alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

জুলাই সনদ আদিবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি

মিথুশিলাক মুরমু

: শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের সরকার ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষিতে আদিবাসীরা আশান্বিত হয়েছিল যে আর তাদেরকে বৈষম্যের বেড়াজালে আটকা পড়তে হবে না।

জুলাই সনদে পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক, অন্ত্যজ ও আদিবাসীদের সংরক্ষণ বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন সম্পর্কে কোনো প্রস্তাবনা বা আলোচনার উল্লেখ নেই

পড়তে হবে না-দৈনন্দিন জীবনে কোনো ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে। ৫ আগস্টের পরবর্তী কালে বিশেষত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিফলনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রাজধানীসহ জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ দেয়াল ও মেট্রো রেলের পিলারে অঙ্কিত গ্রাফিতিতে। অন্যতম ছিল-‘আদিবাসী, বৌদ্ধ, মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান’ লেখা, যার পাশে বার্তা ছিল-‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। এটি দেশের বহু জাতিসত্তা ও বহু ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে গ্রহণযোগ্য ছিল। জুলাই আন্দোলনের কয়েক মাসের মধ্যেই ১২ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। এটি নিয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থী ও সচেতন নাগরিকরা ১৫ জানুয়ারি প্রতিবাদ ও স্মারকলিপি নিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ভবনমুখী শান্তিপূর্ণ মিছিলে ‘স্টুডেন্টস ফর সোভরেনটি’ নামক সংগঠনের দ্বারা প্রহৃত ও অপমানিত হতে হয়েছে। আদিবাসীদের প্রধান দাবি ছিল-পাঠ্যবইয়ে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বহাল রাখা এবং বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়কে সম্মান জানানো। জুলাই সনদের প্রতিটি পৃষ্ঠা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখার চেষ্টা করেছি; কোথাও আদিবাসী-অন্ত্যজ শ্রেণীর কথা স্থান পায়নি; স্থান হয়নি ‘আদিবাসী’ শব্দটিরও। আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক অলিক মৃ বলেছেন, ‘যে সনদে আদিবাসীদের কথা থাকবে না, সে সনদ তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।’

সদ্য স্বাধীন দেশের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইএলও সনদের ১০৭ ধারাটি স্বপক্ষে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুন অভিমত ও অনুস্বাক্ষর করেছিলেন। বাংলাদেশ জাতিসংঘের ‘আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী কনভেনশন ১৯৫৭’ (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন কনভেনশন, ১৯৫৭) অনুস্বাক্ষর করলেও এর আলোকে এখনো কোনো আইন প্রণীত হয়নি। কনভেনশনের অন্যতম দিকগুলো ছিল-স্বীকৃতি ও সুরক্ষা, ভূমির অধিকার, উন্নয়ন পরিকল্পনা, জোরপূর্বক স্থানান্তর নিষিদ্ধকরণ, শিক্ষার অধিকার এবং বৈষম্যরোধ ও দূরীকরণ। একটু ধৈর্য ধরে বোঝার চেষ্টা করুন-জুলাই সনদটিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফসল। আন্দোলনটি বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে আবার বৈষম্যের ঘোরটোপে আটকে গেছে। আদিবাসী শিক্ষার্থীরা সর্বাত্মক অংশগ্রহণ করেছে, কিন্তু ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তিতে কোনো সুযোগ প্রদান করা হয়নি। এটি জলের মতো পরিষ্কার-আদিবাসীরা বিশেষ সুবিধাদি-কোটা, সংরক্ষিত আসন ছাড়া মূলধারার মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারবে না। উত্তরবঙ্গের কতকগুলো আদিবাসী গোষ্ঠীতে এখনও এসএসসি-পাস শিক্ষার্থীদের দেখা মেলা ভার। শিক্ষার আলো যেন তাদের কাছে সোনার হরিণসম।

