alt

উপ-সম্পাদকীয়

রক্তাক্ত মাতৃভাষা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা

মোস্তাফা জব্বার

: মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল ২০২১

আট

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকা সফরকালে পল্টন ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ববঙ্গে প্রতিরোধের ঝড় ওঠে। বন্দী অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছাত্র নেতাদের আলোচনা হয় পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে। তখন একমাত্র রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং যুবাদের প্রতিষ্ঠান যুবলীগ সবাই এর তীব্র প্রতিবাদ করে। বঙ্গবন্ধু তখন হাসপাতালে ছিলেন। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বঙ্গবন্ধু ওদের রাত ১টার পরে আসতে বলেন। আরও বলেন, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। পুলিশরা চুপচাপ পড়ে থাকে, কারণ জানে বঙ্গবন্ধু পালিয়ে যাওয়ার মানুষ নয়। বারান্দায় বসে নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেন এবং বলেন, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দেন। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হলো। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছেন। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হননি, তবুও বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু বলেন খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এসো। আরও দু’একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বলেন। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বলেন। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। ২৬ জানুয়ারি মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন উপলক্ষে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় খাজা নাজিমুদ্দিন বক্তৃতা করেন। উক্ত জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো তিনিও ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তার এ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৪৮ সালের চাইতেও ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণায় জেলের অভ্যন্তরে তরুণ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমদ তখন ঢাকা জেলে বন্দী ছিলেন।

মহিউদ্দিন আহমেদ এবংব বঙ্গবন্ধু ঠিক করলেন ‘বঙ্গবন্ধু অসুস্থতার ভান করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবেন এবং ভর্তি করাতে সক্ষম হলেন। ভাষা আন্দোলনকে তীব্র গতিশীল করার উদ্দেশ্যেই এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। এবং পরবর্তীতে আন্দোলনে তার প্রতিফলন লক্ষণীয়। ঢাকা জেলে ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ “বন্দি অবস্থা থেকে শামসুল হক চৌধুরী, আবদুস সামাদ আজাদ ও ড. গোলাম মাওলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল ডেকে অ্যাসেম্বলি ঘেরাও কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দান করেন। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ‘সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রছাত্রীরা মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার পর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে প্রায় ৫ হাজার ছাত্রছাত্রীর এক সুদীর্ঘ মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। সভায় জননেতা মাওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম ও অন্যান্য রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতারা লীগ সরকারের জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র নিন্দা করেন এবং বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সে দিনই ২১ ফেব্রুয়ারি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান দেয়া হয়।’

