এম এ কবীর
সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-৬৩)। জীবনে খাপ খাওয়াতে না-পারা মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মেধাবী ছিলেন। অল্প বয়সেই খ্যাতি পান লেখিকা হিসেবে। পিতাকে হারান যখন, মাত্র ৯ বছরে পা দিয়েছেন তখন। পরিবারের কাছ থেকে যে রক্ষণাবেক্ষণটা দরকার ছিল, সেটা আর পাননি। জন্ম তার আমেরিকায়, লেখাপড়া শেষ করে বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে এলেন। দেখা হলো তরুণ কবি টেড হিউজের সঙ্গে। বিয়ে করলেন। মনে হলো খুব খুশি তারা। দুজনই লিখছেন। ঘুরছেন নানা জায়গায়। একসময়ে টের পেলেন স্বামী টেড হিউজ অন্য এক নারীর প্রতি আসক্ত। বিয়ে ভেঙে দিয়ে দুটি সন্তান নিয়ে তিনি তাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন এবং আত্মহত্যার শেষ চেষ্টাটিতে সফল হয়ে প্রাণ হারালেন। তার মেয়েটির বয়স তখন দুই বছর, ছেলেটির বয়স মাত্র নয় মাস। স্ত্রীর আত্মহত্যার পর টেড হিউজ প্রচুর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সিলভিয়া এক বন্ধুর কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমার জীবন তো শেষ হয়ে গেছে; বাকিটা মরণোত্তর।’ সিলভিয়ার সমাধি প্রস্তরে লেখার জন্য টেড ভারতীয় সাহিত্য থেকে একটি চরণ উদ্ধৃতি করেছিলেন, যাতে বলা হয়েছে, ‘প্রজ্বলন্ত অগ্নিশিখার ভেতরেও সোনালি পদ্ম রোপণ করা সম্ভব’। তা সম্ভব বৈকি; কিন্তু আগুনের কারণে সে পদ্মফুলটি বাঁচে না। সিলভিয়া প্লাথ বাঁচেননি। তার সাহিত্যিক বন্ধুদের একজন বলেছেন, ‘সিলভিয়ার আত্মহনন ছিল সাড়া না-পাওয়া সাহায্যপ্রত্যাশী একটি আর্তনাদ।’ আর্তনাদে অবশ্য ধিক্কারও ছিল, ব্যবস্থার অমানবিকতার প্রতি।
ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৮২-১৯৪১)। সচ্ছল পরিবারেই জন্মেছিলেন। কিন্তু ভেতরে ছিল অস্থিরতা। তারা নিজস্ব একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন শিল্পচর্চাকে যারা খুবই গুরুত্ব দিতেন; কিন্তু শিল্প তো জীবনের বিকল্প হতে পারে না। ভার্জিনিয়া উলফ দুটি বিশ^যুদ্ধ দেখলেন, স্বচক্ষে দেখলেন যুদ্ধের বীভৎস ধ্বংসলীলা। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময়ে তাদের বসতবাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায় জার্মানদের বোমাবর্ষণে। তিনি ছিলেন পিতার যতটা নয় তার চেয়ে অধিক মায়ের, সেই মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন যখন তার বয়স মাত্র ১৩। সংসারের কর্তৃত্ব চলে গিয়েছিল সৎ দুই ভাইয়ের হাতে। ওই ভাইয়েরা কর্তৃত্ব করেছে, সংসার সামলিয়েছে, কিন্তু ভার্জিনিয়ার ওপর হয়রানি করা থেকেও বিরত থাকেনি। সমগ্র পিতৃতান্ত্রিকতার ওপরই তার মনে অসন্তোষ জন্মেছিল। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পাত্র হিসেবে তিনি খুবই যোগ্য ছিলেন; কিন্তু ভার্জিনিয়ার আগ্রহ ছিল না বিবাহে। তবু বিয়ে করেছেন এবং বিবাহিত জীবনে অসুখীও ছিলেন না; সাহিত্যিক খ্যাতিও পেয়েছেন, কিন্তু খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না বাইরের জগতের সঙ্গে। মনে হচ্ছিল বিশ^টা অত্যন্ত বিরূপ। ভার্জিনিয়া উলফ উপন্যাস লিখেছেন স্থায়ী মূল্যের। কিন্তু তার উপন্যাসে ঘটনা কম; অন্তর্গত জগতের বিশ্লেষণ অধিক। সেখানে মনের জগৎ অধিক মূল্যবান বহির্জগতের তুলনায়। সব উন্নয়নের মাঝখানে নারীর জীবনে নিজস্ব পরিসরের যে অভাব ঘটেছে, এই বোধ তার জন্য দুঃসহ মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আত্মহননে মুক্তি খুঁজলেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যে সংকট মোকাবিলা করছেন; তা দেখে রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিরা হাসাহাসি করতে পারেন। মহামারী কোভিড-১৯ চলাকালে যে বিধি জনগণকে মেনে চলতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন সে সময় নিজে তার অফিসে এক জমায়েত সম্পর্কে অসত্য বলেন। প্রধানমন্ত্রী এবং তার স্টাফরা এ ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এতে সাধারণ মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু বিধিনিষেধ আরোপে সাধারণ নাগরিকদের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল যার গুরুতর প্রভাব পড়েছিল জনজীবনে। তারা একত্রিত হতে পারছিলেন না, এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী আপনজনদের শেষ বিদায় জানানোরও সুযোগ পাননি। দিনটি ছিল প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন। দিনটি উদযাপনে প্রাধনমন্ত্রীর অফিস চত্বরে ক্ষণিকের জন্য তার অফিস স্টাফরা একত্রিত হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এবং তার স্ত্রী তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। বিষয়টি যখন জানাজানি হয়, তখন তিনি দাবি করেন, আইন ভঙ্গ করার মতো কোনো সমাবেশ হয়নি। এটি সম্ভবত ভুলবশত বরিস জনসন চিন্তা করে থাকবেন, এ জাতীয় তাৎক্ষণিক একত্র হওয়াটা সমাবেশ হতে পারে না।
