আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
আজকের বিশ্বব্যাপী নগরায়ণের প্রবণতা একদিকে যেমন আধুনিক জীবনযাত্রার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে তা পরিবেশের ওপর বহুমুখী প্রভাব ফেলছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে পরিকল্পিতভাবে নগর গঠন ও উন্নয়নের দায়িত্ব যে শুধু নগর পরিকল্পনাবিদদের নয়, বরং রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও সমানভাবে জড়িত থাকা প্রয়োজন, তা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একটি পরিবেশবান্ধব নগর বা শহর বলতে বোঝায় এমন একটি বসতিস্থল যেখানে আবাসন, পরিবহন, জলবায়ু, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সবুজের পরিসর বা বনায়ন সবকিছু মিলিয়ে টেকসই ও বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় থাকে। এ ধরনের নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দৃষ্টিভঙ্গির স্থায়িত্ব, নীতি-নির্ধারণে দূরদর্শিতা এবং প্রশাসনিক সমন্বয় অপরিহার্য। রাজনীতিবিদরা যেহেতু সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করেন এবং নীতিমালার মাধ্যমে একটি দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো নির্ধারণ করেন, তাই পরিবেশবান্ধব নগর গঠনে তাদের সক্রিয় ও ইতিবাচক অংশগ্রহণ ছাড়া এ লক্ষ্য অর্জন দুরূহ।
বর্তমান বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ যেমন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো, জার্মানি কিংবা জাপান পরিবেশবান্ধব নগর ব্যবস্থাপনায় রাজনীতিবিদদের দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে। সেখানে রাজনীতিবিদরা পরিবেশের সমস্যাগুলোকে কেবলমাত্র একটি পরিপূরক বিবেচ্য বিষয় হিসেবে না দেখে, বরং একটি প্রধান আর্থসামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তারা সবুজ নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন, পরিবেশসম্মত অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন এবং জনগণকে পরিবেশবিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে উদ্যোগ নিয়েছেন। এ উদাহরণগুলো আমাদের দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবেশবান্ধব নগরায়ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রতি বছর গ্রাম থেকে শহরমুখী জনগোষ্ঠীর চাপ, অপরিকল্পিত নির্মাণ, দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নগরগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ঢাকাসহ অন্যান্য প্রধান শহরে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, ট্রাফিক জ্যাম, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা ও সবুজায়নের অভাব নগরবাসীর জীবনে এক ধরনের নীরব সংকট ডেকে আনছে। এ বাস্তবতায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা নতুনভাবে পর্যালোচনা করা অত্যন্ত জরুরি।
আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের উচিত পরিবেশ সংরক্ষণের প্রশ্নে নীতিগত অঙ্গীকার নিশ্চিত করা এবং সেটিকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখে জাতীয় উন্নয়নের মূল কৌশল হিসেবে বিবেচনা করা। প্রতিটি নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশবান্ধব নগর গঠনের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত শহর উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সেটি বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশে প্রায়শই দেখা যায় যে একটি সরকার একটি প্রকল্প শুরু করলেও পরবর্তী সরকার সেটি বাতিল করে নতুন প্রকল্প হাতে নেয়। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ধারাবাহিকতার অভাব নগর পরিকল্পনাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এর ফলে একদিকে যেমন জনসম্পদ ও অর্থের অপচয় হয়, অন্যদিকে কাক্সিক্ষত ফলও আসে না। তাই রাজনীতিবিদদের উচিত সব দলের মধ্যে পরিবেশের সমস্যাগুলোকে সর্বসম্মত সংলাপ ও সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করা এবং যেকোনো নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে পরিবেশগত মূল্যায়নকে বাধ্যতামূলক করা।