প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে প্রায় ডজনখানেক সংস্কার কমিটি গঠিত হয়েছে। প্রতিটি কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা দেখেছি। শ্রম সংস্কার কমিশনে-তপন দত্ত এবং নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনে-নিরুপা দেওয়ান ব্যতীত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নাম চোখে পড়েনি। এইজন্যেই সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত সংস্কারসমূহে আদিবাসী ও অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের স্বার্থটি প্রতিফলিত হয়নি। সাধারণভাবে চোখে পড়েছে-সংবিধান সংস্কার কমিশনে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্তি হওয়া ছিল আবশ্যিক। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সংবিধানের উপর আলোচনায় প্রয়াত আদিবাসী সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ‘বাঙালি’ জাতীয়তা বাধ্যতামূলক করায় তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সকল আদিবাসীর উপর একটি জাতিগত পরিচয় চাপিয়ে দেওয়াকে অন্যায় বলে অভিহিত করেছিলেন। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও একই মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ আমাদের নির্বাক করেছে।

জুলাই জাতীয় সনদের ভাষ্য ভাষার প্রশ্নে বলা হয়েছে-‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। সংবিধানে বাংলাদেশের নাগরিকদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত অন্যান্য সকল ভাষাকে দেশের প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।’ সত্য কথা হলো-সরকার আজ পর্যন্ত আদিবাসীদের মাতৃভাষার সঠিক চিত্র উপস্থাপন করতে পারেনি। স্বীকৃতি প্রদান কথাটি এত সহজসাধ্য নয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৯ হাজার ৫০০-এর বেশি ভাষা বা মাতৃভাষা রয়েছে, যার মধ্যে অদ্যাবধি মাত্র ২২টি ভাষাকে সরকারিভাবে স্বীকৃত বা শিডিউলড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ১২১টি ভাষা রয়েছে, যেগুলোতে ১০ হাজারের বেশি মানুষ কথোপকথন করে থাকে। বাংলাদেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতিতে অনীহা যেমন স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে, ভাষার স্বীকৃতি জাতিগোষ্ঠীর স্বীকৃতি ব্যতীত কিভাবে সম্ভব-সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। আদিবাসীদের ভাষাগুলোর সংরক্ষণ, বিকাশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারের জন্য রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা কতটা নিশ্চিত হবে, তা স্পষ্ট নয়।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত আসনের তথ্যাদি চোখে পড়ে; বিশেষত উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে তথা সমগ্র আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্বের জন্য স্থানীয় থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সংরক্ষিত আসনের কোনো বিকল্প নেই। জুলাই সনদে পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক, অন্ত্যজ ও আদিবাসীদের সংরক্ষণ বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন সম্পর্কে কোনো প্রস্তাবনা বা আলোচনার উল্লেখ নেই।

রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিতে-‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ সংযোজন অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও মর্যাদা সংক্রান্ত ৮-এ বলা হয়েছে-‘বাংলাদেশ একটি বহু জাতিগোষ্ঠী, বহু ধর্মী, বহু ভাষী ও বহু সংস্কৃতির দেশ, যেখানে সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে।’ বহু জাতির মধ্যে যদি আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্তি থেকে থাকে-অর্থাৎ সাঁওতাল, উরাঁও, কোল, মুণ্ডা, গারো, খাসিয়া, হাজং, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতিকে-তাহলে কেন ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ইত্যাদি পদ ব্যবহার করছি? যে নামে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, সেই নামটি ধারণ করার অধিকার তাদের রয়েছে; এটিই তো সাম্যতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার।

