alt

উপ-সম্পাদকীয়

ভারতে মুসলমানের আর্থিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ধারাবাহিক অবহেলা

গৌতম রায়

: শুক্রবার, ২১ জানুয়ারী ২০২২

শতবর্ষ উদযাপন এখন আরএসএসের কাছে প্রধান লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যপথ ঠিক রেখেই তারা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির প্রতিটি পদক্ষেপ মেপেজুপে ঠিক করে দিচ্ছে। ২০২৫ সালে শতবর্ষপূর্তির আগে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের খোলনলচে বদলে, দেশটাকে রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় আরএসএস। সেদিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই তারা আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের ঘুঁটি সাজাচ্ছে। যেভাবে ’১৯ সালের ভোটে জিতে, সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫-এর এ ধারা তারা বিলুপ্ত করেছিল, সেইভাবেই হয় মুসলমানমুক্ত, নতুবা গোলওয়ালকরের ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ তত্ত্ব অনুযায়ী মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করে রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্রের পথে ’২৪-এ জিতে ভারতকে পরিণত করার পরিকল্পনা গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের আছে কিনা- তা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন।

ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে সাম্প্রদায়িক ভারতে পরিণত করে, সেই দেশকে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের দেশে পর্যবসিত করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। এখন সেই দেশকে তাদের শেষ লক্ষ্য, তথা চরম লক্ষ্য রাজনৈতিক হিন্দুত্বের পথে টেনে আনতে চায় আরএসএস। এই কাজ কি সঙ্ঘ শুধু তাদের বহু বর্ণের, বহু চরিত্রের নানা শাখা সংগঠন আর অতীতে হিন্দু মহাসভা থেকে ভারতীয় জনসঙ্ঘ হয়ে আজকের বিজেপির সাহায্যেই করে উঠতে সক্ষম হলো? নাকি হিন্দুত্ববাদী শিবিরের বাইরে, আপাতভাবে যারা নিজেদের খাতা-কলমে ধর্মনিরপেক্ষ বলে কংগ্রেসসহ যাবতীয় দক্ষিণপন্থি, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাধীনতার পরের পঁচাত্তর বছরের কৃতকর্মের ফলের ফসল হিসেবে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে? যে পরিস্থিতিকে দানা বাঁধাবার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভাবে হোক বা উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে নানা কৃতকর্মের জের টানাবার ক্ষেত্রে বামেদের দায়িত্বকেও কখনোই একেবারে অস্বীকার করতে পারা যায় না।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিশায় সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপরে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নামে সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হলেও যে নীতির প্রয়োগ ঘটেছিল, সেখানে সংখ্যাগুরুর বিষয়গুলোই সবথেকে বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল। স্বাধীন ভারতে দারিদ্র্য দূরীকরণ থেকে নগরায়ণ সবক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার পেয়েছে সংখ্যাগুরুর স্বার্থ। রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শগত উপস্থাপনায় খাতা-কলমে ধর্মনিরপেক্ষ বলে যারা নিজেদের দাবি করেন, তাদের ভেতরে বামপন্থিরাও আছেন, আদর্শগত দিক থেকে এরা সবাইই অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে, অগ্রাধিকারের প্রশ্নে সংখ্যালঘু মুসলমানদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, ভারতের স্বাধীনতার কাল থেকে, আজ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পঁচাত্তর বছরের দোরগোড়ায় এসেও কিন্তু ন্যূনতম গুরুত্ব মুসলমানরা পান না ভারতে। আরএসএস-বিজেপি তাদের পরিকল্পিত রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে ভারতকে সঙ্ঘের শতবর্ষপূর্তির মুহূর্তে ঠেলে দেয়ার চেষ্টায় একের পর এক সাফল্য পাচ্ছে কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে মুসলমানদের ওপর অর্থনৈতিক বঞ্চনার ফলে মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক মেরুদ-টা আজও মজবুত না হওয়ার দরুন। আর্থ-সামাজিক মেরুদ-টা মজবুত না হওয়ার ফলেই মুসলমান সমাজ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সংখ্যাগুরুর লেগপুলিংয়ের সঙ্গে আজ ও এঁটে উঠতে পারছে না।

