এম এ হোসাইন
ওমান ও ইতালিতে অনুষ্ঠিত তিন দফা পরোক্ষ যুক্তরাষ্ট্র-ইরান আলোচনা শেষে আরো কয়েকটি আলোচনার পরিকল্পনা থাকলেও একটি পরিষ্কার চিত্র ফুটে উঠেছে; কোনো কঠোর শর্ত ব্যতিরেকে উভয় পক্ষই কী সম্ভব, তা নির্ণয়ের চেষ্টা করছে। এই সতর্ক কূটনীতি ইঙ্গিত দেয়, ইরান বরাবরের মতোই এমন আলোচনায় আগ্রহী যেখানে পেছনের দরজা খোলা থাকে, আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনÑ গভীরতার ঘাটতি থাকলেও “চুক্তি সম্পাদন” দেখানোর চাপ অনেক বেশিÑ এমন একটি অর্জন তুলে ধরতে মরিয়া, যা ট্রাম্পের “ডিলমেকার” ভাবমূর্তিকে টিকিয়ে রাখবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই বাস্তব অগ্রগতি অধরাই রয়ে গেছে।
এইবার যা বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হলো আলোচনার স্বর। কোনো পক্ষই তাড়াহুড়া করছে না, কিংবা নাটকীয় অবস্থান নিচ্ছে না; বরং এটি যেন এক ধীরগতির কৌশলগত দাবার খেলা। ওয়াশিংটন সামরিক জটিলতা ছাড়াই কূটনৈতিক সাফল্য খুঁজছে, আর তেহরান পশ্চিমা ধৈর্যের সীমা, নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা এবং কৌশলগত সহনশীলতা যাচাই করছে। আলোচনার পর যে ভাষা উঠে আসছে তা হলোÑ “ইতিবাচক”, “গঠনমূলক”, “চলমান”Ñ এগুলো কূটনৈতিক অস্পষ্টতার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে কার্যকলাপ চলমান কিন্তু অঙ্গীকার নেই।
তবে ঝুঁকিগুলো কোনোভাবেই বিমূর্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মধ্য প্রাচ্যের মিত্রদের মূল উদ্বেগ একইÑ ইরান যেন পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে না পারে। তেহরান এখনও দাবি করে যে তারা বোমা বানাতে চায় না, কিন্তু তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি এখনো ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধিত, যা অস্ত্র ব্যবহারের উপযোগী মানের কাছাকাছি। তাদের মজুদ বেড়েছে, সেন্ট্রিফিউজ আরও উন্নত হয়েছে এবং স্বচ্ছতা কমেছে, বিশেষ করে ২০২১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা হ্রাস পাওয়ার পর থেকে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের সামনে এটি যেমন সুযোগ, তেমনি এক ভয়ংকর গিরিপথ। ট্রাম্প, যিনি সবসময় নাটকীয় পররাষ্ট্র নীতি অর্জনে আগ্রহী, তিনি এই ইরান ইস্যুকে এক “ঐতিহাসিক চুক্তির” সুযোগ হিসেবে দেখতে ভালো বাসবেনÑ এমন কিছু করতে চাইবেন যা তাকে প্রশংসিত করতে পারে। কিন্তু উচ্চাকাক্সক্ষা কখনোই কার্যকরী কৌশল নয়, বরং আর একটি ভুল পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে বহু বছরের অস্থিরতা নিশ্চিত করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জন্য প্রধান দোটানার একটি হলো, “ভালো চুক্তি” বলতে কী বোঝায়Ñ এবং সেটা কার জন্য? ইরান হয়তো ৪ শতাংশ সমৃদ্ধকরণের একটি সীমা মেনে নিতে পারে, যা অস্ত্র মানের নিচে কিন্তু বেসামরিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট। বিনিময়ে, তারা চায় ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও বিদ্যমান পারমাণবিক পরিকাঠামো বজায় রাখার অধিকার, এর মধ্যে উন্নত সেন্ট্রিফিউজ এবং ৬০ শতাংশের নিচে থাকা ইউরেনিয়ামের মজুদও অন্তর্ভুক্ত।
এই ধরনের একটি কাঠামো হয়তো পশ্চিমা আলোচকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যারা সময় কিনতে চায় এবং সরাসরি পরমাণু বিস্তার রোধ করতে আগ্রহী। কিন্তু আঞ্চলিক অংশীদারদের, বিশেষ করে ইসরায়েলের জন্য এটি হবে কঠিন বোঝা। ইসরায়েল বরাবরই ইরানের পরমাণু সক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংসের পক্ষেÑ এর মধ্যে উচ্চ মাত্রার ইউরেনিয়াম মজুদ ধ্বংস ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পশ্চাদপসরণ অন্তর্ভুক্ত। তাদের দৃষ্টিতে “লিবিয়া-মডেল” হলো আদর্শ: সম্পূর্ণ, যাচাইযোগ্য এবং অপরিবর্তনীয় নিরস্ত্রীকরণ। এর চেয়ে কম কিছু হলে তা ইসরায়েলের জন্য কোন মতেই শান্তির পূর্বাভাস নয়।