কিন্তু প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, তিনি অন্যদের সঙ্গে যোগ দেয়াতে তা সমাবেশে রূপ নেয়। ভেতরে অফিসাররা তার জন্মদিন পালন উপলক্ষে যে পানীয় পানের ব্যবস্থা করেন; তাতে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। গণমাধ্যমকর্মী এবং পার্লামেন্ট সদস্যরা বিষয়টিকে আইনের বরখেলাপ হিসেবে দেখেন। প্রধানমন্ত্রীর পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অসত্য বলাকে তারা গুরুতর ভ্রান্তি হিসেবে গণ্য করেন। শুধু বিরোধীদলীয় সদস্যরাই নন, প্রধানমন্ত্রীর নিজের কনজারভেটিভ দলের কিছু সদস্যও বলছেন, তার পদত্যাগ করা উচিত। তাদের বিবেচনায় একজন আইনভঙ্গকারী এবং মিথ্যাবাদী যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তাকে দেশের জনগণের ভাগ্য নির্মাণে বিশ^াস করা যায় না। ব্রিটিশ গণমাধ্যম এবং পার্লামেন্ট সদস্যরা এ নিয়ে অত্যন্ত কঠোর মনোভাব পোষণ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একাধিকবার অকুণ্ঠচিত্তে উল্লেখিত ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা সত্ত্বেও তার অস্তিত্ব রক্ষার এ অগ্নিপরীক্ষা বড় বেশি কঠিন ও বিব্রতকর হয়ে উঠছে। সমাবেশের ব্যাপারটি পুলিশ তদন্ত করে দেখে। একই সঙ্গে এ সিদ্ধান্তে আসে যে, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কোভিড আইনভঙ্গের অপরাধে দায়ী। তাকে ৫০ পাউন্ড জরিমানা করা হলে তিনি ইতস্তত না করে সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধ করেন।
আইনভঙ্গের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সাজা দিতে পুলিশের মোটেও ভাবতে হয়নি যে, তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী। পুলিশের ভাবনায় ছিল আইন শুধুই আইন। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। তাই পুলিশ তাকে আইনভঙ্গকারী হিসেবে দেখতে ইতস্তত বোধ করেনি। পার্লামেন্ট সদস্যরা এখনো ফুঁসছেন। তারা বিষয়টির ইতি টানতে চাইছেন না। নিজেরাও বিষয়টি তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা নেবেন। বিষয়টির সঙ্গে যে নীতি-নৈতিকতার সম্পৃক্ততা তারা দেখতে পাচ্ছেন তা হলো, যে প্রধানমন্ত্রী আইন ভাঙ্গতে পারেন এবং অসত্য বলতে পারেন, জাতির ভাগ্য নির্ধারণের প্রশ্নে তাকে বিশ^াস করা যায় না। তিনি যদিও জাতীয় কোনো বিষয় সম্পর্কে মিথ্যা বলেননি। বড় ধরনের আইনও ভঙ্গ করেননি।
একজন মানুষের বয়স একই সময়ে একটিই হয়। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথাগতভাবে জন্ম নেয়ার পরপরই একটি শিশুকে এক বছর বয়সী হিসেবে ধরা হয়। পরের নববর্ষের দিন তার বয়সে যোগ হয় আরও একটি বছর। এর অর্থ, ডিসেম্বরে জন্ম নেয়া একটি শিশু মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দুই বছর বয়সী বলে বিবেচিত হবে! তবে বয়স নির্ধারণে কোরিয়ার এই প্রথাগত পদ্ধতি শিগগিরই পরিবর্তিত হতে পারে। কারণ দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল এই শতাব্দীপ্রাচীন গণনাপদ্ধতি বাতিল করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। প্রেসিডেন্টের অন্তর্র্বর্তীকালীন প্রস্তুতি কমিটির প্রধান লি ইয়াং-হো বলেছেন, আসন্ন নতুন প্রশাসন দক্ষিণ কোরিয়াকে বিশে^র অন্যান্য অংশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য বয়স গণনা করার পদ্ধতিকে প্রমিত করতে চাইছে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় মানুষের বয়স গণনা করার উপায় তিনটি। আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটি ১৯৬২ সাল থেকে বেশির ভাগ আইনি সংজ্ঞা এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির জন্মতারিখ ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক গণনাপদ্ধতি ব্যবহার করে। বয়স গণনা করার আরেকটি সরকারি উপায় রয়েছে, যেখানে শিশুরা ‘শূন্য’ বছর বয়সে জন্ম নিয়ে প্রতি বছর ১ জানুয়ারিতে তাদের বয়সের সঙ্গে এক বছর যোগ হয়। এর আওতায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জন্ম নেয়া একটি শিশুর বয়স ২০২২ সালের মধ্যেই দুই বছর হবে। যদিও সেই বছরের ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দুই বছর বয়সী হবে না। তারপর আছে ‘কোরীয় বয়স’ পদ্ধতি, যেটি সাধারণত সমাজের সবাই ব্যবহার করে। এতে প্রত্যেকে জন্মের সময়ই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক বছর বয়সী হয়। আর জন্মতারিখ যা-ই হোক, নববর্ষের দিনেই বয়স এক বছর বেড়ে যায়।
বয়স যাদের ভাটির দিকে তাদের প্রিয়জনরা তাদের আশ^স্ত করতে বলে থাকেন এজ ইজ জাস্ট অ্যা নাম্বার- ষাট হলেও যা, বাহাত্তর হলেও তাই; পঁচাত্তর হলেও যা, সাতানব্বইতেও একই কথা- বয়স শুধুই একটি সংখ্যা!
