আহমদুল কবির
মাঝে কিছু বছর বাদ দিলে সংবাদ বাংলাদেশের উত্থান ও বাঙালি জাতির সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই সুদীর্ঘ ইতিহাস কে লিখবেন, সেটা পরের কথা। আজকের এই নিবেদনে ‘সংবাদ’-এর জীবনের কতগুলো ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, যেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে অবদান রেখেছে এবং রাজনীতি ও বাঙালি জাতীয়তার সঙ্গে ইন্টার্যাকট করেছে।
যেমন ১৯৫১ সালের ১৭ মে ‘সংবাদ’ বের হয় মুসলিম লীগের পত্রিকা হিসেবে। যদিও মুসলিম লীগ কাগজটা কিনে নেয় ১৯৫২ সালে। তখন সংবাদ-এর সম্পাদকীয়তে মুসলিম লীগের মতামত প্রাধান্য পেত, তবে খবর পরিবেশন বা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বাঙালিত্ব সংবাদের নামাবলি ছিল বললেই চলে। খায়রুল কবির (বড় ভাই) এ সম্বন্ধে ছিলেন অনমনীয়।
মুসলিম লীগের ভরাডুবির পর সংবাদের যখন ডুবুডুবু অবস্থা, তখন তার পরিচালকরা তথা নাসিরউদ্দিন, জহুর হোসেন চৌধুরী, সৈয়দ নুরুদ্দিন ঠিক করলেন কাগজ চালাবেন। তারা এসে আমাকে বাধ্য করলেন কাগজে সংশ্লিষ্ট হতে। তখন সংবাদের মাইনা ছিল ৬ হাজার টাকা থেকে একটু বেশি। মাসে মাসে ওই টাকার জোগান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের বিদায় করলাম। তারা মিলে আনোয়ার হোসেনের নামে মুসলিম লীগের কাছ থেকে সংবাদ কিনে নিলেন। তারপর মওলানা ভাসানীর আশীর্বাদ নিয়ে সংবাদ-এর নতুন যাত্রা শুরু হয়।
প্রথম থেকেই সংবাদ-এর জন্য কিছু নীতি সুনির্দিষ্ট করা হয়। তার প্রথম হচ্ছেÑ সংবাদ সম্পূর্ণ দল-নিরপেক্ষভাবে চলবে। বিশেষ কারণ ছাড়া এ কাগজের কোনো কর্তাব্যক্তি রাজনীতিতে অংশ নিতে পারবেন না। যদিও সবাই জানতাম, সংবাদ-এর কর্তারা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত এবং তাদের সঙ্গে আলাপ করেই কাগজ চলছে। তার দু-একটি উদাহরণ এ নিবন্ধেও সংবাদ-এর প্রথম দিনগুলো ও পরিবর্তনের কাহিনী জহুর হোসেন চৌধুরীর লেখায় আছে। এ লেখায় সংবাদ কীভাবে রাজনীতি এবং বাঙালি জাতীয়তার বিকাশের পথে প্রভাব রেখেছে তার সংক্ষেপসার।
রাজনীতির দিক থেকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা দাঁড়িয়ে গেল যখন কাগমারির সম্মেলন হয়। সৈয়দ নুরুদ্দিন ও জহুর সাহেব কাগমারিতে গেলেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির নির্ধারিত নীতি মেনে মওলানা ভাসানীকে দিয়ে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় জোটনিরপেক্ষ নীতি পুনঃগ্রহণ করা হয়েছে বলে ফরমান জারি করান। স্বহস্তে লিখিত সেই ফরমানটি কপার প্লেট করে সংবাদে ছাপা হয়। যদিও কাউন্সিল সভা তখন শুরুই হয়নি। ফল হলো আওয়ামী লীগের দ্বিধা-বিভক্তি এবং ন্যাপের জন্ম।
তারপর রাজনীতির টানাপোড়েনে সোহরাওয়ার্দীর ১৩ মাসের প্রধানমন্ত্রিত্ব খারিজ হলো, ফিরোজ খান নুন এলেন। সামরিক শাসন হবে আন্দাজ করতে পেরে ‘সংবাদ’ অক্টোবরের তিন মাস আগেই আওয়ামী লীগের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিল। এর ফলে রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন এলো এবং মওলানা ভাসানীর কলাকৌশল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রয়োগের ফলে জাতীয় রাজনীতিতে (পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ নয়) আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। আশ্চর্যের বিষয়, তখনকার সময় বাংলাদেশের প্রায় সব নামি-দামি বুদ্ধিজীবী বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; কিন্তু বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, পথে-প্রান্তরে তারা বুদ্ধিহীনতারই পরিচয় দিয়ে গেছেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর তারা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মিলে জহুর সাহেব ও সৈয়দ নুরুদ্দিনকে ‘সংবাদ’ বন্ধ করে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ ঘটনা ঘটত যদি না রণেশ দাশগুপ্তের মতো নমস্য বুদ্ধিজীবী বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে ঘোষণা দিতেন-দু’পৃষ্ঠা হলেও ‘সংবাদ’ বের হবে। আমি তার সঙ্গে একমত হলাম।
