alt

উপ-সম্পাদকীয়

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

জাহিদুল ইসলাম

: শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার চিত্রা কাব্যে ‘নগর সঙ্গীত’ কতিায় বলেছেন, ‘কোথা গেল সেই মহান্ শান্ত/ নব নির্মল শ্যামলকান্ত/ উজ্জ্বলনীল বসনপ্রান্ত/ সুন্দর শুভ ধরণী!”

কবির এই সুন্দর শুভ ধরণী পেতে হলে আমাদের ঢাকাকে পরিবেশগত এবং বাস্তুতান্ত্রিকভাবে সুনির্মল করে গড়ে তুলতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম হয়ে গেলেও বাংলাদেশে একটি পরিকল্পিত শহর গড়ে ওঠেনি। নানা সময়ে পরিবেশবান্ধব নগরী গড়ার পরিকল্পনা করা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

ঢাকাকে আধুনিক ও পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এখন থেকেই কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। নয়তো ঢাকা বসবাসের অনুপযোগী ও পরিত্যক্ত নগরীতে রূপ নেবে। সম্প্রতি এ ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের সহযোগী সংস্থা ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। ২০২৪ সালের প্রকাশিত তালিকায় বিশ্বের বসবাসযোগ্য ১৭৩টি শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ১৬৮তম। সবচেয়ে বসবাস-অযোগ্য তালিকায় শীর্ষে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক (১৭৩তম)। তার উপরে রয়েছে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি (১৭২), আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স (১৭১), নাইজেরিয়ার লাগোস (১৭০) ও পাকিস্তানের করাচি (১৬৯) প্রভৃতি। এই তালিকা তৈরির নেপথ্যে পাঁচটি সূচক রয়েছে। সেগুলো হচ্ছেÑ স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো। এ তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর ঢাকাকে বাসযোগ্য করার ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে দ্রুতই উদ্যোগী হতে তাগিদ অনুভব করবেন।

‘আরবান গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইনফরমাল গ্রোথ রেগুলেশন ইন ঢাকা’ গ্রন্থে মো. তাইবুর রহমান লিখেছেন, ঢাকাকে আধুনিকভাবে সাজাতে বিভিন্ন সময় নানা রকম পরিকল্পনা নেয়া হলেও বাস্তবে বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত ঢাকা শহরকে নিয়ে ৩টি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৯১৭ সালে স্যার প্যাট্রিক গেডিস যে মাস্টারপ্ল্যান করেছিলেন সেখানে বলা হয়েছিল ঢাকা হবে একটি বাগানের শহর। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগর-পরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তবরূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ।

এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ।

ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নিয়ে ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরপরই উদ্যোগ নিয়া উচিত ছিল। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য রাজধানী গড়তে ঢাকাকে সাজাতে সেসময় সুশীল সমাজের চাপে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি), যা বর্তমান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে নানা নির্দেশনামূলক কর্ম সম্পাদনের নির্দেশনা দিলেও লালবাহিনীর কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি (রেফারেন্স : মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী : ইতিহাসের পুনর্পাঠÑআলতাফ পারভেজ) শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি ডিআইটি কর্তৃপক্ষ। ফলে ডিআইটির জমি তখন থেকেই নানা পক্ষ দখল নিতে শুরু করে। শুরু হয় পরিবেশ ও বাসযোগ্য নগরী গঠনের ওপর রাজনৈতিক দস্যুতা। নানা সময়ে রাজা এসছে, গেছে কিন্তু ঢাকা শহরের বসবাস যোগ্য হওয়ার পরিবর্তে তা হয়েছে বসবাসের অযোগ্য শহর।

