মতিউর রহমান
বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক ভূমিহীন, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো খাসজমি ও জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং তাদের মধ্যে এর ন্যায়সঙ্গত বন্দোবস্ত। খাসজমিকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: যে জমি নীতিমালার আওতায় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, তা বন্দোবস্তকৃত; আর যা এখনও বিতরণের জন্য নির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করে হস্তান্তরের অপেক্ষায় আছে, তা অবন্দোবস্তকৃত। এই সহজ সমীকরণটি একটি দেশের সম্পদের বণ্টনে কতটা স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা প্রতিফলিত করে, তা খাসজমি-জলাশয়ের বাস্তব চিত্র দেখলেই বোঝা যায়।
খাসজমি, তা কৃষিকাজের উপযোগী হোক, অকৃষি হোক বা জলাশয় হোক, প্রতিটিই দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের জীবন-জীবিকার উন্নয়নে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। কৃষি খাসজমি গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল করে, অকৃষি খাসজমি শহরের দরিদ্রদের মাথা গোঁজার ঠাঁই দিতে পারে, আর খাস জলাশয় প্রকৃত মৎস্যজীবীদের জীবন ধারণের সুযোগ করে দেয়।
বাংলাদেশে খাসজমি ও জলাশয়ের বন্দোবস্তের একটি তুলনামূলক চিত্র সম্প্রতি উঠে এসেছে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত, শেখ আলী আহমেদ, ফয়সাল এম আহমেদ এবং মো. সাজ্জাদুল করিমের ‘বাংলাদেশে খাসজমি-জলা: দারিদ্র্য-বৈষম্য বিমোচনের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নামক গবেষণা গ্রন্থে। এই গ্রন্থে সরকারি পরিসংখ্যানের পাশাপাশি বিশ্লেষিত তথ্য-উপাত্ত সরকারি ভাষ্য ও গবেষণার ফলাফলের মধ্যেকার ভিন্নতা তুলে ধরে, যা এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত করে।
বাংলাদেশে মোট খাসজমি ও জলাশয়ের পরিমাণ নিয়ে সরকারি পরিসংখ্যানে এবং উল্লিখিত গবেষণা গ্রন্থে উপস্থাপিত তথ্যের মধ্যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অমিল বিদ্যমান। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট খাসজমি-জলাশয়ের পরিমাণ হলো ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ২৭৩ একর। অন্যদিকে, ড. আবুল বারকাত ও তার সহগবেষকদের গবেষণা বলছে এই পরিমাণ আসলে আরও অনেক বেশি, প্রায় ৪৯ লাখ ৬৯ হাজার ১৬০ একর। এর মানে হলো, গবেষণায় মোট খাসজমি-জলাশয়ের পরিমাণ সরকারি হিসাবের চেয়ে প্রায় ৩৭.২% বেশি পাওয়া গেছে।
খাসজমির মোট পরিমাণে এই বিপুল পার্থক্য স্বাভাবিকভাবেই এর বন্দোবস্তকৃত ও অবন্দোবস্তকৃত অংশের হিসাবকেও প্রভাবিত করে। গবেষণায় যেহেতু মোট পরিমাণ বেশি, তাই অবন্দোবস্তকৃত অংশের পরিমাণও সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা প্রকৃতপক্ষে হয়েছেও। এই ভিন্নতার মূল কারণ হলো তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি ও আওতা। ভূমি মন্ত্রণালয় তাদের রেকর্ড অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করে, যা মাঠ পর্যায়ের প্রকৃত চিত্র থেকে ভিন্ন হতে পারে। অন্যদিকে, গবেষকরা মাঠ পর্যায়ে নিবিড় জরিপের মাধ্যমে অধিকতর তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের তথ্যের ভিত্তিতে খাসজমি-জলাশয়ের বন্দোবস্ত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মোট খাসজমি-জলাশয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও বন্দোবস্তের বাইরে রয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, মোট খাসজমি-জলাশয়ের মাত্র ৩২.৩% এ পর্যন্ত বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে কৃষি খাসজমির বন্দোবস্তের হার তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি, ৩৪.৮%। তবে অকৃষি খাসজমির ক্ষেত্রে বন্দোবস্তের হার অত্যন্ত নগণ্য, মাত্র ৬%। খাস জলাশয়ের ক্ষেত্রে এই হার ৬০%, যা অন্যান্য ধরনের খাসজমির তুলনায় বেশি হলেও মোট জলাশয়ের ৪০% এখনও অবন্দোবস্তকৃত।