২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেছে। বিরত থেকেছে-বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্কসবাদী), বাংলাদেশ জাসদসহ আরও কতক রাজনৈতিক দল। এছাড়া জনসংহতি সমিতি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম, গাসু, বাগছাস, সাসু, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদসহ আদিবাসী সংগঠনগুলো জাতীয় জুলাই সনদকে অভিনন্দন জানাতে পারেনি। আদিবাসী নেতারা উষ্মা প্রকাশ করেছেন-জুলাই সনদ একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কথা বললেও তা আদিবাসীদের মৌলিক পরিচয়ের দাবিকে যথাযথভাবে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং অধিকার রক্ষায় পর্যাপ্ত সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের অভাব রয়েছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা-চেতনা ও উদার মানসিকতা জরুরি। সবচেয়ে অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষগুলোর স্বার্থটি এড়িয়ে যাওয়া হলে দেশ এগিয়ে যাবে, কিন্তু দারিদ্র?্য থাকবে; উন্নয়ন ঘটবে, কিন্তু উন্নতি হবে না। আসুন, রাজধানী থেকে মহানগর, উপশহর থেকে উপজেলা, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের আপামর মানুষের পরিবর্তনের কথাকে প্রাধান্য দিই।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: কলামিস্ট]

জমির ভুয়া দলিল কীভাবে বাতিল করবেন?

ব্যাংকের দুরবস্থা থামানো যাচ্ছে না কেন

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্টহপারের প্রাদুর্ভাব

বৈষম্য, অপচয় ও খাদ্যনিরাপত্তার সংকট

“বাঙালি আমরা, নহিতো...”

নারী নির্যাতন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সমাজের দায়

কাঁপছে ডলারের সিংহাসন

ত্রিশতম জলবায়ু সম্মেলন : প্রতীকী প্রদর্শনী, নাকি বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতির বাঁক নেওয়ার মুহূর্ত?

অপরিণত নবজাতক : ঝুঁকি, প্রতিরোধ ও যত্নের জরুরি বাস্তবতা

বাংলাদেশী উত্তরাধিকার: প্রবাস-জীবন ও আমাদের সংস্কৃতি

রাজনীতিতে ভাষার সহনীয় প্রয়োগ

ভারত : এসআইআর এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন

মনে কী দ্বিধা নিয়ে...

নিরাপদ সড়ক ভাবনা

অপরিকল্পিত বাঁধ-শিল্পায়নে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র কৃষি

ছবি

মামদানি দেখালেন নেতৃত্বের মূল পরিচয় কী

চেকের মামলায় বৈধ বিনিময়, লেনদেন, দেনা-পাওনা প্রমাণ ছাড়া আর জেল নয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

মাদকাসক্তি: শুধু নিরাময় নয়, চাই সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার

আমেরিকার “নো কিংস” আন্দোলন

ঘি তো আমাদের লাগবেই, নো হাংকি পাংকি!

“মামদানি না জামদানি...”

ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় নীরব বিপ্লব

উপাত্ত সুরক্ষা আইন : গোপনীয়তা রক্ষা নাকি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ?

সমতা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করে?

ডেঙ্গু সংকট দূরদৃষ্টির ব্যর্থতা

ষাটের দশকে বামপন্থী ভাবনার উত্থান ও বিবর্তন

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে!

বায়ুর অপর নাম জীবন

ছবি

হাওরের জীবন ও সংস্কৃতি

বিখণ্ডিত আত্মপরিচয়: তরল সহানুভূতিতে নৈতিক মূলধনের সমাজতত্ত্ব

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

জুলাই সনদ আদিবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি

মিথুশিলাক মুরমু

শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের সরকার ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষিতে আদিবাসীরা আশান্বিত হয়েছিল যে আর তাদেরকে বৈষম্যের বেড়াজালে আটকা পড়তে হবে না।

জুলাই সনদে পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক, অন্ত্যজ ও আদিবাসীদের সংরক্ষণ বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন সম্পর্কে কোনো প্রস্তাবনা বা আলোচনার উল্লেখ নেই