সামরিক শাসন জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। ইমামগঞ্জ, চকবাজারের ব্যবসায়ীরা অভিযুক্ত হওয়ার দায় না নিয়ে সব মালামাল বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে দিল। তখন ‘সংবাদ’ পরিষ্কার ভাষায় অভিমত জানায়, বাজার নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে কোন কাজে আসবে না। বরং ফলাফল হবে জনগণকে আরও উত্তেজিত করা। তার পরের দিন জামালপুরে চালের দাম মণপ্রতি ৪২ টাকায় উঠল। সামরিক শাসক জেনারেল ওমরাও খাঁ কৈফিয়ত চাওয়াতে আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলতে বাধ্য হয়েছি, ঘটনা সত্যি। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সাত কলাম হেডলাইন দিয়ে খবরটি পরিবেশন করেছিলাম। ব্যবস্থা হলো, সরকার এক রেক চাল জামালপুরে পাঠিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চালের দাম পড়ে গেল। আমরা সে খবরও ছাপলাম। কেউ বলল, আমরা সামরিক শাসকের সঙ্গে সহযোগিতা করছি। আবার কেউ বলল, এছাড়া চালের দাম কমানোর আর কোনো পথ ছিল না।
তেমনি ‘সংবাদ’-এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার বিরুদ্ধে। ১২ জানুয়ারি রাতে করাচি থেকে রওয়ানা দিয়ে ১৩ জানুয়ারি সকালে আমি ঢাকা ফিরে আসি। তখন ঢাকায় আগুন জ্বলছিল। সন্ধ্যায় বের হয়ে টায়ার পোড়া আগুনের ভেতর দিয়ে নবাবপুর রোড ধরে ‘সংবাদ’ অফিসে গেলাম। তার মধ্যেও দেখি ‘সংবাদ’-এ সবাই হাজির। রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, অজিত গুহসহ ৩-৪ জনকে আমার বাসায় নিয়ে এলাম।
১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সাংবাদিক ইউনিয়নের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানি দখলদার আমলে আপনাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু অনেকেই আবার এখানে থেকে জেনারেল ফরমান আলীর আশীর্বাদ নিয়ে কাগজ বের করেছেন। আজ ওইসব লোকই প্রগতির নামে সরকারকে সমালোচনা করছে এবং এমনকি স্বাধীনতার মূলে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ওই দখলদার আমলে একমাত্র দৈনিক সংবাদ, পিপল এবং সাপ্তাহিক বাংলার বাণীই ফরমান আলীর বশ্যতা স্বীকার করে প্রকাশিত হয়নি’
বাসায় ফিরেই খবর পেলাম, দাঙ্গাকারীরা আমার নিজ গ্রাম ঘোড়াশালে আগুন দিয়েছে। তখনকার পাকিস্তান জুট মিলের দাঙ্গাকারীরা আগুন দেয়। পাশের জেলেপাড়ার দুটি শিশু আগুনে পুড়ে মারা যায়। এদিকে ঢাকায় আমার ব্যবসায়িক অফিসে গঠিত হয় সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সর্বদলীয় শান্তি কমিটি। সে কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার সঙ্গে ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী, শহীদ সাঈদুল হাসান, শহীদ শহীদুল্লা কায়সার, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবদুস সালাম, শহীদ সিরাজ উদ্দিন হোসেন প্রমুখ। সংবাদ-ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন কাগজে অভিন্ন সম্পাদকীয় এবং পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও শিরোনামে প্রধান খবর প্রকাশিত হয়। এর ফলে দাঙ্গা বন্ধ হয়ে যায়। মজার ঘটনা হলো : সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী শান্তি কমিটির প্রচারপত্র মিরপুরে তদানীন্তন গভর্নর মোনায়েম খানের গাড়িতে ছুড়ে মারার অভিযোগে সব নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। আমার ব্যবসায়িক পার্টনার সাঈদুল হাসানকে আসামি করা হয়। আর আমি ঢাকায় না থাকা সত্ত্বেও আমাকে করা হয় সাক্ষী।