অনুসন্ধানের দেখা যায়, ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে। ঢাকায় বর্তমানে একরপ্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার এবং ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরো বেশি বলে মনে করা হয়।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। তবে ড্যাপের তথ্য থেকে বাস্তব চিত্র হচ্ছে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ। জনঘনত্ব হিসেবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাস করা এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঢাকায় জলাভূমি ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। আর এ সময় পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কংক্রিট। ইতোমধ্যে ঢাকার দুই সিটির প্রায় ৮২ ভাগ এলাকা কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে। তাদের মতে, পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে সড়ক থাকা দরকার ২৫ শতাংশ, জলাশয় ১৫ শতাংশ, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ ভাগ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট গড়ে উঠবে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তবে কোনো শহরের ৪০ ভাগের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সাড়ে আট ভাগ সবুজ রয়েছে। ঢাকার বর্তমান সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। আর জনসংখ্যা রয়েছে চারগুণ অর্থাৎ, ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে। অবশ্য ভালো হতো ১২ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা থাকলে।

ঢাকার পানি, বাতাস ও শব্দদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পরিবেশের অস্বাভাবিক দূষণে বাড়ছে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ। বর্তমানে ঢাকা দূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে এবং হারাচ্ছে বাসযোগ্যতা। শহরের রাস্তা দিয়ে চলাচল করার সময় উপরে ভবন নির্মাণে কাজ, নিচে বিদ্যুতের তার থেকে শুরু বিভিন্ন লাইনের তার। রাস্তার দুই পাশে রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন অপরিকল্পিত অবকাঠামো, গ্যাস লাইন।

ঢাকাকে কীভাবে বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে তৈরি করা যায়, তার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা খুব কঠিন নয়। এই মহানগরীতে কত মানুষ বসবাস করার উপযুক্ত তারও একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকা প্রয়োজন। কারণ অধিক মানুষের চাপে যে কোনো ভালো পরিকল্পনা ও নাগরিক সুবিধা নষ্ট হতে বাধ্য। ঢাকাকে অধিক মানুষের বসবাস, আগমন কমাতে প্রয়োজন ঢাকার বাইরে প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মানুষের কর্মসংস্থান, উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা, ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে প্রয়োজন বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস। কারণ কর্মসংস্থান, বিচারের আশায় ও অফিশিয়াল প্রয়োজনে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখনো অধিকাংশ মানুষকে প্রতিনিয়ত ঢাকায় আসতে হয়। পাশাপাশি ঢাকার পাশের জেলাসমূহে শহর সম্প্রসারণ, কলকারখানা স্থাপন, ঢাকার বাইরে শিল্পনগরী, কলকারখানা, বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও ভাবা যেতে পারে।

এছাড়া বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন, পৃথিবীর বড় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার বাতাসে সবচেয়ে বেশি মিশছে সিসা। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণাকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় যানবাহনগুলো প্রতিদিন ১০০ কেজি সিসা ১ দশমিক ৫ টন সালফার-ডাইঅক্সাইড, ৬০ টন কার্বন মনোঅক্সাইড নির্গত করে। এসব উপাদান ক্রমাগত বাতাসের সঙ্গে মিশছে। সেই বাতাস আমাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে দেহের ভেতরে প্রবেশ করে যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, হাঁপানি প্রভৃতি মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে।

পরিকল্পিত নগর বলতে একটি পরিকল্পিত জনবসতি, যার সবকিছু হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী। সুপরিকল্পনা ছাড়া কোনো শহরকে সুন্দর শহরে পরিণত করা যায় না। ঢাকা শহরকে সুন্দর শহরে পরিণত করার জন্য সবুজের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য প্রচুর বৃক্ষরোপণ করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় থাকতে হবে খেলার মাঠ, থাকতে হবে জলাশয়, থাকতে হবে পার্ক। এজন্যও দরকার সঠিক পরিকল্পনা। ঢাকা শহরকে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে। ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য শহরের নবনির্মিত প্রতিটি ভবন রাজউকের বিধিমালা মেনে তৈরি করতে হবে। যদি অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ করতে চায় তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমাতে হবে।

