গাজী তারেক আজিজ
১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে শোকের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের- শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী- যারা একটি সদ্য জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত গড়ে তুলতে পারতেন। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত এই গণহত্যা আন্তর্জাতিক অপরাধের সংজ্ঞায় পড়ে। এটি শুধু রাজনৈতিক সহিংসতা নয়, এটি একটি জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পিত, ধিকৃত ও ভয়ঙ্কর প্রচেষ্টার অংশ মাত্র। ৫৪ বছর পর এই হত্যাকা-কে ঘিরে নতুন করে ‘স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ গঠনের দাবি উঠেছে। প্রশ্ন হলো এই দাবি কি সত্য অনুসন্ধানের আকাক্সক্ষা, নাকি দায়মুক্তির পথ প্রশস্ত করার রাজনৈতিক কৌশল? আমাদের ভাবতে হবে!
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত আলোচনা সভা থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রস্তাব দেন। তার বক্তব্যে একাধিক গুরুতর দাবি উত্থাপিত হয়,। দিল্লির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, ভারতীয়দের সম্পৃক্ততা, স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও রহস্য উন্মোচিত না হওয়া এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে জামায়াতের ওপর দায় চাপানোর অভিযোগ। একইসঙ্গে নির্বাচনী নিরাপত্তা ইস্যু টেনে এনে বলা হয়, নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে নির্বাচন ঝুঁকিতে পড়বে। বক্তব্যের আরেক প্রান্তে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ‘প্রভু-ভৃত্য’ নয়, ‘সমতা ও ন্যায্যতা’র ভিত্তিতে দেখতে চাওয়ার দাবি উচ্চারিত হয়। তেমনই সংবাদ প্রকাশ করেছে দেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকাগুলো। ভালো কথা! তাই বলে দিবালোকের মতো স্বচ্ছ ও প্রমাণিত সত্যকে এভাবে অস্বীকার করে দায় চাপানোর ভেলকিবাজি কি এবারই প্রথম, নাকি আগেও করেছে? প্রশ্ন করা ও উত্তর হয়তো মেলানো সহজ হতো যদি, অধুনা সংঘটিত অভ্যুত্থান পরবর্তী একটা গোষ্ঠী রাজনীতির মাঠ, প্রশাসন, মিডিয়া ও সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংবিধান আইনগত অভিভাবক প্রতিষ্ঠানও নিজেদের কব্জায় না নিতে পারতো! আমরা কেবলই দেখছি মিডিয়ার কন্ঠরোধ করা, মব তৈরি করে হামলা, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, আরও কত কী!
এই বক্তব্যসমূহ আলাদা আলাদা করে দেখলে রাজনৈতিক অবস্থান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বরের প্রেক্ষাপটে এগুলো একত্রে একটি নতুন বয়ান নির্মাণের ইঙ্গিত দেয়। যেখানে ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, আন্তর্জাতিক অপরাধের দায়ভার স্থানান্তর করা এবং অতীতে স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধের রাজনৈতিক দায় থেকে সরে যাওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট। শুধুই নিজেকে রক্ষার কৌশল নয়, অন্যকে দোষী সাব্যস্তের রমরমা মিথ্যার বেসাতি। এহেন পরিস্থিতির জন্য দায় নিতে হবে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকেও। হোক ইচ্ছায়, না হয় অনিচ্ছায়। কারণ কখনও আন্দোলনের নামে আওয়ামী লীগের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা। আবার রাজনীতি ও ক্ষমতা দখলের নৈরাজ্যে বিএনপির সাথে জোট-ভোট। এরই মধ্যে নিজেরাই একটা বলয় হয়ে উঠতে চেয়ে মরিয়া ভাব অতীতে এতটা দেখা যায়নি। জামায়াত যদি বিএনপিকে পরিত্যাগ না করতো, বিএনপির সেই রাজনৈতিক সাহস কি ছিল? স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি কোন না কোন দলে ভর করে অস্বস্তি টিকিয়ে রেখেছে। এর দায়ও রাজনৈতিক দলগুলো অস্বীকার করার সুযোগ থাকছে না।