সামগ্রিকভাবে, সরকারি হিসাবেই দেশের মোট খাসজমি-জলাশয়ের প্রায় ৬৭.৭% এখনও অবন্দোবস্তকৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এই বিশাল অবন্দোবস্তকৃত অংশের মধ্যে কৃষি খাসজমির পরিমাণ ৬৫.২%, অকৃষি খাসজমির পরিমাণ ৯৪%, এবং খাস জলাশয়ের পরিমাণ ৪০%। সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে, গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক কৃষি খাসজমি এবং শহরের দরিদ্রদের আবাসন সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অকৃষি খাসজমিÑ উভয়েরই একটি বড় অংশ এখনও সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আসেনি। সরকারি হিসাবে মোট ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ২৭৩ একর খাসজমি-জলাশয়ের মধ্যে ১১ লাখ ৮২ হাজার ৯৬৪ একর বন্দোবস্ত হয়েছে, বাকি ২৪ লক্ষ ৭৭ হাজার ৩০৯ একর এখনও অবন্দোবস্তকৃত। এই অবন্দোবস্তকৃত বিশাল অংশের প্রায় ৫৯.৮% হলো কৃষি খাসজমি, যা দরিদ্র ও ভূমিহীন পরিবারের হাতে তুলে দিতে পারলে তাদের জীবনমানের উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ও তার সহগবেষকদের গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশে খাসজমি-জলা: দারিদ্র্য-বৈষম্য বিমোচনের রাজনৈতিক অর্থনীতি’তে উপস্থাপিত চিত্র সরকারি তথ্যের চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক। গবেষণায় দেখা গেছে, অবন্দোবস্তকৃত খাসজমি-জলাশয়ের পরিমাণ সরকারি হিসাবের চেয়ে ৫২.৮% বেশি। সরকারি হিসাবে অবন্দোবস্তকৃত জমির পরিমাণ ছিল ২৪,৭৭,৩০৯ একর, সেখানে গবেষণায় এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭,৮৬,১৯৬ একর। গবেষণা অনুযায়ী, দেশের মোট খাসজমি-জলাশয়ের প্রায় ৭৬.২% এখনও অবন্দোবস্তকৃত। বিস্তারিতভাবে দেখলে, কৃষি খাসজমির ৭৪.৩%, অকৃষি খাসজমির ৯৫.৬% এবং খাস জলাশয়ের ৫৬.২% এখনও অবন্দোবস্তকৃত।
এই পরিসংখ্যান স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, সরকারের হাতে যে পরিমাণ খাসজমি-জলাশয়ের হিসাব রয়েছে এবং যা বন্দোবস্ত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ সম্পদ এখনও বিতরণের বাইরে রয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত এই বিশাল অবন্দোবস্তকৃত সম্পদ দেশের বিপুলসংখ্যক ভূমিহীন, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জন্য একটি বড় সুযোগ, যা কাজে লাগাতে পারলে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বিমোচনের চলমান প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করা সম্ভব। গবেষণার ফলাফল সরকারি তথ্যের চেয়ে বাস্তবতার অধিকতর কাছাকাছি বলে প্রতীয়মান হয় এবং এটি নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা বহন করে।
সরকারি এবং গবেষণালব্ধ উভয় তথ্যই নিশ্চিত করে যে, বাংলাদেশের একটি বিশাল পরিমাণ খাসজমি ও জলাশয় অব্যবহৃত বা অবন্দোবস্তকৃত অবস্থায় পড়ে আছে। তবে অধ্যাপক আবুল বারকাত ও তার সহগবেষকদের গবেষণা এই অবন্দোবস্তকৃত সম্পদের পরিমাণ যে সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি, সেই বাস্তবতাকে সামনে এনেছে। এই বিশাল অবন্দোবস্তকৃত সম্পদ দেশের দরিদ্র, ভূমিহীন, প্রান্তিক এবং নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আর্থ-সামাজিক মুক্তির এক বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
কৃষি খাসজমির সুষ্ঠু বন্দোবস্ত গ্রামীণ দরিদ্রদের সরাসরি কৃষিকাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেবে, যা তাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও আয় বৃদ্ধি করে জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে। খাস জলাশয়গুলো প্রকৃত মৎস্যজীবী বা জলজীবী সমবায় সমিতিগুলোকে ইজারা দেয়ার মাধ্যমে তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশা ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষিত হবে এবং দারিদ্র্য কমবে।
তেমনি, শহরাঞ্চলের অবন্দোবস্তকৃত অকৃষি খাসজমি শহর এলাকার বস্তিবাসী ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য সুলভে আবাসনের ব্যবস্থা করতে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা শহরের ক্রমবর্ধমান আবাসন সংকট নিরসন এবং সামাজিক বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে। বিভাগ ও জেলাভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করলেও এই একই চিত্র ফুটে ওঠে, যেখানে অনেক অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ অবন্দোবস্তকৃত খাসজমি থাকা সত্ত্বেও ভূমিহীন ও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। এটি অঞ্চলভিত্তিক সুষম বণ্টন এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