শরীরিক যত অসামর্থ্যতাই থাকুক ভাবতে ভালো লাগে- যে কোন বয়সে এজ ইজ জাস্ট এ নাম্বার। আবেগহীন অজৈবিক একটি সংখ্যামাত্র। বয়সের কথাটা এমনিতেই আসেনি, উঠিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার পিপল পাওয়ার পার্টির নেতা সে দেশের প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ইয়ুন সুক ইয়োল। নির্বাচন হয়েছে ৯ মার্চ ২০২২, আনুষ্ঠানিক ফলাফল জানা গেছে পরের দিন, নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা গ্রহণ করবেন ১০ মে ২০২২। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন গদিনসীন হয়েই কোরিয়ানদের বয়স গুনতিতে বিপ্লব সাধন করবেন। দক্ষিণ কোরিয়াতে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে নয়, সন্তান গর্ভধারণের সময় থেকে তার বয়স গণনা শুরু হয়। এই গণনার উৎস চীন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন কোন দেশ বয়স গণনার এই চীনা-কোরিয়ান পদ্ধতি অনুসরণ করে। পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে এতে সমস্যারই বেশি সৃষ্টি হয়। বয়সের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেলেও বয়স নির্ধারিত প্রতিযোগিতায় (যেমন অনূর্ধ্ব ষোলো, অনূর্ধ্ব আঠার ধরনের প্রতিযোগিতা) মার খেয়ে যায়। ইয়ুন সুক ইয়োল যুগ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ানদের ১৪ এপ্রিল ২০২২ তারিখের হিসাবে ৫ কোটি ১৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৩২ জন নাগরিকের বয়স ১ বছর করে কমে যাবে। আদেশ জারির পর থেকেই এক বছরের বাড়তি ভার থেকে দক্ষিণ কোরিয়া মুক্তি পাবে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা উডি অ্যালেন বলেছেন : আমি আমার কাজের মাধ্যমে অমরত্ব চাই না, না মরে অমরত্ব পেতে চাই।
দক্ষিণ কোরিয়াতে বয়স কমুক কিংবা যা আছে তাই থাকুক এতে মৃত্যুর কালের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। অ্যান্ডি রুনি লিখেছেন, আমি এতদিনে শিখেছি জীবনটা টয়লেট পেপার রোলের মতো, যতই শেষের কাছাকাছি আসবে ততই দ্রুত ফুরিয়ে যাবে।
জন মর্টিমার লিখেছেন, বয়স যাই হোক যথাসময়ে বিদায় নেয়াটাই উত্তম, বাড়তি তিন বছর নিয়ে হাসপাতালের জেরিয়াট্রিক ওয়ার্ডে কাটানোর কোনো মানে নেই। বিলি ক্রিস্টাল বলেছেন, যখন মানুষ নিজের পদক্ষেপগুলোর দিকে দৃষ্টি রাখার মতো জ্ঞানী হয়ে উঠে বুঝতে হবে মানুষটি যথেষ্ট বুড়ো হয়ে গেছে, তাকে একা কোথাও যেতে দেয়া ঠিক হবে না। পল ডান লিখেছেন : তুমি তোমার বিশ^াসের মতো তরুণ, তুমি তোমার সন্দেহের মতো বৃদ্ধ; তুমি তোমার আত্মবিশ^াসের মতো তরুণ, তোমার আতঙ্কের মতো বৃদ্ধ।
কোরিয়ান বয়স গণনার ফর্মুলাটি কৌতূহলোদ্দীপক। ঠিক কোন দিন সন্তানটিকে গর্ভধারণ করল, সে হিসাবও মায়ের পক্ষে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেয়া সম্ভব নয়। মায়ের গর্ভে ফুলটার্ম কাটিয়ে আসুক কি প্রিম্যাচুর বেবি হিসেবে জন্মগ্রহণ করুক- জন্মমাত্রই শিশুটির বয়স ধরা হয় এক বছর। যদি দক্ষিণ কোরিয়ার একটি শিশু ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করে থাকে তাহলে পরদিনই, অর্থাৎ ১ জানুয়ারি তার বয়স ধরা হয় দুই বছর। এর নাম ‘কোরিয়ান এজ’, পৃথিবী অভ্যস্ত ‘ইন্টারন্যাশনাল এজ’-এ। বয়স সংশোধনবাদীরা মনে করছেন কোরিয়ান বয়স ঝামেলার সৃষ্টি করছে, আন্তর্জাতিক বয়সের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে বিস্তর কাগজপত্র দাখিল করতে হচ্ছে, এতে খরচ যথেষ্ট হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট যে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন তা প্রশংসনীয়।
কিন্তু সবাই কি প্রশংসা করছেন? সমীক্ষা বলছে প্রতি ১০ জনে তিনজন বিরোধিতা করছেন। তারা মনে করছেন এ সংশোধনী কোরিয়ান সংস্কৃতির সঙ্গে বিশ^াসঘাতকতা। আন্তর্জাতিক বয়সের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার কোরিয়ান প্রয়াস অনেকদিনের। ২০১৯ এবং ২০২১-এ দুটি বিল উপস্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে তা সমর্থিত হয়ে আইন হিসেবে স্বাক্ষরিত হয়নি। চীন, জাপান, কোরিয়া কিংবা ভিয়েতনামে বয়সের তাগিদটা সবচেয়ে বেশি আসে অ্যালকোহলসেবীদের কাছ থেকে। ১৮ না হলে শুঁড়িখানা থেকে ফিরে আসতে হবে। বয়স ১ বছর কমিয়ে দিলে এখনকার সব অষ্টাদশী সপ্তদশী হয়ে যাবে। যুবকও পিছিয়ে যাবে এক বছর। শুঁড়িখানার মালিকরা তখন মদ্যপানের বয়স ১৭-তে নামিয়ে আনার দাবি জানাবে কিনা তাও ভাবনার বিষয়। প্রেসিডেন্ট ইলেক্টের এই বয়স সংস্কারকে পশ্চিমের বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘স্মার্ট মুভ’।
বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত মুরব্বি প্রজন্মের দুই ধরনের বয়স। প্রকৃত বয়স ও কাগুজে বয়স। প্রকৃত বয়স মানে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন থেকে দিন, মাস, বছর গুনে বয়স নির্ধারণ। ৭ ডিসেম্বর ২০০৪ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের বাধ্যতামূলক আইন ‘দ্য বার্থস অ্যান্ড ডেথ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ২০০৪’ জারি হয়। এটি ২০০৪ সালের ২৯ নম্বর আইন। ২০১৬ সাল থেকে আমরা স্মার্ট এনআইডি কার্ডও ধারণ করছি। রমজান আলী যখন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন তখন প্রধান শিক্ষক তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতায় জন্মতারিখ লিখে দিলেন ১ জানুয়ারি। তার ক্লাসমেটদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের জন্মদিন ১ জানুয়ারি। বিভিন্ন স্কুলে পড়ার কারণে রমজান আলীর ভাইবোনদের কারও কারও বয়সের ওপর যে সার্জারি পরিচালিত হয়েছে তাতে কনিষ্ঠ একজন বোন জ্যেষ্ঠকে শুধু ডিঙ্গায়নি সহোদর দুই বোনের বয়সের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন কি চার মাস। আবার অনূর্ধ্ব ষোলো দলে উনিশ-কুড়ি বছরের খেলোয়াড়ও ঠাঁই পেয়েছে।
মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এ বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম। ২০২১ সালে এই র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম। সাংবাদিকদের প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্য অনুসারে, চলতি বছর বাংলাদেশের পয়েন্ট হলো ৩৬ দশমিক ৬৩। গত বছর যা ছিল ৫০ দশমিক ২৯ পয়েন্ট। গণমাধ্যমের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪০তম। অর্থনৈতিক সুরক্ষা সূচকে অবস্থান ১৩৮তম। আইনগত নিয়ন্ত্রণ সূচকে ১৪৮তম এবং সামাজিক সুরক্ষা সূচকে অবস্থান ১৪৯তম। বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থান এসব সূচকের তুলনায় বেশ খানিকটা নিচে। চলতি বছর বৈশি^ক গণমাধ্যম স্বাধীনতা র্যাংকিংয়ে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ নরওয়ে। দেশটির অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ডেনমার্ক। সুইডেন আগের বছরের মতোই এবারও তৃতীয় স্থান দখল করে রেখেছে। ১৮০তম দেশ হিসেবে তালিকার সবচেয়ে নিচে রয়েছে উত্তর কোরিয়া।
[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]
এম এ কবীর
বুধবার, ১১ মে ২০২২
সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-৬৩)। জীবনে খাপ খাওয়াতে না-পারা মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মেধাবী ছিলেন। অল্প বয়সেই খ্যাতি পান লেখিকা হিসেবে। পিতাকে হারান যখন, মাত্র ৯ বছরে পা দিয়েছেন তখন। পরিবারের কাছ থেকে যে রক্ষণাবেক্ষণটা দরকার ছিল, সেটা আর পাননি। জন্ম তার আমেরিকায়, লেখাপড়া শেষ করে বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে এলেন। দেখা হলো তরুণ কবি টেড হিউজের সঙ্গে। বিয়ে করলেন। মনে হলো খুব খুশি তারা। দুজনই লিখছেন। ঘুরছেন নানা জায়গায়। একসময়ে টের পেলেন স্বামী টেড হিউজ অন্য এক নারীর প্রতি আসক্ত। বিয়ে ভেঙে দিয়ে দুটি সন্তান নিয়ে তিনি তাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন এবং আত্মহত্যার শেষ চেষ্টাটিতে সফল হয়ে প্রাণ হারালেন। তার মেয়েটির বয়স তখন দুই বছর, ছেলেটির বয়স মাত্র নয় মাস। স্ত্রীর আত্মহত্যার পর টেড হিউজ প্রচুর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সিলভিয়া এক বন্ধুর কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমার জীবন তো শেষ হয়ে গেছে; বাকিটা মরণোত্তর।’ সিলভিয়ার সমাধি প্রস্তরে লেখার জন্য টেড ভারতীয় সাহিত্য থেকে একটি চরণ উদ্ধৃতি করেছিলেন, যাতে বলা হয়েছে, ‘প্রজ্বলন্ত অগ্নিশিখার ভেতরেও সোনালি পদ্ম রোপণ করা সম্ভব’। তা সম্ভব বৈকি; কিন্তু আগুনের কারণে সে পদ্মফুলটি বাঁচে না। সিলভিয়া প্লাথ বাঁচেননি। তার সাহিত্যিক বন্ধুদের একজন বলেছেন, ‘সিলভিয়ার আত্মহনন ছিল সাড়া না-পাওয়া সাহায্যপ্রত্যাশী একটি আর্তনাদ।’ আর্তনাদে অবশ্য ধিক্কারও ছিল, ব্যবস্থার অমানবিকতার প্রতি।
ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৮২-১৯৪১)। সচ্ছল পরিবারেই জন্মেছিলেন। কিন্তু ভেতরে ছিল অস্থিরতা। তারা নিজস্ব একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন শিল্পচর্চাকে যারা খুবই গুরুত্ব দিতেন; কিন্তু শিল্প তো জীবনের বিকল্প হতে পারে না। ভার্জিনিয়া উলফ দুটি বিশ^যুদ্ধ দেখলেন, স্বচক্ষে দেখলেন যুদ্ধের বীভৎস ধ্বংসলীলা। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময়ে তাদের বসতবাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায় জার্মানদের বোমাবর্ষণে। তিনি ছিলেন পিতার যতটা নয় তার চেয়ে অধিক মায়ের, সেই মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন যখন তার বয়স মাত্র ১৩। সংসারের কর্তৃত্ব চলে গিয়েছিল সৎ দুই ভাইয়ের হাতে। ওই ভাইয়েরা কর্তৃত্ব করেছে, সংসার সামলিয়েছে, কিন্তু ভার্জিনিয়ার ওপর হয়রানি করা থেকেও বিরত থাকেনি। সমগ্র পিতৃতান্ত্রিকতার ওপরই তার মনে অসন্তোষ জন্মেছিল। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পাত্র হিসেবে তিনি খুবই যোগ্য ছিলেন; কিন্তু ভার্জিনিয়ার আগ্রহ ছিল না বিবাহে। তবু বিয়ে করেছেন এবং বিবাহিত জীবনে অসুখীও ছিলেন না; সাহিত্যিক খ্যাতিও পেয়েছেন, কিন্তু খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না বাইরের জগতের সঙ্গে। মনে হচ্ছিল বিশ^টা অত্যন্ত বিরূপ। ভার্জিনিয়া উলফ উপন্যাস লিখেছেন স্থায়ী মূল্যের। কিন্তু তার উপন্যাসে ঘটনা কম; অন্তর্গত জগতের বিশ্লেষণ অধিক। সেখানে মনের জগৎ অধিক মূল্যবান বহির্জগতের তুলনায়। সব উন্নয়নের মাঝখানে নারীর জীবনে নিজস্ব পরিসরের যে অভাব ঘটেছে, এই বোধ তার জন্য দুঃসহ মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আত্মহননে মুক্তি খুঁজলেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যে সংকট মোকাবিলা করছেন; তা দেখে রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিরা হাসাহাসি করতে পারেন। মহামারী কোভিড-১৯ চলাকালে যে বিধি জনগণকে মেনে চলতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন সে সময় নিজে তার অফিসে এক জমায়েত সম্পর্কে অসত্য বলেন। প্রধানমন্ত্রী এবং তার স্টাফরা এ ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এতে সাধারণ মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু বিধিনিষেধ আরোপে সাধারণ নাগরিকদের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল যার গুরুতর প্রভাব পড়েছিল জনজীবনে। তারা একত্রিত হতে পারছিলেন না, এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী আপনজনদের শেষ বিদায় জানানোরও সুযোগ পাননি। দিনটি ছিল প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন। দিনটি উদযাপনে প্রাধনমন্ত্রীর অফিস চত্বরে ক্ষণিকের জন্য তার অফিস স্টাফরা একত্রিত হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এবং তার স্ত্রী তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। বিষয়টি যখন জানাজানি হয়, তখন তিনি দাবি করেন, আইন ভঙ্গ করার মতো কোনো সমাবেশ হয়নি। এটি সম্ভবত ভুলবশত বরিস জনসন চিন্তা করে থাকবেন, এ জাতীয় তাৎক্ষণিক একত্র হওয়াটা সমাবেশ হতে পারে না।