যানজট সমস্যা নিরসনে কয়েকটি প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে, যা বাস্তবায়ন হলে যানজটের সমস্যা থেকে নগরবাসী মুক্তি পেতে পারে। প্রস্তাবগুলো হলোÑ রাজধানী ঢাকায় ব্যক্তিগত মোটরগাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাধিক্য যানজটের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচ্য হয়। চৌরাস্তাগুলোতে টানেল নির্মাণ ছোট ছোট বিকল্প রাস্তা তৈরি করা, ট্রাফিক পুলিশের জনবল বৃদ্ধি করা, ঢাকা থেকে বের হওয়া এবং প্রবেশের রাস্তাগুলো প্রশস্ত করা। যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করা ও গাড়ি ঘোরানো থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা দরকার। ট্রাফিক পুলিশকে আধুনিক সরঞ্জাম ও বিদেশি বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্রশিক্ষণ দেয়া। অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে ফুটপাত ও অন্যান্য রাস্তা দখলমুক্ত করতে হবে। ঢাকার পাশের জেলাগুলোকে দ্রুত উন্নয়ন, সম্প্রসারণ, অবকাঠামো, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তুলে ঢাকার জনসংখ্যা অন্তত এক-চতুর্থাংশে কমিয়ে আনা, অফিস, আদালত, কলকারখানা, বাসাবাড়ি, ব্যাংক-বিমাসহ অন্যান্য কম গুরুত্বসম্পন্ন ভবন, স্থাপনা, যাত্রীবাহী যানবাহন কমিয়ে আনতে হবে। এজন্য সময় দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। কারণ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের গুরুত্ব, অবস্থান যতটা বাড়ছে, ঠিক ততটা গুরুত্ব রাজধানী ঢাকারও। এই বিবেচনায় দ্রুতই ঢাকাকে বাসযোগ্য ও আধুনিক নগরীর রূপ দিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের প্রত্যাশা আমাদের।

[লেখক : শিক্ষক, মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, ঢাকা]

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

লই গো বুক পেতে অনল-বাণ!

সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ

আমেরিকার অলিগার্কি পতনের আখ্যান

রম্যগদ্য : ‘উহু উহু, তোরে মাফ করা যায় না...’

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

জাহিদুল ইসলাম

শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার চিত্রা কাব্যে ‘নগর সঙ্গীত’ কতিায় বলেছেন, ‘কোথা গেল সেই মহান্ শান্ত/ নব নির্মল শ্যামলকান্ত/ উজ্জ্বলনীল বসনপ্রান্ত/ সুন্দর শুভ ধরণী!”

কবির এই সুন্দর শুভ ধরণী পেতে হলে আমাদের ঢাকাকে পরিবেশগত এবং বাস্তুতান্ত্রিকভাবে সুনির্মল করে গড়ে তুলতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম হয়ে গেলেও বাংলাদেশে একটি পরিকল্পিত শহর গড়ে ওঠেনি। নানা সময়ে পরিবেশবান্ধব নগরী গড়ার পরিকল্পনা করা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

ঢাকাকে আধুনিক ও পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এখন থেকেই কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। নয়তো ঢাকা বসবাসের অনুপযোগী ও পরিত্যক্ত নগরীতে রূপ নেবে। সম্প্রতি এ ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের সহযোগী সংস্থা ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। ২০২৪ সালের প্রকাশিত তালিকায় বিশ্বের বসবাসযোগ্য ১৭৩টি শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ১৬৮তম। সবচেয়ে বসবাস-অযোগ্য তালিকায় শীর্ষে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক (১৭৩তম)। তার উপরে রয়েছে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি (১৭২), আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স (১৭১), নাইজেরিয়ার লাগোস (১৭০) ও পাকিস্তানের করাচি (১৬৯) প্রভৃতি। এই তালিকা তৈরির নেপথ্যে পাঁচটি সূচক রয়েছে। সেগুলো হচ্ছেÑ স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো। এ তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর ঢাকাকে বাসযোগ্য করার ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে দ্রুতই উদ্যোগী হতে তাগিদ অনুভব করবেন।