খাসজমি ও জলাশয়ের ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সরকারি এবং ড. আবুল বারকাত ও তার সহগবেষকদের গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে এটা পরিষ্কার যে, এই মূল্যবান সম্পদের একটি বিশাল অংশ এখনও দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষের কল্যাণে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়নি। গবেষণায় প্রাপ্ত উচ্চতর অবন্দোবস্তকৃত জমির পরিমাণ প্রমাণ করে যে, এই সম্পদকে কাজে লাগানোর সুযোগ সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য অবন্দোবস্তকৃত খাসজমি-জলাশয় দ্রুত চিহ্নিত করে প্রকৃত হকদারদের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি।
এজন্য প্রয়োজন খাসজমি-জলাশয়ের একটি নির্ভুল ও হালনাগাদ তালিকা প্রস্তুত করা, বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ার সব ধাপে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, বিদ্যমান নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়ন এবং প্রকৃত ভূমিহীন ও জলজীবীদের চিহ্নিত করে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া। খাসজমি-জলাশয়ের সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত বণ্টন কেবল অর্থনৈতিক মুক্তিই আনবে না, এটি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই অবহেলিত সম্পদকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশের প্রকৃত উন্নয়ন বহুলাংশে ত্বরান্বিত হবে, যেমনটি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ও তার সহগবেষকদের গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশে খাসজমি-জলা: দারিদ্র্য-বৈষম্য বিমোচনের রাজনৈতিক অর্থনীতি’তে আলোকপাত করা হয়েছে। এটি নীতি নির্ধারকদের জন্য একটি অবশ্যপাঠ্য দলিল, যা দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় সংস্কার এবং ভূমিহীনদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
মতিউর রহমান
মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫
বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক ভূমিহীন, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো খাসজমি ও জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং তাদের মধ্যে এর ন্যায়সঙ্গত বন্দোবস্ত। খাসজমিকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: যে জমি নীতিমালার আওতায় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, তা বন্দোবস্তকৃত; আর যা এখনও বিতরণের জন্য নির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করে হস্তান্তরের অপেক্ষায় আছে, তা অবন্দোবস্তকৃত। এই সহজ সমীকরণটি একটি দেশের সম্পদের বণ্টনে কতটা স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা প্রতিফলিত করে, তা খাসজমি-জলাশয়ের বাস্তব চিত্র দেখলেই বোঝা যায়।
খাসজমি, তা কৃষিকাজের উপযোগী হোক, অকৃষি হোক বা জলাশয় হোক, প্রতিটিই দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের জীবন-জীবিকার উন্নয়নে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। কৃষি খাসজমি গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল করে, অকৃষি খাসজমি শহরের দরিদ্রদের মাথা গোঁজার ঠাঁই দিতে পারে, আর খাস জলাশয় প্রকৃত মৎস্যজীবীদের জীবন ধারণের সুযোগ করে দেয়।
বাংলাদেশে খাসজমি ও জলাশয়ের বন্দোবস্তের একটি তুলনামূলক চিত্র সম্প্রতি উঠে এসেছে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত, শেখ আলী আহমেদ, ফয়সাল এম আহমেদ এবং মো. সাজ্জাদুল করিমের ‘বাংলাদেশে খাসজমি-জলা: দারিদ্র্য-বৈষম্য বিমোচনের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নামক গবেষণা গ্রন্থে। এই গ্রন্থে সরকারি পরিসংখ্যানের পাশাপাশি বিশ্লেষিত তথ্য-উপাত্ত সরকারি ভাষ্য ও গবেষণার ফলাফলের মধ্যেকার ভিন্নতা তুলে ধরে, যা এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত করে।
বাংলাদেশে মোট খাসজমি ও জলাশয়ের পরিমাণ নিয়ে সরকারি পরিসংখ্যানে এবং উল্লিখিত গবেষণা গ্রন্থে উপস্থাপিত তথ্যের মধ্যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অমিল বিদ্যমান। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশের মোট খাসজমি-জলাশয়ের পরিমাণ হলো ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ২৭৩ একর। অন্যদিকে, ড. আবুল বারকাত ও তার সহগবেষকদের গবেষণা বলছে এই পরিমাণ আসলে আরও অনেক বেশি, প্রায় ৪৯ লাখ ৬৯ হাজার ১৬০ একর। এর মানে হলো, গবেষণায় মোট খাসজমি-জলাশয়ের পরিমাণ সরকারি হিসাবের চেয়ে প্রায় ৩৭.২% বেশি পাওয়া গেছে।
খাসজমির মোট পরিমাণে এই বিপুল পার্থক্য স্বাভাবিকভাবেই এর বন্দোবস্তকৃত ও অবন্দোবস্তকৃত অংশের হিসাবকেও প্রভাবিত করে। গবেষণায় যেহেতু মোট পরিমাণ বেশি, তাই অবন্দোবস্তকৃত অংশের পরিমাণও সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা প্রকৃতপক্ষে হয়েছেও। এই ভিন্নতার মূল কারণ হলো তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি ও আওতা। ভূমি মন্ত্রণালয় তাদের রেকর্ড অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করে, যা মাঠ পর্যায়ের প্রকৃত চিত্র থেকে ভিন্ন হতে পারে। অন্যদিকে, গবেষকরা মাঠ পর্যায়ে নিবিড় জরিপের মাধ্যমে অধিকতর তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের তথ্যের ভিত্তিতে খাসজমি-জলাশয়ের বন্দোবস্ত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মোট খাসজমি-জলাশয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও বন্দোবস্তের বাইরে রয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, মোট খাসজমি-জলাশয়ের মাত্র ৩২.৩% এ পর্যন্ত বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে কৃষি খাসজমির বন্দোবস্তের হার তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি, ৩৪.৮%। তবে অকৃষি খাসজমির ক্ষেত্রে বন্দোবস্তের হার অত্যন্ত নগণ্য, মাত্র ৬%। খাস জলাশয়ের ক্ষেত্রে এই হার ৬০%, যা অন্যান্য ধরনের খাসজমির তুলনায় বেশি হলেও মোট জলাশয়ের ৪০% এখনও অবন্দোবস্তকৃত।
সামগ্রিকভাবে, সরকারি হিসাবেই দেশের মোট খাসজমি-জলাশয়ের প্রায় ৬৭.৭% এখনও অবন্দোবস্তকৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এই বিশাল অবন্দোবস্তকৃত অংশের মধ্যে কৃষি খাসজমির পরিমাণ ৬৫.২%, অকৃষি খাসজমির পরিমাণ ৯৪%, এবং খাস জলাশয়ের পরিমাণ ৪০%। সরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে, গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক কৃষি খাসজমি এবং শহরের দরিদ্রদের আবাসন সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অকৃষি খাসজমিÑ উভয়েরই একটি বড় অংশ এখনও সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আসেনি। সরকারি হিসাবে মোট ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ২৭৩ একর খাসজমি-জলাশয়ের মধ্যে ১১ লাখ ৮২ হাজার ৯৬৪ একর বন্দোবস্ত হয়েছে, বাকি ২৪ লক্ষ ৭৭ হাজার ৩০৯ একর এখনও অবন্দোবস্তকৃত। এই অবন্দোবস্তকৃত বিশাল অংশের প্রায় ৫৯.৮% হলো কৃষি খাসজমি, যা দরিদ্র ও ভূমিহীন পরিবারের হাতে তুলে দিতে পারলে তাদের জীবনমানের উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ও তার সহগবেষকদের গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশে খাসজমি-জলা: দারিদ্র্য-বৈষম্য বিমোচনের রাজনৈতিক অর্থনীতি’তে উপস্থাপিত চিত্র সরকারি তথ্যের চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক। গবেষণায় দেখা গেছে, অবন্দোবস্তকৃত খাসজমি-জলাশয়ের পরিমাণ সরকারি হিসাবের চেয়ে ৫২.৮% বেশি। সরকারি হিসাবে অবন্দোবস্তকৃত জমির পরিমাণ ছিল ২৪,৭৭,৩০৯ একর, সেখানে গবেষণায় এই পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭,৮৬,১৯৬ একর। গবেষণা অনুযায়ী, দেশের মোট খাসজমি-জলাশয়ের প্রায় ৭৬.২% এখনও অবন্দোবস্তকৃত। বিস্তারিতভাবে দেখলে, কৃষি খাসজমির ৭৪.৩%, অকৃষি খাসজমির ৯৫.৬% এবং খাস জলাশয়ের ৫৬.২% এখনও অবন্দোবস্তকৃত।
এই পরিসংখ্যান স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, সরকারের হাতে যে পরিমাণ খাসজমি-জলাশয়ের হিসাব রয়েছে এবং যা বন্দোবস্ত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ সম্পদ এখনও বিতরণের বাইরে রয়েছে। গবেষণায় প্রাপ্ত এই বিশাল অবন্দোবস্তকৃত সম্পদ দেশের বিপুলসংখ্যক ভূমিহীন, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জন্য একটি বড় সুযোগ, যা কাজে লাগাতে পারলে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বিমোচনের চলমান প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করা সম্ভব। গবেষণার ফলাফল সরকারি তথ্যের চেয়ে বাস্তবতার অধিকতর কাছাকাছি বলে প্রতীয়মান হয় এবং এটি নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা বহন করে।