কিন্তু প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, তিনি অন্যদের সঙ্গে যোগ দেয়াতে তা সমাবেশে রূপ নেয়। ভেতরে অফিসাররা তার জন্মদিন পালন উপলক্ষে যে পানীয় পানের ব্যবস্থা করেন; তাতে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। গণমাধ্যমকর্মী এবং পার্লামেন্ট সদস্যরা বিষয়টিকে আইনের বরখেলাপ হিসেবে দেখেন। প্রধানমন্ত্রীর পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অসত্য বলাকে তারা গুরুতর ভ্রান্তি হিসেবে গণ্য করেন। শুধু বিরোধীদলীয় সদস্যরাই নন, প্রধানমন্ত্রীর নিজের কনজারভেটিভ দলের কিছু সদস্যও বলছেন, তার পদত্যাগ করা উচিত। তাদের বিবেচনায় একজন আইনভঙ্গকারী এবং মিথ্যাবাদী যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তাকে দেশের জনগণের ভাগ্য নির্মাণে বিশ^াস করা যায় না। ব্রিটিশ গণমাধ্যম এবং পার্লামেন্ট সদস্যরা এ নিয়ে অত্যন্ত কঠোর মনোভাব পোষণ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একাধিকবার অকুণ্ঠচিত্তে উল্লেখিত ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা সত্ত্বেও তার অস্তিত্ব রক্ষার এ অগ্নিপরীক্ষা বড় বেশি কঠিন ও বিব্রতকর হয়ে উঠছে। সমাবেশের ব্যাপারটি পুলিশ তদন্ত করে দেখে। একই সঙ্গে এ সিদ্ধান্তে আসে যে, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কোভিড আইনভঙ্গের অপরাধে দায়ী। তাকে ৫০ পাউন্ড জরিমানা করা হলে তিনি ইতস্তত না করে সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধ করেন।
আইনভঙ্গের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সাজা দিতে পুলিশের মোটেও ভাবতে হয়নি যে, তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী। পুলিশের ভাবনায় ছিল আইন শুধুই আইন। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। তাই পুলিশ তাকে আইনভঙ্গকারী হিসেবে দেখতে ইতস্তত বোধ করেনি। পার্লামেন্ট সদস্যরা এখনো ফুঁসছেন। তারা বিষয়টির ইতি টানতে চাইছেন না। নিজেরাও বিষয়টি তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা নেবেন। বিষয়টির সঙ্গে যে নীতি-নৈতিকতার সম্পৃক্ততা তারা দেখতে পাচ্ছেন তা হলো, যে প্রধানমন্ত্রী আইন ভাঙ্গতে পারেন এবং অসত্য বলতে পারেন, জাতির ভাগ্য নির্ধারণের প্রশ্নে তাকে বিশ^াস করা যায় না। তিনি যদিও জাতীয় কোনো বিষয় সম্পর্কে মিথ্যা বলেননি। বড় ধরনের আইনও ভঙ্গ করেননি।
একজন মানুষের বয়স একই সময়ে একটিই হয়। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথাগতভাবে জন্ম নেয়ার পরপরই একটি শিশুকে এক বছর বয়সী হিসেবে ধরা হয়। পরের নববর্ষের দিন তার বয়সে যোগ হয় আরও একটি বছর। এর অর্থ, ডিসেম্বরে জন্ম নেয়া একটি শিশু মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দুই বছর বয়সী বলে বিবেচিত হবে! তবে বয়স নির্ধারণে কোরিয়ার এই প্রথাগত পদ্ধতি শিগগিরই পরিবর্তিত হতে পারে। কারণ দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল এই শতাব্দীপ্রাচীন গণনাপদ্ধতি বাতিল করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। প্রেসিডেন্টের অন্তর্র্বর্তীকালীন প্রস্তুতি কমিটির প্রধান লি ইয়াং-হো বলেছেন, আসন্ন নতুন প্রশাসন দক্ষিণ কোরিয়াকে বিশে^র অন্যান্য অংশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য বয়স গণনা করার পদ্ধতিকে প্রমিত করতে চাইছে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় মানুষের বয়স গণনা করার উপায় তিনটি। আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটি ১৯৬২ সাল থেকে বেশির ভাগ আইনি সংজ্ঞা এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির জন্মতারিখ ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক গণনাপদ্ধতি ব্যবহার করে। বয়স গণনা করার আরেকটি সরকারি উপায় রয়েছে, যেখানে শিশুরা ‘শূন্য’ বছর বয়সে জন্ম নিয়ে প্রতি বছর ১ জানুয়ারিতে তাদের বয়সের সঙ্গে এক বছর যোগ হয়। এর আওতায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জন্ম নেয়া একটি শিশুর বয়স ২০২২ সালের মধ্যেই দুই বছর হবে। যদিও সেই বছরের ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দুই বছর বয়সী হবে না। তারপর আছে ‘কোরীয় বয়স’ পদ্ধতি, যেটি সাধারণত সমাজের সবাই ব্যবহার করে। এতে প্রত্যেকে জন্মের সময়ই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক বছর বয়সী হয়। আর জন্মতারিখ যা-ই হোক, নববর্ষের দিনেই বয়স এক বছর বেড়ে যায়।
বয়স যাদের ভাটির দিকে তাদের প্রিয়জনরা তাদের আশ^স্ত করতে বলে থাকেন এজ ইজ জাস্ট অ্যা নাম্বার- ষাট হলেও যা, বাহাত্তর হলেও তাই; পঁচাত্তর হলেও যা, সাতানব্বইতেও একই কথা- বয়স শুধুই একটি সংখ্যা!
