেছে, শুধু বাংলাদেশের দিকটিকে সম্ভাব্য প্রবেশমুখ হিসেবে রেখেছে। ফলে এই করিডর মানবিক পথের পাশাপাশি কৌশলগত হাইওয়েতেও পরিণত হতে চলেছে এবং এখানেই বিপদের শুরু। কোন করিডরই রাজনীতিবিহীনভাবে পরিচালিত হয় না। বাংলাদেশ এখন এমন এক ত্রিমুখী জটিলতায় জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে যেখানে রয়েছে মায়ানমারের জান্তা, আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীন ও ভারতের অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী স্বার্থ। ফলে এই মানবিক করিডরটি আসলে একটি ভূ-রাজনৈতিক দাবার চাল হয়ে উঠছে।

ঘটনাটিকে আরও জটিল করে তুলেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এর পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো স্পষ্ট ঐকমত্য না থাকা। বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকদের মতে, এই প্রস্তাব সরকার বা নাগরিক সমাজে ব্যাপক আলোচনার মধ্য দিয়ে গৃহীত হয়নি। অনেক রোহিঙ্গা নীতিনির্ধারক নাকি গণমাধ্যম থেকেই এ সিদ্ধান্তের কথা প্রথম জানতে পেরেছেন। এটাই স্পষ্ট করে যে এখানে স্বচ্ছতা ত্যাগ করা হয়েছে তাড়াহুড়োর নামে।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এই করিডর হয়তো দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে। তখন প্রশ্ন উঠবে এই সাহায্য আসলেই বেসামরিক নাগরিকদের কাছে পৌঁছাচ্ছে, নাকি যোদ্ধাদের কাছে? বাংলাদেশ কীভাবে নিশ্চিত করবে এই সরবরাহের ব্যবহার কোথায় হচ্ছে? যদি এই করিডর অস্ত্র বা মাদক পাচারের আড়াল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে দায় কার?

সুতরাং ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রস্তাবিত করিডর, এমনকি যদি জাতিসংঘ কর্তৃক অনুমোদিতও হয়, তবে তা অবশ্যই ঢাকার পূর্ণ পরিচালনাগত নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এই ধরনের তদারকি ছাড়া, অপ্রত্যাশিত এবং সম্ভাব্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতির ঝুঁকি উড়িয়ে দেয়া যায় না। এই সতর্কীকরণটি বিচক্ষণ এবং সময়োপযোগী উভয়ইÑ তবুও ভূ-রাজনীতিতে প্রায়শই যেমনটি ঘটে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলো শব্দের কারসাজির মধ্যে লুকিয়ে থাকে, যা উদ্বেগজনকভাবে অস্পষ্ট থাকে।

আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। চীন দীর্ঘদিন ধরে রাখাইনের মধ্য দিয়ে কৌশলগত কিয়াকফিউ বন্দরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে জড়িত, যা বেইজিংকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার দেয়। ভারতও এ অঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয়। আর যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রভাব ঠেকাতে বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে পশ্চিমমুখী করতে চাচ্ছে। যদি এই করিডর পশ্চিমা সহায়তার প্রবেশপথে পরিণত হয়, তবে আঞ্চলিক টানাপোড়েন আরও বেড়ে যেতে পারে।

তাছাড়া, কক্সবাজারে অবস্থানরত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বিষয়টি ভুলে যাওয়া চলবে না। করিডর হয়তো তাদের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানকে স্বাভাবিক করে তুলবে। রাখাইনে সহায়তা পৌঁছানোর দৃশ্য যদি বাস্তুচ্যুতি নিরসনের পরিবর্তে সংকট ব্যবস্থাপনার বার্তা দেয়, তাহলে আন্তর্জাতিক চাপ কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে, বরং এটি সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করার ঝুঁকি বাড়াবে।

আরেকটি বিপজ্জনক দিক হলো, এই করিডর হয়তো নতুন বাস্তুচ্যুতদের উৎসাহিত করতে পারে। যদি সীমান্ত পেরুলেই সহায়তা মিলবে এমন ধারণা ছড়ায়, তাহলে এই করিডরই পরিণত হতে পারে নতুন শরণার্থীদের প্রবেশপথে। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে সতর্ক করেছেÑ রাখাইনে দুর্ভিক্ষ ও সংঘাত আরও মানুষকে বাংলাদেশমুখী করে তুলতে পারে।

