alt

উপ-সম্পাদকীয়

অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচা

মিহির কুমার রায়

: শনিবার, ১৭ জুলাই ২০২১

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী এ বছর ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১৯ হাজার বেশি। এ বছর এ কার্যক্রমের আওতায় মাঠপর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার গরু-মহিষ, ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং অন্যান্য ৪ হাজার ৭৬৫টি পশুসহ মোট ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে।

ঈদ উপলক্ষে দেশের খামারিরা প্রস্তুত যদিও তাদের খামারে লাখ লাখ গরু-ছাগল বিক্রির অপেক্ষায় কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে হাটবাজারে গিয়ে গরু বিক্রি বিপজ্জনক বিধায় অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। করোনা মহামারীতে এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে ‘ডিজিটাল পশুরহাট’। এছাড়া ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম (মার্কেট প্লেস), ই-কমার্স সাইট, ওয়েবসাইট, ফেসবুকভিত্তিক সাইটগুলোতেও ইতোমধ্যে কোরবানির পশুর বুকিং ও বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। দেশের ক্রেতাদের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও ক্রেতারা কোরবানির পশুর বুকিং দিতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। গত কয়েক দিনে অনলাইনে প্রায় ২০৬ কোটি টাকায় ২৬ হাজার ৩০৮টি গবাদিপশু বিক্রি হয়েছে, যা ৭৪১টি অনলাইন বাজারের তথ্যের ভিত্তিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এ তথ্য জানায়। প্রতিষ্ঠানগুলো ঈদের এক বা দু’দিন আগে ক্রেতাদের বাসায় বাসায় গিয়ে কোরবানির পশু পৌঁছে দেবে। শুধু কোরবানির পশু বিক্রিই নয়, বুকিং করে দিলে জবাই দিয়ে বাসায় মাংস পৌঁছে দেয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, অনলাইনে গরু কেনাবেচায় গ্রাহক যখন গরু পাবেন, তখনই টাকা ছাড় করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা গেছে, গত বছরের মতো এ বছরও গবাদিপশুর পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। এ বছর এ কার্যক্রমের আওতায় মাঠপর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার গরু-মহিষ, ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং অন্য চার হাজার ৭৬৫টি পশুসহ মোট এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে এর মধ্যে এখন পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ১৯ হাজার গবাদিপশু অনলাইনে বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর অনলাইনে পশু বিক্রির সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর সারাদেশে অনলাইন-অফলাইনে প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকার গবাদিপশু কোরবানি উপলক্ষে বিক্রি হয়। সম্প্রতি জুম প্ল্যাটফর্মে ‘ডিএনসিসি ডিজিটাল গরু হাট ২০২১’-এর উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া রয়েছে পশু বিক্রি সংক্রান্ত বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যারা সারাদেশে সার্ভিস দিচ্ছেন। অনলাইনে কেনা কোরবানির পশুতে কোন ত্রুটি পেলে ফোনে বা ই-মেইলে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন (ইক্যাব) কাছে অভিযোগ করা যাবে। অভিযোগ গ্রহণের তিন কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগের সুরাহা করবে ই-ক্যাব। অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রেখে ২০২১ সালের ঈদুল আজহায় অনলাইনে পশু বিক্রির ব্যবস্থা রেখে অনলাইনে পশু বিক্রয়ের নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে।

এখন আসা যাক গ্রামীণ অর্থনীতির আলোচনায় যেখানে এই করোনাকালে আড়াই কোটি মানুষ নতুনভাবে দারিদ্র্য হয়েছে এবং ১০ লাখ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারী চাকরিচ্যুত হয়েছে। ব্র্যাকের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, করোনার অভিঘাতে ৭৭ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় কমে গেছে এবং ৩৪ শতাংশ পরিবারের কেউ না কেউ চাকরি অথবা আয়ের সক্ষমতা হারিয়েছেন। এই সময়ে দৈনন্দিন খরচ মেটাতে পরিবারগুলো সঞ্চয় ও ধার-দেনার ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে পরিবারগুলোর গড় মাসিক সঞ্চয় ৬২ ভাগ কমে গেছে, ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়াও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোরবানির পশুরহাটে যাওয়া, পশু কেনা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সে কারণে এবার পশুর চাহিদা স্বাভাবিক অবস্থার চাইতে অনেক কম হতে পারে। গ্রামের হাটবাজারে স্বাস্থ্যবিধি পালন করে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় করা না গেলে দেশের অবনতিশীল করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এদিকে, দেশীয় খামারিদের কথা চিন্তা করে ভারতীয় গরু আমদানি রোধে আগে থেকেই ভারত সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে। ভারত থেকে চোরাই পথে গরু আমদানি হলে দেশে করোনার ভয়াবহতা যেমন বাড়তে পারে, তেমনি লোকসানের মুখে পড়তে পারে দেশের গ্রামীণ প্রান্তিক খামারিরা, যা করোনাকালে গ্রামীণ অর্থনীতিকে কঠিন চাপে ফেলবে। প্রতি বছর প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ গরু আমদানি করা হতো ভারত, মায়ানমার, নেপাল ও ভুটান থেকে। এর অর্ধেক আমদানি করা হতো কোরবানির ঈদের সময়। অধিকাংশই আসত ভারত থেকে। এখন গরু আমদানি নেই বললেই চলে। গত দু’বছর ধরে গরু আমদানি হয়েছে বছরে এক লাখেরও কম, যা দেশের খামারিদের জন্য একটি সুখবর বলা যায় এবং যে কোন মূল্যে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় খামারিদের সহায়তা দিতে হবে। তথ্য বলছে দেশীয় গরুতেই এবারের কোরবানি, সব ধরনের পশু আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে, ঈদে সোয়া কোটি পশুর চাহিদা রয়েছে এবং চাহিদার তুলনায় প্রাণিসম্পদের পরিমাণ বেশি রয়েছে যা নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই। তাই দেশের খামারিদের উৎপাদিত গবাদি পশু দিয়েই এবারের কোরবানির প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, যা একটি আনন্দের বারতা। উৎপাদন বৃদ্ধি,, দেশীয় খামার বিকশিত করা, মালিকদের প্রণোদনা প্রদান ও সরকারি নীতি সহায়তা অব্যাহত থাকায় বর্তমানে পশু সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ।

এদিকে প্রতি বছরের মতো সরকার এবারও ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা হলো লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা। এছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা ও বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু গত দু-তিন বছর কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য নিয়ে যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা কাম্য নয় কারণ চামড়া দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত, যা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চামড়ার ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সঠিক তদারকির অভাবে এবং অব্যবস্থাপনার কারণে কোরবানি কেন্দ্রিক চামড়া শিল্প সংকটে রয়েছে। দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ পশুর চামড়া সংগৃহীত হয়, তার অধিকাংশই হয় কোরবানির সময়ে। কোরবানির চামড়ার দাম দেশে কম হলেও দেশে-বিদেশে চামড়াজাত পণ্যের দাম বেশ চড়া। তাই বাজার সমন্বয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে। কাঁচা চামড়া পরিবহনে যাতে কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয়, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সজাগ থাকতে হবে। চামড়া কারবারিদের একটি কথা মনে রাখা দরকার, কোরবানির চামড়ার বিক্রির টাকা দিয়ে সারা বছর দেশের অগণিত এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে অবস্থানরত এতিম ও গরিবদের খাবার পরিবেশন করা হয়ে থাকে।

সম্প্রতি ঈদুল আজহা উপলক্ষে আন্তঃমন্ত্রণালয় প্রস্তুতিমূলক একটি বৈঠকে বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশন-পৌরসভাগুলোর ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনের স্থানীয় প্রতিনিধি, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে অনলাইনে গবাদি পশু বেচাকেনার উদ্যোগ গ্রহণে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত হয়। বিভাগীয় কমিশনাররা অনলাইনে গবাদিপশু বিক্রির লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে নির্দেশনা দেয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া সিদ্ধান্ত হয়, সংশ্লিষ্ট ভেটেরিনারি সার্জনরা অনলাইনে আপলোড করার আগে গবাদিপশুর স্বাস্থ্যসনদ প্রদান করবে, যা অনলাইনে আপলোড করতে হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর অনলাইনে গবাদিপশু বিক্রির জন্য খামারিদের সংশ্লিষ্ট অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযোগের সহযোগিতা প্রদান করবে এবং আপলোডকৃত গবাদিপশুর ক্ষেত্রে মালিকের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, গবাদিপশুর বয়স, ওজন, মূল্য ও গবাদিপশুর ছবি প্রদান করতে হবে। আশা করা যায় করোনাকালীন ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারের এই মহতি উদ্যোগ দেশের অগণিত খামারির জীবনের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে এবং ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত কোরবানির আদর্শ সফল কাম হবে।

[লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, সিটি ইউনিভার্সিটি]

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

অনলাইনে কোরবানির পশু কেনাবেচা

মিহির কুমার রায়

শনিবার, ১৭ জুলাই ২০২১

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী এ বছর ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১৯ হাজার বেশি। এ বছর এ কার্যক্রমের আওতায় মাঠপর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার গরু-মহিষ, ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং অন্যান্য ৪ হাজার ৭৬৫টি পশুসহ মোট ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে।

ঈদ উপলক্ষে দেশের খামারিরা প্রস্তুত যদিও তাদের খামারে লাখ লাখ গরু-ছাগল বিক্রির অপেক্ষায় কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে হাটবাজারে গিয়ে গরু বিক্রি বিপজ্জনক বিধায় অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। করোনা মহামারীতে এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে ‘ডিজিটাল পশুরহাট’। এছাড়া ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম (মার্কেট প্লেস), ই-কমার্স সাইট, ওয়েবসাইট, ফেসবুকভিত্তিক সাইটগুলোতেও ইতোমধ্যে কোরবানির পশুর বুকিং ও বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। দেশের ক্রেতাদের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও ক্রেতারা কোরবানির পশুর বুকিং দিতে শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। গত কয়েক দিনে অনলাইনে প্রায় ২০৬ কোটি টাকায় ২৬ হাজার ৩০৮টি গবাদিপশু বিক্রি হয়েছে, যা ৭৪১টি অনলাইন বাজারের তথ্যের ভিত্তিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এ তথ্য জানায়। প্রতিষ্ঠানগুলো ঈদের এক বা দু’দিন আগে ক্রেতাদের বাসায় বাসায় গিয়ে কোরবানির পশু পৌঁছে দেবে। শুধু কোরবানির পশু বিক্রিই নয়, বুকিং করে দিলে জবাই দিয়ে বাসায় মাংস পৌঁছে দেয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, অনলাইনে গরু কেনাবেচায় গ্রাহক যখন গরু পাবেন, তখনই টাকা ছাড় করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা গেছে, গত বছরের মতো এ বছরও গবাদিপশুর পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। এ বছর এ কার্যক্রমের আওতায় মাঠপর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার গরু-মহিষ, ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং অন্য চার হাজার ৭৬৫টি পশুসহ মোট এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে এর মধ্যে এখন পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ১৯ হাজার গবাদিপশু অনলাইনে বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর অনলাইনে পশু বিক্রির সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর সারাদেশে অনলাইন-অফলাইনে প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকার গবাদিপশু কোরবানি উপলক্ষে বিক্রি হয়। সম্প্রতি জুম প্ল্যাটফর্মে ‘ডিএনসিসি ডিজিটাল গরু হাট ২০২১’-এর উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া রয়েছে পশু বিক্রি সংক্রান্ত বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যারা সারাদেশে সার্ভিস দিচ্ছেন। অনলাইনে কেনা কোরবানির পশুতে কোন ত্রুটি পেলে ফোনে বা ই-মেইলে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন (ইক্যাব) কাছে অভিযোগ করা যাবে। অভিযোগ গ্রহণের তিন কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগের সুরাহা করবে ই-ক্যাব। অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রেখে ২০২১ সালের ঈদুল আজহায় অনলাইনে পশু বিক্রির ব্যবস্থা রেখে অনলাইনে পশু বিক্রয়ের নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে।

এখন আসা যাক গ্রামীণ অর্থনীতির আলোচনায় যেখানে এই করোনাকালে আড়াই কোটি মানুষ নতুনভাবে দারিদ্র্য হয়েছে এবং ১০ লাখ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারী চাকরিচ্যুত হয়েছে। ব্র্যাকের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, করোনার অভিঘাতে ৭৭ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় কমে গেছে এবং ৩৪ শতাংশ পরিবারের কেউ না কেউ চাকরি অথবা আয়ের সক্ষমতা হারিয়েছেন। এই সময়ে দৈনন্দিন খরচ মেটাতে পরিবারগুলো সঞ্চয় ও ধার-দেনার ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে পরিবারগুলোর গড় মাসিক সঞ্চয় ৬২ ভাগ কমে গেছে, ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩১ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়াও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোরবানির পশুরহাটে যাওয়া, পশু কেনা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সে কারণে এবার পশুর চাহিদা স্বাভাবিক অবস্থার চাইতে অনেক কম হতে পারে। গ্রামের হাটবাজারে স্বাস্থ্যবিধি পালন করে কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয় করা না গেলে দেশের অবনতিশীল করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এদিকে, দেশীয় খামারিদের কথা চিন্তা করে ভারতীয় গরু আমদানি রোধে আগে থেকেই ভারত সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে। ভারত থেকে চোরাই পথে গরু আমদানি হলে দেশে করোনার ভয়াবহতা যেমন বাড়তে পারে, তেমনি লোকসানের মুখে পড়তে পারে দেশের গ্রামীণ প্রান্তিক খামারিরা, যা করোনাকালে গ্রামীণ অর্থনীতিকে কঠিন চাপে ফেলবে। প্রতি বছর প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ গরু আমদানি করা হতো ভারত, মায়ানমার, নেপাল ও ভুটান থেকে। এর অর্ধেক আমদানি করা হতো কোরবানির ঈদের সময়। অধিকাংশই আসত ভারত থেকে। এখন গরু আমদানি নেই বললেই চলে। গত দু’বছর ধরে গরু আমদানি হয়েছে বছরে এক লাখেরও কম, যা দেশের খামারিদের জন্য একটি সুখবর বলা যায় এবং যে কোন মূল্যে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় খামারিদের সহায়তা দিতে হবে। তথ্য বলছে দেশীয় গরুতেই এবারের কোরবানি, সব ধরনের পশু আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে, ঈদে সোয়া কোটি পশুর চাহিদা রয়েছে এবং চাহিদার তুলনায় প্রাণিসম্পদের পরিমাণ বেশি রয়েছে যা নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই। তাই দেশের খামারিদের উৎপাদিত গবাদি পশু দিয়েই এবারের কোরবানির প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, যা একটি আনন্দের বারতা। উৎপাদন বৃদ্ধি,, দেশীয় খামার বিকশিত করা, মালিকদের প্রণোদনা প্রদান ও সরকারি নীতি সহায়তা অব্যাহত থাকায় বর্তমানে পশু সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ।

এদিকে প্রতি বছরের মতো সরকার এবারও ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা হলো লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা। এছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা ও বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু গত দু-তিন বছর কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য নিয়ে যে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা কাম্য নয় কারণ চামড়া দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত, যা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চামড়ার ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সঠিক তদারকির অভাবে এবং অব্যবস্থাপনার কারণে কোরবানি কেন্দ্রিক চামড়া শিল্প সংকটে রয়েছে। দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ পশুর চামড়া সংগৃহীত হয়, তার অধিকাংশই হয় কোরবানির সময়ে। কোরবানির চামড়ার দাম দেশে কম হলেও দেশে-বিদেশে চামড়াজাত পণ্যের দাম বেশ চড়া। তাই বাজার সমন্বয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে। কাঁচা চামড়া পরিবহনে যাতে কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয়, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সজাগ থাকতে হবে। চামড়া কারবারিদের একটি কথা মনে রাখা দরকার, কোরবানির চামড়ার বিক্রির টাকা দিয়ে সারা বছর দেশের অগণিত এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে অবস্থানরত এতিম ও গরিবদের খাবার পরিবেশন করা হয়ে থাকে।

সম্প্রতি ঈদুল আজহা উপলক্ষে আন্তঃমন্ত্রণালয় প্রস্তুতিমূলক একটি বৈঠকে বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশন-পৌরসভাগুলোর ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনের স্থানীয় প্রতিনিধি, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে অনলাইনে গবাদি পশু বেচাকেনার উদ্যোগ গ্রহণে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত হয়। বিভাগীয় কমিশনাররা অনলাইনে গবাদিপশু বিক্রির লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে নির্দেশনা দেয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া সিদ্ধান্ত হয়, সংশ্লিষ্ট ভেটেরিনারি সার্জনরা অনলাইনে আপলোড করার আগে গবাদিপশুর স্বাস্থ্যসনদ প্রদান করবে, যা অনলাইনে আপলোড করতে হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর অনলাইনে গবাদিপশু বিক্রির জন্য খামারিদের সংশ্লিষ্ট অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযোগের সহযোগিতা প্রদান করবে এবং আপলোডকৃত গবাদিপশুর ক্ষেত্রে মালিকের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, গবাদিপশুর বয়স, ওজন, মূল্য ও গবাদিপশুর ছবি প্রদান করতে হবে। আশা করা যায় করোনাকালীন ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারের এই মহতি উদ্যোগ দেশের অগণিত খামারির জীবনের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে এবং ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত কোরবানির আদর্শ সফল কাম হবে।

[লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, সিটি ইউনিভার্সিটি]

back to top