গুজরাট গণহত্যার বেশ আগে থেকেই বনবাসী কল্যাণ আশ্রম নামক একটি শাখা সংগঠন আরএসএস অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশের রায়গড়কে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিল। উচ্চবর্ণের, উচ্চবিত্তের হিন্দুর ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে আরএসএস। কিন্তু সেই ক্ষমতায়নের পথে এগোতে হলে দরকার নিম্নবর্গীয়ের সমর্থন। সেই নিম্নবর্গীয়কে লোক দেখানো উচ্চবর্ণে পরিণত করা হলো এই বনবাসী কল্যাণ আশ্রমের অন্যতম কাজ। এই সংগঠনটিকেই গুজরাট গণহত্যার সময়ে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির ব্যবহার করেছিল।

বাম এবং অবিজেপি বুর্জোয়া রাজনৈতিক শিবির কাগজে-কলমে গোটা পিছড়ে বর্গের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। কিন্তু মজার কথা হলো, সংখ্যালঘুদের সমুচিত গুরুত্ব দেয়ার প্রশ্নে অবাম, অবিজেপি শিবির মুখে কুম্ভিরাশ্রুর উপক্রম করলেও বামেরা শ্রেণী প্রশ্নকে সামনে এনে অনেক রাজনৈতিক বোধের বিষয়কে তুলে ধরে। শেষ কথা হলো, তাদের দলগুলোতে তপশিলি জাতি, উপজাতির মানুষদের অ্যাডভোকেসি করবার জোর এবং দক্ষতার কারণে পশ্চিমবঙ্গে বামেরা এইক্ষেত্রে একাংশের পিছড়ে বর্গের আর্থ-সামাজিক দিকের একটা উন্নতি ঘটাতে পারলেও মুসলমান যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই পড়ে থাকে। তবে বাম জামানায় এ তপশিলি জাতি, উপজাতি, ওবিসি ইত্যাদিদের উন্নতির ক্ষেত্রেও একটা অদ্ভুত প্রবণতা দেখা যেত। শাসক শিবিরের ঘনিষ্ঠ অংশ সরকারের পিছড়ে বর্গের জন্যে গৃহীত নীতির সুবাদে নিজের নিজের উন্নতি ঘটালেও প্রত্যন্ত গ্রামে পড়ে থাকা নিজের সম্প্রদায়ের মানুষ সম্পর্কে প্রায় উদাসীন থেকেছে। ফলে গ্রাম গ্রামান্তরে এই পিছড়ে বর্গের আর্থ-সামাজিক অবস্থাটা আপামর মুসলমান সমাজের থেকে বিশেষ আলাদা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে এ ছবি আমরা যেভাবে দেখেছি, ভারতের অন্যান্য অংশে অঘোষিত সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক পরিবেশ, পরিস্থিতির জন্যে সেই অবস্থা থেকেছে আর ও অনেক বেশি ভয়াবহ।

আজ প্রায় আট বছর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালক চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী চেতনার ধারক-বাহক আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। নরেন্দ্র মোদি পরিচালিত সরকারের মুসলমানদের আর্থিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে নীতি কি হবে, তা নিয়ে কোনো সংশয় জাগে না। রাজনৈতিক হিন্দু সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন যে কোন অবস্থাতেই মুসলমান সমাজকে আর্থিক নিরাপত্তা দেবে না- এ নিয়েও কোন প্রশ্ন বা বিতর্কের অবকাশ নেই। তবু প্রশ্ন এখানটাতেই যে, কংগ্রেস দীর্ঘকাল ভারত শাসন করেছে, জনতা দল, রাষ্ট্রীয় মোর্চা ইত্যাদিরাও কখনো সখনো অল্প সময়ের জন্যে ভারত সরকার পরিচালনা করেছে। এই সময়গুলোতে ভারতের মুসলমান সমাজের আর্থিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারত সরকার কি ভূমিকা পালন করেছে?

