লিখন ইসলাম
মানুষের জন্য আছে নির্দিষ্ট চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র বা হাসপাতাল, পশুপাখির জন্য রয়েছে প্রাণী হাসপাতাল ও পেট ক্লিনিক। কিন্তু কখনো ভেবে দেখছেন কি মানুষ বা পশুপাখির মতো উদ্ভিদেরও তো জীবন আছে। জীবন যখন আছে স্বাভাবিকভাবেই অসুস্থতার প্রশ্ন থেকেই যায়। মানবজাতির খাদ্যশস্য, শাক-সবজি, ফলমূল ও বাসস্থান থেকে শুরু করে সবকিছুর জন্যই উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। এ দেশের বিপুল জনসংখ্যার জন্য খাদ্য উৎপাদনে উদ্ভিদের পোকা ও রোগ নির্ণয়, প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা জরুরি। কারণ আক্রান্ত একটি উদ্ভিদ থেকে তা সমগ্র ফসলের ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়তে পারে মহামারী আকারে, যা কখনো কখনো দুর্ভিক্ষের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারে।
একসময় গ্রামীণ কৃষকরা ফসলের রোগবালাই নিয়ে দিশেহারা থাকতেন। কোন গাছে কী রোগ হয়েছে, কী কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত এই সব প্রশ্নের উত্তর তারা পেতেন না সময়মতো। অনেক সময় স্থানীয় দোকানদারের ভুল পরামর্শে ভেজাল ওষুধ কিনে ফসলের আরও ক্ষতি করে বসতেন। কিন্তু এখন দৃশ্যপট বদলেছে। কারণ সাভারের ধামরাই উপজেলার শিরামপুর ইউনিয়নে দেশের প্রথম হিসেবে চালু হওয়া একটি ছোট্ট উদ্যোগ ‘প্লান্ট ক্লিনিক’ যা বদলে দিচ্ছে কৃষকদের ভাবনা, জীবন ও আয়ের চিত্র।
প্লান্ট ক্লিনিক হলো কৃষককেন্দ্রিক পরামর্শ সেবা, যা গাছের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নির্ণয় ও সমাধান প্রদানের জন্য তৈরি করা হয়েছে। কৃষকরা আক্রান্ত গাছের নমুনা নিয়ে আসেন বা মাঠে দেখা সমস্যাগুলোর বর্ণনা দেন, আর প্রশিক্ষিত ‘প্লান্ট ডাক্তাররা’ বা কৃষি বিশেষজ্ঞরা কৃষকদের গাছের পোকা ও রোগ নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে পরামর্শ দেন। তারা রোগ প্রতিরোধ ও দমন কৌশল সম্পর্কে পরামর্শ দেন, যার মধ্যে জৈবিক, সাংস্কৃতিক, যান্ত্রিক ও রাসায়নিক পদ্ধতির সমন্বয় থাকতে পারে।
উদ্ভিদের বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পোকা ও রোগের ব্যবস্থাপনা করে কৃষকের ক্ষতি কমানো এবং রোগের বিস্তার রোধে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও সেন্টার ফর অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড বায়োসায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল (সিএবিআই) প্লান্ট ওয়াইসপ্লাসের কারিগরি সহায়তায় বর্তমানে বাংলাদেশজুড়ে ৪০৫টি প্লান্ট ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে।
সফলতার ধারাবাহিকতায় সাভার, ধামরাই, চুয়াডাঙ্গা, মুন্সিগঞ্জ ও টাঙ্গাইলসহ দেশজুড়ে ৪০৫টি প্লান্ট ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে, যার মধ্যে ৩৮৩টি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার ২৮৫টি সমস্যার সমাধান দিয়েছে এই ক্লিনিকগুলো। সবচেয়ে বড় কথা, এই সেবা কৃষকের জন্য একদম বিনামূল্যে। সরকারের কৃষি বিভাগ, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে এটি পরিচালিত হয়।
প্রতি মাসে সাধারণত দুবার কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায়, কখনো কোনো প্রগতিশীল কৃষকের বাড়িতে, কখনো মাঠেই বসে এই ক্লিনিক। সেখানে কৃষকরা তাদের সমস্যার কথা সরাসরি প্লান্ট ডাক্তারের কাছে তুলে ধরেন। রোগাক্রান্ত পাতার নমুনা নিয়ে এসে জানতে চান কী সমস্যা হয়েছে, কীভাবে সমাধান করা যায়। সেই সমস্যার সমাধান তারা পান সঙ্গে সঙ্গেই। শুধু মুখের কথাতেই নয়, ওষুধের নাম, পরিমাণ এবং ব্যবহারের নিয়ম এসএমএসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া হয় কৃষকের মোবাইলে।
এই প্রযুক্তিনির্ভর সেবা এখন হয়ে উঠেছে কৃষকের জন্য এক নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার। কৃষকরা আর ভুল ওষুধে টাকা নষ্ট করছেন না, ফসলও হচ্ছে নিরাপদ। আগের মতো ব্লক অফিসে গিয়েও সময় নষ্ট করতে হচ্ছে না। ফলত, রোগের দ্রুত সুরাহা হচ্ছে, ক্ষতি কমছে, উৎপাদন বাড়ছে।
একসময় যেখানে নারীরা কৃষি-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে অনেকটাই পিছিয়ে থাকতেন, এখন এই ক্লিনিকের মাধ্যমে তারাও সামনে এগিয়ে আসছেন। কোনো কোনো সেশনে নারীর অংশগ্রহণ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই অংশগ্রহণ শুধু তাদের অবদানকেই নয়, স্বনির্ভরতাকেও প্রকাশ করে।
২০১৩ সালে ঢাকার ধামরাই উপজেলার শিরামপুর ইউনিয়নে বাংলাদেশের প্রথম প্লান্ট ক্লিনিক প্রতিষ্ঠিত হয়, যা কৃষি পরামর্শ সেবার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। শিরামপুরে শুরু হওয়া এই ছোট্ট উদ্যোগটি এখন সমগ্র দেশে ছড়িয়েছে। এটি শুধু কৃষকদের সমস্যার সমাধান দেয়নি, দিয়েছে আশার আলো। কৃষক এখন প্রযুক্তি, জ্ঞান ও আস্থার মাধ্যমে গড়ে তুলছে টেকসই কৃষির ভবিষ্যৎ। ‘প্লান্ট ক্লিনিক’ আজ শুধু একটি সেবা নয়, এটি একটি নীরব কৃষি বিপ্লবের নাম।
[লেখক : ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়]
লিখন ইসলাম
শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
মানুষের জন্য আছে নির্দিষ্ট চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র বা হাসপাতাল, পশুপাখির জন্য রয়েছে প্রাণী হাসপাতাল ও পেট ক্লিনিক। কিন্তু কখনো ভেবে দেখছেন কি মানুষ বা পশুপাখির মতো উদ্ভিদেরও তো জীবন আছে। জীবন যখন আছে স্বাভাবিকভাবেই অসুস্থতার প্রশ্ন থেকেই যায়। মানবজাতির খাদ্যশস্য, শাক-সবজি, ফলমূল ও বাসস্থান থেকে শুরু করে সবকিছুর জন্যই উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। এ দেশের বিপুল জনসংখ্যার জন্য খাদ্য উৎপাদনে উদ্ভিদের পোকা ও রোগ নির্ণয়, প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা জরুরি। কারণ আক্রান্ত একটি উদ্ভিদ থেকে তা সমগ্র ফসলের ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়তে পারে মহামারী আকারে, যা কখনো কখনো দুর্ভিক্ষের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারে।
একসময় গ্রামীণ কৃষকরা ফসলের রোগবালাই নিয়ে দিশেহারা থাকতেন। কোন গাছে কী রোগ হয়েছে, কী কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত এই সব প্রশ্নের উত্তর তারা পেতেন না সময়মতো। অনেক সময় স্থানীয় দোকানদারের ভুল পরামর্শে ভেজাল ওষুধ কিনে ফসলের আরও ক্ষতি করে বসতেন। কিন্তু এখন দৃশ্যপট বদলেছে। কারণ সাভারের ধামরাই উপজেলার শিরামপুর ইউনিয়নে দেশের প্রথম হিসেবে চালু হওয়া একটি ছোট্ট উদ্যোগ ‘প্লান্ট ক্লিনিক’ যা বদলে দিচ্ছে কৃষকদের ভাবনা, জীবন ও আয়ের চিত্র।
প্লান্ট ক্লিনিক হলো কৃষককেন্দ্রিক পরামর্শ সেবা, যা গাছের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নির্ণয় ও সমাধান প্রদানের জন্য তৈরি করা হয়েছে। কৃষকরা আক্রান্ত গাছের নমুনা নিয়ে আসেন বা মাঠে দেখা সমস্যাগুলোর বর্ণনা দেন, আর প্রশিক্ষিত ‘প্লান্ট ডাক্তাররা’ বা কৃষি বিশেষজ্ঞরা কৃষকদের গাছের পোকা ও রোগ নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে পরামর্শ দেন। তারা রোগ প্রতিরোধ ও দমন কৌশল সম্পর্কে পরামর্শ দেন, যার মধ্যে জৈবিক, সাংস্কৃতিক, যান্ত্রিক ও রাসায়নিক পদ্ধতির সমন্বয় থাকতে পারে।
উদ্ভিদের বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পোকা ও রোগের ব্যবস্থাপনা করে কৃষকের ক্ষতি কমানো এবং রোগের বিস্তার রোধে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও সেন্টার ফর অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড বায়োসায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল (সিএবিআই) প্লান্ট ওয়াইসপ্লাসের কারিগরি সহায়তায় বর্তমানে বাংলাদেশজুড়ে ৪০৫টি প্লান্ট ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে।
সফলতার ধারাবাহিকতায় সাভার, ধামরাই, চুয়াডাঙ্গা, মুন্সিগঞ্জ ও টাঙ্গাইলসহ দেশজুড়ে ৪০৫টি প্লান্ট ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে, যার মধ্যে ৩৮৩টি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার ২৮৫টি সমস্যার সমাধান দিয়েছে এই ক্লিনিকগুলো। সবচেয়ে বড় কথা, এই সেবা কৃষকের জন্য একদম বিনামূল্যে। সরকারের কৃষি বিভাগ, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে এটি পরিচালিত হয়।
প্রতি মাসে সাধারণত দুবার কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায়, কখনো কোনো প্রগতিশীল কৃষকের বাড়িতে, কখনো মাঠেই বসে এই ক্লিনিক। সেখানে কৃষকরা তাদের সমস্যার কথা সরাসরি প্লান্ট ডাক্তারের কাছে তুলে ধরেন। রোগাক্রান্ত পাতার নমুনা নিয়ে এসে জানতে চান কী সমস্যা হয়েছে, কীভাবে সমাধান করা যায়। সেই সমস্যার সমাধান তারা পান সঙ্গে সঙ্গেই। শুধু মুখের কথাতেই নয়, ওষুধের নাম, পরিমাণ এবং ব্যবহারের নিয়ম এসএমএসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া হয় কৃষকের মোবাইলে।
এই প্রযুক্তিনির্ভর সেবা এখন হয়ে উঠেছে কৃষকের জন্য এক নির্ভরযোগ্য হাতিয়ার। কৃষকরা আর ভুল ওষুধে টাকা নষ্ট করছেন না, ফসলও হচ্ছে নিরাপদ। আগের মতো ব্লক অফিসে গিয়েও সময় নষ্ট করতে হচ্ছে না। ফলত, রোগের দ্রুত সুরাহা হচ্ছে, ক্ষতি কমছে, উৎপাদন বাড়ছে।
একসময় যেখানে নারীরা কৃষি-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে অনেকটাই পিছিয়ে থাকতেন, এখন এই ক্লিনিকের মাধ্যমে তারাও সামনে এগিয়ে আসছেন। কোনো কোনো সেশনে নারীর অংশগ্রহণ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই অংশগ্রহণ শুধু তাদের অবদানকেই নয়, স্বনির্ভরতাকেও প্রকাশ করে।
২০১৩ সালে ঢাকার ধামরাই উপজেলার শিরামপুর ইউনিয়নে বাংলাদেশের প্রথম প্লান্ট ক্লিনিক প্রতিষ্ঠিত হয়, যা কৃষি পরামর্শ সেবার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। শিরামপুরে শুরু হওয়া এই ছোট্ট উদ্যোগটি এখন সমগ্র দেশে ছড়িয়েছে। এটি শুধু কৃষকদের সমস্যার সমাধান দেয়নি, দিয়েছে আশার আলো। কৃষক এখন প্রযুক্তি, জ্ঞান ও আস্থার মাধ্যমে গড়ে তুলছে টেকসই কৃষির ভবিষ্যৎ। ‘প্লান্ট ক্লিনিক’ আজ শুধু একটি সেবা নয়, এটি একটি নীরব কৃষি বিপ্লবের নাম।
[লেখক : ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়]