সাঈদ চৌধুরী
এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন গাজীপুরের টঙ্গীতে এক মা তার দুই শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এমন ঘটনা শুনে মনে প্রশ্ন জাগেÑ এই বাস্তবতা শিশুদের সামনে কীভাবে তুলে ধরা যায় যাতে তাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে? আদৌ কি তা সম্ভব? ছোট ছোট শিশুরা যখন শোনে, একজন মা নিজ সন্তানদের কুপিয়ে হত্যা করেছেন, তখন তারা ভেতরে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়Ñ আমরা যদি তাদের অবস্থানে নিজেকে কল্পনা করি, তাহলেই অনুভব করতে পারি।
আজকাল পত্রিকার পাতায় আমরা দেখি সন্তান বিক্রি করে মা মোবাইল কিনেছেন। এই সন্তান ভবিষ্যতে বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে কতটা আগ্রহী হবে? যদিও এসব ঘটনা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত মানুষের দ্বারা সংঘটিত, তবু সমাজের ওপর এর প্রভাব গভীর ও ব্যাপক।
আমরা এখন এমন এক অস্থিরতার মধ্যে বাস করছি যেখানে কথারও সহ্যশক্তি কমে গেছে। কেউ কারো ভিন্নমত মেনে নিতে পারে না। সামান্য ঘটনায়ই সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে কিছু অটোচালক একজন মোটরসাইকেল আরোহীকে নির্মমভাবে মারধর করছে। মনস্তাত্ত্বিক এক যুদ্ধে যেন আমরা জড়িয়ে পড়েছি, যার পেছনে রয়েছে ক্ষমতার লড়াই, লালসা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি।
এই অস্থিরতা সংসার জীবনে পর্যন্ত চলে এসেছে। যে মা সন্তান হত্যা করেছেন, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন বলে দাবি উঠেছে। প্রশ্ন হলো, তিনি কেন এমন হলেন? তার স্বামী প্রবাসে ছিলেন, অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে বাধ্য হয়ে দূরে ছিলেন। কিন্তু প্রযুক্তির যুগে একাকীত্ব কীভাবে মানসিক চাপ তৈরি করে, তা কি আমরা যথেষ্ট বুঝতে পারি?
আজ আমরা যে পরিবার ভেঙে পড়ছে, সম্পর্ক শিথিল হচ্ছে, তার পেছনে দায় কার? মোবাইল কেনার জন্য সন্তান বিক্রি করা মানসিক বিকারগ্রস্ততার পরিচয়Ñ কিন্তু এই বিকার কীভাবে তৈরি হলো? কে উসকে দিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।
আমরা কেবল অপরাধের বহিরঙ্গ দেখি, ভেতরের উসকানিদাতাদের দেখি না। ফলে অপরাধ রোধের চেষ্টা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। উপরন্তু, অপরাধ যখন নানা মাধ্যমে নানা ব্যাখ্যায় উপস্থাপিত হয়, তখন মানুষের বিশ্লেষণ আরও বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে।
এই পরিস্থিতিতে অপরাধ প্রচারেও দরকার অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা ও দায়িত্বশীলতা। আজ নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষাÑ সবই প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও যৌন নির্যাতনের মতো জঘন্য অপরাধের খবর আসছে। এ দায় কার? কীভাবে ব্যাখ্যা করবো এই বিকৃতি?