অবিজেপি সরকার গুলি যদি সত্যিই মুসলমান সমাজের আর্থিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে ন্যূনতম আন্তরিকতা দেখাত, তাহলে আর্থিক দুরবস্থা হেতু মুসলমান সমাজের সমিজের মূল স্র্রোতে আসা, রাজনৈতিক পরিবেশ- পরিস্থিতিকে খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করার প্রশ্নে আজকের মতো এতখানি শূন্যতা তৈরি হতো না। আর নীতি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে সরকারি সদিচ্ছার কারণ থেকে তৈরি হওয়া অপদার্থতার সুযোগটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এতটা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার ও করতে পারত না। মুসলমানদের আর্থিক স্বাবলম্বন, আধুনিক শিক্ষার সুযোগ, চিকিৎসার সুযোগ, প্রযুক্তিগত আধুনিকতার পরিমণ্ডলে তাদের আসতে না দেয়া, সরকারি চাকরির সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করা- এসব বহুবিধ কারণের জন্যে সমাজ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের অন্যতম নিয়ামক ও নির্ণায়ক হওয়ার সুযোগ একতরফা ভাবে পেয়ে এসেছে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী। সবদিক থেকে বঞ্চিত থেকেছে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা।

নীতি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে সমস্ত অবিজেপি (অতীতের জনসংঘকে ধরেই) রাজনৈতিক দলগুলো যদি মুসলমান সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করার এতটুকু সুযোগ ’৪৭-এর স্বাধীনতার পর থেকে দিত, তাহলে আজ এভাবে ফ্যাসিস্ট বিজেপি একা ফাঁকা মাঠে গোলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারত না। এক্ষেত্রে বামপন্থিদের ভূমিকাকেও আলোচনার ঊর্ধ্বে রাখা যায় না। বামপন্থিরা শ্রেণী রাজনীতির কথা বলেন। সেকথা বলেই ভোট রাজনীতি আর নিজেদের দলে দলিত, তপশিলি জাতি, উপজাতির নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ- তার ওপর ভিত্তি করে দলীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ক্ষমতায় থাকার সময়ে এ পিছড়ে বর্গের একটা অংশ কে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে অনেকখানিই সাহায্য করেছে। যদি সেই সাহায্য দলীয় নেতৃত্বের একাংশের নিজস্ব বৃত্তের বাইরে আম পিছড়ে বর্গের কতখানি ঘটেছে, তা নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়। দলিতেরা, আদিবাসীরাও তাও যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, ক্ষমতায়নের সুযোগ মিলেছে তাদের, তার বিন্দু বিসর্গই মেলেনি মুসলমানদের। একথা ঠিক পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিরা ক্ষমতায় থাকাকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা দাঙ্গার উত্তাপ থেকে অনেকখানি নিস্তার পেয়েছে। তার বাইরে মুসলমান সমাজে আধুনিক প্রযুক্তিগত শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগ মহঃ সেলিম মন্ত্রী থাকাকালীন যে নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছিল, তিনি সাংসদ হয়ে দিল্লি চলে যাওয়ার পরে, বামপন্থিরা ক্ষমতায় থাকাকালীন, আর এক পাও এগোয়নি।

ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে সাম্প্রদায়িক ভারতে পরিণত করে, সেই দেশকে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের দেশে পর্যবসিত করেছে হিন্দুত্ববাদীরা

গোটা ভারতে স্বাধীনতার পর থেকে মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থাটা ঠিক কি অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা যখন সাচার কমিটির প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমাদের সামনে উঠে এলো, তখন মনে হলো, রাজনৈতিক দলগুলো তো বটেই, আমরা যারা দলীয় রাজনীতির বাইরে বামপন্থি রাজনীতিতে বিশ্বাস করি, ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থাবান, সংখ্যালঘুর স্বাধিকারের জন্যে লড়, আমাদের সকলের গালেই যেন বিরাশি সিক্কার একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছেন বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার।