অন্যদিকে, আরব উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর উদ্বেগ কিছুটা আলাদা। তারা ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাক্সক্ষা নিয়ে ইসরায়েলের মতোই সন্দিহান হলেও, তাদের বৃহত্তর উদ্বেগ তেহরানের আঞ্চলিক আচরণ। ইয়েমেন, লেবানন, ইরাক ও সিরিয়ায় ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের উপস্থিতি একটি বড় অস্থিতিশীলতার উৎস। ইরানবিরোধী সমালোচকরা বলেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যৌথ সমন্বিত কার্য পরিকল্পনা চুক্তির মূল দুর্বলতা ছিল এটি কেবল পরমাণু ইস্যুতে কেন্দ্রীভূত ছিল, যেখানে ইরানের উচ্চাভিলাষী আঞ্চলিক তৎপরতাকে উপেক্ষা করেছে। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো আশঙ্কা করছে, ইতিহাস হয়তো আবারও নিজেকে পুনরাবৃত্তি করতে পারেÑ যেভাবে তেহরান অর্থনৈতিক সুবিধাও নিবে, আবার মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাও জিইয়ে রাখবে।
তবে, এবার কিছুটা অন্য রকমের ইঙ্গিত মিলছে যেখানে ইরান এখন আগের চেয়ে কিছুটা নমনীয়। অর্থনৈতিকভাবে দেশটি চরম চাপের মুখে। বহু বছরের মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে ভেঙে দিয়েছে, সরকারি কোষাগার খালি করেছে, আর অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বাড়িয়েছে। ২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর যে বিক্ষোভ শুরু হয়, তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল নাÑ বরং একটি প্রজন্মগত ব্যবধানের প্রতিফলন: ইরানের বৃদ্ধ বিপ্লবী নেতৃত্ব বনাম এক তরুণ, ডিজিটালভাবে সংযুক্ত প্রজন্ম।
ইরান সরকারের দুর্ভেদ্য ভাবমূর্তিও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। শাহিদ রাজায়ী বন্দরে বিস্ফোরণ যেখানে ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র জ্বালানি জড়িত ছিল বলে ধারণা করা হয়, এই দুর্ঘটনা থেকে প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তা ও দক্ষতা নিয়ে। অন্যদিকে, ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবও কমছে, লেবাননে হিজবুল্লাহর অবস্থান দুর্বল, সিরিয়ায় আসাদের সরকার বিদায় নিয়েছে, আর হামাস ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলে হামলার পর ব্যাপক পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্তের সম্মুখীন।
তেহরান তাই হয়তো নতুন হিসাব-নিকাশ করছে। আদর্শগত কারণে নয়, বরং কঠিন কৌশলগত বাস্তবতার কারণে। এমন একটি চুক্তি, যা অর্থনীতি স্থিতিশীল করবে, বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশাধিকার ফিরিয়ে দেবে এবং ঘরোয়া অস্থিরতা কমাবেÑ তা কিছু ছাড় দেয়ার মতো মূল্যবান হতে পারে, যদি ওই ছাড় ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ও আঞ্চলিক প্রভাব অক্ষুণœ রাখে।
একই সঙ্গে, বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ট্রাম্পের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে সংশয় বেড়েছে। ব্রাসেলস ও বার্লিনে উদ্বেগ ছড়িয়েছে, ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফ নিয়মিত মস্কোয় ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করছেন। এটি প্রতীকী, না কি মধ্যপ্রাচ্য নিয়েও মস্কো-ওয়াশিংটনের সম্ভাব্য সমন্বয়ের ইঙ্গিত?
ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকে, ট্রাম্পের কৌশল হয়তো একটি সুযোগ। বাইডেন যেখানে বহু পক্ষীয় সমন্বয়ের ওপর জোর দিয়েছেন, ট্রাম্প বরাবরই একক চমকপ্রদ কূটনীতিতে আগ্রহী ছিলেন। তেহরান হয়তো ভাবছে, প্রতীকী কিছু ইঙ্গিতÑ উদাহরণস্বরূপ বোয়িংয়ের সঙ্গে নতুন চুক্তি, বা মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য তেল প্রকল্পÑ হোয়াইট হাউসকে একটি অসম চুক্তির দিকে টানতে পারে। ট্রাম্পের লেনদেনভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি দৃশ্যমান ফলাফলকে কাঠামোগত সংস্কারের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।
এই সম্ভাবনায় অনেকেই শঙ্কিত। একটি চুক্তি, যা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি, প্রক্সি যুদ্ধ, ও ঘরোয়া দমন-পীড়নের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়, তা আরও আগ্রাসনকে উৎসাহিত করতে পারে। ২০১৫ সালের পর অঞ্চল অনেক বদলে গেছে। আব্রাহাম চুক্তি নতুন মৈত্রী গড়েছে, আর ৭ অক্টোবর হামাসের হামলাÑ যার পেছনে ইরানি সহায়তা ছিল বলেই ধারণা করা হয়, তা পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারকে আরও কঠোর করে তুলেছে।
যদি একটি পারমাণবিক চুক্তি হয়েও যায়, প্রশ্ন থেকে যায়: এটি কী ধরনের শান্তি নিশ্চিত করবে? এটি কি কূটনীতির জন্য সময় কিনবে, না কি কেবল অনিবার্যতা বিলম্বিত করবে? তার চেয়েও উদ্বেগজনক, খারাপভাবে গড়া চুক্তি কি নতুন এক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করতে পারে, যেখানে সৌদি আরবসহ অন্যরা নিজস্ব পরমাণু সক্ষমতা গড়ার চিন্তা শুরু করবে?
এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা শুধু একটি চুক্তি নয়, বরং একটি কৌশলÑ যা পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণকে আঞ্চলিক প্রতিরোধের সঙ্গে, অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততাকে মানবাধিকার উদ্বেগের সঙ্গে এবং স্বল্পমেয়াদি কূটনীতিকে দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবতার সঙ্গে একীভূত করবে। ওয়াশিংটনের চ্যালেঞ্জ হলো সহজ বিজয়ের মোহে না পড়ে এমন একটি সমাধানে পৌঁছানোÑ যা কার্যকর, বিস্তৃত এবং মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তর নিরাপত্তা কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ট্রাম্প প্রশাসন এমন কৌশলগত দূরদর্শিতা দেখাতে পারবে কি না, তা এখনও অনিশ্চিত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতির রেকর্ড অগোছালো, নাটকীয় পদক্ষেপ থেকে হঠাৎ প্রত্যাহার পর্যন্ত, অনেকক্ষেত্রেই অগ্রগতিহীন। তবুও ইতিহাস দ্বিতীয় সুযোগ দিতে জানে। যদি ট্রাম্প নিজেকে ট্যারিফ আর টুইটের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চান, তাহলে একটি টেকসই, যাচাইযোগ্য ইরান চুক্তি, যা ঘরোয়া বিশ্বাসযোগ্যতা ও আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করবেÑ সেটিই হতে পারে তার জন্য উপযুক্ত সূচনা।
কিন্তু সময় ফুরিয়ে আসছে। ইরানের পারমাণবিক ঘড়ি চলছে, আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ছে, এবং পারস্পরিক আস্থা যেটুকু ছিল তা এখন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এখন যা দরকার তা হলো উদ্দেশ্যের স্বচ্ছতা, নেতৃত্বে স্থিরতা এবং অতীত ভুল থেকে শেখার বিনয়। ওয়াশিংটন হয়তো এই পারমাণবিক অচলাবস্থার সমাধান করতে পারবে। তবে তা করতে হলে, প্রথমে তাদের নিজেদের দ্বিধা কাটাতে হবে। তারা কি সত্যিই শান্তি চায়, না কি চায় শুধু একটি শিরোনাম?