পরিবেশবান্ধব নগর গঠনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা। রাজনীতিবিদরা যদি এই লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেন তবে জলাধার, খাল-বিল, নদী, বনাঞ্চল এবং খোলা স্থানগুলো রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে যথাযথ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব। একটি নগরের বায়ু, পানি, মাটি এবং শব্দের গুণগত মান রক্ষা করার জন্য পরিবেশ সংক্রান্ত আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক সহযোগিতা জরুরি। প্রায়শই দেখা যায় যে অবৈধ দখল, বর্জ্য ফেলা, বা বন উজাড়ের ঘটনাগুলো রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে রোধ করা যায় না। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে রাজনীতিবিদদের পরিবেশ সুরক্ষায় অচলাবস্থা ভাঙতে হবে এবং শক্ত হাতে পরিবেশবিধি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবেশবান্ধব নগর গঠনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা। উন্নত গণপরিবহন যেমন মেট্রোরেল, বিআরটি, ইলেকট্রিক বাস ইত্যাদি চালু ও সম্প্রসারণে সরকারের বিনিয়োগ এবং রাজনৈতিক অগ্রাধিকার অত্যন্ত প্রয়োজন। একইসাথে সাইকেল চালনার সুবিধা, হাঁটার পথ ও সবুজ করিডোর তৈরি করতে হলে নগর উন্নয়নের নীতি-নির্ধারণে রাজনীতিবিদদের পরিবেশবান্ধব চিন্তা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রতি দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, সৌরশক্তি ও জিওথার্মাল শক্তির ব্যবহার উৎসাহিত করতে হলে রাজনৈতিকভাবে কর প্রণোদনা, আর্থিক সহায়তা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার কার্যক্রমও পরিচালনা করতে হবে।
এছাড়াও নগর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি জ্বলন্ত ইস্যু যেখানে রাজনীতিবিদদের ইতিবাচক হস্তক্ষেপ অপরিহার্য। বাংলাদেশে এখনও অধিকাংশ শহরে বর্জ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট দুর্বল। এক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থাকলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নজরদারির অভাবে কার্যকর বাস্তবায়ন হয় না। অথচ বর্জ্য থেকে জৈবসার, বিদ্যুৎ উৎপাদন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী আহরণ ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব, যদি রাজনৈতিক নেতারা এটি তাদের উন্নয়নের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করেন।
অন্যদিকে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, শিক্ষা ও সচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা এবং পরিবেশগত আচরণ গঠনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা প্রয়োজন। রাজনীতিবিদরা যদি পরিবেশের বিষয়গুলোকে জাতীয় শিক্ষা নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আইন প্রণয়ন করেন, তাহলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তোলা অনেক সহজ হবে। পাশাপাশি টিভি, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য প্রচারপত্রে পরিবেশবান্ধব আচরণে উৎসাহিত করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
এছাড়া স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে পরিবেশবান্ধব নগর গঠনের ক্ষেত্রে জনগণের চাহিদা ও সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা জরুরি। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যাতে বাস্তবসম্মত ও পরিবেশসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন, তার জন্য কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকনির্দেশনা ও সম্পদ বরাদ্দ দিতে হবে। অনেকে বলেন, স্থানীয় রাজনীতিবিদরা পরিবেশ ইস্যুতে কাজ করতে চাইলেও তারা কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা না পাওয়ায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন না। সুতরাং কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য একটি পরিবেশনীতিভিত্তিক সাংবিধানিক কাঠামো তৈরি করতে হবে।
পরিবেশবান্ধব নগর গঠনে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক। পরিবেশবান্ধব নগর গঠন কেবল একটি প্রযুক্তিনির্ভর নগর পরিকল্পনার ফল নয়, বরং এটি একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দর্শন, যার নেতৃত্ব দিতে পারেন কেবলমাত্র দায়িত্বশীল, দূরদর্শী ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতিবিদরা। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, এবং নগরজীবনের দুর্ভোগ দূর করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে সঠিক পথ দেখাতে। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরিবেশ ইস্যুতে সর্বসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি, টেকসই উন্নয়নের প্রতি অঙ্গীকার এবং সব স্তরের জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা সৃষ্টি। যদি রাজনীতিবিদরা পরিবেশবান্ধব নগর গঠনের উদ্যোগকে একটি জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সেটিকে বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ করেন, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ, বাসযোগ্য ও টেকসই নগর গড়ে তোলা সম্ভব।
[লেখক : ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি]
আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
শনিবার, ৩১ মে ২০২৫
আজকের বিশ্বব্যাপী নগরায়ণের প্রবণতা একদিকে যেমন আধুনিক জীবনযাত্রার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে তা পরিবেশের ওপর বহুমুখী প্রভাব ফেলছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে পরিকল্পিতভাবে নগর গঠন ও উন্নয়নের দায়িত্ব যে শুধু নগর পরিকল্পনাবিদদের নয়, বরং রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও সমানভাবে জড়িত থাকা প্রয়োজন, তা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একটি পরিবেশবান্ধব নগর বা শহর বলতে বোঝায় এমন একটি বসতিস্থল যেখানে আবাসন, পরিবহন, জলবায়ু, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সবুজের পরিসর বা বনায়ন সবকিছু মিলিয়ে টেকসই ও বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় থাকে। এ ধরনের নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দৃষ্টিভঙ্গির স্থায়িত্ব, নীতি-নির্ধারণে দূরদর্শিতা এবং প্রশাসনিক সমন্বয় অপরিহার্য। রাজনীতিবিদরা যেহেতু সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করেন এবং নীতিমালার মাধ্যমে একটি দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো নির্ধারণ করেন, তাই পরিবেশবান্ধব নগর গঠনে তাদের সক্রিয় ও ইতিবাচক অংশগ্রহণ ছাড়া এ লক্ষ্য অর্জন দুরূহ।
বর্তমান বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ যেমন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো, জার্মানি কিংবা জাপান পরিবেশবান্ধব নগর ব্যবস্থাপনায় রাজনীতিবিদদের দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে। সেখানে রাজনীতিবিদরা পরিবেশের সমস্যাগুলোকে কেবলমাত্র একটি পরিপূরক বিবেচ্য বিষয় হিসেবে না দেখে, বরং একটি প্রধান আর্থসামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তারা সবুজ নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন, পরিবেশসম্মত অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন এবং জনগণকে পরিবেশবিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে উদ্যোগ নিয়েছেন। এ উদাহরণগুলো আমাদের দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবেশবান্ধব নগরায়ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রতি বছর গ্রাম থেকে শহরমুখী জনগোষ্ঠীর চাপ, অপরিকল্পিত নির্মাণ, দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নগরগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ঢাকাসহ অন্যান্য প্রধান শহরে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, ট্রাফিক জ্যাম, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা ও সবুজায়নের অভাব নগরবাসীর জীবনে এক ধরনের নীরব সংকট ডেকে আনছে। এ বাস্তবতায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা নতুনভাবে পর্যালোচনা করা অত্যন্ত জরুরি।
আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের উচিত পরিবেশ সংরক্ষণের প্রশ্নে নীতিগত অঙ্গীকার নিশ্চিত করা এবং সেটিকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখে জাতীয় উন্নয়নের মূল কৌশল হিসেবে বিবেচনা করা। প্রতিটি নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশবান্ধব নগর গঠনের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত শহর উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সেটি বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশে প্রায়শই দেখা যায় যে একটি সরকার একটি প্রকল্প শুরু করলেও পরবর্তী সরকার সেটি বাতিল করে নতুন প্রকল্প হাতে নেয়। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ধারাবাহিকতার অভাব নগর পরিকল্পনাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এর ফলে একদিকে যেমন জনসম্পদ ও অর্থের অপচয় হয়, অন্যদিকে কাক্সিক্ষত ফলও আসে না। তাই রাজনীতিবিদদের উচিত সব দলের মধ্যে পরিবেশের সমস্যাগুলোকে সর্বসম্মত সংলাপ ও সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করা এবং যেকোনো নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে পরিবেশগত মূল্যায়নকে বাধ্যতামূলক করা।