২০০৫ সালের ৯ মার্চ ড. মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে প্রথম ইউপিএ সরকার ৮৫০॥৩সি॥৩॥০৫ রাজনৈতিক নোটিফিকেশনের মাধ্যমে এই সাচার কমিটি তৈরি করে। মুসলমানদের আর্থ- সামাজিক অবস্থার ওপর সমীক্ষার দাবিতে সেই সময়ের বাম সাংসদ মহঃ সেলিমের সংসদের ভিতরে ও বাইরের ভূমিকাকে এই কমিটি তৈরির প্রেক্ষিতে বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। নীতি পঙ্গুত্ব ঘিরে মনমোহনের সরকারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, মনমোহন নিজে সংখ্যালঘু শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ছিলেন বলেই হয়তো সাচার কমিটি তৈরির মতো সাহসী পদক্ষেপ, যা নেহরু থেকে ইন্দিরা হয়ে রাজীব- কেউই দেখাতে পারেননি, তেমন পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের (১৮৫৭) নেতৃত্ব যেহেতু মুসলমান দিয়েছিল, তাই মুসলমানকে অর্থনৈতিক ভাবে ধ্বংস করা, যাতে তারা আর কোনো অবস্থাতেই রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে না পারে, এটাই ছিল ইংরেজদের অনুসৃত নীতি। এ নীতির বাইরে ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন গান্ধী, নেহেরু, আজাদেরা। কিন্তু কংগ্রেসের ভেতরকারই সাম্প্রদায়িক স্রোত কখনো চোরা ভাবে, কখনো বা সরাসরি তাদের বাঁধা দিয়েছে। প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে সামনে। ফলে ধীরে ধীরে শক্তি অর্জন করেছে হিন্দু-মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ।

মুসলমান সমাজকে অর্থনৈতিক ভাবে মাথা তুলতে দিও না, অর্থনৈতিক ভাবে মাথা তুললেই তারা মাটিতে পা দিয়ে শক্ত করে দাঁড়াবে। আর শক্ত হয়ে দাঁড়ালেই তারা শতাব্দী ধারার বঞ্চনার প্রতিবাদে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। মুসলমানের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটলে সংখ্যাগুরু হিন্দুরা ক্রমশ সবদিক থেকে পেছিয়ে পড়বে। তখন হিন্দুদের পাঠান, মোগল যুগের মতো মুসলমানদের পদানত হয়ে থাকতে হবে- ১৮৫৭-এর পর থেকে এটাই ছিল ব্রিটিশের একমাত্র রাজনীতি। সেই রাজনীতিরই প্রয়োগ ঘটাতে ব্রিটিশ অখন্ড ভারতে হিন্দু সাম্প্রদাযড়ক রাজনীতিকে আঠারো শতকের শেষ প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে উৎসাহিত করেছে।পরবর্তীতে যেমন উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে করতে শুরু করেছিল মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে।

আরএসএস-জামায়াতে ইসলাম, ব্রিটিশের দেখানো এই পথকেই সময়ের সঙ্গে তাল রেখে আরো ক্ষিপ্র করেছে। উগ্র করেছে। নগ্ন করেছে। ব্রিটিশের এই শয়তানি জওহরলালের মতো মানুষ বুঝেও প্রতিরোধের প্রশ্নে খুব ফলপ্রসূ কিছু করে উঠতে পারেননি তার নিজের দলেরই সাম্প্রদায়িক শিবিরের চাপে। ভুলে গেলে চলবে না যে, ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার খসড়াকারি রাশিবিজ্ঞানী প্রশান্তকুমার মহালনবীশ তার প্রকল্পটি সরকারি শিলমোহর পেয়ে প্রকাশ্যে আসবার পরে চিনতেই পারেননি। কারণ, আধুনিক, বিজ্ঞানমুখী, লিঙ্গ থেকে দলিত, সংখ্যালঘু- সব প্রশ্নে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার যে সংস্থান মহালনবিশের প্রকৃত মডেলে ছিল, সেটি হাওয়া হয়ে গিয়েছিল সরকারি সিলমোহরযুক্ত ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে। ফলে সাচার যে অনুসন্ধান করে সন্দর্ভ তৈরি করেছিলেন, তাকে প্রতিটি ভারতবাসীর অপরাধের ফলশ্রুতি বলেই চিহ্নিত করতে হয়।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ ]