পড়তে হবে না-দৈনন্দিন জীবনে কোনো ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে। ৫ আগস্টের পরবর্তী কালে বিশেষত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতিফলনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রাজধানীসহ জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ দেয়াল ও মেট্রো রেলের পিলারে অঙ্কিত গ্রাফিতিতে। অন্যতম ছিল-‘আদিবাসী, বৌদ্ধ, মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান’ লেখা, যার পাশে বার্তা ছিল-‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। এটি দেশের বহু জাতিসত্তা ও বহু ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে গ্রহণযোগ্য ছিল। জুলাই আন্দোলনের কয়েক মাসের মধ্যেই ১২ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। এটি নিয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থী ও সচেতন নাগরিকরা ১৫ জানুয়ারি প্রতিবাদ ও স্মারকলিপি নিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ভবনমুখী শান্তিপূর্ণ মিছিলে ‘স্টুডেন্টস ফর সোভরেনটি’ নামক সংগঠনের দ্বারা প্রহৃত ও অপমানিত হতে হয়েছে। আদিবাসীদের প্রধান দাবি ছিল-পাঠ্যবইয়ে ‘আদিবাসী’ শব্দটি বহাল রাখা এবং বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়কে সম্মান জানানো। জুলাই সনদের প্রতিটি পৃষ্ঠা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখার চেষ্টা করেছি; কোথাও আদিবাসী-অন্ত্যজ শ্রেণীর কথা স্থান পায়নি; স্থান হয়নি ‘আদিবাসী’ শব্দটিরও। আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক অলিক মৃ বলেছেন, ‘যে সনদে আদিবাসীদের কথা থাকবে না, সে সনদ তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।’

সদ্য স্বাধীন দেশের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইএলও সনদের ১০৭ ধারাটি স্বপক্ষে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুন অভিমত ও অনুস্বাক্ষর করেছিলেন। বাংলাদেশ জাতিসংঘের ‘আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী কনভেনশন ১৯৫৭’ (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন কনভেনশন, ১৯৫৭) অনুস্বাক্ষর করলেও এর আলোকে এখনো কোনো আইন প্রণীত হয়নি। কনভেনশনের অন্যতম দিকগুলো ছিল-স্বীকৃতি ও সুরক্ষা, ভূমির অধিকার, উন্নয়ন পরিকল্পনা, জোরপূর্বক স্থানান্তর নিষিদ্ধকরণ, শিক্ষার অধিকার এবং বৈষম্যরোধ ও দূরীকরণ। একটু ধৈর্য ধরে বোঝার চেষ্টা করুন-জুলাই সনদটিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফসল। আন্দোলনটি বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে আবার বৈষম্যের ঘোরটোপে আটকে গেছে। আদিবাসী শিক্ষার্থীরা সর্বাত্মক অংশগ্রহণ করেছে, কিন্তু ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তিতে কোনো সুযোগ প্রদান করা হয়নি। এটি জলের মতো পরিষ্কার-আদিবাসীরা বিশেষ সুবিধাদি-কোটা, সংরক্ষিত আসন ছাড়া মূলধারার মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারবে না। উত্তরবঙ্গের কতকগুলো আদিবাসী গোষ্ঠীতে এখনও এসএসসি-পাস শিক্ষার্থীদের দেখা মেলা ভার। শিক্ষার আলো যেন তাদের কাছে সোনার হরিণসম।

প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে প্রায় ডজনখানেক সংস্কার কমিটি গঠিত হয়েছে। প্রতিটি কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা দেখেছি। শ্রম সংস্কার কমিশনে-তপন দত্ত এবং নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনে-নিরুপা দেওয়ান ব্যতীত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নাম চোখে পড়েনি। এইজন্যেই সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত সংস্কারসমূহে আদিবাসী ও অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের স্বার্থটি প্রতিফলিত হয়নি। সাধারণভাবে চোখে পড়েছে-সংবিধান সংস্কার কমিশনে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্তি হওয়া ছিল আবশ্যিক। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সংবিধানের উপর আলোচনায় প্রয়াত আদিবাসী সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ‘বাঙালি’ জাতীয়তা বাধ্যতামূলক করায় তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সকল আদিবাসীর উপর একটি জাতিগত পরিচয় চাপিয়ে দেওয়াকে অন্যায় বলে অভিহিত করেছিলেন। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও একই মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ আমাদের নির্বাক করেছে।

