alt

উপ-সম্পাদকীয়

প্রান্তিক শিশুর মনোসামাজিক অবস্থা

হাছিনা ভূঁইয়া ও স্বপন সিং

: বৃহস্পতিবার, ১০ জুন ২০২১

করোনাভাইরাস, এক বৈশ্বিক মহামারী। পুরো পৃথিবী প্রায় স্থবির করে দেয়া এক আতঙ্কের নাম। পুরো মানবজাতি লড়ছে এক অদৃশ্য (শত্রু) ভাইরাসের বিরুদ্ধে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদে। বিগত ৮ মার্চ ২০২০ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে শুরু হয় এই অদৃশ্য জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই। সব ক্ষেত্রে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে আরোপিত হয় বহুবিধ নিয়ন্ত্রণ। এ নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের অংশ হিসেবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সার্বিক মঙ্গল চিন্তা করে সরকার বিগত ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ রেখেছে। শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করছে।

বিগত বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহ বন্ধ হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন ভার্চুয়াল মাধ্যম ব্যবহার করে অব্যাহত রাখা হয়েছে করোনাকালীন শিক্ষা কার্যক্রম। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মুঠোফোনে পাঠদান, সংসদ টিভি ও বাংলাদেশ বেতারে সম্প্রচারিত পাঠদান, অনলাইনে পরিচালিত পাঠদান কার্যক্রম এবং তা স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়া। এভাবে যতটুকু সম্ভব, অব্যাহত রাখা হয়েছে এই সংকটকালীন সময়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা।

তবে, এই বৈশ্বিক মহামারীর প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় আমাদের শিক্ষার্থীদের মনোজাগতিক চিন্তাভাবনায় কতটুকু প্রভাব বিস্তার করেছে তা এ মুহূর্তে ভাবার বিষয়! যে বিদ্যালয়ের আঙিনা মুখরিত হতো শিক্ষার্থীদের পদচারণায়, সে বিদ্যালয়ের আঙিনা এখন প্রাণহীন, বিবর্ণ। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থী-শিক্ষার্থী পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া, ভাব বিনিময় পুরোপুরি বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৯ অনুযায়ী বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধির প্রসারতা বয়ষ্কদের মধ্যে ১৬.৮ এবং শিশুদের মধ্যে ১৩.৬। তাদের মধ্যে ৯২.৩ শতাংশ বয়ষ্ক এবং ৯৪.৫ শতাংশ শিশু যথাযথ চিকিসা নিচ্ছে না। যথেষ্ট চিকিৎসা বঞ্চিত হওয়ার কারণে বছরে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে।

এ প্রেক্ষিতে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সবার ভাবনার বিষয়। কিভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে একুশ শতকের উপযোগী করে গড়ে তোলা যায়? একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে আরও সুদৃঢ় ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার জন্য মনস্তাত্মিক শিক্ষার উপর ও সবাই গুরুত্বারোপ করছেন।

বাংলাদেশে প্রত্যের ১ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ০.৪৯ শতাংশ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। পাশাপাশি ০.৫ শতাংশ সরকারি স্বাস্থ্য বাজেটের ব্যবহৃত হয় মানসিক স্বাস্থ্য খাতে, যা প্রায় ৬৭ শতাংশ খরচ করা হয় মানসিক হাসপাতালে। অল্পকিছু দীর্ঘ চিকিৎসাধীন রোগীদের জন্য।

এ রকম পরিস্থিতিতে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী ছিলেন সবসময় শিক্ষার্থীদের পাশে। করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন সারা দেশের ন্যায় ফুলবাড়ীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহও বন্ধ হয়ে যায়, তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ সবসময় মুঠোফোনে শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর রেখেছেন। বিভিন্ন কায়দায় পাঠদান অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি লকডাউনে গৃহবন্দি প্রত্যন্ত এলাকার হতদরিদ্র শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের মাঝে বিতরণ করেছেন খাদ্যসামগ্রী ও স্বাস্থ্যসুরক্ষাসামগ্রী। আর এ কাজটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করতে কোন sympathy নয়, empathy থেকে এগিয়ে এসেছিলেন শিক্ষকরা।

শিক্ষকদের মনোজগতে এ ভাবনার বিস্তারে যৌথভাবে ভূমিকা পালন করেছে, ফুলবাড়ী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ফুলবাড়ী এপির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত শিক্ষকদের জন্য সাইকোসোশ্যাল প্রশিক্ষণ। এ প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা শিক্ষকগণ তাদের কর্মক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগের সুযোগ পান, যার সুফল ভোগ করেন ফুলবাড়ী উপজেলার প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী অভিভাবকরা।

আলাদীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক মনোয়ারা সুলতানা বলেন, ‘আমি বিভিন্ন সময়ে শ্রেণীকক্ষে বেথ নিয়ে যেতাম, কিন্তু এখন বুজি আসলে এটি ঠিক নয়। এখন আমি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান সম্পূর্ণ করি। এর ফল পাওয়া গেছে তারা খুব মজা করে পাঠ গ্রহণ করে। ’

উপজেলা শিক্ষা অফিস, ফুলবাড়ী এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ফুলবাড়ী এপি’র সমন্বিতভাবে কাজ করার যাত্রা শুরু আরও আগে থেকে অর্থাৎ ২০১৮ সাল থেকে। “শিখবে শিশু হেসে খেলে, শাস্তি মুক্ত পরিবেশ পেলে” শীর্ষক প্রতিপাদ্য বিষয়টি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উপজেলার সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করার মধ্যদিয়ে। যার ধারাবাহিকতায় ওয়ার্ল্ড ভিশন এবং উপজেলা শিক্ষা অফিস বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ আয়োজন এবং শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করেন।

আর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে ফুলবাড়ী উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে। “আমিই পারি” এ মন্ত্রে উজ্জীবিত ফুলবাড়ী উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বেড়েছে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার, কমেছে ঝরে পড়ার সংখ্যা। পিপিআরসি ও বিআইডিজির তথ্যমতে, ‘সারাদেশে যেখানে শুধুমাত্র ১০ শতাংশ শিশু দুরবর্তী শিক্ষণ সুবিধা গ্রহণ করতে পেরেছে। সেখানে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার প্রায় ৬৫ শতাংশ শিশু শিক্ষকদের অভিনব প্রচেষ্টায় এই সুবিধা ভোগ করেছে। আবার, যেখানে করোনাকালীন সময়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হয়েছে, সেখানে ফুলবাড়ীতে ০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার। তা শুধু সম্ভব হয়েছে শিক্ষক এবং অভিভাবকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।’

সম্পূর্ণ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনমুক্ত পরিবেশে শিক্ষার্থীদের আনন্দদায়ক পাঠদান নিশ্চিত করা হচ্ছে। আর এ কাজটি সম্ভব হয়েছে সমমনা মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে। এই প্রচেষ্টাকে টেকসই করার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আগামীতে শিশুদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন-

সরকারি-বেসরকারি পারস্পরিক সহযোগিতায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ।

প্রাথমিক শিক্ষা খাতে মনোসামাজিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ।

মনোসামাজিক যত্নে যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ।

[লেখক : হাছিনা ভূঁইয়া- উপজেলা শিক্ষা অফিসার, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর; স্বপন সিং- এরিয়া প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ]

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

প্রান্তিক শিশুর মনোসামাজিক অবস্থা

হাছিনা ভূঁইয়া ও স্বপন সিং

বৃহস্পতিবার, ১০ জুন ২০২১

করোনাভাইরাস, এক বৈশ্বিক মহামারী। পুরো পৃথিবী প্রায় স্থবির করে দেয়া এক আতঙ্কের নাম। পুরো মানবজাতি লড়ছে এক অদৃশ্য (শত্রু) ভাইরাসের বিরুদ্ধে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদে। বিগত ৮ মার্চ ২০২০ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে শুরু হয় এই অদৃশ্য জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই। সব ক্ষেত্রে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে আরোপিত হয় বহুবিধ নিয়ন্ত্রণ। এ নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের অংশ হিসেবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সার্বিক মঙ্গল চিন্তা করে সরকার বিগত ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ রেখেছে। শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করছে।

বিগত বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহ বন্ধ হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন ভার্চুয়াল মাধ্যম ব্যবহার করে অব্যাহত রাখা হয়েছে করোনাকালীন শিক্ষা কার্যক্রম। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মুঠোফোনে পাঠদান, সংসদ টিভি ও বাংলাদেশ বেতারে সম্প্রচারিত পাঠদান, অনলাইনে পরিচালিত পাঠদান কার্যক্রম এবং তা স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়া। এভাবে যতটুকু সম্ভব, অব্যাহত রাখা হয়েছে এই সংকটকালীন সময়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা।

তবে, এই বৈশ্বিক মহামারীর প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় আমাদের শিক্ষার্থীদের মনোজাগতিক চিন্তাভাবনায় কতটুকু প্রভাব বিস্তার করেছে তা এ মুহূর্তে ভাবার বিষয়! যে বিদ্যালয়ের আঙিনা মুখরিত হতো শিক্ষার্থীদের পদচারণায়, সে বিদ্যালয়ের আঙিনা এখন প্রাণহীন, বিবর্ণ। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থী-শিক্ষার্থী পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া, ভাব বিনিময় পুরোপুরি বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৯ অনুযায়ী বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধির প্রসারতা বয়ষ্কদের মধ্যে ১৬.৮ এবং শিশুদের মধ্যে ১৩.৬। তাদের মধ্যে ৯২.৩ শতাংশ বয়ষ্ক এবং ৯৪.৫ শতাংশ শিশু যথাযথ চিকিসা নিচ্ছে না। যথেষ্ট চিকিৎসা বঞ্চিত হওয়ার কারণে বছরে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে।

এ প্রেক্ষিতে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সবার ভাবনার বিষয়। কিভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে একুশ শতকের উপযোগী করে গড়ে তোলা যায়? একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে আরও সুদৃঢ় ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার জন্য মনস্তাত্মিক শিক্ষার উপর ও সবাই গুরুত্বারোপ করছেন।

বাংলাদেশে প্রত্যের ১ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ০.৪৯ শতাংশ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। পাশাপাশি ০.৫ শতাংশ সরকারি স্বাস্থ্য বাজেটের ব্যবহৃত হয় মানসিক স্বাস্থ্য খাতে, যা প্রায় ৬৭ শতাংশ খরচ করা হয় মানসিক হাসপাতালে। অল্পকিছু দীর্ঘ চিকিৎসাধীন রোগীদের জন্য।

এ রকম পরিস্থিতিতে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী ছিলেন সবসময় শিক্ষার্থীদের পাশে। করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন সারা দেশের ন্যায় ফুলবাড়ীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহও বন্ধ হয়ে যায়, তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ সবসময় মুঠোফোনে শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর রেখেছেন। বিভিন্ন কায়দায় পাঠদান অব্যাহত রেখেছেন। এমনকি লকডাউনে গৃহবন্দি প্রত্যন্ত এলাকার হতদরিদ্র শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের মাঝে বিতরণ করেছেন খাদ্যসামগ্রী ও স্বাস্থ্যসুরক্ষাসামগ্রী। আর এ কাজটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে করতে কোন sympathy নয়, empathy থেকে এগিয়ে এসেছিলেন শিক্ষকরা।

শিক্ষকদের মনোজগতে এ ভাবনার বিস্তারে যৌথভাবে ভূমিকা পালন করেছে, ফুলবাড়ী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ফুলবাড়ী এপির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত শিক্ষকদের জন্য সাইকোসোশ্যাল প্রশিক্ষণ। এ প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান, অভিজ্ঞতা শিক্ষকগণ তাদের কর্মক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগের সুযোগ পান, যার সুফল ভোগ করেন ফুলবাড়ী উপজেলার প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী অভিভাবকরা।

আলাদীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক মনোয়ারা সুলতানা বলেন, ‘আমি বিভিন্ন সময়ে শ্রেণীকক্ষে বেথ নিয়ে যেতাম, কিন্তু এখন বুজি আসলে এটি ঠিক নয়। এখন আমি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান সম্পূর্ণ করি। এর ফল পাওয়া গেছে তারা খুব মজা করে পাঠ গ্রহণ করে। ’

উপজেলা শিক্ষা অফিস, ফুলবাড়ী এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ফুলবাড়ী এপি’র সমন্বিতভাবে কাজ করার যাত্রা শুরু আরও আগে থেকে অর্থাৎ ২০১৮ সাল থেকে। “শিখবে শিশু হেসে খেলে, শাস্তি মুক্ত পরিবেশ পেলে” শীর্ষক প্রতিপাদ্য বিষয়টি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উপজেলার সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করার মধ্যদিয়ে। যার ধারাবাহিকতায় ওয়ার্ল্ড ভিশন এবং উপজেলা শিক্ষা অফিস বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ আয়োজন এবং শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করেন।

আর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে ফুলবাড়ী উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে। “আমিই পারি” এ মন্ত্রে উজ্জীবিত ফুলবাড়ী উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বেড়েছে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার, কমেছে ঝরে পড়ার সংখ্যা। পিপিআরসি ও বিআইডিজির তথ্যমতে, ‘সারাদেশে যেখানে শুধুমাত্র ১০ শতাংশ শিশু দুরবর্তী শিক্ষণ সুবিধা গ্রহণ করতে পেরেছে। সেখানে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার প্রায় ৬৫ শতাংশ শিশু শিক্ষকদের অভিনব প্রচেষ্টায় এই সুবিধা ভোগ করেছে। আবার, যেখানে করোনাকালীন সময়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হয়েছে, সেখানে ফুলবাড়ীতে ০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার। তা শুধু সম্ভব হয়েছে শিক্ষক এবং অভিভাবকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।’

সম্পূর্ণ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনমুক্ত পরিবেশে শিক্ষার্থীদের আনন্দদায়ক পাঠদান নিশ্চিত করা হচ্ছে। আর এ কাজটি সম্ভব হয়েছে সমমনা মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে। এই প্রচেষ্টাকে টেকসই করার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আগামীতে শিশুদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন-

সরকারি-বেসরকারি পারস্পরিক সহযোগিতায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ।

প্রাথমিক শিক্ষা খাতে মনোসামাজিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ।

মনোসামাজিক যত্নে যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ।

[লেখক : হাছিনা ভূঁইয়া- উপজেলা শিক্ষা অফিসার, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর; স্বপন সিং- এরিয়া প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ]

back to top