ঘটনাটা মুখরোচক বলে এখানে উল্লেখ করছি। সাক্ষী দিতে কোর্টে গিয়ে দেখি আসামিরা সব হাজির। কী কী ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে হবে কোর্ট দারোগা আমাকে শেখালেন। তথাস্তু বলে আমি উকিল বারের দিকে রওনা দিলাম। আতাউর রহমান খান তখন বারের প্রেসিডেন্ট। আমার ওপর কোর্ট দারোগার সন্দেহ হওয়ায় তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি সাক্ষ্য দেব? আমি জবাবে বললাম, কোর্ট দারোগা আমাকে এসব কথা বলতে বলেছেন। এ অবস্থায় ডিএসপি আমাকে কোর্টে নিয়ে গিয়ে বৈরী ঘোষণা করার অনুমতি চাইলেন। মামলার সেখানেই শেষ। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় সংবাদ যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে, তা ইতিহাসে লেখা থাকবে। সংবাদ বাঙালি জাতীয়তার মুখপত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ বন্ধ ছিল। জন্মলগ্নে সংবাদ বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে প্রতিজ্ঞা করেছিল, বামপন্থি কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও সংবাদ বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ ও প্রত্যয় থেকে বিচ্যুত হয়নি। ১৯৬৭-৬৯-এ তার প্রতিফলন ঘটে। ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে সংবাদ-এর বিশিষ্ট ভূমিকার কথা সবারই মনে থাকার কথা। ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের খবর সংবাদ যেভাবে তুলে ধরে, তেমনি গুরুত্ব সহকারে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিহতদের খবর ছাপতেও সংবাদ পিছপা হয়নি। আন্দোলন যখন তুঙ্গে ওঠে, সেই ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ৮ মার্চ একমাত্র সংবাদ-এর শিরোনাম ছিল-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। অন্য কোন কাগজ এ রকম শিরোনাম দেয়নি। ফলে সংবাদ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রুদ্ররোষে পড়ে। ২৮ মার্চ সংবাদ ও সংবাদ-এর সাংবাদিক শহীদ সাবেরকে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
পাকিস্তান থাকাকালে আর সংবাদ বের হয়নি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন, সেদিন সংবাদ বের হয়। অবশ্য অনেক কাগজই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের সময় যথারীতি প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সাংবাদিক ইউনিয়নের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানি দখলদার আমলে আপনাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু অনেকেই আবার এখানে থেকে জেনারেল ফরমান আলীর আশীর্বাদ নিয়ে কাগজ বের করেছেন। আজ ওইসব লোকই প্রগতির নামে সরকারকে সমালোচনা করছে এবং এমনকি স্বাধীনতার মূলে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ওই দখলদার আমলে একমাত্র দৈনিক সংবাদ, পিপল এবং সাপ্তাহিক বাংলার বাণীই ফরমান আলীর বশ্যতা স্বীকার করে প্রকাশিত হয়নি।’
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সংবাদ বেরুলো। বাঁশের খুঁটি, টিনের চালার নিচে কম্পোজ বিভাগ। পোড়া ঘরে পোড়া মেশিন কিছু সংস্কার করে ছাপার ব্যবস্থা। কাগজে তখন যারা কাজ করতে শুরু করলেন তারা সবাই অদ্ভুত চরিত্রের। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, আওয়ামী লীগ অর্থাৎ সর্বদলীয় ভাজাপোড়া সব একসঙ্গে জুটেছে। টাকা-পয়সার খবর নেই। দেশের অর্থনীতি এবং ব্যবসা দুটোই শূন্যের কোঠায়। আমি নতুন ব্যবসা জোটাতে ব্যস্ত।
