জিয়াউদ্দীন আহমেদ
টিকা নেয়ার পর সারা বিশ্বে করোনার প্রকোপ কমলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা করছিল করোনা আবার বাড়তে পারে। আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, সোশ্যাল ডিসট্যান্স, লকডাউন- করোনা ভাইরাসের কারণে শব্দগুলো সবার নিকট পরিচিত হয়ে উঠেছে। করোনাভাইরাসের ভয়ে এক সময় পৃথিবীর সর্বত্র ব্যাপকতম লকডাউন ছিল; হাজার হাজার মানুষ এখনও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ ইতোমধ্যে মারা গেছে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানুষের জীবন-জীবিকা, চিন্তা-ভাবনা, চলাফেরা সবকিছুতে একটা অস্বাভাবিকত্ব এনে দিয়েছে। শুধু করোনাভাইরাস নয়, অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎও মানবসমাজকে আতঙ্কিত করে তুলছে; এই অনিশ্চয়তা ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবনকে আজ বিপর্যস্ত করে তুলছে, সহজ সমাধান না পাওয়ায় ব্যক্তিজীবনে অনেকে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হচ্ছে। করোনার আগ্রাসনে কর্মহারা বেকার মানুষগুলো হতাশাগ্রস্ত হয়ে জড়িয়ে পড়ছে নেশা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ নানা সন্ত্রাসী কমর্কান্ডে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণভীতির সঙ্গে যোগ হয়েছে উপার্জন ও চাকরি হারানোর ভয়। ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মানসিক পীড়া ভাইরাসের চেয়েও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের বিহ্বলতা শারীরিক স্বাস্থ্যের চেয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে, স্বাভাবিক মানসিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
২০১৯ সনের শেষের দিকে চীনের উহানে যে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি তা সারা বিশ্বের মানুষ এবং অর্থনীতিকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। মানুষ ও যানবাহনের গতিবিধি কোথাও বদ্ধ, আবার কোথাও নিয়ন্ত্রিত। যে দেশের মানুষগুলো ভিসা ছাড়াই পাসপোর্ট নিয়ে অবাধে যে কোন দেশে চলে যেতে পারত তাদের জন্যও আগের মতো বিমান আকাশে উড়ছে না। উৎপাদন নেই, কাজ নেই, খাবার নেই, নিঃশেষিত সব সঞ্চয়। অনেক দেশে অপেক্ষা করছে দুর্ভিক্ষের দুর্বিষহ দুর্ভোগ। জীবন এবং জীবিকার সংগ্রামে কখনো জীবন প্রাধান্য পায়, আবার কখনো জীবিকা। দুটোর বিকল্পহীন অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। কিন্তু এখন একটির জন্য অন্যটিকে পরিহার করতে হচ্ছে, গুরুত্বহীন করে পাশে সরিয়ে দিতে হচ্ছে। দিন দিন মানুষ কর্মহীন হচ্ছে, এত কর্মহীন লোকের দীর্ঘ মেয়াদে খাবারের ব্যবস্থা করা পৃথিবীর কোন দেশের সরকারের পক্ষে সহজ নয়। কিছু লোকের নেতিবাচক অনুভূতি প্রগাঢ়, তার সঙ্গে মিশে আছে ধর্মের অন্ধ বিশ্বাস, ওরা মাস্কও পরেন না। ওয়াজি আলেমদের আবেগী ওয়াজে অশিক্ষিত-শিক্ষিত নির্বিশেষে কিছু লোক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, করোনা ‘আল্লাহর সৈনিক’; এই লোকগুলোর অনেকে স্বাস্থ্যবিধির ঘোরবিরোধী।
শারীরিক দূরত্ব আর সামাজিক দূরত্ব এক কথা নয়। শারীরিক দূরত্ব স্বাস্থ্যনীতির মূল কথা হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি। তবে সশরীরে উপস্থিতি এবং ভার্চুয়াল উপস্থিতির মধ্যে পার্থক্য অনেক। করোনার কারণে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে আমরা সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেলেছি। করোনায় মা মরলে সন্তান তাকায়নি, চিতায় মরদেহ রেখে সন্তান পালিয়েছে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আপনজনের উপস্থিতি ছিল না। করোনায় মৃত্যু সংবাদ শুনে সবাই ভার্চুয়াল জগতে ‘ইন্নালিল্লাহ’ কপি-পেস্ট করেছি, ‘আমিন’ বলেছি বা দূর থেকে বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছি, আগের মতো দৌড়ে মৃতদেহের কাছে যাইনি, কান্নারত আত্মীয়-স্বজনকে বুকে নিয়ে সান্তনা দেয়ার কথা ভাবিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব না থাকলে ঘরে আবদ্ধ মানুষগুলো বদ্ধ উম্মাদ হয়ে যেত। ফোনকল, ভিডিও কল বা টেলি কনফারেন্সে বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহস জোগানো সম্ভব হয়েছিল বলেই এখনও অধিকাংশ মানুষের মানসিক শক্তি অফুরন্ত।
মানুষকে নানা কারণেই কখনো কখনো কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন ও সঙ্গহীন থাকতে হয়, কিন্তু করোনার কারণে যেমন তেমনভাবে মানবসমাজকে এত দীর্ঘ সময় ধরে ঘরে আবদ্ধ থাকতে হয়নি। দীর্ঘদিন ঘর বন্দি থাকলে মানুষের মানসিক জগতে যে একটা বৈকল্য বিরাজ করে তা করোনার সংক্রমণ না হলে বোঝা যেত না। স্থবির, অচল, আবদ্ধ জীবনে অবসাদ আসবেই। সঙ্গবিহীন জীবনের নৈঃসঙ্গতা এবং শারীরিক ও সামাজিক দূরত্বের স্বাস্থ্যবিধি থেকে ব্যক্তির মনে তৈরি হয়েছে বিষণ্নতা, ভয়ভীতি, আতঙ্ক, বিরক্তিবোধ, ক্রোধ ইত্যাদি। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা দীর্ঘস্থায়ী হলে মানুষের আবেগ, অনুভূতি, সহমর্মিতাবোধ ইত্যাদি লোপ পেতে থাকে। করোনায় আক্রান্ত হলে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী রোগীকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে, মারা গেলে তার চেহারাও কেউ দেখার আগ্রহ দেখায়নি। এমন নির্মম বাস্তবতায় মানুষ আবেগ হারিয়ে নির্বাক হয়েছে, দিন দিন মনের ওপর চাপ বেড়েছে।
নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের উৎপত্তি হতে থাকলে করোনাভাইরাসের বিনাশ হতে আরও অনেক সময়ের প্রয়োজন হতে পারে; কারণ ভ্যাকসিনের দুই ডোজ নেয়ার পরও আমার এক প্রতিবেশী কিছুদিন আগে এবং আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী খসরুজ্জমানের স্ত্রী গতকাল ১২ জানুয়ারি মারা গেলেন, যিনি মারা গেছেন তিনিও টাকশালে আমার সহকর্মী ছিলেন। তবুও ভ্যাকসিনই একমাত্র ভরসা। ভ্যাকসিন দিয়ে মানবসমাজকে সুরক্ষিত করার কোন বিকল্প নেই। তবে নতুন অভিজ্ঞতায় মানুষ ভবিষ্যতে লকডাউনের চেয়ে রোগের সঙ্গে বসবাসের অভ্যাস গড়ে তুলতে বেশি আগ্রহী হবে। বিরাজমান বিভিন্ন ভয়ানক রোগের মতো করোনাও হয়তো কিছুদিন পর একটি রোগ হিসেবে গণ্য হতে থাকবে,- বহুমূত্র, কিডনি, ক্যান্সার, হৃদরোগের মতো করোনার জন্যও বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে উঠবে।
করোনার থাবা শুধু অর্থনীতিতে নয়, মানুষের মনের মধ্যেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। করোনার প্রকোপ কমে গেলেও সচেতনদের মুখ এখনো মাস্ক দিয়ে বন্ধ, পাশাপাশি চলছে, অথচ কথা নেই, কথা বললেও মাস্ক খুলছে না। কারণ তাদের মানসিক বৈকল্য থেকে জন্ম নিয়েছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা; উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা থেকে তৈরি হয়েছে বিষণ্নতা এবং বিষণ্নতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে বিচ্ছিন্নতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্ভব হলে ঘরের বাইরে গিয়ে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটাহাঁটি করতে উপদেশ দিয়েছে; কিন্তু এই উপদেশ বাংলাদেশের জনবহুল দেশে প্রায়ই অসম্ভব। ঢাকা শহরে ঘরের বাইর হলেই ঠেলাঠেলি করে রাস্তায় চলতে হয়। লকডাউনকেও সহনীয় করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো যদি সবাই শুধু মাস্ক পরতো। শুধু মাস্ক পরলেও পার্কগুলো খোলা রাখা যেত, খোলা পার্কে গিয়ে রুদ্ধ জীবনে একটু বাতাস লাগানো সম্ভব হতো। অবশ্য জনবহুল বাংলাদেশে খোলা জায়গাও খুব বেশি নেই। বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় স্থানে স্থানে মসজিদ তৈরি করা হলেও নকশায় প্রদর্শিত পার্কগুলো উদাও, খেলার মাঠ প্লট করে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে, ফলে সেখানে গড়ে উঠেছে বিরাট বিরাট আবাসিক ভবন। এই অনাচার নিয়ে রাজউকের কোন মাথাব্যথা নেই। এই অবস্থায় লাখ লাখ মানুষ ছোট্ট একটি ঘরে গাদাগাদি করে আবদ্ধ থাকছে, মানসিক চাপে নিজের সঙ্গে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মানসিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে। করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মানসিক বিচ্ছিন্নতার যে অবসাদ ও বিষণ্নতা তা কাটিয়ে উঠার জন্য টিকার অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করা সময় সাপেক্ষ; তবে উৎফুল্ল জীবন ফিরিয়ে আনতে আমাদের মনোচিকিৎসকদের দায় ও দায়িত্ব বেড়ে গেল।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২২
টিকা নেয়ার পর সারা বিশ্বে করোনার প্রকোপ কমলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা করছিল করোনা আবার বাড়তে পারে। আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, সোশ্যাল ডিসট্যান্স, লকডাউন- করোনা ভাইরাসের কারণে শব্দগুলো সবার নিকট পরিচিত হয়ে উঠেছে। করোনাভাইরাসের ভয়ে এক সময় পৃথিবীর সর্বত্র ব্যাপকতম লকডাউন ছিল; হাজার হাজার মানুষ এখনও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ ইতোমধ্যে মারা গেছে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানুষের জীবন-জীবিকা, চিন্তা-ভাবনা, চলাফেরা সবকিছুতে একটা অস্বাভাবিকত্ব এনে দিয়েছে। শুধু করোনাভাইরাস নয়, অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎও মানবসমাজকে আতঙ্কিত করে তুলছে; এই অনিশ্চয়তা ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবনকে আজ বিপর্যস্ত করে তুলছে, সহজ সমাধান না পাওয়ায় ব্যক্তিজীবনে অনেকে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হচ্ছে। করোনার আগ্রাসনে কর্মহারা বেকার মানুষগুলো হতাশাগ্রস্ত হয়ে জড়িয়ে পড়ছে নেশা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ নানা সন্ত্রাসী কমর্কান্ডে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণভীতির সঙ্গে যোগ হয়েছে উপার্জন ও চাকরি হারানোর ভয়। ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মানসিক পীড়া ভাইরাসের চেয়েও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের বিহ্বলতা শারীরিক স্বাস্থ্যের চেয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে, স্বাভাবিক মানসিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
২০১৯ সনের শেষের দিকে চীনের উহানে যে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি তা সারা বিশ্বের মানুষ এবং অর্থনীতিকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে। মানুষ ও যানবাহনের গতিবিধি কোথাও বদ্ধ, আবার কোথাও নিয়ন্ত্রিত। যে দেশের মানুষগুলো ভিসা ছাড়াই পাসপোর্ট নিয়ে অবাধে যে কোন দেশে চলে যেতে পারত তাদের জন্যও আগের মতো বিমান আকাশে উড়ছে না। উৎপাদন নেই, কাজ নেই, খাবার নেই, নিঃশেষিত সব সঞ্চয়। অনেক দেশে অপেক্ষা করছে দুর্ভিক্ষের দুর্বিষহ দুর্ভোগ। জীবন এবং জীবিকার সংগ্রামে কখনো জীবন প্রাধান্য পায়, আবার কখনো জীবিকা। দুটোর বিকল্পহীন অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। কিন্তু এখন একটির জন্য অন্যটিকে পরিহার করতে হচ্ছে, গুরুত্বহীন করে পাশে সরিয়ে দিতে হচ্ছে। দিন দিন মানুষ কর্মহীন হচ্ছে, এত কর্মহীন লোকের দীর্ঘ মেয়াদে খাবারের ব্যবস্থা করা পৃথিবীর কোন দেশের সরকারের পক্ষে সহজ নয়। কিছু লোকের নেতিবাচক অনুভূতি প্রগাঢ়, তার সঙ্গে মিশে আছে ধর্মের অন্ধ বিশ্বাস, ওরা মাস্কও পরেন না। ওয়াজি আলেমদের আবেগী ওয়াজে অশিক্ষিত-শিক্ষিত নির্বিশেষে কিছু লোক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, করোনা ‘আল্লাহর সৈনিক’; এই লোকগুলোর অনেকে স্বাস্থ্যবিধির ঘোরবিরোধী।
শারীরিক দূরত্ব আর সামাজিক দূরত্ব এক কথা নয়। শারীরিক দূরত্ব স্বাস্থ্যনীতির মূল কথা হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি। তবে সশরীরে উপস্থিতি এবং ভার্চুয়াল উপস্থিতির মধ্যে পার্থক্য অনেক। করোনার কারণে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে আমরা সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেলেছি। করোনায় মা মরলে সন্তান তাকায়নি, চিতায় মরদেহ রেখে সন্তান পালিয়েছে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আপনজনের উপস্থিতি ছিল না। করোনায় মৃত্যু সংবাদ শুনে সবাই ভার্চুয়াল জগতে ‘ইন্নালিল্লাহ’ কপি-পেস্ট করেছি, ‘আমিন’ বলেছি বা দূর থেকে বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছি, আগের মতো দৌড়ে মৃতদেহের কাছে যাইনি, কান্নারত আত্মীয়-স্বজনকে বুকে নিয়ে সান্তনা দেয়ার কথা ভাবিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব না থাকলে ঘরে আবদ্ধ মানুষগুলো বদ্ধ উম্মাদ হয়ে যেত। ফোনকল, ভিডিও কল বা টেলি কনফারেন্সে বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহস জোগানো সম্ভব হয়েছিল বলেই এখনও অধিকাংশ মানুষের মানসিক শক্তি অফুরন্ত।
মানুষকে নানা কারণেই কখনো কখনো কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন ও সঙ্গহীন থাকতে হয়, কিন্তু করোনার কারণে যেমন তেমনভাবে মানবসমাজকে এত দীর্ঘ সময় ধরে ঘরে আবদ্ধ থাকতে হয়নি। দীর্ঘদিন ঘর বন্দি থাকলে মানুষের মানসিক জগতে যে একটা বৈকল্য বিরাজ করে তা করোনার সংক্রমণ না হলে বোঝা যেত না। স্থবির, অচল, আবদ্ধ জীবনে অবসাদ আসবেই। সঙ্গবিহীন জীবনের নৈঃসঙ্গতা এবং শারীরিক ও সামাজিক দূরত্বের স্বাস্থ্যবিধি থেকে ব্যক্তির মনে তৈরি হয়েছে বিষণ্নতা, ভয়ভীতি, আতঙ্ক, বিরক্তিবোধ, ক্রোধ ইত্যাদি। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা দীর্ঘস্থায়ী হলে মানুষের আবেগ, অনুভূতি, সহমর্মিতাবোধ ইত্যাদি লোপ পেতে থাকে। করোনায় আক্রান্ত হলে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী রোগীকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে, মারা গেলে তার চেহারাও কেউ দেখার আগ্রহ দেখায়নি। এমন নির্মম বাস্তবতায় মানুষ আবেগ হারিয়ে নির্বাক হয়েছে, দিন দিন মনের ওপর চাপ বেড়েছে।
নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের উৎপত্তি হতে থাকলে করোনাভাইরাসের বিনাশ হতে আরও অনেক সময়ের প্রয়োজন হতে পারে; কারণ ভ্যাকসিনের দুই ডোজ নেয়ার পরও আমার এক প্রতিবেশী কিছুদিন আগে এবং আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী খসরুজ্জমানের স্ত্রী গতকাল ১২ জানুয়ারি মারা গেলেন, যিনি মারা গেছেন তিনিও টাকশালে আমার সহকর্মী ছিলেন। তবুও ভ্যাকসিনই একমাত্র ভরসা। ভ্যাকসিন দিয়ে মানবসমাজকে সুরক্ষিত করার কোন বিকল্প নেই। তবে নতুন অভিজ্ঞতায় মানুষ ভবিষ্যতে লকডাউনের চেয়ে রোগের সঙ্গে বসবাসের অভ্যাস গড়ে তুলতে বেশি আগ্রহী হবে। বিরাজমান বিভিন্ন ভয়ানক রোগের মতো করোনাও হয়তো কিছুদিন পর একটি রোগ হিসেবে গণ্য হতে থাকবে,- বহুমূত্র, কিডনি, ক্যান্সার, হৃদরোগের মতো করোনার জন্যও বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে উঠবে।
করোনার থাবা শুধু অর্থনীতিতে নয়, মানুষের মনের মধ্যেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। করোনার প্রকোপ কমে গেলেও সচেতনদের মুখ এখনো মাস্ক দিয়ে বন্ধ, পাশাপাশি চলছে, অথচ কথা নেই, কথা বললেও মাস্ক খুলছে না। কারণ তাদের মানসিক বৈকল্য থেকে জন্ম নিয়েছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা; উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা থেকে তৈরি হয়েছে বিষণ্নতা এবং বিষণ্নতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে বিচ্ছিন্নতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্ভব হলে ঘরের বাইরে গিয়ে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটাহাঁটি করতে উপদেশ দিয়েছে; কিন্তু এই উপদেশ বাংলাদেশের জনবহুল দেশে প্রায়ই অসম্ভব। ঢাকা শহরে ঘরের বাইর হলেই ঠেলাঠেলি করে রাস্তায় চলতে হয়। লকডাউনকেও সহনীয় করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো যদি সবাই শুধু মাস্ক পরতো। শুধু মাস্ক পরলেও পার্কগুলো খোলা রাখা যেত, খোলা পার্কে গিয়ে রুদ্ধ জীবনে একটু বাতাস লাগানো সম্ভব হতো। অবশ্য জনবহুল বাংলাদেশে খোলা জায়গাও খুব বেশি নেই। বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় স্থানে স্থানে মসজিদ তৈরি করা হলেও নকশায় প্রদর্শিত পার্কগুলো উদাও, খেলার মাঠ প্লট করে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে, ফলে সেখানে গড়ে উঠেছে বিরাট বিরাট আবাসিক ভবন। এই অনাচার নিয়ে রাজউকের কোন মাথাব্যথা নেই। এই অবস্থায় লাখ লাখ মানুষ ছোট্ট একটি ঘরে গাদাগাদি করে আবদ্ধ থাকছে, মানসিক চাপে নিজের সঙ্গে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মানসিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে। করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মানসিক বিচ্ছিন্নতার যে অবসাদ ও বিষণ্নতা তা কাটিয়ে উঠার জন্য টিকার অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করা সময় সাপেক্ষ; তবে উৎফুল্ল জীবন ফিরিয়ে আনতে আমাদের মনোচিকিৎসকদের দায় ও দায়িত্ব বেড়ে গেল।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
ahmedzeauddin0@gmail.com