শরীরিক যত অসামর্থ্যতাই থাকুক ভাবতে ভালো লাগে- যে কোন বয়সে এজ ইজ জাস্ট এ নাম্বার। আবেগহীন অজৈবিক একটি সংখ্যামাত্র। বয়সের কথাটা এমনিতেই আসেনি, উঠিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার পিপল পাওয়ার পার্টির নেতা সে দেশের প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ইয়ুন সুক ইয়োল। নির্বাচন হয়েছে ৯ মার্চ ২০২২, আনুষ্ঠানিক ফলাফল জানা গেছে পরের দিন, নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা গ্রহণ করবেন ১০ মে ২০২২। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন গদিনসীন হয়েই কোরিয়ানদের বয়স গুনতিতে বিপ্লব সাধন করবেন। দক্ষিণ কোরিয়াতে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে নয়, সন্তান গর্ভধারণের সময় থেকে তার বয়স গণনা শুরু হয়। এই গণনার উৎস চীন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন কোন দেশ বয়স গণনার এই চীনা-কোরিয়ান পদ্ধতি অনুসরণ করে। পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে এতে সমস্যারই বেশি সৃষ্টি হয়। বয়সের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেলেও বয়স নির্ধারিত প্রতিযোগিতায় (যেমন অনূর্ধ্ব ষোলো, অনূর্ধ্ব আঠার ধরনের প্রতিযোগিতা) মার খেয়ে যায়। ইয়ুন সুক ইয়োল যুগ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ানদের ১৪ এপ্রিল ২০২২ তারিখের হিসাবে ৫ কোটি ১৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৩২ জন নাগরিকের বয়স ১ বছর করে কমে যাবে। আদেশ জারির পর থেকেই এক বছরের বাড়তি ভার থেকে দক্ষিণ কোরিয়া মুক্তি পাবে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা উডি অ্যালেন বলেছেন : আমি আমার কাজের মাধ্যমে অমরত্ব চাই না, না মরে অমরত্ব পেতে চাই।
দক্ষিণ কোরিয়াতে বয়স কমুক কিংবা যা আছে তাই থাকুক এতে মৃত্যুর কালের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। অ্যান্ডি রুনি লিখেছেন, আমি এতদিনে শিখেছি জীবনটা টয়লেট পেপার রোলের মতো, যতই শেষের কাছাকাছি আসবে ততই দ্রুত ফুরিয়ে যাবে।
জন মর্টিমার লিখেছেন, বয়স যাই হোক যথাসময়ে বিদায় নেয়াটাই উত্তম, বাড়তি তিন বছর নিয়ে হাসপাতালের জেরিয়াট্রিক ওয়ার্ডে কাটানোর কোনো মানে নেই। বিলি ক্রিস্টাল বলেছেন, যখন মানুষ নিজের পদক্ষেপগুলোর দিকে দৃষ্টি রাখার মতো জ্ঞানী হয়ে উঠে বুঝতে হবে মানুষটি যথেষ্ট বুড়ো হয়ে গেছে, তাকে একা কোথাও যেতে দেয়া ঠিক হবে না। পল ডান লিখেছেন : তুমি তোমার বিশ^াসের মতো তরুণ, তুমি তোমার সন্দেহের মতো বৃদ্ধ; তুমি তোমার আত্মবিশ^াসের মতো তরুণ, তোমার আতঙ্কের মতো বৃদ্ধ।
কোরিয়ান বয়স গণনার ফর্মুলাটি কৌতূহলোদ্দীপক। ঠিক কোন দিন সন্তানটিকে গর্ভধারণ করল, সে হিসাবও মায়ের পক্ষে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেয়া সম্ভব নয়। মায়ের গর্ভে ফুলটার্ম কাটিয়ে আসুক কি প্রিম্যাচুর বেবি হিসেবে জন্মগ্রহণ করুক- জন্মমাত্রই শিশুটির বয়স ধরা হয় এক বছর। যদি দক্ষিণ কোরিয়ার একটি শিশু ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করে থাকে তাহলে পরদিনই, অর্থাৎ ১ জানুয়ারি তার বয়স ধরা হয় দুই বছর। এর নাম ‘কোরিয়ান এজ’, পৃথিবী অভ্যস্ত ‘ইন্টারন্যাশনাল এজ’-এ। বয়স সংশোধনবাদীরা মনে করছেন কোরিয়ান বয়স ঝামেলার সৃষ্টি করছে, আন্তর্জাতিক বয়সের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে বিস্তর কাগজপত্র দাখিল করতে হচ্ছে, এতে খরচ যথেষ্ট হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট যে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন তা প্রশংসনীয়।
কিন্তু সবাই কি প্রশংসা করছেন? সমীক্ষা বলছে প্রতি ১০ জনে তিনজন বিরোধিতা করছেন। তারা মনে করছেন এ সংশোধনী কোরিয়ান সংস্কৃতির সঙ্গে বিশ^াসঘাতকতা। আন্তর্জাতিক বয়সের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার কোরিয়ান প্রয়াস অনেকদিনের। ২০১৯ এবং ২০২১-এ দুটি বিল উপস্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে তা সমর্থিত হয়ে আইন হিসেবে স্বাক্ষরিত হয়নি। চীন, জাপান, কোরিয়া কিংবা ভিয়েতনামে বয়সের তাগিদটা সবচেয়ে বেশি আসে অ্যালকোহলসেবীদের কাছ থেকে। ১৮ না হলে শুঁড়িখানা থেকে ফিরে আসতে হবে। বয়স ১ বছর কমিয়ে দিলে এখনকার সব অষ্টাদশী সপ্তদশী হয়ে যাবে। যুবকও পিছিয়ে যাবে এক বছর। শুঁড়িখানার মালিকরা তখন মদ্যপানের বয়স ১৭-তে নামিয়ে আনার দাবি জানাবে কিনা তাও ভাবনার বিষয়। প্রেসিডেন্ট ইলেক্টের এই বয়স সংস্কারকে পশ্চিমের বিশেষজ্ঞরা বলছেন ‘স্মার্ট মুভ’।
বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত মুরব্বি প্রজন্মের দুই ধরনের বয়স। প্রকৃত বয়স ও কাগুজে বয়স। প্রকৃত বয়স মানে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন থেকে দিন, মাস, বছর গুনে বয়স নির্ধারণ। ৭ ডিসেম্বর ২০০৪ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের বাধ্যতামূলক আইন ‘দ্য বার্থস অ্যান্ড ডেথ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ২০০৪’ জারি হয়। এটি ২০০৪ সালের ২৯ নম্বর আইন। ২০১৬ সাল থেকে আমরা স্মার্ট এনআইডি কার্ডও ধারণ করছি। রমজান আলী যখন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন তখন প্রধান শিক্ষক তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতায় জন্মতারিখ লিখে দিলেন ১ জানুয়ারি। তার ক্লাসমেটদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের জন্মদিন ১ জানুয়ারি। বিভিন্ন স্কুলে পড়ার কারণে রমজান আলীর ভাইবোনদের কারও কারও বয়সের ওপর যে সার্জারি পরিচালিত হয়েছে তাতে কনিষ্ঠ একজন বোন জ্যেষ্ঠকে শুধু ডিঙ্গায়নি সহোদর দুই বোনের বয়সের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন কি চার মাস। আবার অনূর্ধ্ব ষোলো দলে উনিশ-কুড়ি বছরের খেলোয়াড়ও ঠাঁই পেয়েছে।
মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এ বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম। ২০২১ সালে এই র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম। সাংবাদিকদের প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্য অনুসারে, চলতি বছর বাংলাদেশের পয়েন্ট হলো ৩৬ দশমিক ৬৩। গত বছর যা ছিল ৫০ দশমিক ২৯ পয়েন্ট। গণমাধ্যমের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪০তম। অর্থনৈতিক সুরক্ষা সূচকে অবস্থান ১৩৮তম। আইনগত নিয়ন্ত্রণ সূচকে ১৪৮তম এবং সামাজিক সুরক্ষা সূচকে অবস্থান ১৪৯তম। বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থান এসব সূচকের তুলনায় বেশ খানিকটা নিচে। চলতি বছর বৈশি^ক গণমাধ্যম স্বাধীনতা র্যাংকিংয়ে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ নরওয়ে। দেশটির অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ডেনমার্ক। সুইডেন আগের বছরের মতোই এবারও তৃতীয় স্থান দখল করে রেখেছে। ১৮০তম দেশ হিসেবে তালিকার সবচেয়ে নিচে রয়েছে উত্তর কোরিয়া।
[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]