‘আরবান গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইনফরমাল গ্রোথ রেগুলেশন ইন ঢাকা’ গ্রন্থে মো. তাইবুর রহমান লিখেছেন, ঢাকাকে আধুনিকভাবে সাজাতে বিভিন্ন সময় নানা রকম পরিকল্পনা নেয়া হলেও বাস্তবে বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত ঢাকা শহরকে নিয়ে ৩টি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৯১৭ সালে স্যার প্যাট্রিক গেডিস যে মাস্টারপ্ল্যান করেছিলেন সেখানে বলা হয়েছিল ঢাকা হবে একটি বাগানের শহর। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগর-পরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তবরূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ।

এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ।

ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নিয়ে ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরপরই উদ্যোগ নিয়া উচিত ছিল। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য রাজধানী গড়তে ঢাকাকে সাজাতে সেসময় সুশীল সমাজের চাপে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি), যা বর্তমান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে নানা নির্দেশনামূলক কর্ম সম্পাদনের নির্দেশনা দিলেও লালবাহিনীর কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি (রেফারেন্স : মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী : ইতিহাসের পুনর্পাঠÑআলতাফ পারভেজ) শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি ডিআইটি কর্তৃপক্ষ। ফলে ডিআইটির জমি তখন থেকেই নানা পক্ষ দখল নিতে শুরু করে। শুরু হয় পরিবেশ ও বাসযোগ্য নগরী গঠনের ওপর রাজনৈতিক দস্যুতা। নানা সময়ে রাজা এসছে, গেছে কিন্তু ঢাকা শহরের বসবাস যোগ্য হওয়ার পরিবর্তে তা হয়েছে বসবাসের অযোগ্য শহর।

অনুসন্ধানের দেখা যায়, ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে। ঢাকায় বর্তমানে একরপ্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার এবং ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরো বেশি বলে মনে করা হয়।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। তবে ড্যাপের তথ্য থেকে বাস্তব চিত্র হচ্ছে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ। জনঘনত্ব হিসেবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাস করা এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঢাকায় জলাভূমি ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। আর এ সময় পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কংক্রিট। ইতোমধ্যে ঢাকার দুই সিটির প্রায় ৮২ ভাগ এলাকা কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে। তাদের মতে, পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে সড়ক থাকা দরকার ২৫ শতাংশ, জলাশয় ১৫ শতাংশ, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ ভাগ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট গড়ে উঠবে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তবে কোনো শহরের ৪০ ভাগের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সাড়ে আট ভাগ সবুজ রয়েছে। ঢাকার বর্তমান সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। আর জনসংখ্যা রয়েছে চারগুণ অর্থাৎ, ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে। অবশ্য ভালো হতো ১২ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা থাকলে।

ঢাকার পানি, বাতাস ও শব্দদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পরিবেশের অস্বাভাবিক দূষণে বাড়ছে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ। বর্তমানে ঢাকা দূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে এবং হারাচ্ছে বাসযোগ্যতা। শহরের রাস্তা দিয়ে চলাচল করার সময় উপরে ভবন নির্মাণে কাজ, নিচে বিদ্যুতের তার থেকে শুরু বিভিন্ন লাইনের তার। রাস্তার দুই পাশে রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন অপরিকল্পিত অবকাঠামো, গ্যাস লাইন।

ঢাকাকে কীভাবে বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে তৈরি করা যায়, তার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা খুব কঠিন নয়। এই মহানগরীতে কত মানুষ বসবাস করার উপযুক্ত তারও একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকা প্রয়োজন। কারণ অধিক মানুষের চাপে যে কোনো ভালো পরিকল্পনা ও নাগরিক সুবিধা নষ্ট হতে বাধ্য। ঢাকাকে অধিক মানুষের বসবাস, আগমন কমাতে প্রয়োজন ঢাকার বাইরে প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মানুষের কর্মসংস্থান, উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা, ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে প্রয়োজন বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস। কারণ কর্মসংস্থান, বিচারের আশায় ও অফিশিয়াল প্রয়োজনে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখনো অধিকাংশ মানুষকে প্রতিনিয়ত ঢাকায় আসতে হয়। পাশাপাশি ঢাকার পাশের জেলাসমূহে শহর সম্প্রসারণ, কলকারখানা স্থাপন, ঢাকার বাইরে শিল্পনগরী, কলকারখানা, বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও ভাবা যেতে পারে।