[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]
এম এ হোসাইন
শনিবার, ১০ মে ২০২৫
ওমান ও ইতালিতে অনুষ্ঠিত তিন দফা পরোক্ষ যুক্তরাষ্ট্র-ইরান আলোচনা শেষে আরো কয়েকটি আলোচনার পরিকল্পনা থাকলেও একটি পরিষ্কার চিত্র ফুটে উঠেছে; কোনো কঠোর শর্ত ব্যতিরেকে উভয় পক্ষই কী সম্ভব, তা নির্ণয়ের চেষ্টা করছে। এই সতর্ক কূটনীতি ইঙ্গিত দেয়, ইরান বরাবরের মতোই এমন আলোচনায় আগ্রহী যেখানে পেছনের দরজা খোলা থাকে, আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনÑ গভীরতার ঘাটতি থাকলেও “চুক্তি সম্পাদন” দেখানোর চাপ অনেক বেশিÑ এমন একটি অর্জন তুলে ধরতে মরিয়া, যা ট্রাম্পের “ডিলমেকার” ভাবমূর্তিকে টিকিয়ে রাখবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই বাস্তব অগ্রগতি অধরাই রয়ে গেছে।
এইবার যা বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হলো আলোচনার স্বর। কোনো পক্ষই তাড়াহুড়া করছে না, কিংবা নাটকীয় অবস্থান নিচ্ছে না; বরং এটি যেন এক ধীরগতির কৌশলগত দাবার খেলা। ওয়াশিংটন সামরিক জটিলতা ছাড়াই কূটনৈতিক সাফল্য খুঁজছে, আর তেহরান পশ্চিমা ধৈর্যের সীমা, নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা এবং কৌশলগত সহনশীলতা যাচাই করছে। আলোচনার পর যে ভাষা উঠে আসছে তা হলোÑ “ইতিবাচক”, “গঠনমূলক”, “চলমান”Ñ এগুলো কূটনৈতিক অস্পষ্টতার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে কার্যকলাপ চলমান কিন্তু অঙ্গীকার নেই।
তবে ঝুঁকিগুলো কোনোভাবেই বিমূর্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মধ্য প্রাচ্যের মিত্রদের মূল উদ্বেগ একইÑ ইরান যেন পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে না পারে। তেহরান এখনও দাবি করে যে তারা বোমা বানাতে চায় না, কিন্তু তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি এখনো ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধিত, যা অস্ত্র ব্যবহারের উপযোগী মানের কাছাকাছি। তাদের মজুদ বেড়েছে, সেন্ট্রিফিউজ আরও উন্নত হয়েছে এবং স্বচ্ছতা কমেছে, বিশেষ করে ২০২১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা হ্রাস পাওয়ার পর থেকে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের সামনে এটি যেমন সুযোগ, তেমনি এক ভয়ংকর গিরিপথ। ট্রাম্প, যিনি সবসময় নাটকীয় পররাষ্ট্র নীতি অর্জনে আগ্রহী, তিনি এই ইরান ইস্যুকে এক “ঐতিহাসিক চুক্তির” সুযোগ হিসেবে দেখতে ভালো বাসবেনÑ এমন কিছু করতে চাইবেন যা তাকে প্রশংসিত করতে পারে। কিন্তু উচ্চাকাক্সক্ষা কখনোই কার্যকরী কৌশল নয়, বরং আর একটি ভুল পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে বহু বছরের অস্থিরতা নিশ্চিত করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জন্য প্রধান দোটানার একটি হলো, “ভালো চুক্তি” বলতে কী বোঝায়Ñ এবং সেটা কার জন্য? ইরান হয়তো ৪ শতাংশ সমৃদ্ধকরণের একটি সীমা মেনে নিতে পারে, যা অস্ত্র মানের নিচে কিন্তু বেসামরিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট। বিনিময়ে, তারা চায় ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও বিদ্যমান পারমাণবিক পরিকাঠামো বজায় রাখার অধিকার, এর মধ্যে উন্নত সেন্ট্রিফিউজ এবং ৬০ শতাংশের নিচে থাকা ইউরেনিয়ামের মজুদও অন্তর্ভুক্ত।
এই ধরনের একটি কাঠামো হয়তো পশ্চিমা আলোচকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যারা সময় কিনতে চায় এবং সরাসরি পরমাণু বিস্তার রোধ করতে আগ্রহী। কিন্তু আঞ্চলিক অংশীদারদের, বিশেষ করে ইসরায়েলের জন্য এটি হবে কঠিন বোঝা। ইসরায়েল বরাবরই ইরানের পরমাণু সক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংসের পক্ষেÑ এর মধ্যে উচ্চ মাত্রার ইউরেনিয়াম মজুদ ধ্বংস ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পশ্চাদপসরণ অন্তর্ভুক্ত। তাদের দৃষ্টিতে “লিবিয়া-মডেল” হলো আদর্শ: সম্পূর্ণ, যাচাইযোগ্য এবং অপরিবর্তনীয় নিরস্ত্রীকরণ। এর চেয়ে কম কিছু হলে তা ইসরায়েলের জন্য কোন মতেই শান্তির পূর্বাভাস নয়।