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সারাদেশে ধর্মঘটের ঘোষণায় মুসলিম লীগ সরকার রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর দমনপীড়ন বাড়িয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী আহূত ধর্মঘট সফল করার জন্য তখন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের যার যার অবস্থান থেকে কর্মসূচি প্রণয়ন ও গ্রহণ করতে হয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চিকিৎসা না করে ঢাকা জেলে প্রেরণ করা হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ ও ‘বন্দি মুক্তি’র দাবিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমদ কারাগারের অভ্যন্তরে আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। চারদিকে বিষয়টি জানাজানি হতে থাকে। বাইরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে থাকে। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাদের ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু এবং মহিউদ্দিন আহমদ ৯ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বরাবরে তাদের আটকাদেশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার না করা হলে ১৬ তারিখ থেকে অনশন ধর্মঘট করার হুমকি দিয়ে একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। জেল কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন যাতে অনশন ধর্মঘট না করে। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, ছাব্বিশ-সাতাশ মাস বিনাবিচারে বন্দি রেখেছেন। কোন অন্যায়ও করি নাই। ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব, হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় না হয় মৃত অবস্থায় যাব। তারা সরকারকে জানিয়ে দিল। বাহিরে সমস্ত জেলায় ছাত্রলীগ কর্মীরা যেখানে আওয়ামী লীগ ছিল সেখানে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিল। এদিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও গঠন করা হয়েছে। এদিকে জেলের ভেতর বঙ্গবন্ধু এবং মহিউদ্দিন আহমদ প্রস্তুত হচ্ছিলেন অনশন ধর্মঘট করার জন্য। তারা আলোচনা করে ঠিক করলেন, যাই হোক না কেন, অনশন ভাঙবেন না। যদি এ পথেই মৃত্যু এসে থাকে তবে তাই হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে সকালবেলা বঙ্গবন্ধুকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হলো এই কথা বলে যে, তার সঙ্গে আলোচনা আছে অনশন ধর্মঘটের ব্যাপার নিয়ে। বঙ্গবন্ধু যখন জেলগেটে পৌঁছালেন দেখেন, একটু পরেই মহিউদ্দিনকেও নিয়ে আসা হয়েছে একই কথা বলে। এরই প্রেক্ষিতে সরকার তাদেরকে ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল শামসুদ্দোহাসহ কয়েকজন ছাত্রনেতার। আলাপ আলোচনা করলেন তারা। ভাসানী সাহেব, হক সাহেব ও অন্যান্য নেতাদের খবর দিতে বললেন বঙ্গবন্ধু। এবং বললেন আগামীকাল থেকে তারা আমরণ অনশন শুরু করবেন ছাত্র নেতারা জানালেন “২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে নারায়ণগঞ্জে পূর্ণ হরতাল হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতো আছেই, আপনাদের মুক্তির দাবিও আমরা করব।” রাত ৪টায় ফরিদপুর পৌঁছালেন। অনশন ধর্মঘট শুরু করলাম। দুদিন পর অবস্থা খারাপ হলে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। দুজনেরই শরীর খারাপ। একজন কয়েদিকে দিয়ে গোপনে কয়েক টুকরা কাগজ আনালাম ভাসানী সাহেবের কাছে চিঠি লিখলেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু ‘অনুরোধ করে গেলেন যেন একুশে ফেব্রুয়ারিতে হরতাল মিছিল শেষে আইনসভা ঘেরাও করে বাংলা ভাষার সমর্থনে সদস্যদের স্বাক্ষর আদায় করা হয়।’ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধুর অনশন শুরু এবং ভঙ্গের তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। বিভ্রান্তির কারণগুলো, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রচারপত্রে এবং সংবাদপত্রে প্রচার করা হয় যে, শেখ মুজিব এবং মহিউদ্দিন আহমদ ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ থেকে অনশনে গেছেন। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রকাশ যে নিরাপত্তা বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হইতে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করিয়াছেন। আরও প্রকাশ গত ৯ ফেব্রুয়ারি তাহারা পূর্ব পাকিস্তানের উজিরে আজম নুরুল আমিন সমীপে এক স্মারকলিপি পেশ করেন। তাতে তাদের নিরাপত্তা আইনানুসারে আটক সম্পূর্ণ অন্যায় এবং নীতিবিরুদ্ধ বলে জানানো হয়। কারণ প্রকাশ্য আদালতের বিচারে তাহাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ্য কোন অভিযোগ নিতে সরকার সক্ষম হননি। তারা পাকিস্তান সংগ্রামের গৌরবময় অধ্যয়ে তাদের অপার ত্যাগ ও কাজের উল্লেখ করেন... সরকার যদি তাদের সব নিরাপত্তা বন্দিসহ ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মুক্ত না করেন তবে তারা প্রতিবাদে ১৬ ফেব্রুয়ারি হইতে আমরন অনশন করবেন উপযুক্ত প্রচারপত্রে ওপর ভিত্তি করে “শেখ মুজিবের অনশন ধর্মঘট” নামে খবর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়।

বঙ্গবন্ধু এবং মহিউদ্দিন আহমেদের অনশন ধর্মঘট ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করার হুমকি দিয়েছিলেন। তারা যাতে অনশন শুরু করতে না পারেন সেজন্য নুরুল আমিন সরকার তাদের ঢাকা জেল থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলে প্রেরণ করেন। ফলে তারা ঐদিন অনশন শুরু করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু এবং মহিউদ্দিন আহমদ ১৮ তারিখ সকাল থেকে ফরিদপুর জেলে অনশন শুরু করেন। তাদের অনশন নিয়ে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে আনোয়ারা বেগম, বেশ জোরালো বক্তব্য রাখেন। বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন স্বাস্থ্যের অবনতি তার প্রতি অত্যাচার নির্যাতন সম্পর্কিত বিষয় জাতির বিবেককে বিশেষ করে বঙ্গীয় পরিষদকে প্রচ-ভাবে নাড়া দেয় তার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে জনগণের উদ্যোগ জাতীয় দাবি হয়ে উঠে। কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দীন আহমদকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৭-০২-৫২ তারিখে স্থানান্তর করা হয়েছে। নিঃশর্তভাবে মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত ১৮-০২-৫২ তারিখ সকাল থেকে তারা অনশন শুরু করেন। ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ১৯-০২-৫২ তারিখে মতামত ব্যক্ত করে বলেন এ অনশন চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য নিরাপদ না।

এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের অনশনের বিষয়টি ২০ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য আনোয়ারা খাতুন মুলতবী প্রস্তাব হিসেবে উত্থাপন করেন। অনশনের বিষয়টি মুখ্যভাবে পরিস্ফুটিত হয় বঙ্গীয় আইন পরিষদে। সবচাইতে নির্লজ্জ বক্তব্য দিয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ববাংলার সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। তিনি আনোয়ারা খাতুনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। আনোয়ারা খাতুনের আনীত প্রস্তাবটি পূর্ববাংলা সরকার গুরুত্ব না দিতে চাইলেও আইন পরিষদে এর উত্থাপন শেখ মুজিবুর রহমানের অনশনকে গুরুত্বপূর্ণ করেছিল, একই সঙ্গে নুরুল আমিনের পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল, সংকীর্ণ, বাঙালি স্বার্থবিরোধী মানসিকতাও স্পষ্ট হয়ে উঠে। ইতোমধ্যে ঢাকায় ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টার দিকে মাইকে ১৪৪ ধারা জারির কথা ঘোষিত হয় এবং ১ মাসের জন্য ঢাকা শহরে সভা শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়। এই খবর প্রচারিত হওয়ার পর পরই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের নেতৃবৃন্দ এক জরুরি সভায় বসেন। পরদিন ছাত্ররা বিশ^বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে শুরু করে সহস্র কণ্ঠে গর্জে উঠে ১৪৪ ধারা মানব না, মানব না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘নাজিম নুরুল নিপাত যাক’ ‘চলো চলো এসেম্বলি চলো’। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার শহীদ আর ১৭ জনের মতো গুরুতর আহত হন।

ঢাকা। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯। সর্বশেষ সম্পাদিত : ২৫ এপ্রিল, ২০২১।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

রক্তাক্ত মাতৃভাষা, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা ভাষা

মোস্তাফা জব্বার

মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল ২০২১

আট

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকা সফরকালে পল্টন ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ববঙ্গে প্রতিরোধের ঝড় ওঠে। বন্দী অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছাত্র নেতাদের আলোচনা হয় পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে। তখন একমাত্র রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং যুবাদের প্রতিষ্ঠান যুবলীগ সবাই এর তীব্র প্রতিবাদ করে। বঙ্গবন্ধু তখন হাসপাতালে ছিলেন। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বঙ্গবন্ধু ওদের রাত ১টার পরে আসতে বলেন। আরও বলেন, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। পুলিশরা চুপচাপ পড়ে থাকে, কারণ জানে বঙ্গবন্ধু পালিয়ে যাওয়ার মানুষ নয়। বারান্দায় বসে নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেন এবং বলেন, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দেন। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হলো। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছেন। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হননি, তবুও বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু বলেন খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এসো। আরও দু’একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বলেন। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বলেন। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। ২৬ জানুয়ারি মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন উপলক্ষে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় খাজা নাজিমুদ্দিন বক্তৃতা করেন। উক্ত জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো তিনিও ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তার এ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৪৮ সালের চাইতেও ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণায় জেলের অভ্যন্তরে তরুণ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমদ তখন ঢাকা জেলে বন্দী ছিলেন।

মহিউদ্দিন আহমেদ এবংব বঙ্গবন্ধু ঠিক করলেন ‘বঙ্গবন্ধু অসুস্থতার ভান করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবেন এবং ভর্তি করাতে সক্ষম হলেন। ভাষা আন্দোলনকে তীব্র গতিশীল করার উদ্দেশ্যেই এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। এবং পরবর্তীতে আন্দোলনে তার প্রতিফলন লক্ষণীয়। ঢাকা জেলে ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ “বন্দি অবস্থা থেকে শামসুল হক চৌধুরী, আবদুস সামাদ আজাদ ও ড. গোলাম মাওলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল ডেকে অ্যাসেম্বলি ঘেরাও কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দান করেন। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ‘সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রছাত্রীরা মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার পর এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে প্রায় ৫ হাজার ছাত্রছাত্রীর এক সুদীর্ঘ মিছিল বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে করতে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। সভায় জননেতা মাওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম ও অন্যান্য রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতারা লীগ সরকারের জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতার তীব্র নিন্দা করেন এবং বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালাবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। সে দিনই ২১ ফেব্রুয়ারি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান দেয়া হয়।’