ঢাকা করিডরের ওপর কিছু শর্ত আরোপ করেছে ঠিকই, কিন্তু তা এখনও অজানা। জনসমক্ষে না আনলে এসব শর্তের বাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। ‘শর্তগুলো কী? বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো কারা? প্রস্থান কৌশল কী?’ এসব কোনো প্রান্তিক কাগুজে প্রশ্ন নয়Ñ এগুলো বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার নিরাপত্তাকবচ।

তাহলে করণীয় কী? প্রথমত, বাংলাদেশকে অবশ্যই জাতিসংঘের পাশাপাশি চীন, ভারত ও আসিয়ানসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অংশগ্রহণে একটি বহুপক্ষীয় কাঠামোর ওপর জোর দিতে হবেÑ যাতে করিডর অস্ত্র পরিবহনের রুটে পরিণত না হয়। দ্বিতীয়ত, করিডরের কার্যক্রম নির্ভর করতে হবে সুনির্দিষ্ট পরিমাপক সূচকের ওপর স্বচ্ছতা, তৃতীয় পক্ষীয় পর্যবেক্ষণ ও কার্যকর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের রূপরেখা। তৃতীয়ত, সরকারের উচিত বিষয়টি জনসমক্ষে নিয়ে আসা। গোপনে নেয়া নিরাপত্তা সিদ্ধান্তগুলো পরে গুরুতর পরিণতি ডেকে আনে।

সবচেয়ে জরুরি হলো বাংলাদেশ যেন এই ভূ-রাজনৈতিক দাবার খেলায় কৌশলগত দাবার ঘুঁটি হয়ে না পড়ে। মানবিক করিডর হয়তো জীবনের জন্য দরজা খুলবে, কিন্তু তার বিনিময়ে যদি স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেটি হবে এক করুণ পরিণতি।

মানবিকতা কোন দুর্বলতা নয়; কিন্তু যখন তা ভূ-রাজনীতির সঙ্গে মিশে যায়, তখন তা বাস্তবতার কঠিন বোধ নিয়ে পরিচালিত হওয়া জরুরি। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যে সহানুভূতির নজির দেখিয়েছে, তা প্রশংসনীয় ঠিকই, তবে এখন সময় এসেছে হিসাব করে এগোনোর। তা না হলে, আজকের মহৎ পদক্ষেপ আগামী দিনের নীরব বিপর্যয়ে পরিণত হতে পারে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

এম এ হোসাইন

রোববার, ০৪ মে ২০২৫

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘মানবিক করিডর’ গঠনে বাংলাদেশের নীতিগত সম্মতির ঘোষণা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছ থেকে শুধু বিনীত সম্মতি নয়, বরং গভীর পর্যালোচনার আহ্বান জানানো উচিত। কারণ এমন উদ্যোগ, যতই মানবিক উদ্দেশ্যপ্রসূতই হোক না কেন, ভৌগোলিক জটিলতা, ভূ-রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সংঘাতে অনেক সময় আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির জন্ম দেয়।

মায়ানমারের সেনা দমন-পীড়ন থেকে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার দীর্ঘদিনের অনিচ্ছুক আশ্রয়দাতা বাংলাদেশ এবার আরেক মানবিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে এবার আর শুধু শিকার নয়, বরং একধরনের সক্রিয় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছে ঢাকা। এই রূপান্তর যত মহৎই মনে হোক না কেন বহুমাত্রিক ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে, যার প্রতিটি দিক খোলা চোখে বিশ্লেষণ করা জরুরি।

প্রথমেই বলা উচিত, এই করিডর শুধুই ত্রাণ পরিবহনের রাস্তা নয়; ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, এটি একটি কূটনৈতিক বার্তা ও কৌশলগত প্রভাবের মাধ্যম হয়ে দাঁড়াবে। করিডর স্থাপনের যুক্তি আপাতদৃষ্টিতে মানবিক: রাখাইনে দুর্ভিক্ষসম অবস্থা, অর্থনীতির ধ্বংস এবং নতুন শরণার্থী ঢলের আশঙ্কা। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এক নির্মম চিত্র এঁকেছেÑ যেখানে খাদ্যের অভাব, যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা ও হতাশার বিস্তার রয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে মানবিক করিডরের দাবি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু ইতিহাস জানায়, এসব করিডর খুব কম ক্ষেত্রেই তাদের মূল উদ্দেশ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

চেচনিয়ার গ্রোজনি, সিরিয়ার আলেপ্পো কিংবা ইউক্রেনের দোনবাসÑ এসব স্থানে মানবিক করিডরগুলো কখনো নিরাপদ পথ হয়ে ওঠেনি, বরং সেগুলো পরিণত হয়েছে সংঘর্ষ, অস্ত্র পাচার ও কৌশলগত ব্যবহারের মঞ্চে। বাংলাদেশ কি এর ব্যতিক্রম হতে পারবে?

করিডরের ভৌগোলিক বাস্তবতাই ঢাকার নীতিনির্ধারকদের নির্ঘুম রাখার মতো। এটি এমন অঞ্চল দিয়ে যাবে, যেগুলো বর্তমানে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণেÑ যারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত। এদিকে, মায়ানমারের সামরিক জান্তা সব রকম পরিবহনপথ বন্ধ করে রেখেছে, শুধু বাংলাদেশের দিকটিকে সম্ভাব্য প্রবেশমুখ হিসেবে রেখেছে। ফলে এই করিডর মানবিক পথের পাশাপাশি কৌশলগত হাইওয়েতেও পরিণত হতে চলেছে এবং এখানেই বিপদের শুরু। কোন করিডরই রাজনীতিবিহীনভাবে পরিচালিত হয় না। বাংলাদেশ এখন এমন এক ত্রিমুখী জটিলতায় জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে যেখানে রয়েছে মায়ানমারের জান্তা, আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীন ও ভারতের অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী স্বার্থ। ফলে এই মানবিক করিডরটি আসলে একটি ভূ-রাজনৈতিক দাবার চাল হয়ে উঠছে।

ঘটনাটিকে আরও জটিল করে তুলেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এর পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো স্পষ্ট ঐকমত্য না থাকা। বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকদের মতে, এই প্রস্তাব সরকার বা নাগরিক সমাজে ব্যাপক আলোচনার মধ্য দিয়ে গৃহীত হয়নি। অনেক রোহিঙ্গা নীতিনির্ধারক নাকি গণমাধ্যম থেকেই এ সিদ্ধান্তের কথা প্রথম জানতে পেরেছেন। এটাই স্পষ্ট করে যে এখানে স্বচ্ছতা ত্যাগ করা হয়েছে তাড়াহুড়োর নামে।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এই করিডর হয়তো দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থায় পরিণত হতে পারে। তখন প্রশ্ন উঠবে এই সাহায্য আসলেই বেসামরিক নাগরিকদের কাছে পৌঁছাচ্ছে, নাকি যোদ্ধাদের কাছে? বাংলাদেশ কীভাবে নিশ্চিত করবে এই সরবরাহের ব্যবহার কোথায় হচ্ছে? যদি এই করিডর অস্ত্র বা মাদক পাচারের আড়াল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে দায় কার?

সুতরাং ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রস্তাবিত করিডর, এমনকি যদি জাতিসংঘ কর্তৃক অনুমোদিতও হয়, তবে তা অবশ্যই ঢাকার পূর্ণ পরিচালনাগত নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এই ধরনের তদারকি ছাড়া, অপ্রত্যাশিত এবং সম্ভাব্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতির ঝুঁকি উড়িয়ে দেয়া যায় না। এই সতর্কীকরণটি বিচক্ষণ এবং সময়োপযোগী উভয়ইÑ তবুও ভূ-রাজনীতিতে প্রায়শই যেমনটি ঘটে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলো শব্দের কারসাজির মধ্যে লুকিয়ে থাকে, যা উদ্বেগজনকভাবে অস্পষ্ট থাকে।

আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। চীন দীর্ঘদিন ধরে রাখাইনের মধ্য দিয়ে কৌশলগত কিয়াকফিউ বন্দরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে জড়িত, যা বেইজিংকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার দেয়। ভারতও এ অঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয়। আর যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রভাব ঠেকাতে বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে পশ্চিমমুখী করতে চাচ্ছে। যদি এই করিডর পশ্চিমা সহায়তার প্রবেশপথে পরিণত হয়, তবে আঞ্চলিক টানাপোড়েন আরও বেড়ে যেতে পারে।

তাছাড়া, কক্সবাজারে অবস্থানরত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বিষয়টি ভুলে যাওয়া চলবে না। করিডর হয়তো তাদের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানকে স্বাভাবিক করে তুলবে। রাখাইনে সহায়তা পৌঁছানোর দৃশ্য যদি বাস্তুচ্যুতি নিরসনের পরিবর্তে সংকট ব্যবস্থাপনার বার্তা দেয়, তাহলে আন্তর্জাতিক চাপ কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে, বরং এটি সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করার ঝুঁকি বাড়াবে।

আরেকটি বিপজ্জনক দিক হলো, এই করিডর হয়তো নতুন বাস্তুচ্যুতদের উৎসাহিত করতে পারে। যদি সীমান্ত পেরুলেই সহায়তা মিলবে এমন ধারণা ছড়ায়, তাহলে এই করিডরই পরিণত হতে পারে নতুন শরণার্থীদের প্রবেশপথে। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে সতর্ক করেছেÑ রাখাইনে দুর্ভিক্ষ ও সংঘাত আরও মানুষকে বাংলাদেশমুখী করে তুলতে পারে।

ঢাকা করিডরের ওপর কিছু শর্ত আরোপ করেছে ঠিকই, কিন্তু তা এখনও অজানা। জনসমক্ষে না আনলে এসব শর্তের বাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। ‘শর্তগুলো কী? বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো কারা? প্রস্থান কৌশল কী?’ এসব কোনো প্রান্তিক কাগুজে প্রশ্ন নয়Ñ এগুলো বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার নিরাপত্তাকবচ।

তাহলে করণীয় কী? প্রথমত, বাংলাদেশকে অবশ্যই জাতিসংঘের পাশাপাশি চীন, ভারত ও আসিয়ানসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অংশগ্রহণে একটি বহুপক্ষীয় কাঠামোর ওপর জোর দিতে হবেÑ যাতে করিডর অস্ত্র পরিবহনের রুটে পরিণত না হয়। দ্বিতীয়ত, করিডরের কার্যক্রম নির্ভর করতে হবে সুনির্দিষ্ট পরিমাপক সূচকের ওপর স্বচ্ছতা, তৃতীয় পক্ষীয় পর্যবেক্ষণ ও কার্যকর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের রূপরেখা। তৃতীয়ত, সরকারের উচিত বিষয়টি জনসমক্ষে নিয়ে আসা। গোপনে নেয়া নিরাপত্তা সিদ্ধান্তগুলো পরে গুরুতর পরিণতি ডেকে আনে।

সবচেয়ে জরুরি হলো বাংলাদেশ যেন এই ভূ-রাজনৈতিক দাবার খেলায় কৌশলগত দাবার ঘুঁটি হয়ে না পড়ে। মানবিক করিডর হয়তো জীবনের জন্য দরজা খুলবে, কিন্তু তার বিনিময়ে যদি স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেটি হবে এক করুণ পরিণতি।

মানবিকতা কোন দুর্বলতা নয়; কিন্তু যখন তা ভূ-রাজনীতির সঙ্গে মিশে যায়, তখন তা বাস্তবতার কঠিন বোধ নিয়ে পরিচালিত হওয়া জরুরি। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যে সহানুভূতির নজির দেখিয়েছে, তা প্রশংসনীয় ঠিকই, তবে এখন সময় এসেছে হিসাব করে এগোনোর। তা না হলে, আজকের মহৎ পদক্ষেপ আগামী দিনের নীরব বিপর্যয়ে পরিণত হতে পারে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]

back to top