’৬০-এর দশকে ‘সংবাদ’-এর কর্তৃপক্ষ কিছু ব্যবসা করে, কিছু ব্যবসা বেচে, কেউ বৌয়ের গয়না বেচে ‘সংবাদ’ চালিয়েছেন। তাদের কেউই এখন নেই। বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার আগে মরহুম সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বলে গিয়েছিলেন, ‘ইত্তেফাক’, ‘বাংলার বাণী’র মতো ‘সংবাদ’ চাইলেই যেন যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিকের লাইসেন্স দেয়া হয়। ‘সংবাদ’-এর ২৬৩ বংশাল রোডের পোড়া বাড়ি অধিগ্রহণ করা হলো। বঙ্গবন্ধুর দেয়া লাইসেন্সে মেশিন আনা হলো এবং ব্যাংকের টাকায় বাড়িও করা হলো। ধীরে ধীরে সংবাদের প্রতিষ্ঠা বাড়তে শুরু করল নতুন ব্যবস্থাপনায় পুরাতন আদর্শের পরিসীমার ভেতরে।
সংবাদ এবং দেশের বিপর্যয় চলেছে এক সঙ্গেই। বাকশাল হওয়ার ফলশ্রুতি হিসেবে ‘সংবাদ’ বন্ধ করে দেয়া হলো। কিন্তু কালের চক্রে দেশ থেকে গণতন্ত্র, বাকশাল সবই উড়ে গেল। বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। বিভীষণ মোশতাক ক্ষমতায় গিয়ে বাকশাল থেকে নতুন রাজনীতির চেষ্টা করলেন। বেশ কিছু আওয়ামী লীগার জুটে গেলেন মোশতাকের সঙ্গে। মোশতাক সাহেব ‘সংবাদ’ পুনঃপ্রকাশের অনুমতি দিলেন। আবার সংবাদ বেরুলো।
রাজনীতির এই ঘূর্ণাবর্তে মোশতাক গেলেন, জিয়াউর রহমান এলেন, জিয়াউর রহমান গেলেন, এরশাদ এলেন। নাটকের চরিত্র পরিবর্তন হলো। কিন্তু দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। সংবাদ প্রগতিশীল শক্তির মুখপত্র হয়েই থাকল, তৃণমূলে পৌঁছাতে পারল না। মধ্যবিত্তের যাদের মনোভাব চিরকালই সুযোগ-সন্ধানী তাদেরও মুখপত্র হতে পারল না। একমাত্র সংবাদ-এর কর্মীদের দৃঢ় মনোবলের জন্যই ‘সংবাদ’ বেঁচে থাকল ওয়েজবোর্ড এবং আনুষঙ্গিক নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে।
দীর্ঘ পথচলায় যখনই নতুন বছরে পা দেবে তখন ‘সংবাদ’কে নতুন করে ভাবতে হবে। এখন সংবাদ প্রচার মাধ্যমের যে বিপ্লবী পরিবর্তন হয়েছে, আঙ্গিকের দিক থেকে, প্রযুক্তির দিক থেকে এবং প্রকাশনার দিক থেকে-সেখানে ‘সংবাদ’কে প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই টিকে থাকতে হবে। সেই সঙ্গে নতুন সামাজিক, ব্যবসায়িক চিন্তাধারা, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের চিন্তাধারার সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে আদর্শের ব্যতিক্রম না ঘটিয়ে।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সংবাদের অবদান ঐতিহাসিক। বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে সংবাদ তার প্রচেষ্টার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। অসাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ ও শোষণমুক্ত সমাজের সম্ভাবনা হচ্ছে সংবাদের আদর্শ। এ আদর্শ থেকে সংবাদের বিকৃতি কখনও ঘটেনি এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে না। এই দীর্ঘ পথচলায় সংবাদ-এ অনেকেই এসেছেন, এদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। অনেকেই এখন বেঁচে নেই। সংবাদ-এর দীর্ঘ পথচলায় এদের প্রত্যেকের জীবনী এবং ব্যক্তিগত দান বিশেষভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয় শুধু স্থানাভাবে। এদের প্রতি আমরা যারা এখন সংবাদে কর্মরত তাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন রইল।
(কিছুটা পরিমার্জিত। লেখাটি সংবাদ-এর পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে রচিত ও প্রকাশিত হয়েছিল।)
[নিবন্ধের লেখক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সংবাদ-এর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন]
আহমদুল কবির
সোমবার, ১৬ মে ২০২২
মাঝে কিছু বছর বাদ দিলে সংবাদ বাংলাদেশের উত্থান ও বাঙালি জাতির সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই সুদীর্ঘ ইতিহাস কে লিখবেন, সেটা পরের কথা। আজকের এই নিবেদনে ‘সংবাদ’-এর জীবনের কতগুলো ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, যেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে অবদান রেখেছে এবং রাজনীতি ও বাঙালি জাতীয়তার সঙ্গে ইন্টার্যাকট করেছে।
যেমন ১৯৫১ সালের ১৭ মে ‘সংবাদ’ বের হয় মুসলিম লীগের পত্রিকা হিসেবে। যদিও মুসলিম লীগ কাগজটা কিনে নেয় ১৯৫২ সালে। তখন সংবাদ-এর সম্পাদকীয়তে মুসলিম লীগের মতামত প্রাধান্য পেত, তবে খবর পরিবেশন বা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বাঙালিত্ব সংবাদের নামাবলি ছিল বললেই চলে। খায়রুল কবির (বড় ভাই) এ সম্বন্ধে ছিলেন অনমনীয়।
মুসলিম লীগের ভরাডুবির পর সংবাদের যখন ডুবুডুবু অবস্থা, তখন তার পরিচালকরা তথা নাসিরউদ্দিন, জহুর হোসেন চৌধুরী, সৈয়দ নুরুদ্দিন ঠিক করলেন কাগজ চালাবেন। তারা এসে আমাকে বাধ্য করলেন কাগজে সংশ্লিষ্ট হতে। তখন সংবাদের মাইনা ছিল ৬ হাজার টাকা থেকে একটু বেশি। মাসে মাসে ওই টাকার জোগান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের বিদায় করলাম। তারা মিলে আনোয়ার হোসেনের নামে মুসলিম লীগের কাছ থেকে সংবাদ কিনে নিলেন। তারপর মওলানা ভাসানীর আশীর্বাদ নিয়ে সংবাদ-এর নতুন যাত্রা শুরু হয়।
প্রথম থেকেই সংবাদ-এর জন্য কিছু নীতি সুনির্দিষ্ট করা হয়। তার প্রথম হচ্ছেÑ সংবাদ সম্পূর্ণ দল-নিরপেক্ষভাবে চলবে। বিশেষ কারণ ছাড়া এ কাগজের কোনো কর্তাব্যক্তি রাজনীতিতে অংশ নিতে পারবেন না। যদিও সবাই জানতাম, সংবাদ-এর কর্তারা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত এবং তাদের সঙ্গে আলাপ করেই কাগজ চলছে। তার দু-একটি উদাহরণ এ নিবন্ধেও সংবাদ-এর প্রথম দিনগুলো ও পরিবর্তনের কাহিনী জহুর হোসেন চৌধুরীর লেখায় আছে। এ লেখায় সংবাদ কীভাবে রাজনীতি এবং বাঙালি জাতীয়তার বিকাশের পথে প্রভাব রেখেছে তার সংক্ষেপসার।
রাজনীতির দিক থেকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা দাঁড়িয়ে গেল যখন কাগমারির সম্মেলন হয়। সৈয়দ নুরুদ্দিন ও জহুর সাহেব কাগমারিতে গেলেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির নির্ধারিত নীতি মেনে মওলানা ভাসানীকে দিয়ে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় জোটনিরপেক্ষ নীতি পুনঃগ্রহণ করা হয়েছে বলে ফরমান জারি করান। স্বহস্তে লিখিত সেই ফরমানটি কপার প্লেট করে সংবাদে ছাপা হয়। যদিও কাউন্সিল সভা তখন শুরুই হয়নি। ফল হলো আওয়ামী লীগের দ্বিধা-বিভক্তি এবং ন্যাপের জন্ম।
তারপর রাজনীতির টানাপোড়েনে সোহরাওয়ার্দীর ১৩ মাসের প্রধানমন্ত্রিত্ব খারিজ হলো, ফিরোজ খান নুন এলেন। সামরিক শাসন হবে আন্দাজ করতে পেরে ‘সংবাদ’ অক্টোবরের তিন মাস আগেই আওয়ামী লীগের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিল। এর ফলে রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন এলো এবং মওলানা ভাসানীর কলাকৌশল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রয়োগের ফলে জাতীয় রাজনীতিতে (পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ নয়) আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। আশ্চর্যের বিষয়, তখনকার সময় বাংলাদেশের প্রায় সব নামি-দামি বুদ্ধিজীবী বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; কিন্তু বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, পথে-প্রান্তরে তারা বুদ্ধিহীনতারই পরিচয় দিয়ে গেছেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর তারা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মিলে জহুর সাহেব ও সৈয়দ নুরুদ্দিনকে ‘সংবাদ’ বন্ধ করে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ ঘটনা ঘটত যদি না রণেশ দাশগুপ্তের মতো নমস্য বুদ্ধিজীবী বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে ঘোষণা দিতেন-দু’পৃষ্ঠা হলেও ‘সংবাদ’ বের হবে। আমি তার সঙ্গে একমত হলাম।
সামরিক শাসন জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। ইমামগঞ্জ, চকবাজারের ব্যবসায়ীরা অভিযুক্ত হওয়ার দায় না নিয়ে সব মালামাল বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে দিল। তখন ‘সংবাদ’ পরিষ্কার ভাষায় অভিমত জানায়, বাজার নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে কোন কাজে আসবে না। বরং ফলাফল হবে জনগণকে আরও উত্তেজিত করা। তার পরের দিন জামালপুরে চালের দাম মণপ্রতি ৪২ টাকায় উঠল। সামরিক শাসক জেনারেল ওমরাও খাঁ কৈফিয়ত চাওয়াতে আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলতে বাধ্য হয়েছি, ঘটনা সত্যি। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সাত কলাম হেডলাইন দিয়ে খবরটি পরিবেশন করেছিলাম। ব্যবস্থা হলো, সরকার এক রেক চাল জামালপুরে পাঠিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চালের দাম পড়ে গেল। আমরা সে খবরও ছাপলাম। কেউ বলল, আমরা সামরিক শাসকের সঙ্গে সহযোগিতা করছি। আবার কেউ বলল, এছাড়া চালের দাম কমানোর আর কোনো পথ ছিল না।
তেমনি ‘সংবাদ’-এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার বিরুদ্ধে। ১২ জানুয়ারি রাতে করাচি থেকে রওয়ানা দিয়ে ১৩ জানুয়ারি সকালে আমি ঢাকা ফিরে আসি। তখন ঢাকায় আগুন জ্বলছিল। সন্ধ্যায় বের হয়ে টায়ার পোড়া আগুনের ভেতর দিয়ে নবাবপুর রোড ধরে ‘সংবাদ’ অফিসে গেলাম। তার মধ্যেও দেখি ‘সংবাদ’-এ সবাই হাজির। রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, অজিত গুহসহ ৩-৪ জনকে আমার বাসায় নিয়ে এলাম।
১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সাংবাদিক ইউনিয়নের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানি দখলদার আমলে আপনাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু অনেকেই আবার এখানে থেকে জেনারেল ফরমান আলীর আশীর্বাদ নিয়ে কাগজ বের করেছেন। আজ ওইসব লোকই প্রগতির নামে সরকারকে সমালোচনা করছে এবং এমনকি স্বাধীনতার মূলে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ওই দখলদার আমলে একমাত্র দৈনিক সংবাদ, পিপল এবং সাপ্তাহিক বাংলার বাণীই ফরমান আলীর বশ্যতা স্বীকার করে প্রকাশিত হয়নি’
বাসায় ফিরেই খবর পেলাম, দাঙ্গাকারীরা আমার নিজ গ্রাম ঘোড়াশালে আগুন দিয়েছে। তখনকার পাকিস্তান জুট মিলের দাঙ্গাকারীরা আগুন দেয়। পাশের জেলেপাড়ার দুটি শিশু আগুনে পুড়ে মারা যায়। এদিকে ঢাকায় আমার ব্যবসায়িক অফিসে গঠিত হয় সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সর্বদলীয় শান্তি কমিটি। সে কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার সঙ্গে ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী, শহীদ সাঈদুল হাসান, শহীদ শহীদুল্লা কায়সার, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবদুস সালাম, শহীদ সিরাজ উদ্দিন হোসেন প্রমুখ। সংবাদ-ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন কাগজে অভিন্ন সম্পাদকীয় এবং পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও শিরোনামে প্রধান খবর প্রকাশিত হয়। এর ফলে দাঙ্গা বন্ধ হয়ে যায়। মজার ঘটনা হলো : সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী শান্তি কমিটির প্রচারপত্র মিরপুরে তদানীন্তন গভর্নর মোনায়েম খানের গাড়িতে ছুড়ে মারার অভিযোগে সব নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। আমার ব্যবসায়িক পার্টনার সাঈদুল হাসানকে আসামি করা হয়। আর আমি ঢাকায় না থাকা সত্ত্বেও আমাকে করা হয় সাক্ষী।
ঘটনাটা মুখরোচক বলে এখানে উল্লেখ করছি। সাক্ষী দিতে কোর্টে গিয়ে দেখি আসামিরা সব হাজির। কী কী ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে হবে কোর্ট দারোগা আমাকে শেখালেন। তথাস্তু বলে আমি উকিল বারের দিকে রওনা দিলাম। আতাউর রহমান খান তখন বারের প্রেসিডেন্ট। আমার ওপর কোর্ট দারোগার সন্দেহ হওয়ায় তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি সাক্ষ্য দেব? আমি জবাবে বললাম, কোর্ট দারোগা আমাকে এসব কথা বলতে বলেছেন। এ অবস্থায় ডিএসপি আমাকে কোর্টে নিয়ে গিয়ে বৈরী ঘোষণা করার অনুমতি চাইলেন। মামলার সেখানেই শেষ। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় সংবাদ যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে, তা ইতিহাসে লেখা থাকবে। সংবাদ বাঙালি জাতীয়তার মুখপত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ বন্ধ ছিল। জন্মলগ্নে সংবাদ বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে প্রতিজ্ঞা করেছিল, বামপন্থি কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও সংবাদ বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ ও প্রত্যয় থেকে বিচ্যুত হয়নি। ১৯৬৭-৬৯-এ তার প্রতিফলন ঘটে। ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে সংবাদ-এর বিশিষ্ট ভূমিকার কথা সবারই মনে থাকার কথা। ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের খবর সংবাদ যেভাবে তুলে ধরে, তেমনি গুরুত্ব সহকারে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিহতদের খবর ছাপতেও সংবাদ পিছপা হয়নি। আন্দোলন যখন তুঙ্গে ওঠে, সেই ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ৮ মার্চ একমাত্র সংবাদ-এর শিরোনাম ছিল-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। অন্য কোন কাগজ এ রকম শিরোনাম দেয়নি। ফলে সংবাদ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রুদ্ররোষে পড়ে। ২৮ মার্চ সংবাদ ও সংবাদ-এর সাংবাদিক শহীদ সাবেরকে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
পাকিস্তান থাকাকালে আর সংবাদ বের হয়নি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যেদিন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন, সেদিন সংবাদ বের হয়। অবশ্য অনেক কাগজই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের সময় যথারীতি প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সাংবাদিক ইউনিয়নের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানি দখলদার আমলে আপনাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু অনেকেই আবার এখানে থেকে জেনারেল ফরমান আলীর আশীর্বাদ নিয়ে কাগজ বের করেছেন। আজ ওইসব লোকই প্রগতির নামে সরকারকে সমালোচনা করছে এবং এমনকি স্বাধীনতার মূলে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ওই দখলদার আমলে একমাত্র দৈনিক সংবাদ, পিপল এবং সাপ্তাহিক বাংলার বাণীই ফরমান আলীর বশ্যতা স্বীকার করে প্রকাশিত হয়নি।’
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সংবাদ বেরুলো। বাঁশের খুঁটি, টিনের চালার নিচে কম্পোজ বিভাগ। পোড়া ঘরে পোড়া মেশিন কিছু সংস্কার করে ছাপার ব্যবস্থা। কাগজে তখন যারা কাজ করতে শুরু করলেন তারা সবাই অদ্ভুত চরিত্রের। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, আওয়ামী লীগ অর্থাৎ সর্বদলীয় ভাজাপোড়া সব একসঙ্গে জুটেছে। টাকা-পয়সার খবর নেই। দেশের অর্থনীতি এবং ব্যবসা দুটোই শূন্যের কোঠায়। আমি নতুন ব্যবসা জোটাতে ব্যস্ত।
’৬০-এর দশকে ‘সংবাদ’-এর কর্তৃপক্ষ কিছু ব্যবসা করে, কিছু ব্যবসা বেচে, কেউ বৌয়ের গয়না বেচে ‘সংবাদ’ চালিয়েছেন। তাদের কেউই এখন নেই। বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার আগে মরহুম সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বলে গিয়েছিলেন, ‘ইত্তেফাক’, ‘বাংলার বাণী’র মতো ‘সংবাদ’ চাইলেই যেন যন্ত্রপাতি ও আনুষঙ্গিকের লাইসেন্স দেয়া হয়। ‘সংবাদ’-এর ২৬৩ বংশাল রোডের পোড়া বাড়ি অধিগ্রহণ করা হলো। বঙ্গবন্ধুর দেয়া লাইসেন্সে মেশিন আনা হলো এবং ব্যাংকের টাকায় বাড়িও করা হলো। ধীরে ধীরে সংবাদের প্রতিষ্ঠা বাড়তে শুরু করল নতুন ব্যবস্থাপনায় পুরাতন আদর্শের পরিসীমার ভেতরে।
সংবাদ এবং দেশের বিপর্যয় চলেছে এক সঙ্গেই। বাকশাল হওয়ার ফলশ্রুতি হিসেবে ‘সংবাদ’ বন্ধ করে দেয়া হলো। কিন্তু কালের চক্রে দেশ থেকে গণতন্ত্র, বাকশাল সবই উড়ে গেল। বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন। বিভীষণ মোশতাক ক্ষমতায় গিয়ে বাকশাল থেকে নতুন রাজনীতির চেষ্টা করলেন। বেশ কিছু আওয়ামী লীগার জুটে গেলেন মোশতাকের সঙ্গে। মোশতাক সাহেব ‘সংবাদ’ পুনঃপ্রকাশের অনুমতি দিলেন। আবার সংবাদ বেরুলো।
রাজনীতির এই ঘূর্ণাবর্তে মোশতাক গেলেন, জিয়াউর রহমান এলেন, জিয়াউর রহমান গেলেন, এরশাদ এলেন। নাটকের চরিত্র পরিবর্তন হলো। কিন্তু দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। সংবাদ প্রগতিশীল শক্তির মুখপত্র হয়েই থাকল, তৃণমূলে পৌঁছাতে পারল না। মধ্যবিত্তের যাদের মনোভাব চিরকালই সুযোগ-সন্ধানী তাদেরও মুখপত্র হতে পারল না। একমাত্র সংবাদ-এর কর্মীদের দৃঢ় মনোবলের জন্যই ‘সংবাদ’ বেঁচে থাকল ওয়েজবোর্ড এবং আনুষঙ্গিক নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে।
দীর্ঘ পথচলায় যখনই নতুন বছরে পা দেবে তখন ‘সংবাদ’কে নতুন করে ভাবতে হবে। এখন সংবাদ প্রচার মাধ্যমের যে বিপ্লবী পরিবর্তন হয়েছে, আঙ্গিকের দিক থেকে, প্রযুক্তির দিক থেকে এবং প্রকাশনার দিক থেকে-সেখানে ‘সংবাদ’কে প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই টিকে থাকতে হবে। সেই সঙ্গে নতুন সামাজিক, ব্যবসায়িক চিন্তাধারা, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের চিন্তাধারার সঙ্গে সংযুক্ত হতে হবে আদর্শের ব্যতিক্রম না ঘটিয়ে।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সংবাদের অবদান ঐতিহাসিক। বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে সংবাদ তার প্রচেষ্টার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। অসাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ ও শোষণমুক্ত সমাজের সম্ভাবনা হচ্ছে সংবাদের আদর্শ। এ আদর্শ থেকে সংবাদের বিকৃতি কখনও ঘটেনি এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে না। এই দীর্ঘ পথচলায় সংবাদ-এ অনেকেই এসেছেন, এদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। অনেকেই এখন বেঁচে নেই। সংবাদ-এর দীর্ঘ পথচলায় এদের প্রত্যেকের জীবনী এবং ব্যক্তিগত দান বিশেষভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয় শুধু স্থানাভাবে। এদের প্রতি আমরা যারা এখন সংবাদে কর্মরত তাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন রইল।
(কিছুটা পরিমার্জিত। লেখাটি সংবাদ-এর পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে রচিত ও প্রকাশিত হয়েছিল।)
[নিবন্ধের লেখক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সংবাদ-এর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন]