alt

opinion » post-editorial

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

: সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার আকাশে যে ঘন কালো মেঘ দীর্ঘদিন ধরে ছায়া বিস্তার করে আছে, তার নামই মামলাজট। এ এক ভয়াল বোঝা, যা ন্যায়বিচারের পথকে শুধু দীর্ঘায়িতই করে না, বরং বিচারপ্রার্থী মানুষের হৃদয়ে হতাশার আঁধার নামিয়ে আনে। বর্তমানে দেশে প্রায় সতেরো লাখ দেওয়ানি মোকদ্দমা বিচারাধীন—সংখ্যাটির ভার যেন গোটা বিচারব্যবস্থার শিরদাঁড়ায় চাপ সৃষ্টি করছে। পরিসংখ্যান বলছে, মোট মামলার প্রায় চল্লিশ শতাংশই দেওয়ানি বিরোধ নিয়ে, অথচ সংখ্যার বাইরে প্রতিটি মামলার ভেতর লুকিয়ে আছে মানুষের জীবনের জটিল গল্প—কখনো উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা, কখনো জমিজমার দখল-সংক্রান্ত দ্বন্ধ, কখনো বা পারিবারিক বিবাদের গাঢ় ছায়া।

এই জটিলতার কারণে শুধু দেওয়ানি মামলা নয়, বহু ফৌজদারি মামলারও নেপথ্যে থাকে জমি-সম্পত্তি সংক্রান্ত দ্বন্ধের রূঢ় বাস্তবতা। ফলে দেওয়ানি মামলার দীর্ঘসূত্রিতা আমাদের পুরো বিচারব্যবস্থাকেই গ্রাস করছে। ন্যায়বিচার যেখানে হওয়া উচিত দ্রুত, সেখানেই তা পরিণত হচ্ছে এক অন্তহীন অপেক্ষার খেলায়। বছরের পর বছর আদালতের সিঁড়ি ঘষতে ঘষতে বিচারপ্রার্থী মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন, তাদের মুখে ফুটে উঠছে আর্তনাদের রেখা। যেন আইন ও আদালতের প্রতি আস্থা হারাতে বসেছেন অনেকেই।

মামলাজটের এই অভিশাপ তাই কেবল আদালতের কাঠগড়ায় নয়, বরং সাধারণ মানুষের জীবন-যাপনের প্রতিটি স্তরে ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ঠিক এই মুহূর্তে প্রয়োজন যুগান্তকারী সংস্কারের, যাতে বিচারব্যবস্থা মুক্তি পায় দীর্ঘসূত্রিতার শৃঙ্খল থেকে, আর জনগণ ফিরে পায় দ্রুত ও কার্যকর ন্যায়বিচারের আলো।

বহুবার সংস্কারের দাবি উঠেছে, নানা মহল থেকে সুপারিশ এসেছে, কিন্তু বাস্তবায়নের অভাবে সবই থেকে গেছে কেবল কাগজে-কলমে। অবশেষে ২০২৫ সালে সরকার জারি করেছে ‘দেওয়ানি কার্যবিধি (সংশোধন) অধ্যাদেশ’—যা নিছক একটি আইনি সংস্কার নয়, বরং বিচারব্যবস্থাকে সময়োপযোগী, প্রযুক্তিনির্ভর ও কার্যকর করার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ যেন শতবর্ষ পুরোনো আইনি কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে নতুন এক দিগন্তে পদার্পণ।

নতুন এই সংস্কারের ফলে আদালতে আরজি দাখিলের সময় বাদী-বিবাদীর জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর এবং ই-মেইল ঠিকানা উল্লেখ করা হবে বাধ্যতামূলক। এর মাধ্যমে ভুয়া পরিচয় ব্যবহার বা একই নামে বিভ্রান্তি সৃষ্টির যে অবকাশ এতদিন ছিল, তা কার্যত রুদ্ধ হবে। সমন জারির প্রক্রিয়া হবে আরও দ্রুত, নির্ভুল ও স্বচ্ছ। অতীতের মতো ডাকপিয়ন বা পদাতিক বাহকের মাধ্যমে সমন পৌঁছানোর ঝামেলা আর থাকবে না। তার বদলে সমন পৌঁছে যাবে মুহূর্তের মধ্যেই এসএমএস, ভয়েস কল কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। আদালতের কাছে প্রতিটি ডেলিভারি রিপোর্ট থাকবে প্রমাণ হিসেবে সংরক্ষিত।

এর ফলে শুধু সময়ই সাশ্রয় হবে না, খরচও কমে আসবে উল্লেখযোগ্যভাবে। বিচারপ্রার্থী মানুষকে আর বছরের পর বছর সমনের অপেক্ষায় আদালতের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। প্রযুক্তির এই নতুন সংযোজন বিচারব্যবস্থাকে করবে আধুনিক, গতিশীল ও মানুষের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য। বলা যায়, দীর্ঘসূত্রিতার অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বিচারব্যবস্থা বেরিয়ে আসছে আলোকিত এক পথে—যেখানে গতি ও স্বচ্ছতাই হবে প্রধান হাতিয়ার।

সংস্কারের অন্যতম বড় দিক হলো একতরফা আদেশ রহিত করার সুযোগকে সীমিত করা। এতদিন বিবাদীরা ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতে হাজির না হয়ে পরে একতরফা রায় বাতিলের আবেদন করতেন। ফলে মামলার অগ্রগতি বারবার থমকে যেত, আর বাদী পক্ষ বছরের পর বছর ধরে ভোগান্তির শিকার হতেন। নতুন সংশোধনের ফলে সেই সুযোগ অনেকটাই সীমিত হয়েছে। এতে উদ্দেশ্যমূলক বিলম্ব আর আইনের অপব্যবহার বন্ধ হবে, এবং বিচারপ্রক্রিয়া হবে আরও স্বচ্ছ ও গতিশীল।

তদুপরি, সংস্কারে ঘনঘন মুলতবি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। আগে একটি মামলায় সর্বোচ্চ বারো বার মুলতবি নেওয়ার সুযোগ ছিল। অনেক সময় তা অপব্যবহার করে মামলা বছরের পর বছর অচলাবস্থায় পড়ে থাকত। এখন সেই সুযোগ কমিয়ে আটে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। ফলে মামলার গতি অযথা আটকে থাকবে না, আদালতের সময়ও সাশ্রয় হবে, আর বিচারপ্রার্থীরা পাবেন দ্রুত নিষ্পত্তির আশ্বাস।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো সাক্ষ্যগ্রহণের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন। এখন থেকে বাদী-বিবাদী লিখিত এফিডেভিট আকারে সাক্ষ্য দাখিল করতে পারবেন। এর ফলে আদালতের মূল্যবান সময় সাশ্রয় হবে এবং পক্ষগণকে অযথা বারবার হাজির হতে হবে না। তবে ন্যায়বিচারের মৌলিক কাঠামো অক্ষুন্ন রাখতে ক্রস-এক্সামিনেশনের সুযোগ আগের মতোই বজায় রাখা হয়েছে, যাতে সাক্ষ্যের সত্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা যথাযথভাবে যাচাই করা যায়।

সবচেয়ে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। এতদিন একটি ডিক্রি কার্যকর করতে হলে আলাদা করে ‘জারি মোকদ্দমা’ দায়ের করতে হতো—যা বিচারপ্রক্রিয়াকে আরও দীর্ঘ করত এবং বিচারপ্রার্থীদের জন্য হয়ে উঠত বাড়তি ঝামেলার কারণ। নতুন সংশোধনের ফলে এখন মূল মামলার মধ্যেই আদালত রায় বাস্তবায়নের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। এতে সময় ও খরচ উভয়ই কমবে, এবং সবচেয়ে বড় কথা—ন্যায়বিচার জনগণের কাছে পৌঁছাবে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় দ্রুততরভাবে। এভাবে সংস্কারের ধারাবাহিক পদক্ষেপগুলো কেবল আইনি কাঠামোকেই আধুনিক করে তুলছে না, বরং বিচারপ্রার্থীর আস্থা ও আশা ফিরিয়ে আনছে এক নতুন অধ্যায়ের দিকে।

সংস্কারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আদালতের ক্ষমতা বৃদ্ধি। এখন থেকে প্রয়োজনে আদালত সরাসরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে পারবেন। এর ফলে ডিক্রি বাস্তবায়ন হবে আরও দ্রুত, নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্যভাবে। বিচারপ্রার্থীর আর আশঙ্কায় ভুগতে হবে না যে আদালতের রায় কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। এছাড়াও অধ্যাদেশে যুক্ত করা হয়েছে আরও কিছু যুগোপযোগী সংশোধন। দেওয়ানি কারাবাসে খোরপোষ বাতিল করা হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় রোধ হয়। মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে জরিমানার অঙ্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে, ফলে অযথা মামলা দায়ের করার প্রবণতা অনেকটাই হ্রাস পাবে। টাকা আদায়ের মামলায় সরাসরি কারাবাসের বিধান রাখা হয়েছে, যাতে দেনাদারদের দায় এড়ানোর সুযোগ না থাকে। রিমান্ডের সুযোগ সীমিত করে দেওয়া হয়েছে, যাতে মানবাধিকার রক্ষা পায় এবং অযথা হয়রানি বন্ধ হয়। একই সঙ্গে কার্যতালিকার আধুনিকায়ন করা হয়েছে, যা আদালতের দৈনন্দিন কার্যক্রমকে করবে আরও সুসংগঠিত, শৃঙ্খলাপূর্ণ ও কার্যকর।