অন্যদিকে, আরব উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর উদ্বেগ কিছুটা আলাদা। তারা ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাক্সক্ষা নিয়ে ইসরায়েলের মতোই সন্দিহান হলেও, তাদের বৃহত্তর উদ্বেগ তেহরানের আঞ্চলিক আচরণ। ইয়েমেন, লেবানন, ইরাক ও সিরিয়ায় ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের উপস্থিতি একটি বড় অস্থিতিশীলতার উৎস। ইরানবিরোধী সমালোচকরা বলেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যৌথ সমন্বিত কার্য পরিকল্পনা চুক্তির মূল দুর্বলতা ছিল এটি কেবল পরমাণু ইস্যুতে কেন্দ্রীভূত ছিল, যেখানে ইরানের উচ্চাভিলাষী আঞ্চলিক তৎপরতাকে উপেক্ষা করেছে। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো আশঙ্কা করছে, ইতিহাস হয়তো আবারও নিজেকে পুনরাবৃত্তি করতে পারেÑ যেভাবে তেহরান অর্থনৈতিক সুবিধাও নিবে, আবার মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাও জিইয়ে রাখবে।
তবে, এবার কিছুটা অন্য রকমের ইঙ্গিত মিলছে যেখানে ইরান এখন আগের চেয়ে কিছুটা নমনীয়। অর্থনৈতিকভাবে দেশটি চরম চাপের মুখে। বহু বছরের মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে ভেঙে দিয়েছে, সরকারি কোষাগার খালি করেছে, আর অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বাড়িয়েছে। ২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর যে বিক্ষোভ শুরু হয়, তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল নাÑ বরং একটি প্রজন্মগত ব্যবধানের প্রতিফলন: ইরানের বৃদ্ধ বিপ্লবী নেতৃত্ব বনাম এক তরুণ, ডিজিটালভাবে সংযুক্ত প্রজন্ম।
ইরান সরকারের দুর্ভেদ্য ভাবমূর্তিও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। শাহিদ রাজায়ী বন্দরে বিস্ফোরণ যেখানে ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র জ্বালানি জড়িত ছিল বলে ধারণা করা হয়, এই দুর্ঘটনা থেকে প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তা ও দক্ষতা নিয়ে। অন্যদিকে, ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবও কমছে, লেবাননে হিজবুল্লাহর অবস্থান দুর্বল, সিরিয়ায় আসাদের সরকার বিদায় নিয়েছে, আর হামাস ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলে হামলার পর ব্যাপক পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্তের সম্মুখীন।
তেহরান তাই হয়তো নতুন হিসাব-নিকাশ করছে। আদর্শগত কারণে নয়, বরং কঠিন কৌশলগত বাস্তবতার কারণে। এমন একটি চুক্তি, যা অর্থনীতি স্থিতিশীল করবে, বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশাধিকার ফিরিয়ে দেবে এবং ঘরোয়া অস্থিরতা কমাবেÑ তা কিছু ছাড় দেয়ার মতো মূল্যবান হতে পারে, যদি ওই ছাড় ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ও আঞ্চলিক প্রভাব অক্ষুণœ রাখে।
একই সঙ্গে, বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ট্রাম্পের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে সংশয় বেড়েছে। ব্রাসেলস ও বার্লিনে উদ্বেগ ছড়িয়েছে, ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফ নিয়মিত মস্কোয় ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করছেন। এটি প্রতীকী, না কি মধ্যপ্রাচ্য নিয়েও মস্কো-ওয়াশিংটনের সম্ভাব্য সমন্বয়ের ইঙ্গিত?
ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকে, ট্রাম্পের কৌশল হয়তো একটি সুযোগ। বাইডেন যেখানে বহু পক্ষীয় সমন্বয়ের ওপর জোর দিয়েছেন, ট্রাম্প বরাবরই একক চমকপ্রদ কূটনীতিতে আগ্রহী ছিলেন। তেহরান হয়তো ভাবছে, প্রতীকী কিছু ইঙ্গিতÑ উদাহরণস্বরূপ বোয়িংয়ের সঙ্গে নতুন চুক্তি, বা মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য তেল প্রকল্পÑ হোয়াইট হাউসকে একটি অসম চুক্তির দিকে টানতে পারে। ট্রাম্পের লেনদেনভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি দৃশ্যমান ফলাফলকে কাঠামোগত সংস্কারের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।
এই সম্ভাবনায় অনেকেই শঙ্কিত। একটি চুক্তি, যা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি, প্রক্সি যুদ্ধ, ও ঘরোয়া দমন-পীড়নের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়, তা আরও আগ্রাসনকে উৎসাহিত করতে পারে। ২০১৫ সালের পর অঞ্চল অনেক বদলে গেছে। আব্রাহাম চুক্তি নতুন মৈত্রী গড়েছে, আর ৭ অক্টোবর হামাসের হামলাÑ যার পেছনে ইরানি সহায়তা ছিল বলেই ধারণা করা হয়, তা পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারকে আরও কঠোর করে তুলেছে।
যদি একটি পারমাণবিক চুক্তি হয়েও যায়, প্রশ্ন থেকে যায়: এটি কী ধরনের শান্তি নিশ্চিত করবে? এটি কি কূটনীতির জন্য সময় কিনবে, না কি কেবল অনিবার্যতা বিলম্বিত করবে? তার চেয়েও উদ্বেগজনক, খারাপভাবে গড়া চুক্তি কি নতুন এক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করতে পারে, যেখানে সৌদি আরবসহ অন্যরা নিজস্ব পরমাণু সক্ষমতা গড়ার চিন্তা শুরু করবে?
এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা শুধু একটি চুক্তি নয়, বরং একটি কৌশলÑ যা পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণকে আঞ্চলিক প্রতিরোধের সঙ্গে, অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততাকে মানবাধিকার উদ্বেগের সঙ্গে এবং স্বল্পমেয়াদি কূটনীতিকে দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবতার সঙ্গে একীভূত করবে। ওয়াশিংটনের চ্যালেঞ্জ হলো সহজ বিজয়ের মোহে না পড়ে এমন একটি সমাধানে পৌঁছানোÑ যা কার্যকর, বিস্তৃত এবং মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তর নিরাপত্তা কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ট্রাম্প প্রশাসন এমন কৌশলগত দূরদর্শিতা দেখাতে পারবে কি না, তা এখনও অনিশ্চিত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতির রেকর্ড অগোছালো, নাটকীয় পদক্ষেপ থেকে হঠাৎ প্রত্যাহার পর্যন্ত, অনেকক্ষেত্রেই অগ্রগতিহীন। তবুও ইতিহাস দ্বিতীয় সুযোগ দিতে জানে। যদি ট্রাম্প নিজেকে ট্যারিফ আর টুইটের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চান, তাহলে একটি টেকসই, যাচাইযোগ্য ইরান চুক্তি, যা ঘরোয়া বিশ্বাসযোগ্যতা ও আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করবেÑ সেটিই হতে পারে তার জন্য উপযুক্ত সূচনা।
কিন্তু সময় ফুরিয়ে আসছে। ইরানের পারমাণবিক ঘড়ি চলছে, আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ছে, এবং পারস্পরিক আস্থা যেটুকু ছিল তা এখন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এখন যা দরকার তা হলো উদ্দেশ্যের স্বচ্ছতা, নেতৃত্বে স্থিরতা এবং অতীত ভুল থেকে শেখার বিনয়। ওয়াশিংটন হয়তো এই পারমাণবিক অচলাবস্থার সমাধান করতে পারবে। তবে তা করতে হলে, প্রথমে তাদের নিজেদের দ্বিধা কাটাতে হবে। তারা কি সত্যিই শান্তি চায়, না কি চায় শুধু একটি শিরোনাম?
[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক]