রায়হান আলী
আধুনিক জীবন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর। এই প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাপনে অনেকাংশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইবার অপরাধ। দিন দিন বেড়েই চলছে এ অপরাধ। সাইবার অপরাধ হলো মূলত ইন্টারনেটভিত্তিক অপরাধ। সাইবার অপরাধ সম্পর্কিত বিশ্লেষক দেবারতি হালদার ও কে জয়শংকর সাইবার অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- ‘আধুনিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক, যেমন ইন্টারনেট (চ্যাট রুম, ই-মেইল, নোটিস বোর্ড ও গ্রুপ) এবং মোবাইল ফোন (এসএমএস কিংবা এমএমএস) ব্যবহার করে, অপরাধমূলক অভিপ্রায়ে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে সম্মানহানি, কিংবা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি বা ক্ষতির কারণ হওয়া’। এ ধরনের অপরাধ একটি জাতির নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে।
ইন্টারনেট সেবা এখন অনেক প্রেক্ষাপটে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ইন্টারনেট শিশু-কিশোর থেকে বয়োবৃদ্ধরাও ব্যবহার করে থাকে। বিআইজিডির গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা অন্যান্য বয়সের ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং এ বিষয়ে তাদের দক্ষতাও আছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। গবেষণা বলছে, একজন মানুষ দিনে অন্তত ২ হাজার ৬৬৪ বার তার নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রিণ স্পর্শ করে। আর এই স্ক্রিণ স্পর্শ করার কারণ ফোনের নোটিফিকেশন চেক, কোন এসএমএস আসলো কিনা ইত্যাদির দিকে মনোনিবেশ করে। অল্পবয়সীরা লেখাপড়ার প্রতি মনোনিবেশ না করে দিনে দিনে ঝুঁকে যাচ্ছে ইন্টারনেটের অপব্যবহারে।
বর্তমানে যারা দ্রুত ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে তাদের বয়স ১৪ থেকে ২৪ বছর অর্থাৎ তরুণ সমাজ। এদের মধ্যে প্রায় ৭৭ ভাগ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, এবং পৃথিবীতে প্রায় ২২০ কোটি মানুষ ভিডিও গেম খেলে। বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ২৭ লাখ, যাদের মধ্যে ১০ কোটি ৩২ লাখ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। এই বিশাল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতিদিন শুধু পাবজী নামক ভিডিও গেম খেলে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। ইন্টারনেটের এমন ব্যবহার শুধু শিশু-কিশোররা নয় সব বয়সীরাই ব্যবহার করছে। এমন ইন্টারনেট ব্যবহারে অসতর্কতার কারণে সাইবার অপরাধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। অনায়াসে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী কারও পোস্টে লাইক, কমেন্ট কিংবা শেয়ার করে বসে। কিন্তু অনেকেই সঠিক বিচার বিশ্লেষণ না করেই এসব করছে। এছাড়া অনেকে না বুঝে ইউটিউব, ইনস্ট্রাগ্রাম, হোয়াটস আপ, ইমোতে নানা প্রকার ভিডিও আপলোড, লাইক, কমেন্ট, ম্যাসেজিং, শেয়ার করে বসে। এ ছাড়া অনেকে ইচ্ছা করে কিংবা কারও সঙ্গে মজা করে অন্যের পরিচয় প্রতারণা করে বা ছদ্মবেশ ধারণ করে ফেসবুকে ফেইক আইডি তৈরি করে প্রতারণা করছে।
পরবর্তী সময়ে হয়তবা দেখা যায় এর ফলে কারও বিরুদ্ধে মানহানি, কটূক্তি কিংবা অপপ্রচারের শামিল হয়ে গেছে। ফেসে গেল সাইবার অপরাধে। অনেকে সরল বিশ্বাস বা অজান্তেই সাইবার অপরাধে জড়াচ্ছে। বর্তমানে হ্যাকিং, কপিরাইট লঙ্ঘন, শিশু পর্নোগ্রাফি, অনলাইনভিত্তিক প্রতারণার মতো অপরাধগুলো উচ্চমাত্রায় বাড়ছে। আন্তর্জাতিকভাবে, রাষ্ট্রীয় বা অ-রাষ্ট্রীয় সত্তা কর্তৃক গুপ্তচরবৃত্তি, আর্থিক প্রতারণা, আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, কিংবা অন্তত একটি রাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত এরূপ বিষয়ে হস্তক্ষেপ জনিত সাইবার অপরাধকে সাইবার যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
ক্রাইম সার্ভে অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাজ্যে ২০১৯ সালে ৩৮ লাখ অনলাইন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, যা দেশটিতে মোট অপরাধের এক-তৃতীয়াংশ। ২০১৭ সালে দেশটি এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ শুরু করার পর থেকে প্রতিবছর সাইবার জালিয়াতির ঘটনা বাড়তে দেখেছে। সেখানে প্রায় ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এ জালিয়াতির শিকার হন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৫ শতাংশের বেশি মানুষ এক হাজার ডলারের বেশি অর্থ খুইয়েছেন। যুক্তরাজ্যের মতোই অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের। গত বছর দেশটিতে ইন্টারনেটে প্রতারণা ৬৯ শতাংশ বেড়েছে। দেশটিতে ইন্টারনেটে প্রতারণায় গত বছর মোট লোকসান হয়েছে ৪২০ কোটি ডলার, যা ২০১৭ সালের তুলনায় তিন গুণ বেশি।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা হু হু করে বেড়েই চলছে। এ অপরাধের রাশ টেনে ধরতে সরকার নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। প্রথমে সাইবার অপরাধের বিচার করার জন্য একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল ঢাকাতে ছিল। পরবর্তীতে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের সুবিধার্থে সরকার ২০২১ সালে আরো ৭টি সাইবার ট্রাইব্যুনাল যুক্ত করে। তাতে মোট সাইবার ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮টি। আর বর্তমানে বিভাগীয় শহরে অবস্থিত এই আটটি ট্রাইব্যুনাল হচ্ছে-ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনাল, চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনাল, রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনাল, খুলনা সাইবার ট্রাইব্যুনাল, বরিশাল সাইবার ট্রাইব্যুনাল, সিলেট সাইবার ট্রাইব্যুনাল, রংপুর সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও ময়মনসিংহ সাইবার ট্রাইব্যুনাল।
এই ট্রাইব্যুনালে বিচার্য অপরাধসমূহ সাইবার অপরাধসংক্রান্ত আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত-২০১৩)-এ সংযোজিত ধারায় ২০১৮ সালের আগে বিচার করা হতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত-২০১৩)-এর কিছু ধারার সংশোধন ও বাতিল সাপেক্ষে
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ করা হয়। আর সে মোতাবেক ট্রাইব্যুনালগুলোতে সাইবার অপরাধের বিচার কাজ চলছে। নতুন এই আইনে অপরাধের শাস্তি অনধিক ১০ বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি কার্যকর হয়েছে ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর। এর পরের তিন বছরে এ আইনে মামলা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৬৫৭টি। ‘২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন থানা থেকে বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোট মামলা এসেছে দুই হাজার ৬৪২টি। প্রতি বছরই মামলার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৯ সালে ৭২১টি, ২০১৮ সালে ৬৭৬টি, ২০১৭ সালে ৫৬৮টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৪ সালে ৩৩টি এবং ২০১৩ সালে এসেছে ৩টি মামলা। চলতি বছরে ২৫৬টি মামলা হয়েছে।
এখন পর্ন্ত সরাসরি ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা হয়েছে ১ হাজার ৮২টি মামলা। এর মধ্যে ৪৪৭টি মামলায় বিভিন্ন সংস্থাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। বাকি ৬৩৫টির প্রয়োজনীয় উপাদান না থাকায় আদালত খারিজ করে দেন। ৪৪৭টির মধ্যে ১৫০টি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে আদালতে জমা হয়েছে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে সব মিলিয়ে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দুই হাজার ২১টি।
সাইবার অপরাধ একটি দেশ ও জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। সাইবার অপরাধের রাশ টেনে ধরতে সরকারকে আরও উদ্যোগ বাড়াতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও আরও সচেতন হতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহার যখন আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় তখন এই ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের আরও বেশি জানতে হবে।
[লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, খুলনা]
রায়হান আলী
রোববার, ১৫ মে ২০২২
আধুনিক জীবন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর। এই প্রযুক্তিনির্ভর জীবনযাপনে অনেকাংশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইবার অপরাধ। দিন দিন বেড়েই চলছে এ অপরাধ। সাইবার অপরাধ হলো মূলত ইন্টারনেটভিত্তিক অপরাধ। সাইবার অপরাধ সম্পর্কিত বিশ্লেষক দেবারতি হালদার ও কে জয়শংকর সাইবার অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- ‘আধুনিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক, যেমন ইন্টারনেট (চ্যাট রুম, ই-মেইল, নোটিস বোর্ড ও গ্রুপ) এবং মোবাইল ফোন (এসএমএস কিংবা এমএমএস) ব্যবহার করে, অপরাধমূলক অভিপ্রায়ে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে সম্মানহানি, কিংবা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি বা ক্ষতির কারণ হওয়া’। এ ধরনের অপরাধ একটি জাতির নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে।
ইন্টারনেট সেবা এখন অনেক প্রেক্ষাপটে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ইন্টারনেট শিশু-কিশোর থেকে বয়োবৃদ্ধরাও ব্যবহার করে থাকে। বিআইজিডির গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা অন্যান্য বয়সের ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং এ বিষয়ে তাদের দক্ষতাও আছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। গবেষণা বলছে, একজন মানুষ দিনে অন্তত ২ হাজার ৬৬৪ বার তার নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রিণ স্পর্শ করে। আর এই স্ক্রিণ স্পর্শ করার কারণ ফোনের নোটিফিকেশন চেক, কোন এসএমএস আসলো কিনা ইত্যাদির দিকে মনোনিবেশ করে। অল্পবয়সীরা লেখাপড়ার প্রতি মনোনিবেশ না করে দিনে দিনে ঝুঁকে যাচ্ছে ইন্টারনেটের অপব্যবহারে।
বর্তমানে যারা দ্রুত ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে তাদের বয়স ১৪ থেকে ২৪ বছর অর্থাৎ তরুণ সমাজ। এদের মধ্যে প্রায় ৭৭ ভাগ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, এবং পৃথিবীতে প্রায় ২২০ কোটি মানুষ ভিডিও গেম খেলে। বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ২৭ লাখ, যাদের মধ্যে ১০ কোটি ৩২ লাখ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। এই বিশাল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতিদিন শুধু পাবজী নামক ভিডিও গেম খেলে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। ইন্টারনেটের এমন ব্যবহার শুধু শিশু-কিশোররা নয় সব বয়সীরাই ব্যবহার করছে। এমন ইন্টারনেট ব্যবহারে অসতর্কতার কারণে সাইবার অপরাধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। অনায়াসে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী কারও পোস্টে লাইক, কমেন্ট কিংবা শেয়ার করে বসে। কিন্তু অনেকেই সঠিক বিচার বিশ্লেষণ না করেই এসব করছে। এছাড়া অনেকে না বুঝে ইউটিউব, ইনস্ট্রাগ্রাম, হোয়াটস আপ, ইমোতে নানা প্রকার ভিডিও আপলোড, লাইক, কমেন্ট, ম্যাসেজিং, শেয়ার করে বসে। এ ছাড়া অনেকে ইচ্ছা করে কিংবা কারও সঙ্গে মজা করে অন্যের পরিচয় প্রতারণা করে বা ছদ্মবেশ ধারণ করে ফেসবুকে ফেইক আইডি তৈরি করে প্রতারণা করছে।
পরবর্তী সময়ে হয়তবা দেখা যায় এর ফলে কারও বিরুদ্ধে মানহানি, কটূক্তি কিংবা অপপ্রচারের শামিল হয়ে গেছে। ফেসে গেল সাইবার অপরাধে। অনেকে সরল বিশ্বাস বা অজান্তেই সাইবার অপরাধে জড়াচ্ছে। বর্তমানে হ্যাকিং, কপিরাইট লঙ্ঘন, শিশু পর্নোগ্রাফি, অনলাইনভিত্তিক প্রতারণার মতো অপরাধগুলো উচ্চমাত্রায় বাড়ছে। আন্তর্জাতিকভাবে, রাষ্ট্রীয় বা অ-রাষ্ট্রীয় সত্তা কর্তৃক গুপ্তচরবৃত্তি, আর্থিক প্রতারণা, আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, কিংবা অন্তত একটি রাষ্ট্রের স্বার্থ জড়িত এরূপ বিষয়ে হস্তক্ষেপ জনিত সাইবার অপরাধকে সাইবার যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
ক্রাইম সার্ভে অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাজ্যে ২০১৯ সালে ৩৮ লাখ অনলাইন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, যা দেশটিতে মোট অপরাধের এক-তৃতীয়াংশ। ২০১৭ সালে দেশটি এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ শুরু করার পর থেকে প্রতিবছর সাইবার জালিয়াতির ঘটনা বাড়তে দেখেছে। সেখানে প্রায় ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এ জালিয়াতির শিকার হন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৫ শতাংশের বেশি মানুষ এক হাজার ডলারের বেশি অর্থ খুইয়েছেন। যুক্তরাজ্যের মতোই অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের। গত বছর দেশটিতে ইন্টারনেটে প্রতারণা ৬৯ শতাংশ বেড়েছে। দেশটিতে ইন্টারনেটে প্রতারণায় গত বছর মোট লোকসান হয়েছে ৪২০ কোটি ডলার, যা ২০১৭ সালের তুলনায় তিন গুণ বেশি।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা হু হু করে বেড়েই চলছে। এ অপরাধের রাশ টেনে ধরতে সরকার নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। প্রথমে সাইবার অপরাধের বিচার করার জন্য একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল ঢাকাতে ছিল। পরবর্তীতে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের সুবিধার্থে সরকার ২০২১ সালে আরো ৭টি সাইবার ট্রাইব্যুনাল যুক্ত করে। তাতে মোট সাইবার ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮টি। আর বর্তমানে বিভাগীয় শহরে অবস্থিত এই আটটি ট্রাইব্যুনাল হচ্ছে-ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনাল, চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনাল, রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনাল, খুলনা সাইবার ট্রাইব্যুনাল, বরিশাল সাইবার ট্রাইব্যুনাল, সিলেট সাইবার ট্রাইব্যুনাল, রংপুর সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও ময়মনসিংহ সাইবার ট্রাইব্যুনাল।
এই ট্রাইব্যুনালে বিচার্য অপরাধসমূহ সাইবার অপরাধসংক্রান্ত আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত-২০১৩)-এ সংযোজিত ধারায় ২০১৮ সালের আগে বিচার করা হতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত-২০১৩)-এর কিছু ধারার সংশোধন ও বাতিল সাপেক্ষে
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ করা হয়। আর সে মোতাবেক ট্রাইব্যুনালগুলোতে সাইবার অপরাধের বিচার কাজ চলছে। নতুন এই আইনে অপরাধের শাস্তি অনধিক ১০ বছরের কারাদন্ড বা অনধিক ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি কার্যকর হয়েছে ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর। এর পরের তিন বছরে এ আইনে মামলা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৬৫৭টি। ‘২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন থানা থেকে বিচারের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোট মামলা এসেছে দুই হাজার ৬৪২টি। প্রতি বছরই মামলার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৯ সালে ৭২১টি, ২০১৮ সালে ৬৭৬টি, ২০১৭ সালে ৫৬৮টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৪ সালে ৩৩টি এবং ২০১৩ সালে এসেছে ৩টি মামলা। চলতি বছরে ২৫৬টি মামলা হয়েছে।
এখন পর্ন্ত সরাসরি ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা হয়েছে ১ হাজার ৮২টি মামলা। এর মধ্যে ৪৪৭টি মামলায় বিভিন্ন সংস্থাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। বাকি ৬৩৫টির প্রয়োজনীয় উপাদান না থাকায় আদালত খারিজ করে দেন। ৪৪৭টির মধ্যে ১৫০টি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে আদালতে জমা হয়েছে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে সব মিলিয়ে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দুই হাজার ২১টি।
সাইবার অপরাধ একটি দেশ ও জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। সাইবার অপরাধের রাশ টেনে ধরতে সরকারকে আরও উদ্যোগ বাড়াতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও আরও সচেতন হতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহার যখন আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় তখন এই ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের আরও বেশি জানতে হবে।
[লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, খুলনা]