ফলের রাজ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম

ছবি

তৃতীয় শক্তির জন্য জায়গা খালি : বামপন্থীরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ভারতে মুসলমানের আর্থিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ধারাবাহিক অবহেলা

গৌতম রায়

শুক্রবার, ২১ জানুয়ারী ২০২২

শতবর্ষ উদযাপন এখন আরএসএসের কাছে প্রধান লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যপথ ঠিক রেখেই তারা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির প্রতিটি পদক্ষেপ মেপেজুপে ঠিক করে দিচ্ছে। ২০২৫ সালে শতবর্ষপূর্তির আগে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের খোলনলচে বদলে, দেশটাকে রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় আরএসএস। সেদিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই তারা আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের ঘুঁটি সাজাচ্ছে। যেভাবে ’১৯ সালের ভোটে জিতে, সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫-এর এ ধারা তারা বিলুপ্ত করেছিল, সেইভাবেই হয় মুসলমানমুক্ত, নতুবা গোলওয়ালকরের ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ তত্ত্ব অনুযায়ী মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করে রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্রের পথে ’২৪-এ জিতে ভারতকে পরিণত করার পরিকল্পনা গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের আছে কিনা- তা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন।

ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে সাম্প্রদায়িক ভারতে পরিণত করে, সেই দেশকে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের দেশে পর্যবসিত করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। এখন সেই দেশকে তাদের শেষ লক্ষ্য, তথা চরম লক্ষ্য রাজনৈতিক হিন্দুত্বের পথে টেনে আনতে চায় আরএসএস। এই কাজ কি সঙ্ঘ শুধু তাদের বহু বর্ণের, বহু চরিত্রের নানা শাখা সংগঠন আর অতীতে হিন্দু মহাসভা থেকে ভারতীয় জনসঙ্ঘ হয়ে আজকের বিজেপির সাহায্যেই করে উঠতে সক্ষম হলো? নাকি হিন্দুত্ববাদী শিবিরের বাইরে, আপাতভাবে যারা নিজেদের খাতা-কলমে ধর্মনিরপেক্ষ বলে কংগ্রেসসহ যাবতীয় দক্ষিণপন্থি, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাধীনতার পরের পঁচাত্তর বছরের কৃতকর্মের ফলের ফসল হিসেবে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে? যে পরিস্থিতিকে দানা বাঁধাবার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভাবে হোক বা উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে নানা কৃতকর্মের জের টানাবার ক্ষেত্রে বামেদের দায়িত্বকেও কখনোই একেবারে অস্বীকার করতে পারা যায় না।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিশায় সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপরে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নামে সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হলেও যে নীতির প্রয়োগ ঘটেছিল, সেখানে সংখ্যাগুরুর বিষয়গুলোই সবথেকে বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল। স্বাধীন ভারতে দারিদ্র্য দূরীকরণ থেকে নগরায়ণ সবক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার পেয়েছে সংখ্যাগুরুর স্বার্থ। রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শগত উপস্থাপনায় খাতা-কলমে ধর্মনিরপেক্ষ বলে যারা নিজেদের দাবি করেন, তাদের ভেতরে বামপন্থিরাও আছেন, আদর্শগত দিক থেকে এরা সবাইই অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে, অগ্রাধিকারের প্রশ্নে সংখ্যালঘু মুসলমানদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, ভারতের স্বাধীনতার কাল থেকে, আজ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পঁচাত্তর বছরের দোরগোড়ায় এসেও কিন্তু ন্যূনতম গুরুত্ব মুসলমানরা পান না ভারতে। আরএসএস-বিজেপি তাদের পরিকল্পিত রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে ভারতকে সঙ্ঘের শতবর্ষপূর্তির মুহূর্তে ঠেলে দেয়ার চেষ্টায় একের পর এক সাফল্য পাচ্ছে কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে মুসলমানদের ওপর অর্থনৈতিক বঞ্চনার ফলে মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক মেরুদ-টা আজও মজবুত না হওয়ার দরুন। আর্থ-সামাজিক মেরুদ-টা মজবুত না হওয়ার ফলেই মুসলমান সমাজ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সংখ্যাগুরুর লেগপুলিংয়ের সঙ্গে আজ ও এঁটে উঠতে পারছে না।

গুজরাট গণহত্যার বেশ আগে থেকেই বনবাসী কল্যাণ আশ্রম নামক একটি শাখা সংগঠন আরএসএস অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশের রায়গড়কে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিল। উচ্চবর্ণের, উচ্চবিত্তের হিন্দুর ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে আরএসএস। কিন্তু সেই ক্ষমতায়নের পথে এগোতে হলে দরকার নিম্নবর্গীয়ের সমর্থন। সেই নিম্নবর্গীয়কে লোক দেখানো উচ্চবর্ণে পরিণত করা হলো এই বনবাসী কল্যাণ আশ্রমের অন্যতম কাজ। এই সংগঠনটিকেই গুজরাট গণহত্যার সময়ে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির ব্যবহার করেছিল।

বাম এবং অবিজেপি বুর্জোয়া রাজনৈতিক শিবির কাগজে-কলমে গোটা পিছড়ে বর্গের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। কিন্তু মজার কথা হলো, সংখ্যালঘুদের সমুচিত গুরুত্ব দেয়ার প্রশ্নে অবাম, অবিজেপি শিবির মুখে কুম্ভিরাশ্রুর উপক্রম করলেও বামেরা শ্রেণী প্রশ্নকে সামনে এনে অনেক রাজনৈতিক বোধের বিষয়কে তুলে ধরে। শেষ কথা হলো, তাদের দলগুলোতে তপশিলি জাতি, উপজাতির মানুষদের অ্যাডভোকেসি করবার জোর এবং দক্ষতার কারণে পশ্চিমবঙ্গে বামেরা এইক্ষেত্রে একাংশের পিছড়ে বর্গের আর্থ-সামাজিক দিকের একটা উন্নতি ঘটাতে পারলেও মুসলমান যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই পড়ে থাকে। তবে বাম জামানায় এ তপশিলি জাতি, উপজাতি, ওবিসি ইত্যাদিদের উন্নতির ক্ষেত্রেও একটা অদ্ভুত প্রবণতা দেখা যেত। শাসক শিবিরের ঘনিষ্ঠ অংশ সরকারের পিছড়ে বর্গের জন্যে গৃহীত নীতির সুবাদে নিজের নিজের উন্নতি ঘটালেও প্রত্যন্ত গ্রামে পড়ে থাকা নিজের সম্প্রদায়ের মানুষ সম্পর্কে প্রায় উদাসীন থেকেছে। ফলে গ্রাম গ্রামান্তরে এই পিছড়ে বর্গের আর্থ-সামাজিক অবস্থাটা আপামর মুসলমান সমাজের থেকে বিশেষ আলাদা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে এ ছবি আমরা যেভাবে দেখেছি, ভারতের অন্যান্য অংশে অঘোষিত সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক পরিবেশ, পরিস্থিতির জন্যে সেই অবস্থা থেকেছে আর ও অনেক বেশি ভয়াবহ।

আজ প্রায় আট বছর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালক চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী চেতনার ধারক-বাহক আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। নরেন্দ্র মোদি পরিচালিত সরকারের মুসলমানদের আর্থিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে নীতি কি হবে, তা নিয়ে কোনো সংশয় জাগে না। রাজনৈতিক হিন্দু সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন যে কোন অবস্থাতেই মুসলমান সমাজকে আর্থিক নিরাপত্তা দেবে না- এ নিয়েও কোন প্রশ্ন বা বিতর্কের অবকাশ নেই। তবু প্রশ্ন এখানটাতেই যে, কংগ্রেস দীর্ঘকাল ভারত শাসন করেছে, জনতা দল, রাষ্ট্রীয় মোর্চা ইত্যাদিরাও কখনো সখনো অল্প সময়ের জন্যে ভারত সরকার পরিচালনা করেছে। এই সময়গুলোতে ভারতের মুসলমান সমাজের আর্থিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারত সরকার কি ভূমিকা পালন করেছে?

অবিজেপি সরকার গুলি যদি সত্যিই মুসলমান সমাজের আর্থিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে ন্যূনতম আন্তরিকতা দেখাত, তাহলে আর্থিক দুরবস্থা হেতু মুসলমান সমাজের সমিজের মূল স্র্রোতে আসা, রাজনৈতিক পরিবেশ- পরিস্থিতিকে খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করার প্রশ্নে আজকের মতো এতখানি শূন্যতা তৈরি হতো না। আর নীতি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে সরকারি সদিচ্ছার কারণ থেকে তৈরি হওয়া অপদার্থতার সুযোগটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এতটা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার ও করতে পারত না। মুসলমানদের আর্থিক স্বাবলম্বন, আধুনিক শিক্ষার সুযোগ, চিকিৎসার সুযোগ, প্রযুক্তিগত আধুনিকতার পরিমণ্ডলে তাদের আসতে না দেয়া, সরকারি চাকরির সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করা- এসব বহুবিধ কারণের জন্যে সমাজ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের অন্যতম নিয়ামক ও নির্ণায়ক হওয়ার সুযোগ একতরফা ভাবে পেয়ে এসেছে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী। সবদিক থেকে বঞ্চিত থেকেছে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা।

নীতি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে সমস্ত অবিজেপি (অতীতের জনসংঘকে ধরেই) রাজনৈতিক দলগুলো যদি মুসলমান সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করার এতটুকু সুযোগ ’৪৭-এর স্বাধীনতার পর থেকে দিত, তাহলে আজ এভাবে ফ্যাসিস্ট বিজেপি একা ফাঁকা মাঠে গোলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারত না। এক্ষেত্রে বামপন্থিদের ভূমিকাকেও আলোচনার ঊর্ধ্বে রাখা যায় না। বামপন্থিরা শ্রেণী রাজনীতির কথা বলেন। সেকথা বলেই ভোট রাজনীতি আর নিজেদের দলে দলিত, তপশিলি জাতি, উপজাতির নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ- তার ওপর ভিত্তি করে দলীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ক্ষমতায় থাকার সময়ে এ পিছড়ে বর্গের একটা অংশ কে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে অনেকখানিই সাহায্য করেছে। যদি সেই সাহায্য দলীয় নেতৃত্বের একাংশের নিজস্ব বৃত্তের বাইরে আম পিছড়ে বর্গের কতখানি ঘটেছে, তা নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়। দলিতেরা, আদিবাসীরাও তাও যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, ক্ষমতায়নের সুযোগ মিলেছে তাদের, তার বিন্দু বিসর্গই মেলেনি মুসলমানদের। একথা ঠিক পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিরা ক্ষমতায় থাকাকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা দাঙ্গার উত্তাপ থেকে অনেকখানি নিস্তার পেয়েছে। তার বাইরে মুসলমান সমাজে আধুনিক প্রযুক্তিগত শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগ মহঃ সেলিম মন্ত্রী থাকাকালীন যে নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছিল, তিনি সাংসদ হয়ে দিল্লি চলে যাওয়ার পরে, বামপন্থিরা ক্ষমতায় থাকাকালীন, আর এক পাও এগোয়নি।

ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে সাম্প্রদায়িক ভারতে পরিণত করে, সেই দেশকে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের দেশে পর্যবসিত করেছে হিন্দুত্ববাদীরা

গোটা ভারতে স্বাধীনতার পর থেকে মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থাটা ঠিক কি অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা যখন সাচার কমিটির প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমাদের সামনে উঠে এলো, তখন মনে হলো, রাজনৈতিক দলগুলো তো বটেই, আমরা যারা দলীয় রাজনীতির বাইরে বামপন্থি রাজনীতিতে বিশ্বাস করি, ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থাবান, সংখ্যালঘুর স্বাধিকারের জন্যে লড়, আমাদের সকলের গালেই যেন বিরাশি সিক্কার একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছেন বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার।

২০০৫ সালের ৯ মার্চ ড. মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে প্রথম ইউপিএ সরকার ৮৫০॥৩সি॥৩॥০৫ রাজনৈতিক নোটিফিকেশনের মাধ্যমে এই সাচার কমিটি তৈরি করে। মুসলমানদের আর্থ- সামাজিক অবস্থার ওপর সমীক্ষার দাবিতে সেই সময়ের বাম সাংসদ মহঃ সেলিমের সংসদের ভিতরে ও বাইরের ভূমিকাকে এই কমিটি তৈরির প্রেক্ষিতে বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। নীতি পঙ্গুত্ব ঘিরে মনমোহনের সরকারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, মনমোহন নিজে সংখ্যালঘু শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ছিলেন বলেই হয়তো সাচার কমিটি তৈরির মতো সাহসী পদক্ষেপ, যা নেহরু থেকে ইন্দিরা হয়ে রাজীব- কেউই দেখাতে পারেননি, তেমন পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের (১৮৫৭) নেতৃত্ব যেহেতু মুসলমান দিয়েছিল, তাই মুসলমানকে অর্থনৈতিক ভাবে ধ্বংস করা, যাতে তারা আর কোনো অবস্থাতেই রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে না পারে, এটাই ছিল ইংরেজদের অনুসৃত নীতি। এ নীতির বাইরে ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন গান্ধী, নেহেরু, আজাদেরা। কিন্তু কংগ্রেসের ভেতরকারই সাম্প্রদায়িক স্রোত কখনো চোরা ভাবে, কখনো বা সরাসরি তাদের বাঁধা দিয়েছে। প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে সামনে। ফলে ধীরে ধীরে শক্তি অর্জন করেছে হিন্দু-মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ।

মুসলমান সমাজকে অর্থনৈতিক ভাবে মাথা তুলতে দিও না, অর্থনৈতিক ভাবে মাথা তুললেই তারা মাটিতে পা দিয়ে শক্ত করে দাঁড়াবে। আর শক্ত হয়ে দাঁড়ালেই তারা শতাব্দী ধারার বঞ্চনার প্রতিবাদে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। মুসলমানের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটলে সংখ্যাগুরু হিন্দুরা ক্রমশ সবদিক থেকে পেছিয়ে পড়বে। তখন হিন্দুদের পাঠান, মোগল যুগের মতো মুসলমানদের পদানত হয়ে থাকতে হবে- ১৮৫৭-এর পর থেকে এটাই ছিল ব্রিটিশের একমাত্র রাজনীতি। সেই রাজনীতিরই প্রয়োগ ঘটাতে ব্রিটিশ অখন্ড ভারতে হিন্দু সাম্প্রদাযড়ক রাজনীতিকে আঠারো শতকের শেষ প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে উৎসাহিত করেছে।পরবর্তীতে যেমন উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে করতে শুরু করেছিল মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে।

আরএসএস-জামায়াতে ইসলাম, ব্রিটিশের দেখানো এই পথকেই সময়ের সঙ্গে তাল রেখে আরো ক্ষিপ্র করেছে। উগ্র করেছে। নগ্ন করেছে। ব্রিটিশের এই শয়তানি জওহরলালের মতো মানুষ বুঝেও প্রতিরোধের প্রশ্নে খুব ফলপ্রসূ কিছু করে উঠতে পারেননি তার নিজের দলেরই সাম্প্রদায়িক শিবিরের চাপে। ভুলে গেলে চলবে না যে, ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার খসড়াকারি রাশিবিজ্ঞানী প্রশান্তকুমার মহালনবীশ তার প্রকল্পটি সরকারি শিলমোহর পেয়ে প্রকাশ্যে আসবার পরে চিনতেই পারেননি। কারণ, আধুনিক, বিজ্ঞানমুখী, লিঙ্গ থেকে দলিত, সংখ্যালঘু- সব প্রশ্নে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার যে সংস্থান মহালনবিশের প্রকৃত মডেলে ছিল, সেটি হাওয়া হয়ে গিয়েছিল সরকারি সিলমোহরযুক্ত ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে। ফলে সাচার যে অনুসন্ধান করে সন্দর্ভ তৈরি করেছিলেন, তাকে প্রতিটি ভারতবাসীর অপরাধের ফলশ্রুতি বলেই চিহ্নিত করতে হয়।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ ]

back to top