একটি বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া ছেলে তুচ্ছ কারণে খুন হলো। হত্যাকারীর কি অনুশোচনা আছে? নাকি সে ভেবে নিচ্ছে, আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবে? রাজনীতির ছায়া এসব অপরাধে পড়ছে কিনা, সেটাও ভাবনার বিষয়।
পরকীয়া, কিশোর গ্যাং, নেশাÑ সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ সামাজিক সংকট। পরকীয়ার জন্য শুধু প্রযুক্তি দায়ী নয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কেও এসেছে শিথিলতা, অবহেলা, অনাকর্ষণ। সন্তান বড় হলে শারীরিক সম্পর্ক দুর্বল হয়, কিন্তু তা অন্যত্র গোপনে পূরণ করা হয়Ñ এখানে একধরনের আত্মপ্রতারণা কাজ করে, যা শেষ পর্যন্ত অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়।
তাই পরিবারে আন্তরিক সম্পর্ক, বোঝাপড়া, পারস্পরিক আকর্ষণ বজায় রাখার বিষয়গুলো অপরাধ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ধর্ম শিক্ষা নয়, দরকার বাস্তব জীবনভিত্তিক নৈতিকতা, সহানুভূতি ও সচেতনতা গড়ে তোলা।
কিশোর গ্যাং প্রসঙ্গেও অভিভাবকদের দায় অস্বীকার করা যায় না। সন্তানের হাতে মোবাইল আর মোটরসাইকেল ধরিয়ে দিয়ে তাদের যেন বাইরে থাকার লাইসেন্স দিচ্ছেন অনেকে। খেলার মাঠ নেই, পারিবারিক সময় নেই, সুস্থ বিনোদনের বিকল্প নেই। ফলে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে।
আমরা এখন এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ভালো উদাহরণ খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। আমাদের সমাজের ভেতর অদৃশ্য অপরাধ জন্ম নিচ্ছে, যা ঠেকাতে হলে ভেতরের দিক থেকেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থাও একমুখী হয়ে পড়েছে, খেলাধুলাবিহীন, আনন্দহীন শিক্ষা শিশুর মনন বিকাশে ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি সমাজে।
আমাদের শিশুদের সামনে আমরা যদি ভালো উদাহরণ উপস্থাপন করতে না পারি, তবে তারা শিখবে কীভাবে? আমরা চাই তারা শুনুক ভালো কথা, দেখুক ভালো কাজ। চাই তারা সমাজ নিয়ে ভাবুক, দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখুক, নিজেকে গড়–ক ভবিষ্যতের জন্য।
[লেখক : রসায়নবিদ]
সাঈদ চৌধুরী
মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫
এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন গাজীপুরের টঙ্গীতে এক মা তার দুই শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এমন ঘটনা শুনে মনে প্রশ্ন জাগেÑ এই বাস্তবতা শিশুদের সামনে কীভাবে তুলে ধরা যায় যাতে তাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে? আদৌ কি তা সম্ভব? ছোট ছোট শিশুরা যখন শোনে, একজন মা নিজ সন্তানদের কুপিয়ে হত্যা করেছেন, তখন তারা ভেতরে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়Ñ আমরা যদি তাদের অবস্থানে নিজেকে কল্পনা করি, তাহলেই অনুভব করতে পারি।
আজকাল পত্রিকার পাতায় আমরা দেখি সন্তান বিক্রি করে মা মোবাইল কিনেছেন। এই সন্তান ভবিষ্যতে বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে কতটা আগ্রহী হবে? যদিও এসব ঘটনা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত মানুষের দ্বারা সংঘটিত, তবু সমাজের ওপর এর প্রভাব গভীর ও ব্যাপক।
আমরা এখন এমন এক অস্থিরতার মধ্যে বাস করছি যেখানে কথারও সহ্যশক্তি কমে গেছে। কেউ কারো ভিন্নমত মেনে নিতে পারে না। সামান্য ঘটনায়ই সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে কিছু অটোচালক একজন মোটরসাইকেল আরোহীকে নির্মমভাবে মারধর করছে। মনস্তাত্ত্বিক এক যুদ্ধে যেন আমরা জড়িয়ে পড়েছি, যার পেছনে রয়েছে ক্ষমতার লড়াই, লালসা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি।
এই অস্থিরতা সংসার জীবনে পর্যন্ত চলে এসেছে। যে মা সন্তান হত্যা করেছেন, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন বলে দাবি উঠেছে। প্রশ্ন হলো, তিনি কেন এমন হলেন? তার স্বামী প্রবাসে ছিলেন, অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে বাধ্য হয়ে দূরে ছিলেন। কিন্তু প্রযুক্তির যুগে একাকীত্ব কীভাবে মানসিক চাপ তৈরি করে, তা কি আমরা যথেষ্ট বুঝতে পারি?
আজ আমরা যে পরিবার ভেঙে পড়ছে, সম্পর্ক শিথিল হচ্ছে, তার পেছনে দায় কার? মোবাইল কেনার জন্য সন্তান বিক্রি করা মানসিক বিকারগ্রস্ততার পরিচয়Ñ কিন্তু এই বিকার কীভাবে তৈরি হলো? কে উসকে দিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।
আমরা কেবল অপরাধের বহিরঙ্গ দেখি, ভেতরের উসকানিদাতাদের দেখি না। ফলে অপরাধ রোধের চেষ্টা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। উপরন্তু, অপরাধ যখন নানা মাধ্যমে নানা ব্যাখ্যায় উপস্থাপিত হয়, তখন মানুষের বিশ্লেষণ আরও বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে।
এই পরিস্থিতিতে অপরাধ প্রচারেও দরকার অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা ও দায়িত্বশীলতা। আজ নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষাÑ সবই প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও যৌন নির্যাতনের মতো জঘন্য অপরাধের খবর আসছে। এ দায় কার? কীভাবে ব্যাখ্যা করবো এই বিকৃতি?
একটি বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া ছেলে তুচ্ছ কারণে খুন হলো। হত্যাকারীর কি অনুশোচনা আছে? নাকি সে ভেবে নিচ্ছে, আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবে? রাজনীতির ছায়া এসব অপরাধে পড়ছে কিনা, সেটাও ভাবনার বিষয়।
পরকীয়া, কিশোর গ্যাং, নেশাÑ সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ সামাজিক সংকট। পরকীয়ার জন্য শুধু প্রযুক্তি দায়ী নয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কেও এসেছে শিথিলতা, অবহেলা, অনাকর্ষণ। সন্তান বড় হলে শারীরিক সম্পর্ক দুর্বল হয়, কিন্তু তা অন্যত্র গোপনে পূরণ করা হয়Ñ এখানে একধরনের আত্মপ্রতারণা কাজ করে, যা শেষ পর্যন্ত অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়।
তাই পরিবারে আন্তরিক সম্পর্ক, বোঝাপড়া, পারস্পরিক আকর্ষণ বজায় রাখার বিষয়গুলো অপরাধ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ধর্ম শিক্ষা নয়, দরকার বাস্তব জীবনভিত্তিক নৈতিকতা, সহানুভূতি ও সচেতনতা গড়ে তোলা।
কিশোর গ্যাং প্রসঙ্গেও অভিভাবকদের দায় অস্বীকার করা যায় না। সন্তানের হাতে মোবাইল আর মোটরসাইকেল ধরিয়ে দিয়ে তাদের যেন বাইরে থাকার লাইসেন্স দিচ্ছেন অনেকে। খেলার মাঠ নেই, পারিবারিক সময় নেই, সুস্থ বিনোদনের বিকল্প নেই। ফলে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে।
আমরা এখন এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ভালো উদাহরণ খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। আমাদের সমাজের ভেতর অদৃশ্য অপরাধ জন্ম নিচ্ছে, যা ঠেকাতে হলে ভেতরের দিক থেকেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থাও একমুখী হয়ে পড়েছে, খেলাধুলাবিহীন, আনন্দহীন শিক্ষা শিশুর মনন বিকাশে ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি সমাজে।
আমাদের শিশুদের সামনে আমরা যদি ভালো উদাহরণ উপস্থাপন করতে না পারি, তবে তারা শিখবে কীভাবে? আমরা চাই তারা শুনুক ভালো কথা, দেখুক ভালো কাজ। চাই তারা সমাজ নিয়ে ভাবুক, দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখুক, নিজেকে গড়–ক ভবিষ্যতের জন্য।
[লেখক : রসায়নবিদ]