যদি এই বিধানগুলো কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থেকে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে আমাদের বিচারব্যবস্থার চেহারায় ঘটবে এক দৃশ্যমান রূপান্তর। মামলাজটের ভয়াল পাহাড় ধীরে ধীরে ভেঙে পড়বে, বছরের পর বছর ধরে আদালতের সিঁড়ি ঘষতে থাকা বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘশ্বাস লাঘব হবে, আর হয়রানি ও অনিশ্চয়তার পরিবর্তে জন্ম নেবে স্বস্তি ও নিশ্চয়তার নতুন ভোর। আদালতের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে বহুগুণে, প্রতিটি মামলা অগ্রসর হবে সময়োপযোগী গতিতে, আর সর্বোপরি—সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরবে ন্যায়বিচারের অঙ্গনে।

[লেখক: আইনজীবী]

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

ছবি

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

ভারত-চীন সম্পর্কে কৌশলগত উষ্ণতার সূচনা

একজন নাগরিকের অভিমানী বিদায় ও রাষ্ট্রের নৈতিক সংকট

নিষিদ্ধ জালের অভিশাপে হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য

আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল এবং পুঁজির লুন্ঠন যাদের রক্তাক্ত করে, তাদের চাই একজোটে

জার্মানি : কৃচ্ছসাধনের বোঝা জনগণের কাঁধে

পাট চাষের সংকট ও সম্ভাবনা

সামাজিক-প্রযুক্তিগত কল্পনা: বাংলাদেশের উন্নয়ন চিন্তার নতুন দিগন্ত

অগ্রক্রয় মোকদ্দমায় উভয় পক্ষের আইনি ডিফেন্স

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম

এক সাংবাদিকের খোলা চিঠি

বাংলাদেশের দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ

ক্লাউডবার্স্ট: মৃত্যুর বার্তা নিয়ে, আকাশ যখন কান্নায় ভেঙে পড়ে

রম্যগদ্য:“কবি এখন জেলে...”

কারা কর্তৃপক্ষের সীমাবদ্ধতা ও ‘কারেকশন সার্ভিস’-এর বাস্তবতা

ছবি

বাংলাদেশের শহর পরিকল্পনার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

ছবি

‘আজ ফির তুমপে পেয়ার আয়া হ্যায়’

স্বপ্নের দক্ষিণ কোরিয়া; বাংলাদেশে আন্দোলন, ভিয়েতনামের সাফল্য

ডাকসু নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতি

ঢাকা শহরের উষ্ণতা: সবুজ হারানোর মূল্য

তিন বাহিনী প্রধানদের আশা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা

গনমাধ্যম জগতও নিষ্ঠুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে!

মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা: জাপান এক অনুসরণীয় আদর্শ

tab

opinion » post-editorial

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার আকাশে যে ঘন কালো মেঘ দীর্ঘদিন ধরে ছায়া বিস্তার করে আছে, তার নামই মামলাজট। এ এক ভয়াল বোঝা, যা ন্যায়বিচারের পথকে শুধু দীর্ঘায়িতই করে না, বরং বিচারপ্রার্থী মানুষের হৃদয়ে হতাশার আঁধার নামিয়ে আনে। বর্তমানে দেশে প্রায় সতেরো লাখ দেওয়ানি মোকদ্দমা বিচারাধীন—সংখ্যাটির ভার যেন গোটা বিচারব্যবস্থার শিরদাঁড়ায় চাপ সৃষ্টি করছে। পরিসংখ্যান বলছে, মোট মামলার প্রায় চল্লিশ শতাংশই দেওয়ানি বিরোধ নিয়ে, অথচ সংখ্যার বাইরে প্রতিটি মামলার ভেতর লুকিয়ে আছে মানুষের জীবনের জটিল গল্প—কখনো উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা, কখনো জমিজমার দখল-সংক্রান্ত দ্বন্ধ, কখনো বা পারিবারিক বিবাদের গাঢ় ছায়া।