পরিবেশবান্ধব নগর গঠনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা। রাজনীতিবিদরা যদি এই লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেন তবে জলাধার, খাল-বিল, নদী, বনাঞ্চল এবং খোলা স্থানগুলো রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে যথাযথ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব। একটি নগরের বায়ু, পানি, মাটি এবং শব্দের গুণগত মান রক্ষা করার জন্য পরিবেশ সংক্রান্ত আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক সহযোগিতা জরুরি। প্রায়শই দেখা যায় যে অবৈধ দখল, বর্জ্য ফেলা, বা বন উজাড়ের ঘটনাগুলো রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে রোধ করা যায় না। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে রাজনীতিবিদদের পরিবেশ সুরক্ষায় অচলাবস্থা ভাঙতে হবে এবং শক্ত হাতে পরিবেশবিধি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবেশবান্ধব নগর গঠনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা। উন্নত গণপরিবহন যেমন মেট্রোরেল, বিআরটি, ইলেকট্রিক বাস ইত্যাদি চালু ও সম্প্রসারণে সরকারের বিনিয়োগ এবং রাজনৈতিক অগ্রাধিকার অত্যন্ত প্রয়োজন। একইসাথে সাইকেল চালনার সুবিধা, হাঁটার পথ ও সবুজ করিডোর তৈরি করতে হলে নগর উন্নয়নের নীতি-নির্ধারণে রাজনীতিবিদদের পরিবেশবান্ধব চিন্তা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রতি দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, সৌরশক্তি ও জিওথার্মাল শক্তির ব্যবহার উৎসাহিত করতে হলে রাজনৈতিকভাবে কর প্রণোদনা, আর্থিক সহায়তা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার কার্যক্রমও পরিচালনা করতে হবে।
এছাড়াও নগর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি জ্বলন্ত ইস্যু যেখানে রাজনীতিবিদদের ইতিবাচক হস্তক্ষেপ অপরিহার্য। বাংলাদেশে এখনও অধিকাংশ শহরে বর্জ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট দুর্বল। এক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থাকলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নজরদারির অভাবে কার্যকর বাস্তবায়ন হয় না। অথচ বর্জ্য থেকে জৈবসার, বিদ্যুৎ উৎপাদন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী আহরণ ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব, যদি রাজনৈতিক নেতারা এটি তাদের উন্নয়নের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করেন।
অন্যদিকে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, শিক্ষা ও সচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা এবং পরিবেশগত আচরণ গঠনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা প্রয়োজন। রাজনীতিবিদরা যদি পরিবেশের বিষয়গুলোকে জাতীয় শিক্ষা নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আইন প্রণয়ন করেন, তাহলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তোলা অনেক সহজ হবে। পাশাপাশি টিভি, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য প্রচারপত্রে পরিবেশবান্ধব আচরণে উৎসাহিত করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
এছাড়া স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে পরিবেশবান্ধব নগর গঠনের ক্ষেত্রে জনগণের চাহিদা ও সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা জরুরি। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যাতে বাস্তবসম্মত ও পরিবেশসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন, তার জন্য কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকনির্দেশনা ও সম্পদ বরাদ্দ দিতে হবে। অনেকে বলেন, স্থানীয় রাজনীতিবিদরা পরিবেশ ইস্যুতে কাজ করতে চাইলেও তারা কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা না পাওয়ায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন না। সুতরাং কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য একটি পরিবেশনীতিভিত্তিক সাংবিধানিক কাঠামো তৈরি করতে হবে।
পরিবেশবান্ধব নগর গঠনে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক। পরিবেশবান্ধব নগর গঠন কেবল একটি প্রযুক্তিনির্ভর নগর পরিকল্পনার ফল নয়, বরং এটি একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দর্শন, যার নেতৃত্ব দিতে পারেন কেবলমাত্র দায়িত্বশীল, দূরদর্শী ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতিবিদরা। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, এবং নগরজীবনের দুর্ভোগ দূর করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে সঠিক পথ দেখাতে। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরিবেশ ইস্যুতে সর্বসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি, টেকসই উন্নয়নের প্রতি অঙ্গীকার এবং সব স্তরের জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা সৃষ্টি। যদি রাজনীতিবিদরা পরিবেশবান্ধব নগর গঠনের উদ্যোগকে একটি জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সেটিকে বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ করেন, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ, বাসযোগ্য ও টেকসই নগর গড়ে তোলা সম্ভব।
[লেখক : ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি]