মিহির কুমার রায়
সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন এবং জনজীবনে তার প্রভাব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, বিশেষ করে দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে। বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা সম্প্রতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যদিও বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে ভেনেজুয়েলা ও ব্রাজিলে। বর্তমানে দেশে গ্রীষ্মকাল চলছে, এবং কালবৈশাখীর প্রকোপ তুঙ্গে। হাওর অঞ্চলে এখন পুরোদমে ধান কাটার মৌসুম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃষকদের বিরাম নেই। খোলা প্রান্তরে কাজ করা এই কৃষকদের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো নিরাপদ আশ্রয় থাকে না।
গত রোববার, ২৬ এপ্রিল রাত থেকে সোমবার, ২৭ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যমতে, এটি চলতি বছরে ২৪ ঘণ্টায় বজ্রপাতে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এই ঘটনাসহ চলতি মাসে বজ্রপাতে মোট ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা এ বছরের সর্বোচ্চ। এছাড়া, এ মাসে বজ্রপাতে ৩০ জন আহত হয়েছেন। বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা খবরে প্রকাশ পেলেও, আহতদের ভোগান্তি নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। অথচ, বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিরা দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক কষ্ট ভোগ করেন।
২০২২ সালে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পঞ্চক্রোশী ইউনিয়নের মাটিকাটা গ্রামে একটি ইঞ্জিনচালিত টিনের ঘরে বজ্রপাতে ১৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন কৃষিশ্রমিক, যার মধ্যে দুই বোনসহ তিন কিশোরীও ছিলেন। তারা সবাই রোপা আমনের চারা তুলতে খেতে গিয়েছিলেন। বৃষ্টি শুরু হলে তারা টিনের সেচঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই ১৪ জনের মৃত্যু হয়, এবং পরে আরও একজন মারা যান। এ ঘটনায় পাঁচজন আহত হন। এই ঘটনায় নিহতদের স্বজন ও এলাকাবাসী শোকাভিভূত হয়েছিলেন। এর আগেও বজ্রপাতে একসঙ্গে বহু মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে বরযাত্রীদের একটি দল নদীতীরে টিনের টংঘরে আশ্রয় নেয়ার সময় বজ্রপাতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়।
২৭ এপ্রিল নিহত ১৩ জনের মধ্যে তিনজন ছিলেন নারী। তাদের একজন বিশাখা রানী (৩৫), চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার নাহারা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি কৃষক হরিপদ সরকারের স্ত্রী ছিলেন। বাড়ির পাশে স্বামী-স্ত্রী মিলে ধান তুলছিলেন। এ সময় বিকট শব্দে বজ্রপাত হলে বিশাখা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। একইভাবে, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার আড়িয়ামুগুর হাওরে বজ্রপাতে দুর্বাসা দাস (৩৫) নামে এক ধানকাটা শ্রমিক প্রাণ হারান। মিঠামইন উপজেলার শান্তিগঞ্জ হাওরে ফুলেছা বেগম (৬৫) বজ্রপাতে নিহত হন। মিঠামইন থানার এসআই অর্পণ বিশ্বাস জানান, ফুলেছা বেগম সকালে বাড়ির পাশে ধানের খড় শুকাতে দিচ্ছিলেন। এ সময় বজ্রপাতে তার মৃত্যু হয়।
আবহাওয়াবিদদের মতে, দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর থেকে আসা আর্দ্র বায়ু এবং উত্তর হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বাতাসের মিলনে বজ্রমেঘ, ঝড় ও বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। দেশের প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ৪০টি বজ্রপাত ঘটে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ঘটনা আরও তীব্র হচ্ছে। নাসার গবেষক কাল প্রাইস উল্লেখ করেছেন, বায়ুদূষণ এবং কার্বনের মাত্রা বৃদ্ধি বজ্রপাতের হার বাড়ায়। তিনি জানান, পরিবেশে কার্বনের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে বজ্রপাত ৩২% বৃদ্ধি পেতে পারে। অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি গবেষকদের মতে, দেশে উঁচু গাছপালা ও বনায়ন কমে যাওয়ায় বজ্রপাতের ঘটনা ত্বরান্বিত হয়েছে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে বজ্রপাতের সংখ্যা প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১,৮০০ ছাড়িয়েছে। সরকার ১৭ মে ২০১৬-এ বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করলেও, এর কারণ অনুসন্ধান বা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। গবেষণার অভাব এবং জাতীয় নীতিতে এ বিষয়ের গুরুত্ব না দেয়ায় সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে।
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। তালগাছ রোপণের মতো দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ কার্যকর হতে ১০-১৬ বছর সময় লাগতে পারে। বিশেষজ্ঞরা তাই জরুরি ভিত্তিতে লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপনের ওপর জোর দিচ্ছেন। হাওরসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় লাইটনিং ডিটেকশন সেন্সর ও বজ্রপাত প্রতিরোধী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা প্রয়োজন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরামর্শ অনুযায়ী, বজ্রপাতের সময় জানালা-দরজা বন্ধ রাখা, গাছের নিচে আশ্রয় না নেয়া, বৈদ্যুতিক যন্ত্রের প্লাগ খুলে রাখা, জলাশয় থেকে দ্রুত সরে আসা এবং বিদ্যুৎ পরিবাহী বস্তু থেকে দূরে থাকা জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তালগাছ বজ্রপাত প্রতিরোধে কার্যকর কারণ এটি দীর্ঘজীবী, মাটির গভীরে শিকড় বিস্তৃত এবং প্রতিকূল আবহাওয়া সহ্য করতে পারে। তবে, তালগাছ বজ্রপাত প্রতিরোধে সক্ষম হতে ১৪-১৬ বছর লাগে। এছাড়া, দ্রুতবর্ধনশীল সুপারিগাছও তালগাছের মধ্যবর্তী স্থানে রোপণ করে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমানো যেতে পারে।
বজ্রপাতের কবল থেকে রক্ষা পেতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ জরুরি। সরকার, গবেষক এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই দুর্যোগের প্রভাব কমানো সম্ভব।
[লেখক : ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]
মিহির কুমার রায়
সোমবার, ০৫ মে ২০২৫
সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন এবং জনজীবনে তার প্রভাব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, বিশেষ করে দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে। বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা সম্প্রতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যদিও বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে ভেনেজুয়েলা ও ব্রাজিলে। বর্তমানে দেশে গ্রীষ্মকাল চলছে, এবং কালবৈশাখীর প্রকোপ তুঙ্গে। হাওর অঞ্চলে এখন পুরোদমে ধান কাটার মৌসুম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃষকদের বিরাম নেই। খোলা প্রান্তরে কাজ করা এই কৃষকদের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো নিরাপদ আশ্রয় থাকে না।
গত রোববার, ২৬ এপ্রিল রাত থেকে সোমবার, ২৭ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যমতে, এটি চলতি বছরে ২৪ ঘণ্টায় বজ্রপাতে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এই ঘটনাসহ চলতি মাসে বজ্রপাতে মোট ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা এ বছরের সর্বোচ্চ। এছাড়া, এ মাসে বজ্রপাতে ৩০ জন আহত হয়েছেন। বজ্রপাতে নিহতের সংখ্যা খবরে প্রকাশ পেলেও, আহতদের ভোগান্তি নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। অথচ, বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিরা দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক কষ্ট ভোগ করেন।
২০২২ সালে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পঞ্চক্রোশী ইউনিয়নের মাটিকাটা গ্রামে একটি ইঞ্জিনচালিত টিনের ঘরে বজ্রপাতে ১৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন কৃষিশ্রমিক, যার মধ্যে দুই বোনসহ তিন কিশোরীও ছিলেন। তারা সবাই রোপা আমনের চারা তুলতে খেতে গিয়েছিলেন। বৃষ্টি শুরু হলে তারা টিনের সেচঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বজ্রপাতে ঘটনাস্থলেই ১৪ জনের মৃত্যু হয়, এবং পরে আরও একজন মারা যান। এ ঘটনায় পাঁচজন আহত হন। এই ঘটনায় নিহতদের স্বজন ও এলাকাবাসী শোকাভিভূত হয়েছিলেন। এর আগেও বজ্রপাতে একসঙ্গে বহু মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে বরযাত্রীদের একটি দল নদীতীরে টিনের টংঘরে আশ্রয় নেয়ার সময় বজ্রপাতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়।
২৭ এপ্রিল নিহত ১৩ জনের মধ্যে তিনজন ছিলেন নারী। তাদের একজন বিশাখা রানী (৩৫), চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার নাহারা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি কৃষক হরিপদ সরকারের স্ত্রী ছিলেন। বাড়ির পাশে স্বামী-স্ত্রী মিলে ধান তুলছিলেন। এ সময় বিকট শব্দে বজ্রপাত হলে বিশাখা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। একইভাবে, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার আড়িয়ামুগুর হাওরে বজ্রপাতে দুর্বাসা দাস (৩৫) নামে এক ধানকাটা শ্রমিক প্রাণ হারান। মিঠামইন উপজেলার শান্তিগঞ্জ হাওরে ফুলেছা বেগম (৬৫) বজ্রপাতে নিহত হন। মিঠামইন থানার এসআই অর্পণ বিশ্বাস জানান, ফুলেছা বেগম সকালে বাড়ির পাশে ধানের খড় শুকাতে দিচ্ছিলেন। এ সময় বজ্রপাতে তার মৃত্যু হয়।
আবহাওয়াবিদদের মতে, দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর থেকে আসা আর্দ্র বায়ু এবং উত্তর হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বাতাসের মিলনে বজ্রমেঘ, ঝড় ও বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। দেশের প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ৪০টি বজ্রপাত ঘটে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ঘটনা আরও তীব্র হচ্ছে। নাসার গবেষক কাল প্রাইস উল্লেখ করেছেন, বায়ুদূষণ এবং কার্বনের মাত্রা বৃদ্ধি বজ্রপাতের হার বাড়ায়। তিনি জানান, পরিবেশে কার্বনের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে বজ্রপাত ৩২% বৃদ্ধি পেতে পারে। অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি গবেষকদের মতে, দেশে উঁচু গাছপালা ও বনায়ন কমে যাওয়ায় বজ্রপাতের ঘটনা ত্বরান্বিত হয়েছে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে বজ্রপাতের সংখ্যা প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১,৮০০ ছাড়িয়েছে। সরকার ১৭ মে ২০১৬-এ বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করলেও, এর কারণ অনুসন্ধান বা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। গবেষণার অভাব এবং জাতীয় নীতিতে এ বিষয়ের গুরুত্ব না দেয়ায় সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে।
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। তালগাছ রোপণের মতো দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ কার্যকর হতে ১০-১৬ বছর সময় লাগতে পারে। বিশেষজ্ঞরা তাই জরুরি ভিত্তিতে লাইটনিং অ্যারেস্টার স্থাপনের ওপর জোর দিচ্ছেন। হাওরসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় লাইটনিং ডিটেকশন সেন্সর ও বজ্রপাত প্রতিরোধী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা প্রয়োজন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরামর্শ অনুযায়ী, বজ্রপাতের সময় জানালা-দরজা বন্ধ রাখা, গাছের নিচে আশ্রয় না নেয়া, বৈদ্যুতিক যন্ত্রের প্লাগ খুলে রাখা, জলাশয় থেকে দ্রুত সরে আসা এবং বিদ্যুৎ পরিবাহী বস্তু থেকে দূরে থাকা জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তালগাছ বজ্রপাত প্রতিরোধে কার্যকর কারণ এটি দীর্ঘজীবী, মাটির গভীরে শিকড় বিস্তৃত এবং প্রতিকূল আবহাওয়া সহ্য করতে পারে। তবে, তালগাছ বজ্রপাত প্রতিরোধে সক্ষম হতে ১৪-১৬ বছর লাগে। এছাড়া, দ্রুতবর্ধনশীল সুপারিগাছও তালগাছের মধ্যবর্তী স্থানে রোপণ করে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমানো যেতে পারে।
বজ্রপাতের কবল থেকে রক্ষা পেতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ জরুরি। সরকার, গবেষক এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই দুর্যোগের প্রভাব কমানো সম্ভব।
[লেখক : ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]