এছাড়া বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন, পৃথিবীর বড় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার বাতাসে সবচেয়ে বেশি মিশছে সিসা। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণাকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় যানবাহনগুলো প্রতিদিন ১০০ কেজি সিসা ১ দশমিক ৫ টন সালফার-ডাইঅক্সাইড, ৬০ টন কার্বন মনোঅক্সাইড নির্গত করে। এসব উপাদান ক্রমাগত বাতাসের সঙ্গে মিশছে। সেই বাতাস আমাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে দেহের ভেতরে প্রবেশ করে যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, হাঁপানি প্রভৃতি মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে।

পরিকল্পিত নগর বলতে একটি পরিকল্পিত জনবসতি, যার সবকিছু হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী। সুপরিকল্পনা ছাড়া কোনো শহরকে সুন্দর শহরে পরিণত করা যায় না। ঢাকা শহরকে সুন্দর শহরে পরিণত করার জন্য সবুজের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য প্রচুর বৃক্ষরোপণ করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় থাকতে হবে খেলার মাঠ, থাকতে হবে জলাশয়, থাকতে হবে পার্ক। এজন্যও দরকার সঠিক পরিকল্পনা। ঢাকা শহরকে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে। ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য শহরের নবনির্মিত প্রতিটি ভবন রাজউকের বিধিমালা মেনে তৈরি করতে হবে। যদি অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ করতে চায় তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমাতে হবে।

যানজট সমস্যা নিরসনে কয়েকটি প্রস্তাব দেয়া যেতে পারে, যা বাস্তবায়ন হলে যানজটের সমস্যা থেকে নগরবাসী মুক্তি পেতে পারে। প্রস্তাবগুলো হলোÑ রাজধানী ঢাকায় ব্যক্তিগত মোটরগাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাধিক্য যানজটের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচ্য হয়। চৌরাস্তাগুলোতে টানেল নির্মাণ ছোট ছোট বিকল্প রাস্তা তৈরি করা, ট্রাফিক পুলিশের জনবল বৃদ্ধি করা, ঢাকা থেকে বের হওয়া এবং প্রবেশের রাস্তাগুলো প্রশস্ত করা। যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করা ও গাড়ি ঘোরানো থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা দরকার। ট্রাফিক পুলিশকে আধুনিক সরঞ্জাম ও বিদেশি বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্রশিক্ষণ দেয়া। অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে ফুটপাত ও অন্যান্য রাস্তা দখলমুক্ত করতে হবে। ঢাকার পাশের জেলাগুলোকে দ্রুত উন্নয়ন, সম্প্রসারণ, অবকাঠামো, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তুলে ঢাকার জনসংখ্যা অন্তত এক-চতুর্থাংশে কমিয়ে আনা, অফিস, আদালত, কলকারখানা, বাসাবাড়ি, ব্যাংক-বিমাসহ অন্যান্য কম গুরুত্বসম্পন্ন ভবন, স্থাপনা, যাত্রীবাহী যানবাহন কমিয়ে আনতে হবে। এজন্য সময় দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। কারণ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের গুরুত্ব, অবস্থান যতটা বাড়ছে, ঠিক ততটা গুরুত্ব রাজধানী ঢাকারও। এই বিবেচনায় দ্রুতই ঢাকাকে বাসযোগ্য ও আধুনিক নগরীর রূপ দিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের প্রত্যাশা আমাদের।

[লেখক : শিক্ষক, মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, ঢাকা]

back to top