সরকারি এবং গবেষণালব্ধ উভয় তথ্যই নিশ্চিত করে যে, বাংলাদেশের একটি বিশাল পরিমাণ খাসজমি ও জলাশয় অব্যবহৃত বা অবন্দোবস্তকৃত অবস্থায় পড়ে আছে। তবে অধ্যাপক আবুল বারকাত ও তার সহগবেষকদের গবেষণা এই অবন্দোবস্তকৃত সম্পদের পরিমাণ যে সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি, সেই বাস্তবতাকে সামনে এনেছে। এই বিশাল অবন্দোবস্তকৃত সম্পদ দেশের দরিদ্র, ভূমিহীন, প্রান্তিক এবং নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আর্থ-সামাজিক মুক্তির এক বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
কৃষি খাসজমির সুষ্ঠু বন্দোবস্ত গ্রামীণ দরিদ্রদের সরাসরি কৃষিকাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেবে, যা তাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও আয় বৃদ্ধি করে জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে। খাস জলাশয়গুলো প্রকৃত মৎস্যজীবী বা জলজীবী সমবায় সমিতিগুলোকে ইজারা দেয়ার মাধ্যমে তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশা ও জীবন-জীবিকা সুরক্ষিত হবে এবং দারিদ্র্য কমবে।
তেমনি, শহরাঞ্চলের অবন্দোবস্তকৃত অকৃষি খাসজমি শহর এলাকার বস্তিবাসী ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য সুলভে আবাসনের ব্যবস্থা করতে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা শহরের ক্রমবর্ধমান আবাসন সংকট নিরসন এবং সামাজিক বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে। বিভাগ ও জেলাভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করলেও এই একই চিত্র ফুটে ওঠে, যেখানে অনেক অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ অবন্দোবস্তকৃত খাসজমি থাকা সত্ত্বেও ভূমিহীন ও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। এটি অঞ্চলভিত্তিক সুষম বণ্টন এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
খাসজমি ও জলাশয়ের ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সরকারি এবং ড. আবুল বারকাত ও তার সহগবেষকদের গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে এটা পরিষ্কার যে, এই মূল্যবান সম্পদের একটি বিশাল অংশ এখনও দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষের কল্যাণে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়নি। গবেষণায় প্রাপ্ত উচ্চতর অবন্দোবস্তকৃত জমির পরিমাণ প্রমাণ করে যে, এই সম্পদকে কাজে লাগানোর সুযোগ সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য অবন্দোবস্তকৃত খাসজমি-জলাশয় দ্রুত চিহ্নিত করে প্রকৃত হকদারদের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি।
এজন্য প্রয়োজন খাসজমি-জলাশয়ের একটি নির্ভুল ও হালনাগাদ তালিকা প্রস্তুত করা, বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ার সব ধাপে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, বিদ্যমান নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়ন এবং প্রকৃত ভূমিহীন ও জলজীবীদের চিহ্নিত করে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া। খাসজমি-জলাশয়ের সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত বণ্টন কেবল অর্থনৈতিক মুক্তিই আনবে না, এটি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই অবহেলিত সম্পদকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশের প্রকৃত উন্নয়ন বহুলাংশে ত্বরান্বিত হবে, যেমনটি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ও তার সহগবেষকদের গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশে খাসজমি-জলা: দারিদ্র্য-বৈষম্য বিমোচনের রাজনৈতিক অর্থনীতি’তে আলোকপাত করা হয়েছে। এটি নীতি নির্ধারকদের জন্য একটি অবশ্যপাঠ্য দলিল, যা দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় সংস্কার এবং ভূমিহীনদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]