এই জটিলতার কারণে শুধু দেওয়ানি মামলা নয়, বহু ফৌজদারি মামলারও নেপথ্যে থাকে জমি-সম্পত্তি সংক্রান্ত দ্বন্ধের রূঢ় বাস্তবতা। ফলে দেওয়ানি মামলার দীর্ঘসূত্রিতা আমাদের পুরো বিচারব্যবস্থাকেই গ্রাস করছে। ন্যায়বিচার যেখানে হওয়া উচিত দ্রুত, সেখানেই তা পরিণত হচ্ছে এক অন্তহীন অপেক্ষার খেলায়। বছরের পর বছর আদালতের সিঁড়ি ঘষতে ঘষতে বিচারপ্রার্থী মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন, তাদের মুখে ফুটে উঠছে আর্তনাদের রেখা। যেন আইন ও আদালতের প্রতি আস্থা হারাতে বসেছেন অনেকেই।

মামলাজটের এই অভিশাপ তাই কেবল আদালতের কাঠগড়ায় নয়, বরং সাধারণ মানুষের জীবন-যাপনের প্রতিটি স্তরে ন্যায়বিচারের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ঠিক এই মুহূর্তে প্রয়োজন যুগান্তকারী সংস্কারের, যাতে বিচারব্যবস্থা মুক্তি পায় দীর্ঘসূত্রিতার শৃঙ্খল থেকে, আর জনগণ ফিরে পায় দ্রুত ও কার্যকর ন্যায়বিচারের আলো।

বহুবার সংস্কারের দাবি উঠেছে, নানা মহল থেকে সুপারিশ এসেছে, কিন্তু বাস্তবায়নের অভাবে সবই থেকে গেছে কেবল কাগজে-কলমে। অবশেষে ২০২৫ সালে সরকার জারি করেছে ‘দেওয়ানি কার্যবিধি (সংশোধন) অধ্যাদেশ’—যা নিছক একটি আইনি সংস্কার নয়, বরং বিচারব্যবস্থাকে সময়োপযোগী, প্রযুক্তিনির্ভর ও কার্যকর করার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ যেন শতবর্ষ পুরোনো আইনি কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে নতুন এক দিগন্তে পদার্পণ।

নতুন এই সংস্কারের ফলে আদালতে আরজি দাখিলের সময় বাদী-বিবাদীর জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বর এবং ই-মেইল ঠিকানা উল্লেখ করা হবে বাধ্যতামূলক। এর মাধ্যমে ভুয়া পরিচয় ব্যবহার বা একই নামে বিভ্রান্তি সৃষ্টির যে অবকাশ এতদিন ছিল, তা কার্যত রুদ্ধ হবে। সমন জারির প্রক্রিয়া হবে আরও দ্রুত, নির্ভুল ও স্বচ্ছ। অতীতের মতো ডাকপিয়ন বা পদাতিক বাহকের মাধ্যমে সমন পৌঁছানোর ঝামেলা আর থাকবে না। তার বদলে সমন পৌঁছে যাবে মুহূর্তের মধ্যেই এসএমএস, ভয়েস কল কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। আদালতের কাছে প্রতিটি ডেলিভারি রিপোর্ট থাকবে প্রমাণ হিসেবে সংরক্ষিত।

এর ফলে শুধু সময়ই সাশ্রয় হবে না, খরচও কমে আসবে উল্লেখযোগ্যভাবে। বিচারপ্রার্থী মানুষকে আর বছরের পর বছর সমনের অপেক্ষায় আদালতের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। প্রযুক্তির এই নতুন সংযোজন বিচারব্যবস্থাকে করবে আধুনিক, গতিশীল ও মানুষের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য। বলা যায়, দীর্ঘসূত্রিতার অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বিচারব্যবস্থা বেরিয়ে আসছে আলোকিত এক পথে—যেখানে গতি ও স্বচ্ছতাই হবে প্রধান হাতিয়ার।

সংস্কারের অন্যতম বড় দিক হলো একতরফা আদেশ রহিত করার সুযোগকে সীমিত করা। এতদিন বিবাদীরা ইচ্ছাকৃতভাবে আদালতে হাজির না হয়ে পরে একতরফা রায় বাতিলের আবেদন করতেন। ফলে মামলার অগ্রগতি বারবার থমকে যেত, আর বাদী পক্ষ বছরের পর বছর ধরে ভোগান্তির শিকার হতেন। নতুন সংশোধনের ফলে সেই সুযোগ অনেকটাই সীমিত হয়েছে। এতে উদ্দেশ্যমূলক বিলম্ব আর আইনের অপব্যবহার বন্ধ হবে, এবং বিচারপ্রক্রিয়া হবে আরও স্বচ্ছ ও গতিশীল।