আসা যাক মূল কথায়, প্রথমত, ‘স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ এই ধারণা নীতিগতভাবে আপত্তিকর নয়। যেকোনো গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধে সত্য উদ্ঘাটন, ন্যায়বিচার ও স্মৃতির সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে প্রেক্ষিত ও উদ্দেশ্য গুরুত্বপূর্ণ। ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকা- নিয়ে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি পর্যায়ে বিস্তৃত গবেষণা, সাক্ষ্য, দলিল ও বিচারিক প্রক্রিয়া রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়সমূহে আলবদর-আলশামসের ভূমিকা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্দেশনা ও দেশীয় সহযোগীদের সম্পৃক্ততা বিচারিকভাবে প্রমাণিত ও প্রতীয়মান হয়েছে। এই বিচারিক সত্যকে পাশ কাটিয়ে নতুন করে ‘রহস্যাবৃত’ আখ্যা দেওয়া কি ইতিহাসকে পুনর্লিখনের প্রয়াস নয়? কিন্তু সত্য পাশ কাটানো এতটা সহজও নয়। দেশের সর্বত্র এই দিবসটিকে উদযাপন করা হলেও তার নিয়ন্ত্রণ যদিও অভিযুক্ত পক্ষ হয়েও জামায়াতই নিয়েছে। তারপরও দেশব্যাপী তীব্র নিন্দা, ক্ষোভ, ঘৃণা প্রদর্শিত হয়েছে পাকিস্তানি ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে প্রবেশমুখে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, কাদের মোল্লাসহ অন্যান্যদের ছবি মাটিতে লেপ্টে দিয়ে পা দিয়ে মাড়ানো এবং ঘৃণাস্তম্ভ করে জুতা নিক্ষেপ। এর চেয়ে কার্যকর প্রতিবাদ ছাত্র-জনতার কিছু অংশ আর কিভাবে দেখিয়েছে! তাহলে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া গেছে, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রাসঙ্গিক সকল দিবস ভুলিয়ে চুকিয়ে দেয়ার সুযোগও থাকছে না।
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় ষড়যন্ত্রের দাবি, এটি কেবল কূটনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর নয়, এটি প্রমাণের ভারে অত্যন্ত দুর্বল। আন্তর্জাতিক আইনের মানদ-ে এমন অভিযোগ আনতে হলে প্রামাণ্য দলিল, নিরপেক্ষ তদন্ত ও স্বীকৃত ফোরামের প্রয়োজন হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের বাস্তবতায় পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয়ের মুখে ‘স্কর্চড আর্থ’ নীতিতে বুদ্ধিজীবী হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, এমন তথ্য বহু আন্তর্জাতিক গবেষণা ও প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত। স্বাধীনতার স্বপক্ষে থাকা বুদ্ধিজীবীরা ‘ভারতবিরোধী’ ছিলেন-এমন সাধারণীকরণ ইতিহাসের জটিলতাকে সরলীকৃত করে এবং শহীদদের স্মৃতির প্রতি অবিচার করে। আর এই ইতিহাস বিকৃতির বয়ান কি দেশের আপামর জনতা গ্রহণ করতে প্রস্তুত!
তৃতীয়ত, জামায়াতের বিরুদ্ধে ‘সব দোষ চাপানো হয়েছে’ এই বক্তব্যের নৈতিক ও আইনগত মূল্যায়ন জরুরি। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের ভেতরে ব্যক্তিগত দায় ও সাংগঠনিক দায়ের প্রশ্ন আলাদা হতে পারে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারে ব্যক্তিগত অপরাধের দায় প্রমাণিত হলে সেটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলা আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস ছড়ায়। দায় স্বীকার, অনুশোচনা ও পুনর্মিলন, এই তিনটি পথই অতীতের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত বোঝাপড়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত উপায়। দায় অস্বীকার ও পাল্টা অভিযোগ সেই পথকে রুদ্ধ করে। বারবার জামায়াত সেই কাজটিই করে এসেছে। যা দলটিকে জনবিচ্যুত করে রেখেছে। এই জন্যই কি দলটির সাবেক ও বর্তমান নেতারা ‘ঐতিহাসিক ভুল’ করে চলেছেন মর্মেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। যেমন- ব্রিটিশ ভাগের বিরোধিতা, পাকিস্তানকে আহাম্মকের বেহেশত আখ্যা দেয়া, স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতা ও হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতার বিষয়টিও দলটির ভুল বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন। জামায়াত সেই পথেই রোজকার পথিক!
এখানে একটি বড় রাজনৈতিক প্রবণতা লক্ষণীয়। স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীদের ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে পুনর্বর্ণনা করার চেষ্টা। ইতিহাসে এটি নতুন নয়। নানা দেশে সংঘাত-পরবর্তী রাজনীতিতে দেখা গেছে, পরাজিত বা অভিযুক্ত পক্ষ সময়ের ব্যবধানে স্মৃতির রাজনীতিকে বদলাতে চায়। পাঠ্যপুস্তক, স্মরণদিবস, ভাষ্য ও প্রতীক, সবখানেই ধীরে ধীরে নতুন ব্যাখ্যা ঢোকানো হয়। বাংলাদেশে এই প্রচেষ্টা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির ধারাবাহিক প্রতিবাদের মুখে পড়েছে। তথাপিও টানাপোড়েনেই রাজনীতির মেরুকরণ বাড়ছে, আর মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষের শিকার বানানো হচ্ছে-যা উদ্বেগজনক।
জামায়াত এরপর আর কী কী দাবি তুলতে পারে- এই প্রশ্ন অনুমাননির্ভর হলেও প্রবণতা বিশ্লেষণ করা যায়। এক. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় পুনর্বিবেচনার দাবি। দুই. যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা ও সময়সীমা নিয়ে বিতর্ক তোলা। তিন. ‘জাতীয় পুনর্মিলন’-এর নামে সাধারণ ক্ষমা বা বিচারিক প্রক্রিয়া স্থগিতের প্রস্তাব। চার. পাঠ্যপুস্তক ও স্মরণদিবসের ভাষ্য পরিবর্তনের চাপ। পাঁচ. নির্বাচন ও নিরাপত্তা ইস্যুকে সামনে এনে রাজনৈতিক দরকষাকষি। এগুলো আলোচনায় প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারে। যেমন করে একটি মিথ্যাকে বারবার বলে সত্যে রূপান্তর করার অবাস্তব ও কাল্পনিক প্রচেষ্টার অংশ করে তোলা।
নির্বাচনী নিরাপত্তা প্রসঙ্গে শরিফ ওসমান হাদীর হুমকির অভিযোগ গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল। রাজনৈতিক সহিংসতা গণতন্ত্রের শত্রু। তবে নিরাপত্তা ইস্যুকে ইতিহাস পুনর্লিখনের দাবির সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে জনআলোচনা বিভ্রান্ত হয়। একইভাবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে সমতা ও ন্যায্যতার দাবি যৌক্তিক। কিন্তু তা যেন মুক্তিযুদ্ধের দায়ভার স্থানান্তরের অজুহাত না হয়। সে দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরি। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে অটুট রাখতে তরুণ ছাত্র-যুবাকেই বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে।
সবকিছু ছাপিয়ে প্রশ্ন দাঁড়ায়, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কী প্রমাণ করতে চাইছে? একটি সম্ভাব্য উত্তর হলো: রাজনৈতিক বৈধতা পুনর্গঠন। অভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তি দাবি করে আওয়ামী লীগের বিরোধিতার নামে যে ভাষ্য তৈরি হচ্ছে, তাতে অনেক সময় মুক্তিযুদ্ধকেই কটাক্ষ করা হয়। এতে স্বল্পমেয়াদে রাজনৈতিক মুনাফা মিললেও দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রীয় ঐকমত্য ভাঙে। মুক্তিযুদ্ধ কোনো দলীয় সম্পত্তি নয়, এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি। এই ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করলে গণতন্ত্রের ঘরটাই নড়বড়ে হয়।
পরিশেষে, ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে কোনো তদন্ত বা আলোচনা হতে হবে প্রতিষ্ঠিত সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে, বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, শহীদদের মর্যাদা অক্ষুণ্য রেখে। স্বাধীন তদন্ত কমিশন যদি হয়, তা হতে হবে সর্বসম্মত, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডসম্মত, এবং পূর্ববর্তী বিচারিক সত্যকে অস্বীকার না করে। অন্যথায়, এই দাবি ইতিহাসের দায় থেকে সরে যাওয়ার পথ হিসেবেই বিবেচিত হবে। বাংলাদেশকে অপ্রাসঙ্গিক করে, বিজয়কে অবজ্ঞা করে, শহীদের আত্মত্যাগ অস্বীকার করে মীমাংসিত ইস্যু নিয়ে দাবি তোলা পারতপক্ষে বাংলাদেশকেই কি অস্বীকৃতি নয়? শহীদদের স্মৃতি রাজনীতির হাতিয়ার নয়; এটি জাতির নৈতিক কম্পাস। সেই কম্পাসকে ঘুরিয়ে দিলে পথ হারায় রাষ্ট্র, হারায় ভবিষ্যৎ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
গাজী তারেক আজিজ
শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫
১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে শোকের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের- শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী- যারা একটি সদ্য জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত গড়ে তুলতে পারতেন। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত এই গণহত্যা আন্তর্জাতিক অপরাধের সংজ্ঞায় পড়ে। এটি শুধু রাজনৈতিক সহিংসতা নয়, এটি একটি জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পিত, ধিকৃত ও ভয়ঙ্কর প্রচেষ্টার অংশ মাত্র। ৫৪ বছর পর এই হত্যাকা-কে ঘিরে নতুন করে ‘স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ গঠনের দাবি উঠেছে। প্রশ্ন হলো এই দাবি কি সত্য অনুসন্ধানের আকাক্সক্ষা, নাকি দায়মুক্তির পথ প্রশস্ত করার রাজনৈতিক কৌশল? আমাদের ভাবতে হবে!
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত আলোচনা সভা থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রস্তাব দেন। তার বক্তব্যে একাধিক গুরুতর দাবি উত্থাপিত হয়,। দিল্লির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, ভারতীয়দের সম্পৃক্ততা, স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও রহস্য উন্মোচিত না হওয়া এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে জামায়াতের ওপর দায় চাপানোর অভিযোগ। একইসঙ্গে নির্বাচনী নিরাপত্তা ইস্যু টেনে এনে বলা হয়, নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে নির্বাচন ঝুঁকিতে পড়বে। বক্তব্যের আরেক প্রান্তে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ‘প্রভু-ভৃত্য’ নয়, ‘সমতা ও ন্যায্যতা’র ভিত্তিতে দেখতে চাওয়ার দাবি উচ্চারিত হয়। তেমনই সংবাদ প্রকাশ করেছে দেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকাগুলো। ভালো কথা! তাই বলে দিবালোকের মতো স্বচ্ছ ও প্রমাণিত সত্যকে এভাবে অস্বীকার করে দায় চাপানোর ভেলকিবাজি কি এবারই প্রথম, নাকি আগেও করেছে? প্রশ্ন করা ও উত্তর হয়তো মেলানো সহজ হতো যদি, অধুনা সংঘটিত অভ্যুত্থান পরবর্তী একটা গোষ্ঠী রাজনীতির মাঠ, প্রশাসন, মিডিয়া ও সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংবিধান আইনগত অভিভাবক প্রতিষ্ঠানও নিজেদের কব্জায় না নিতে পারতো! আমরা কেবলই দেখছি মিডিয়ার কন্ঠরোধ করা, মব তৈরি করে হামলা, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, আরও কত কী!
এই বক্তব্যসমূহ আলাদা আলাদা করে দেখলে রাজনৈতিক অবস্থান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বরের প্রেক্ষাপটে এগুলো একত্রে একটি নতুন বয়ান নির্মাণের ইঙ্গিত দেয়। যেখানে ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, আন্তর্জাতিক অপরাধের দায়ভার স্থানান্তর করা এবং অতীতে স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধের রাজনৈতিক দায় থেকে সরে যাওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট। শুধুই নিজেকে রক্ষার কৌশল নয়, অন্যকে দোষী সাব্যস্তের রমরমা মিথ্যার বেসাতি। এহেন পরিস্থিতির জন্য দায় নিতে হবে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকেও। হোক ইচ্ছায়, না হয় অনিচ্ছায়। কারণ কখনও আন্দোলনের নামে আওয়ামী লীগের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা। আবার রাজনীতি ও ক্ষমতা দখলের নৈরাজ্যে বিএনপির সাথে জোট-ভোট। এরই মধ্যে নিজেরাই একটা বলয় হয়ে উঠতে চেয়ে মরিয়া ভাব অতীতে এতটা দেখা যায়নি। জামায়াত যদি বিএনপিকে পরিত্যাগ না করতো, বিএনপির সেই রাজনৈতিক সাহস কি ছিল? স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি কোন না কোন দলে ভর করে অস্বস্তি টিকিয়ে রেখেছে। এর দায়ও রাজনৈতিক দলগুলো অস্বীকার করার সুযোগ থাকছে না।
আসা যাক মূল কথায়, প্রথমত, ‘স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ এই ধারণা নীতিগতভাবে আপত্তিকর নয়। যেকোনো গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধে সত্য উদ্ঘাটন, ন্যায়বিচার ও স্মৃতির সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে প্রেক্ষিত ও উদ্দেশ্য গুরুত্বপূর্ণ। ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকা- নিয়ে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি পর্যায়ে বিস্তৃত গবেষণা, সাক্ষ্য, দলিল ও বিচারিক প্রক্রিয়া রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়সমূহে আলবদর-আলশামসের ভূমিকা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্দেশনা ও দেশীয় সহযোগীদের সম্পৃক্ততা বিচারিকভাবে প্রমাণিত ও প্রতীয়মান হয়েছে। এই বিচারিক সত্যকে পাশ কাটিয়ে নতুন করে ‘রহস্যাবৃত’ আখ্যা দেওয়া কি ইতিহাসকে পুনর্লিখনের প্রয়াস নয়? কিন্তু সত্য পাশ কাটানো এতটা সহজও নয়। দেশের সর্বত্র এই দিবসটিকে উদযাপন করা হলেও তার নিয়ন্ত্রণ যদিও অভিযুক্ত পক্ষ হয়েও জামায়াতই নিয়েছে। তারপরও দেশব্যাপী তীব্র নিন্দা, ক্ষোভ, ঘৃণা প্রদর্শিত হয়েছে পাকিস্তানি ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে প্রবেশমুখে গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, কাদের মোল্লাসহ অন্যান্যদের ছবি মাটিতে লেপ্টে দিয়ে পা দিয়ে মাড়ানো এবং ঘৃণাস্তম্ভ করে জুতা নিক্ষেপ। এর চেয়ে কার্যকর প্রতিবাদ ছাত্র-জনতার কিছু অংশ আর কিভাবে দেখিয়েছে! তাহলে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া গেছে, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রাসঙ্গিক সকল দিবস ভুলিয়ে চুকিয়ে দেয়ার সুযোগও থাকছে না।
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় ষড়যন্ত্রের দাবি, এটি কেবল কূটনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর নয়, এটি প্রমাণের ভারে অত্যন্ত দুর্বল। আন্তর্জাতিক আইনের মানদ-ে এমন অভিযোগ আনতে হলে প্রামাণ্য দলিল, নিরপেক্ষ তদন্ত ও স্বীকৃত ফোরামের প্রয়োজন হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের বাস্তবতায় পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয়ের মুখে ‘স্কর্চড আর্থ’ নীতিতে বুদ্ধিজীবী হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, এমন তথ্য বহু আন্তর্জাতিক গবেষণা ও প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত। স্বাধীনতার স্বপক্ষে থাকা বুদ্ধিজীবীরা ‘ভারতবিরোধী’ ছিলেন-এমন সাধারণীকরণ ইতিহাসের জটিলতাকে সরলীকৃত করে এবং শহীদদের স্মৃতির প্রতি অবিচার করে। আর এই ইতিহাস বিকৃতির বয়ান কি দেশের আপামর জনতা গ্রহণ করতে প্রস্তুত!
তৃতীয়ত, জামায়াতের বিরুদ্ধে ‘সব দোষ চাপানো হয়েছে’ এই বক্তব্যের নৈতিক ও আইনগত মূল্যায়ন জরুরি। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের ভেতরে ব্যক্তিগত দায় ও সাংগঠনিক দায়ের প্রশ্ন আলাদা হতে পারে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারে ব্যক্তিগত অপরাধের দায় প্রমাণিত হলে সেটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলা আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস ছড়ায়। দায় স্বীকার, অনুশোচনা ও পুনর্মিলন, এই তিনটি পথই অতীতের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত বোঝাপড়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত উপায়। দায় অস্বীকার ও পাল্টা অভিযোগ সেই পথকে রুদ্ধ করে। বারবার জামায়াত সেই কাজটিই করে এসেছে। যা দলটিকে জনবিচ্যুত করে রেখেছে। এই জন্যই কি দলটির সাবেক ও বর্তমান নেতারা ‘ঐতিহাসিক ভুল’ করে চলেছেন মর্মেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। যেমন- ব্রিটিশ ভাগের বিরোধিতা, পাকিস্তানকে আহাম্মকের বেহেশত আখ্যা দেয়া, স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতা ও হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতার বিষয়টিও দলটির ভুল বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন। জামায়াত সেই পথেই রোজকার পথিক!
এখানে একটি বড় রাজনৈতিক প্রবণতা লক্ষণীয়। স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীদের ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে পুনর্বর্ণনা করার চেষ্টা। ইতিহাসে এটি নতুন নয়। নানা দেশে সংঘাত-পরবর্তী রাজনীতিতে দেখা গেছে, পরাজিত বা অভিযুক্ত পক্ষ সময়ের ব্যবধানে স্মৃতির রাজনীতিকে বদলাতে চায়। পাঠ্যপুস্তক, স্মরণদিবস, ভাষ্য ও প্রতীক, সবখানেই ধীরে ধীরে নতুন ব্যাখ্যা ঢোকানো হয়। বাংলাদেশে এই প্রচেষ্টা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির ধারাবাহিক প্রতিবাদের মুখে পড়েছে। তথাপিও টানাপোড়েনেই রাজনীতির মেরুকরণ বাড়ছে, আর মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষের শিকার বানানো হচ্ছে-যা উদ্বেগজনক।
জামায়াত এরপর আর কী কী দাবি তুলতে পারে- এই প্রশ্ন অনুমাননির্ভর হলেও প্রবণতা বিশ্লেষণ করা যায়। এক. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় পুনর্বিবেচনার দাবি। দুই. যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞা ও সময়সীমা নিয়ে বিতর্ক তোলা। তিন. ‘জাতীয় পুনর্মিলন’-এর নামে সাধারণ ক্ষমা বা বিচারিক প্রক্রিয়া স্থগিতের প্রস্তাব। চার. পাঠ্যপুস্তক ও স্মরণদিবসের ভাষ্য পরিবর্তনের চাপ। পাঁচ. নির্বাচন ও নিরাপত্তা ইস্যুকে সামনে এনে রাজনৈতিক দরকষাকষি। এগুলো আলোচনায় প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারে। যেমন করে একটি মিথ্যাকে বারবার বলে সত্যে রূপান্তর করার অবাস্তব ও কাল্পনিক প্রচেষ্টার অংশ করে তোলা।
নির্বাচনী নিরাপত্তা প্রসঙ্গে শরিফ ওসমান হাদীর হুমকির অভিযোগ গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল। রাজনৈতিক সহিংসতা গণতন্ত্রের শত্রু। তবে নিরাপত্তা ইস্যুকে ইতিহাস পুনর্লিখনের দাবির সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে জনআলোচনা বিভ্রান্ত হয়। একইভাবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে সমতা ও ন্যায্যতার দাবি যৌক্তিক। কিন্তু তা যেন মুক্তিযুদ্ধের দায়ভার স্থানান্তরের অজুহাত না হয়। সে দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরি। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে অটুট রাখতে তরুণ ছাত্র-যুবাকেই বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে।
সবকিছু ছাপিয়ে প্রশ্ন দাঁড়ায়, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কী প্রমাণ করতে চাইছে? একটি সম্ভাব্য উত্তর হলো: রাজনৈতিক বৈধতা পুনর্গঠন। অভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তি দাবি করে আওয়ামী লীগের বিরোধিতার নামে যে ভাষ্য তৈরি হচ্ছে, তাতে অনেক সময় মুক্তিযুদ্ধকেই কটাক্ষ করা হয়। এতে স্বল্পমেয়াদে রাজনৈতিক মুনাফা মিললেও দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রীয় ঐকমত্য ভাঙে। মুক্তিযুদ্ধ কোনো দলীয় সম্পত্তি নয়, এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি। এই ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করলে গণতন্ত্রের ঘরটাই নড়বড়ে হয়।
পরিশেষে, ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে কোনো তদন্ত বা আলোচনা হতে হবে প্রতিষ্ঠিত সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে, বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, শহীদদের মর্যাদা অক্ষুণ্য রেখে। স্বাধীন তদন্ত কমিশন যদি হয়, তা হতে হবে সর্বসম্মত, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডসম্মত, এবং পূর্ববর্তী বিচারিক সত্যকে অস্বীকার না করে। অন্যথায়, এই দাবি ইতিহাসের দায় থেকে সরে যাওয়ার পথ হিসেবেই বিবেচিত হবে। বাংলাদেশকে অপ্রাসঙ্গিক করে, বিজয়কে অবজ্ঞা করে, শহীদের আত্মত্যাগ অস্বীকার করে মীমাংসিত ইস্যু নিয়ে দাবি তোলা পারতপক্ষে বাংলাদেশকেই কি অস্বীকৃতি নয়? শহীদদের স্মৃতি রাজনীতির হাতিয়ার নয়; এটি জাতির নৈতিক কম্পাস। সেই কম্পাসকে ঘুরিয়ে দিলে পথ হারায় রাষ্ট্র, হারায় ভবিষ্যৎ।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]