জুলাই জাতীয় সনদের ভাষ্য ভাষার প্রশ্নে বলা হয়েছে-‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। সংবিধানে বাংলাদেশের নাগরিকদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত অন্যান্য সকল ভাষাকে দেশের প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।’ সত্য কথা হলো-সরকার আজ পর্যন্ত আদিবাসীদের মাতৃভাষার সঠিক চিত্র উপস্থাপন করতে পারেনি। স্বীকৃতি প্রদান কথাটি এত সহজসাধ্য নয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৯ হাজার ৫০০-এর বেশি ভাষা বা মাতৃভাষা রয়েছে, যার মধ্যে অদ্যাবধি মাত্র ২২টি ভাষাকে সরকারিভাবে স্বীকৃত বা শিডিউলড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ১২১টি ভাষা রয়েছে, যেগুলোতে ১০ হাজারের বেশি মানুষ কথোপকথন করে থাকে। বাংলাদেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতিতে অনীহা যেমন স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে, ভাষার স্বীকৃতি জাতিগোষ্ঠীর স্বীকৃতি ব্যতীত কিভাবে সম্ভব-সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। আদিবাসীদের ভাষাগুলোর সংরক্ষণ, বিকাশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারের জন্য রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা কতটা নিশ্চিত হবে, তা স্পষ্ট নয়।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত আসনের তথ্যাদি চোখে পড়ে; বিশেষত উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে তথা সমগ্র আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্বের জন্য স্থানীয় থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সংরক্ষিত আসনের কোনো বিকল্প নেই। জুলাই সনদে পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক, অন্ত্যজ ও আদিবাসীদের সংরক্ষণ বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন সম্পর্কে কোনো প্রস্তাবনা বা আলোচনার উল্লেখ নেই।

রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিতে-‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ সংযোজন অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও মর্যাদা সংক্রান্ত ৮-এ বলা হয়েছে-‘বাংলাদেশ একটি বহু জাতিগোষ্ঠী, বহু ধর্মী, বহু ভাষী ও বহু সংস্কৃতির দেশ, যেখানে সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে।’ বহু জাতির মধ্যে যদি আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্তি থেকে থাকে-অর্থাৎ সাঁওতাল, উরাঁও, কোল, মুণ্ডা, গারো, খাসিয়া, হাজং, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতিকে-তাহলে কেন ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ইত্যাদি পদ ব্যবহার করছি? যে নামে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, সেই নামটি ধারণ করার অধিকার তাদের রয়েছে; এটিই তো সাম্যতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার।

২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেছে। বিরত থেকেছে-বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্কসবাদী), বাংলাদেশ জাসদসহ আরও কতক রাজনৈতিক দল। এছাড়া জনসংহতি সমিতি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম, গাসু, বাগছাস, সাসু, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদসহ আদিবাসী সংগঠনগুলো জাতীয় জুলাই সনদকে অভিনন্দন জানাতে পারেনি। আদিবাসী নেতারা উষ্মা প্রকাশ করেছেন-জুলাই সনদ একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কথা বললেও তা আদিবাসীদের মৌলিক পরিচয়ের দাবিকে যথাযথভাবে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং অধিকার রক্ষায় পর্যাপ্ত সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের অভাব রয়েছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা-চেতনা ও উদার মানসিকতা জরুরি। সবচেয়ে অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষগুলোর স্বার্থটি এড়িয়ে যাওয়া হলে দেশ এগিয়ে যাবে, কিন্তু দারিদ্র?্য থাকবে; উন্নয়ন ঘটবে, কিন্তু উন্নতি হবে না। আসুন, রাজধানী থেকে মহানগর, উপশহর থেকে উপজেলা, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের আপামর মানুষের পরিবর্তনের কথাকে প্রাধান্য দিই।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: কলামিস্ট]

back to top