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সারাদেশে ধর্মঘটের ঘোষণায় মুসলিম লীগ সরকার রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর দমনপীড়ন বাড়িয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী আহূত ধর্মঘট সফল করার জন্য তখন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের যার যার অবস্থান থেকে কর্মসূচি প্রণয়ন ও গ্রহণ করতে হয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চিকিৎসা না করে ঢাকা জেলে প্রেরণ করা হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ ও ‘বন্দি মুক্তি’র দাবিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমদ কারাগারের অভ্যন্তরে আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। চারদিকে বিষয়টি জানাজানি হতে থাকে। বাইরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে থাকে। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাদের ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠানো হয়। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু এবং মহিউদ্দিন আহমদ ৯ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বরাবরে তাদের আটকাদেশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার না করা হলে ১৬ তারিখ থেকে অনশন ধর্মঘট করার হুমকি দিয়ে একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। জেল কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন যাতে অনশন ধর্মঘট না করে। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, ছাব্বিশ-সাতাশ মাস বিনাবিচারে বন্দি রেখেছেন। কোন অন্যায়ও করি নাই। ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব, হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় না হয় মৃত অবস্থায় যাব। তারা সরকারকে জানিয়ে দিল। বাহিরে সমস্ত জেলায় ছাত্রলীগ কর্মীরা যেখানে আওয়ামী লীগ ছিল সেখানে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিল। এদিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও গঠন করা হয়েছে। এদিকে জেলের ভেতর বঙ্গবন্ধু এবং মহিউদ্দিন আহমদ প্রস্তুত হচ্ছিলেন অনশন ধর্মঘট করার জন্য। তারা আলোচনা করে ঠিক করলেন, যাই হোক না কেন, অনশন ভাঙবেন না। যদি এ পথেই মৃত্যু এসে থাকে তবে তাই হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে সকালবেলা বঙ্গবন্ধুকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হলো এই কথা বলে যে, তার সঙ্গে আলোচনা আছে অনশন ধর্মঘটের ব্যাপার নিয়ে। বঙ্গবন্ধু যখন জেলগেটে পৌঁছালেন দেখেন, একটু পরেই মহিউদ্দিনকেও নিয়ে আসা হয়েছে একই কথা বলে। এরই প্রেক্ষিতে সরকার তাদেরকে ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল শামসুদ্দোহাসহ কয়েকজন ছাত্রনেতার। আলাপ আলোচনা করলেন তারা। ভাসানী সাহেব, হক সাহেব ও অন্যান্য নেতাদের খবর দিতে বললেন বঙ্গবন্ধু। এবং বললেন আগামীকাল থেকে তারা আমরণ অনশন শুরু করবেন ছাত্র নেতারা জানালেন “২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে নারায়ণগঞ্জে পূর্ণ হরতাল হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতো আছেই, আপনাদের মুক্তির দাবিও আমরা করব।” রাত ৪টায় ফরিদপুর পৌঁছালেন। অনশন ধর্মঘট শুরু করলাম। দুদিন পর অবস্থা খারাপ হলে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। দুজনেরই শরীর খারাপ। একজন কয়েদিকে দিয়ে গোপনে কয়েক টুকরা কাগজ আনালাম ভাসানী সাহেবের কাছে চিঠি লিখলেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু ‘অনুরোধ করে গেলেন যেন একুশে ফেব্রুয়ারিতে হরতাল মিছিল শেষে আইনসভা ঘেরাও করে বাংলা ভাষার সমর্থনে সদস্যদের স্বাক্ষর আদায় করা হয়।’ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধুর অনশন শুরু এবং ভঙ্গের তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। বিভ্রান্তির কারণগুলো, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রচারপত্রে এবং সংবাদপত্রে প্রচার করা হয় যে, শেখ মুজিব এবং মহিউদ্দিন আহমদ ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ থেকে অনশনে গেছেন। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রকাশ যে নিরাপত্তা বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হইতে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করিয়াছেন। আরও প্রকাশ গত ৯ ফেব্রুয়ারি তাহারা পূর্ব পাকিস্তানের উজিরে আজম নুরুল আমিন সমীপে এক স্মারকলিপি পেশ করেন। তাতে তাদের নিরাপত্তা আইনানুসারে আটক সম্পূর্ণ অন্যায় এবং নীতিবিরুদ্ধ বলে জানানো হয়। কারণ প্রকাশ্য আদালতের বিচারে তাহাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ্য কোন অভিযোগ নিতে সরকার সক্ষম হননি। তারা পাকিস্তান সংগ্রামের গৌরবময় অধ্যয়ে তাদের অপার ত্যাগ ও কাজের উল্লেখ করেন... সরকার যদি তাদের সব নিরাপত্তা বন্দিসহ ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মুক্ত না করেন তবে তারা প্রতিবাদে ১৬ ফেব্রুয়ারি হইতে আমরন অনশন করবেন উপযুক্ত প্রচারপত্রে ওপর ভিত্তি করে “শেখ মুজিবের অনশন ধর্মঘট” নামে খবর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়।

বঙ্গবন্ধু এবং মহিউদ্দিন আহমেদের অনশন ধর্মঘট ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করার হুমকি দিয়েছিলেন। তারা যাতে অনশন শুরু করতে না পারেন সেজন্য নুরুল আমিন সরকার তাদের ঢাকা জেল থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলে প্রেরণ করেন। ফলে তারা ঐদিন অনশন শুরু করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু এবং মহিউদ্দিন আহমদ ১৮ তারিখ সকাল থেকে ফরিদপুর জেলে অনশন শুরু করেন। তাদের অনশন নিয়ে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে আনোয়ারা বেগম, বেশ জোরালো বক্তব্য রাখেন। বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন স্বাস্থ্যের অবনতি তার প্রতি অত্যাচার নির্যাতন সম্পর্কিত বিষয় জাতির বিবেককে বিশেষ করে বঙ্গীয় পরিষদকে প্রচ-ভাবে নাড়া দেয় তার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে জনগণের উদ্যোগ জাতীয় দাবি হয়ে উঠে। কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দীন আহমদকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৭-০২-৫২ তারিখে স্থানান্তর করা হয়েছে। নিঃশর্তভাবে মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত ১৮-০২-৫২ তারিখ সকাল থেকে তারা অনশন শুরু করেন। ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ১৯-০২-৫২ তারিখে মতামত ব্যক্ত করে বলেন এ অনশন চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য নিরাপদ না।

এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের অনশনের বিষয়টি ২০ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য আনোয়ারা খাতুন মুলতবী প্রস্তাব হিসেবে উত্থাপন করেন। অনশনের বিষয়টি মুখ্যভাবে পরিস্ফুটিত হয় বঙ্গীয় আইন পরিষদে। সবচাইতে নির্লজ্জ বক্তব্য দিয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ববাংলার সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। তিনি আনোয়ারা খাতুনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। আনোয়ারা খাতুনের আনীত প্রস্তাবটি পূর্ববাংলা সরকার গুরুত্ব না দিতে চাইলেও আইন পরিষদে এর উত্থাপন শেখ মুজিবুর রহমানের অনশনকে গুরুত্বপূর্ণ করেছিল, একই সঙ্গে নুরুল আমিনের পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল, সংকীর্ণ, বাঙালি স্বার্থবিরোধী মানসিকতাও স্পষ্ট হয়ে উঠে। ইতোমধ্যে ঢাকায় ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টার দিকে মাইকে ১৪৪ ধারা জারির কথা ঘোষিত হয় এবং ১ মাসের জন্য ঢাকা শহরে সভা শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়। এই খবর প্রচারিত হওয়ার পর পরই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের নেতৃবৃন্দ এক জরুরি সভায় বসেন। পরদিন ছাত্ররা বিশ^বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে শুরু করে সহস্র কণ্ঠে গর্জে উঠে ১৪৪ ধারা মানব না, মানব না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘নাজিম নুরুল নিপাত যাক’ ‘চলো চলো এসেম্বলি চলো’। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই রফিকউদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার শহীদ আর ১৭ জনের মতো গুরুতর আহত হন।

ঢাকা। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯। সর্বশেষ সম্পাদিত : ২৫ এপ্রিল, ২০২১।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক]

mustafajabbar@gmail.com

back to top