তদুপরি, সংস্কারে ঘনঘন মুলতবি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। আগে একটি মামলায় সর্বোচ্চ বারো বার মুলতবি নেওয়ার সুযোগ ছিল। অনেক সময় তা অপব্যবহার করে মামলা বছরের পর বছর অচলাবস্থায় পড়ে থাকত। এখন সেই সুযোগ কমিয়ে আটে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। ফলে মামলার গতি অযথা আটকে থাকবে না, আদালতের সময়ও সাশ্রয় হবে, আর বিচারপ্রার্থীরা পাবেন দ্রুত নিষ্পত্তির আশ্বাস।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো সাক্ষ্যগ্রহণের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন। এখন থেকে বাদী-বিবাদী লিখিত এফিডেভিট আকারে সাক্ষ্য দাখিল করতে পারবেন। এর ফলে আদালতের মূল্যবান সময় সাশ্রয় হবে এবং পক্ষগণকে অযথা বারবার হাজির হতে হবে না। তবে ন্যায়বিচারের মৌলিক কাঠামো অক্ষুন্ন রাখতে ক্রস-এক্সামিনেশনের সুযোগ আগের মতোই বজায় রাখা হয়েছে, যাতে সাক্ষ্যের সত্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা যথাযথভাবে যাচাই করা যায়।

সবচেয়ে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। এতদিন একটি ডিক্রি কার্যকর করতে হলে আলাদা করে ‘জারি মোকদ্দমা’ দায়ের করতে হতো—যা বিচারপ্রক্রিয়াকে আরও দীর্ঘ করত এবং বিচারপ্রার্থীদের জন্য হয়ে উঠত বাড়তি ঝামেলার কারণ। নতুন সংশোধনের ফলে এখন মূল মামলার মধ্যেই আদালত রায় বাস্তবায়নের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। এতে সময় ও খরচ উভয়ই কমবে, এবং সবচেয়ে বড় কথা—ন্যায়বিচার জনগণের কাছে পৌঁছাবে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় দ্রুততরভাবে। এভাবে সংস্কারের ধারাবাহিক পদক্ষেপগুলো কেবল আইনি কাঠামোকেই আধুনিক করে তুলছে না, বরং বিচারপ্রার্থীর আস্থা ও আশা ফিরিয়ে আনছে এক নতুন অধ্যায়ের দিকে।

সংস্কারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আদালতের ক্ষমতা বৃদ্ধি। এখন থেকে প্রয়োজনে আদালত সরাসরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে পারবেন। এর ফলে ডিক্রি বাস্তবায়ন হবে আরও দ্রুত, নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্যভাবে। বিচারপ্রার্থীর আর আশঙ্কায় ভুগতে হবে না যে আদালতের রায় কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। এছাড়াও অধ্যাদেশে যুক্ত করা হয়েছে আরও কিছু যুগোপযোগী সংশোধন। দেওয়ানি কারাবাসে খোরপোষ বাতিল করা হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় রোধ হয়। মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে জরিমানার অঙ্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে, ফলে অযথা মামলা দায়ের করার প্রবণতা অনেকটাই হ্রাস পাবে। টাকা আদায়ের মামলায় সরাসরি কারাবাসের বিধান রাখা হয়েছে, যাতে দেনাদারদের দায় এড়ানোর সুযোগ না থাকে। রিমান্ডের সুযোগ সীমিত করে দেওয়া হয়েছে, যাতে মানবাধিকার রক্ষা পায় এবং অযথা হয়রানি বন্ধ হয়। একই সঙ্গে কার্যতালিকার আধুনিকায়ন করা হয়েছে, যা আদালতের দৈনন্দিন কার্যক্রমকে করবে আরও সুসংগঠিত, শৃঙ্খলাপূর্ণ ও কার্যকর।

যদি এই বিধানগুলো কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থেকে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে আমাদের বিচারব্যবস্থার চেহারায় ঘটবে এক দৃশ্যমান রূপান্তর। মামলাজটের ভয়াল পাহাড় ধীরে ধীরে ভেঙে পড়বে, বছরের পর বছর ধরে আদালতের সিঁড়ি ঘষতে থাকা বিচারপ্রার্থীদের দীর্ঘশ্বাস লাঘব হবে, আর হয়রানি ও অনিশ্চয়তার পরিবর্তে জন্ম নেবে স্বস্তি ও নিশ্চয়তার নতুন ভোর। আদালতের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে বহুগুণে, প্রতিটি মামলা অগ্রসর হবে সময়োপযোগী গতিতে, আর সর্বোপরি—সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরবে ন্যায়বিচারের অঙ্গনে।

[লেখক: আইনজীবী]

back to top